কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » সায়েন্স ফিকশন গল্প » বৈচিত্রের মেশিন

বৈচিত্রের মেশিন

বৈচিত্রের মেশিন সায়েন্স ফিকশন গল্প – দিলীপ কুমার মধু

ভোম্বল কাকু, ভোম্বল কাকু…

     ভোম্বলের সাড়া পায় না বানু। তাই কিছুটা রেগে বলে –এই ভোম্বলকাকুকে নিয়ে আমার হয়েছে এক জ্বালা । একবার ডেকে কখনোই সাড়া পাই না । সবার কাকু কেমন মুখ উঁচিয়ে থাকে কখন তাদের ভাইপোরা এসে কাকু বলবে আর অমনি ভাইপো ভাইপো বলে গলা শুকোবে। বুকে জড়িয়ে ধরবে। আর আমার কাকু তার ধারে কাছেও নয়। আর উল্টোটাও নয়। কেমন একটা যেন । প্রায় প্রতিদিনই বলি তবুও শোনে না । আমি এবার বেশ বুঝতে পারছি আমার কাকা বদলানোর সুযোগ এসেছে । এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো না । যাই পাড়ার আরো কতো কাকু আছে– নাদু কাকু, কালিকাকু, পেদু কাকু তাদের কাকু বলে গলার জল শুকোই । এই ভোম্বল কাকু, ভোম্বল কাকু বলে গলার জল শুকোলে আমি কোষ্টকাঠিন্য রোগে ভুগবো । কি দরকার শুধু শুধু রোগে ভুগে তার চেয়ে….

       বলে ঘুরতেই দেখে ভোম্বল একটা ছোট্ট বাটিতে দুটো ল্যাংচা আর একটা চামচ এনে বললো –নে, খা ।

      ল্যাংচার গন্ধ নাকে যেতেই সব ভুলে গেল বানু । বললো —তুমি অমন কেন গো । সব সময় আমার সঙ্গে মশকরা করো । মাঝে মাঝে তোমার উপর খুব রাগ হয় । কিন্তু সেই রাগটা চড়াও হবার আগেই তোমার উপস্থিতি আমাকে রাগ থেকে বিরত করে। 

—-বেশ । আগে খা, পরে কথা বলবি । বাটিটা দেয় বানুর হাতে। 

      বাটি হাতে নিয়ে ল্যাংচা খেতে খেতে বানু বলে –জানো কাকু, সকালে একটু ভাবতে বসে ছিলাম । হঠাৎ একটা বুদ্ধি মাথায় এসে ধাক্কা খেলো । আমি সেই বুদ্ধিটাকে রাস্তা থেকে তুলে এনে মনে গেঁথে রাখলাম । শুনবে কি বুদ্ধি। 

       স্বাভাবিক নিয়মেই ভোম্বল বললো– সে তো শুনবেই । তোর মনে নতুন ভাবনা উদয় হয়েছে আর আমি সেটা শুনবো না এটা কখনো হয় নাকি। 

—-বেশ তবে বলি 

—-হ্যাঁ, বল ।

       ততক্ষণে ল্যাংচা দুটো খাওয়া শেষ হয়েছে বানুর । হাত ধুয়ে এসে বোতলের জল ঢকঢক করে খেয়ে বসলো ছোট্ট চেয়ারটাতে। 

       ঘরের ডাইনিং-এ সব সময় দুটো চেয়ার রাখা থাকে । একটা বড়ো আর একটা একটু ছোটো। বড়োটাতে ভোম্বল বসে আর ছোটোটাতে বানু । বসতে বসতে মুখস্ত হয়ে গেছে বলে আর ভুল হয়না বানুর। 

     যাহোক, বেশ আয়েশ করে বসে মুখটাকে দুই একবার খাবি খাওয়ার মতো করে তারপর বলল— বলি কাকু 

—বল ।

     ভোম্বলের ব্যস্ততার লেশমাত্র নেই । এতেও রাগ হলো বানুর।  তারই প্রকৃত জানান দিয়ে বললো — ভোম্বলকাকু, তোমার একটুও কৌতূহল হচ্ছে না । আমি বারবার বলছি গুরুত্বপূর্ণ কথা, গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধি। তোমার যদি আগ্রহ না থাকে তবে আমি বলবো না । আমার মানসিকতা আবার অন্যরকম । যার কোনো কিছুতে আগ্রহ থাকে না, তাকে আমি বলি না। এটা আমার একটা সৎ গুনের মধ্যে পড়ে। তার চেয়ে বরং দক্ষিণ পাড়ার ভুতুকাকু, উত্তর পাড়ার টুলুকাকু, পূব পাড়ার মন্টুকাকু আর পশ্চিম পাড়ার হীরাকাকুকে গিয়ে বলি । তারা যথেষ্ট আগ্রহ দেখাবে আমার কথা শোনার ব্যাপারে। তোমার গরজের মাত্রা দেখে আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি । যে বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল তা বুঝি আবার রাস্তার কোণে কোণে ধাক্কা খেতে খেতে ধুলোবালি সঙ্গে মিশে যায়। 

      তারপর একটু ব্যঙ্গ করে বলে–আঃ! জীবনে একটা মনের মতো কাকু  পেয়েছি । ভোম্বলকাকু না বলে রুক্ষ কাকু, কাষ্ঠকাকু বলাই ঠিক—-

          রুক্ষ কাকু, কাষ্ঠ কাকু 

          মরুভূমির মতো 

          ঘন্টা তিনেক দেয় না সাড়া 

          ডাকোই তুমি যতো। 

          এমন কাকু আছে যার 

          তারই ততো জ্বালা 

          অন্য কেউ হলে বলত—

          পালা, শিগগির পালা। 

    ভোম্বল এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল বানুর কথা। ওর অনুরাগের মাত্রা বাড়ছে দেখে নিজে এসে বললো –আর দুটো ল্যাংচা খাবি ?

      ল্যাংচার লোভ সামলাতে পারে না বানু। তবে এক্ষুনি দুটো আত্মসাৎ করেছে। এখনো তার ঢেকুর বর্তমান । সেজন্য জোর দিয়ে খাবার কথা বলতে পারল না । তবে ভবিষ্যতের জন্য কথা দিয়ে রাখল– ওগুলো রেখে দাও ।বিকেলে এসে খেয়ে যাব। 

—-বেশ । এবার কি বলছিলি তাই বল ।

      তেমনি অনুরাগেই বলে বানু –তোমার শোনার আগ্রহ থাকলে আমি বলতে পারি ।

—–হ্যাঁ, পুরোপুরি আছে বল ।

—-বলি তাহলে । কথা দিচ্ছ তো ।

—-হ্যাঁ রে, কথা দিচ্ছি , বল ।

      বানু বলতে শুরু করে । ততক্ষণে পুরোপুরি সংযত হয়েছে বানু । ওর রাগের মাত্রা থার্মোমিটারে জ্বর ওঠা নামার মতো । এই উঠলো আবার পরক্ষণে তরতর করে নামলো। 

—-জানো ভোম্বলকাকু, আমার মাথায় সার সার দিয়ে কতোগুলো বুদ্ধি সাজানো রয়েছে । এক— জেরক্স মেশিন তৈরি। 

      বানুর কথায় বাধা দিয়ে ভোম্বল বলে –হ্যাঁ, সে তো আছে, আবার নতুন করে….

      হঠাৎই রেগে যায় বানু । বলে– শেষ করতে দেবে তো নাকি । তুমি যদি সব জেনে বসে থাকবে তবে আমি এত কষ্ট করে ধাক্কা খাওয়া বুদ্ধিটাকে মাথায় রাখলাম কেন ।

       ভোম্বল সংযত হয় । বানুকে বলতে সুযোগ দেয় । তারই জানান দিয়ে বলে –আচ্ছা বেশ। তোর কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি একটিও কথা বলবো না। 

       বানু পুনরায় বলতে শুরু করে– জানো ভোম্বলকাকু, জেরক্স মেশিন বানাবে তুমি । কাঠ দিয়ে । এমন একটা বানাবে যার সমস্ত পার্টসগুলোই কাঠের হবে । এটা নতুন বুদ্ধি ।  তবে এখানেই শেষ নয় । আরো চমকপ্রদ কথাটা হলো তোমার সৃষ্টি সেই জেরক্স মেশিনের বৈচিত্রে কেমন হবে, এবার তা শোনো । একসঙ্গে একাধিক ভাষার জেরক্স হবে । বুঝলে না । ক্লিয়ার করি । ধরো, কেউ এক পাতা বাংলা লেখা নিয়ে এসে বলল আমার এই লেখাটাকে ইংরেজি, হিন্দি আর সংস্কৃত অনুবাদে জেরক্স করে দিন । তুমিও তেমনি ইংরেজি, হিন্দি আর সংস্কৃত অনুবাদের সুইচ টিপলে আর সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি ও সংস্কৃতর জেরক্স বেরিয়ে এলো। এই আর কি । কি এবার বুঝলে তো? নতুনত্ব কিছু সৃষ্টি করতে হবে বুঝলে ? নতুনত্ব। তবেই তো বিশ্ব মহল  বলবে– একেই বলে বিগ ভোম্বল আর বানু। তবে এখানে কিন্তু শেষ নয়। শুধু ইংরেজি, হিন্দি আর সংস্কৃতই অপশনে শেষ নয় । পৃথিবীর যত ভাষা আছে, তার সব কটিরই যেন অনুবাদ জেরক্স হয় । এমন মেশিন তোমাকে আবিষ্কার করতে হবে। কি পারবে তো ? 

—–তুই আমার সঙ্গে থাকলে এই কাজ মোটেই কঠিন নয়। 

      লাফিয়ে ওঠে বানু । এই না হলে আমার ভোম্বলকাকু । ভোম্বলকে জড়িয়ে ধরে । তারপর বলে দাঁড়াও দাঁড়াও । এখনো শেষ হয়নি । এ তো গেল এক নম্বর । এবার —দুই। 

      বানু বলতে শুরু করে –তোমার দ্বিতীয় কাজ হবে মুড়ির মেশিন আবিষ্কার করা । এমন মেশিন আবিষ্কার করবে যাতে অপশন থাকবে । তবে সবটাই কিন্তু কাঠের । তবেই না বিশ্ব দরবারে তোমার নাম জ্বলজ্বল করবে । হ্যাঁ, যা বলছিলাম। মুড়ির মেশিনটার ফানেল থাকবে একটা । কিন্তু মুখ থাকবে তিন চার টা। যার যেমন চাহিদা সেই অনুযায়ী সব পাওয়া যাবে। আমার দিকে অমন করে তাকিও না । তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। তোমার বুদ্ধিটা একটু দুর্বল গোছের । আমার আগেই তা মনে রাখা উচিত ছিল। যা হোক বলি মন দিয়ে শোনো –মুড়ির মেশিনে বাছাই করা ধান ফেলবে । মেশিন চলবে। কেউ হয়তো বলবে –আমার এই ধান কটা দিয়ে চাল বের করে দাও । অপশন অনুযায়ী সুইচ টিপে তুমি তাকে চাল বের করে দিলে । কেউ এসে বলল– আমার এই চাল কটা দিয়ে মুড়ি তৈরি করে দাও । অপশন অনুযায়ী সুইচ টিপে তুমি তাকে মুড়ি তৈরি করে দিলে। আবার কেউ এসে বলল –আমার খুব চিড়ার দরকার । এই ধানগুলো থেকে চিড়ে বের করে দাও । তাড়াতাড়ি তুমিও সময় না দিয়ে চিড়ে বের করে দিলে । কেউ যদি বলে –আমার এই প্রয়োজন, তুমিও সেই মতো করবে । এবার বুঝলে কেমন মুড়ির মেশিন আবিষ্কার করতে হবে তোমাকে । আবার কেউ যদি এসে বলে– তার ধান গুলোর অর্ধেকটা চাল আর অর্ধেকটা চিড়ে, তাহলে তোমাকে সেই মতো কাজ করতে হবে । একটাই মুড়ির মেশিনে ধান থেকে একইসঙ্গে চাল, মুড়ি, চিড়ে কিংবা খই বেরিয়ে আসবে । এবার বলো কেমন বুদ্ধি ধরে রেখেছি মাথায়। 

—-অতুলনীয় ! ভোম্বল বলে । সত্যি সত্যি ভোম্বল আশ্চর্য হয় এমন ভাবনা সাধারণ মানুষের মাথাতে আসে না। 

     ভোম্বলের ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটায় বানু। বলে– এখানে শেষ নয় , আরো আছে। 

—-বেশ, বল ।

—–তোমার তৃতীয় আবিষ্কার, ইক্ষু মেশিন আবিষ্কার । তোমাকে আবারো মনে করে দিই মেশিনটা কিন্তু কাঠেরই হবে । এমন মেশিন আবিষ্কার করবে যাতে খোসা ছাড়ানো আঁখ ঢোকালে অপশন অনুযায়ী একইসঙ্গে আখের রস, আখের গুড় কিংবা চিনি উৎপন্ন হবে । তবে এটা কিন্তু মনে রেখো মেশিনটার বিশিষ্টতা এখানে যে, যে স্থান দিয়ে রস বেরোবে সেখানে যেন পাইপ থাকে । আর যেখান থেকে চিনি বেরোবে সেটা যেন জামার হাফ হাতার মতো হয়। আর যেখান থেকে গুড় বেরোবে সেখানে তো অবশ্যই ফিতে সিস্টেম করতে হবে । গুড়ের টুকরোগুলো যেন সার সার বিয়ে এসে টপটপ করে নির্দিষ্ট স্থানে জমা হয়। 

     ঢোক গিলে বানু বলে –তোমাকে আর বিশেষ কষ্ট দেব না । আমার আর একটা নতুন বুদ্ধির কথা বলেই শেষ করবো আমার চার কাহন। তা হল– গম মেশিন । ওই একই রকম সিস্টেম। বৈচিত্র শুধু অক্টোপাসের মতো কতগুলো লম্বা পাইপ অতিরিক্ত তৈরি করা। যার মাধ্যমে বাছাই করা গম থেকে আটা, ময়দা, সুজি তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসবে। ব্যাস । আমার বুদ্ধির গভীরতা এখানেই শেষ । এবার তুমি বলো, যা বললাম তার কোন্ কোন্ জায়গায় তোমার বুঝতে অসুবিধা হয়েছে । চটপট। আমার আবার বেশি সময় নেই। 

      ভোম্বল চুপ রয়েছে দেখে বানু বলে– নীরবতা হলো দুর্বলতার প্রথম ধাপ । হায়  ভগবান ! আমাকে আবার প্রথম থেকে সবকিছু বোঝাতে হবে । এই ভোম্বলকাকুকে না বুঝিয়ে যদি একটা মরা গাছকে বোঝাতাম, তাহলে অন্তত চারটি পাতা তো ঝরতো । ভোম্বলকাকুর মতো অন্তত নট নড়ন চড়ন  তো থাকতো না । হায় কি করি !

      ভোম্বল বলে– তোকে ব্যস্ত হতে হবে না । আমি সবই শুনেছি মন দিয়ে। এতক্ষণ ওগুলিই ভালো করে ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম । আমার বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আর তোর বোঝাতেও কোনো অসুবিধা হয়নি । বেশ, চল বিকেল তো হয়ে এলো । দুটো ল্যাংচা খেয়ে তবে বাড়ি ফিরবি। 

       ল্যাংচা খেতে খেতে বানু বলে –তাহলে তুমি কবে থেকে কাজে লেগে পড়বে ভোম্বল কাকু ? 

—-আগামীকাল থেকে ।

—-বাহ ! এই না হলে আমার ভোম্বলকাকু । বলে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে ল্যাংচার রস গলায় আটকে গেল । ভোম্বল হাত দিয়ে পিঠে মৃদু থাবড়ালে রসগোল্লার রস গলা থেকে  পেটে নামে। 

      ভোম্বল  বলে– মিষ্টি খাওয়ার সময় কথা বলা উচিত নয়। 

     জল খেয়ে হাঁফ ছেড়ে বানু বলে– তুমি ঠিকই বলেছ ভোম্বল কাকু।

বৈচিত্রের মেশিন সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!