দুই মা ছোট গল্প – বদরুদ্দোজা শেখু
দুই মা- জলিল সরদার বেশ ধনী লোক,প্রচুর সম্পত্তি, লোকজন এবং সে গ্রামের মোড়ল।পদ্মার এপারে বাড়ি। ওপারে রাজশাহী শহর। তার ছেলে খলিলও চাষী। বেশী দূর পড়াশুনা করে নি। পাশের গাঁয়ের অন্য এক মোড়ল আরশাদ মন্ডলের মেয়ের সাথে দেখাশুনা ক’রে বিয়ে দিয়েছে খলিলের । প্রায় পাঁচ সাত বছর হলো। কিন্তু তাদের কোলে আজও কোনো সন্তান আসেনি । এধার ওধার অনেক স্থানীয় চিকিৎসা মানত তাগা তাবিজ করা হয়েছে, কাজ হয়নি। অনেকে পরামর্শ দিয়েছে, তাই শুনে বহরমপুর আর মালদহ শহরের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে ঘুরে এসেছে ।ওরা দুজনের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়েছে। তাদের ফলাফল এই যে, খলিলের শারীরিক সমস্যা রয়েছে। তারা সেই জন্য অনেক কিছু ওষুধ দিয়েছে, কিন্তু সেসবে তার কিছু কাজ হয়নি। বাড়ির লোকের ধারণা, এই সন্তান না হওয়ার জন্য খলিলের স্ত্রী ফিরোজাই দায়ী। তার জন্য ফিরোজাকে অনেক আপত্তিকর কথাও শুনতে হয়। জলিল তার ছেলে খলিলের আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পাত্রীও খুঁজছে। তাই শুনে ফিরোজার বাপ তার মেয়ে জামাইকে নিয়ে কলকাতার কোনো হাসপাতালে গিয়ে দেখাতে চায়। পরীক্ষানিরীক্ষা করাতে চায়। কিন্তু তার জামাই নারাজ। ইতিমধ্যে ফিরোজার এক চাচা শামসাদ বাড়ি এসেছে। সে মিলিটারিতে কী একটা চাকরি করে। দু’বছর পরপর একবার ক’রে বাড়ি আসে। যখন সে গ্রামে ঘোরাফেরা করে তখন সে সরকারী উর্দি প’রে ঘোরাফেরা করে। তাতে নাকি তার ওজন বাড়ে। তার প্রতি মানুষের সমীহ বাড়ে। তার পরিবার গ্রামেই থাকে। সে একদিন ফিরোজাদের বাড়ি এলো। আরশাদ ভাইয়ের কাছ থেকে ফিরোজার বিষয়টা শুনলো। তারপর তার বড়োভাইকে বললো, চলো ফিরোজার শ্বশুর বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসি। জলিল মিঁয়াকে বুঝাই ,খলিলকেও বুঝাই। এখন দেশে কতো উন্নত ধরণের চিকিৎসা এসেছে। দেশ বিদেশ থেকে লোকজন এসে এখানের সস্তায় চিকিৎসার সুবিধা নিয়ে ভালো হ’য়ে যাচ্ছে। নিঃসন্তানদের বাচ্চা হচ্ছে। হ্যাঁ, খরচখরচা অনেক বেশী,তবে জলিলের তো আর টাকাপয়সার কমতি নাই তো সেই সুবিধা তারা নিবে না কেন ?
তারা পরেরদিন জলিল সরদারের বাড়িতে গেলো আর তার সাথে একান্তে খলিলকে ডেকে নিয়ে বৈঠক করলো। শামসাদ তাদেরকে বুঝিয়ে বললো , জোয়ান মেয়ে জামাই, অথচ তাদের যখন সন্তান হচ্ছে না, তখন দুজনের অথবা কোনো একজনের কিছু খামতি বা অসুস্থতা আছে। তার জন্য আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নেওযা জরুরী। কলকাতায় এখন বড়ো হাসপাতালে সেই ব্যবস্থা আছে। এমন কি আইভিএফ ( IVF )পদ্ধতি আছে, যাকে বলে নলশিশু পদ্ধতি, যাতে মায়ের ডিম্বানু ও বাপের শুক্রাণুকে শরীরের বাইরে মিলন ঘটিয়ে ভ্রূণ তৈরী করা হয়। আর তারপর তা মায়ের গর্ভে সময়মতো দিয়ে দেওয়া হয়। আর নিঃসন্তান দম্পতিদের বাচ্চাও হচ্ছে। আর তোমরা যে বলছো, ছেলের আবার বিয়ে দিবে , তাতে যদি তোমার ছেলেরই কোনো খামতি বা অসুস্থতা থাকে তখন তো সেই বৌয়েরও বাচ্চা হবে না। তখন কী করবে ? তার আগে আধুনিক চিকিৎসা নেওয়া কি ভালো হবে না ? আমতা আমতা ক’রে জলিল ছেলেকে রাজী করালো, তবে হ্যাঁ, খরচাপাতি সে করতে পারবে না আর একবছর সময় দিবে। তাতে কিছু না হ’লে সে ছেলের বিয়ে দিবে। খরচের কথা ওঠায় মেয়ের বাপ আরশাদ বললো ,সব খরচাপাতি সে মেটাবে। তবে সময়টা একটু বাড়াও। অন্ততঃ দেড় বছর করো ভাই, এই চিকিৎসায় তো সময় বেশী লাগে। তোমরা এতেই শুধু রাজী হও। বেশ, আমতা আমতা ক’রে জলিল ও খলিল রাজী হলো।
তারপর শামসাদের সহযোগিতায় কলকাতার এক নামীদামী হাসপাতালে তাদেরকে নিয়ে গিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে জানা গেল ,খলিলের বীর্যরসে শুক্রাণু খুবই কম । তবে তাতে সক্ষম সচল ও পুষ্ট শুক্রাণুও অল্প পাওয়া গেছে। ফিরোজার গর্ভধারণের পক্ষে কোনো ত্রুটি নাই। ডাক্তারেরা আইভিএফ পদ্ধতির আশ্রয় নিতে বললেন এবং আশ্বাস দিলেন যে তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। বছরখানেকের চেষ্টায় এবং হাসপাতালের সরাসরি তদারকিতে ফিরোজা গর্ভবতী হলো এবং যথাসময়ে ওই হাসপাতালেই একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো।যাক ফিরোজার দুঃখের ভাগ্য কাটলো। জলিল সরদার ও খলিল সর্দার বেশ গর্বিত হলো। তবে ফিরোজার বাপের বেশ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হলো।তা হোক আরশাদের টাকাপয়সার কমতি নাই।জলিল একবার খরচের কথা জানতে চেয়েছিল, তবে আরশাদ খরচের পরিমাণ বললেও তার কিছু অংশও দাবি করেনি। তাদের মেয়েটা সুখী থাকলেই তারা সুখী।
তাদের গ্রামে এমনকি আশেপাশের গ্রামেও খবরটা র’টে গেল। এবং খরচের কথাও লোকমুখে নানান মাত্রা পেলো। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর জয়যাত্রার প্রচার পেলো।তবে তা সাধারণ দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে।
আরশাদের গ্রামেরই এক ঘর নিঃসন্তান দম্পতি ছিলো।তার বউ কমলি বেশ সুশ্রী ও নম্র স্বভাবের যুবতী, তার স্বামী নিয়ামত ক্ষুদ্র চাষী, কখনো নিজের জমিতে কাজ করে ,কখনো ছোটখাটো ব্যবসা বা সবজি ফেরি ক’রে তাদের দিন চ’লে যায়।তাদের বিয়ের প্রায় দশ বছর হতে চললো ।অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিলো, তারা এখনো তিরিশের কোঠায়। সেই কমলিও সবার সাথে বাচ্চাকে দেখতে গেলো। দেখতে পেলো, তবে দূর থেকে।বাচ্চার কাছে যাওয়া একেবারে মানা। কমলির তখন মনে আশা ,তাহলে তো তারও বাচ্চা হ’তে পারে। ওরা একদিন পরামর্শ ক’রে ফিরোজার বাপের কাছে গেলো , বিষয়টা জানতে , পরামর্শ নিতে। ফিরোজার বাপ বাড়িতেই ছিলো । নিয়ামত তার চেনা লোক, সাথে তার স্ত্রী।সব শুনেটুনে আরশাদ বললো, সে বাচ্চা পাওয়া সম্ভব। তবে চিকিৎসার যা খরচ তার উপর কলকাতায় থাকাখাওয়া যাতায়াত সব মিলিয়ে প্রায় বিশ লাখের ধাক্কা।তোমাদের মতো পরিবারের পক্ষে বহন করা একেবারেই সম্ভব না। তবে তোমরা দ্ত্তক নিতে পারো। সব শুনে তারা বিমর্ষ হ’য়ে বাড়ি ফিরে এলো । কমলি তো রাস্তায় কেঁদেই ফেললো। তাদের মতো সংসারে কেন এমন অসুখ দ্যায় আল্লা ? নিয়ামত তাকে সান্ত্বনা দিলো, কমলি তুই কাঁদিস না। আমি তো আর দ্বিতীয় বিহ্যা করবো না।দেখছি ,কোনোভাবে আমরা একটা বাচ্চা দত্তক নিবো বা যাদের কিছু নাই অথচ অনেকগুলো বাচ্চা তাদের থেকে একটা মেয়েকে নিয়ে মানুষ করবো। বিয়েশাদি দেয়ে আমাদের ঘরেই রেখে দিবো। আল্লা চাইলে তেমন কেউ নিশ্চয় জুটে যাবে। কমলি অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকে।
একদিন ভোরে হাল্কা আঁধার থাকতে নিয়ামত প্রাত্যকৃত্য সারতে ধূলফেলার পুকুরের ঝোপের দিকে গেছে, হঠাৎ তার মনে হলো, ঝোপের কাছে কোনো বাচ্চার কান্নার মৃদু আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তার কেমন খটকা লাগলো। সে তাড়াতাড়ি
সেদিকে এগিয়ে গেলো। দেখলো ধূলফেলার আস্তকুঁড়ের মধ্যে একটা সদ্যঃজাত বাচ্চা নড়াচড়া করছে আর ক্ষীণ কন্ঠে কেঁদে কেঁদে উঠছে যেন মরণোন্মুখ। ভাগ্যিস কোনো কুকুর শিয়াল টের পায়নি ! সাথে সাথে সে নোংরা জঞ্জালের পরোয়া না ক’রে এগিয়ে গেলো আর ঘাড়ের গামছা দিয়ে
বাচ্চাটাকে খুব আলগোছে তুলে নিয়ে ছুটলো তার বাড়ি। বাড়ি গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে কমলিকে ডেকে তুললো আর বললো, দ্যাখ কমলি, আল্লা আমাদের মনস্কামনা পূর্ণ করেছে। সে সমস্ত ঘটনা বললো। এখন বাচ্চাটাকে সেঁকাপোড়া ক’রে গরম কাপড়ে মুড়ে সুস্থ ক’রে তুলতে হবে। কমলি ঘুঁটের আগুন জ্বালালো আর কোলে তুলে নিয়ে একরত্তি বাচ্চাকে সেঁকতে লাগলো । তার কান্না থামাতে সে অজান্তেই নিজের স্তনে তার মুখ লাগিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। নিয়ামত তাড়াতাড়ি কার বাড়ি থেকে দুধ এনে গরম ক’রে চামচ দিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলো। তাদের ঐকান্তিক পরিচর্যায় কন্যা বাচ্চাটি বেঁচে উঠলো।- – – – এই খবর কি চাপা থাকে ? কেউ কেউ বাচ্চাটাকে হাসপাতালে বা পুলিশে দেওয়ার কথা বললো। বাচ্চাটাকে কেউ কেড়ে নিবে সেই ভয়ে তারা ওকে হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলো না। সবাই যখন জানলো বিষয়টা, বললো পুলিশ এসে তোমাদের থানায় নিয়ে যাবে। – – তারা গাঁয়ের মোড়ল আরশাদ মন্ডলের কাছে গেলো। আরশাদ গ্রামের মানুষকে ডেকে বুঝালো,তোমরা একথা কোথাও বলবে না। বাচ্চাটাকে আল্লা ওদের কোলে পাঠিয়েছে, ওদেরকে শান্তিতে থাকতে দাও। মোড়লের কথাই শেষ কথা তাই আর কেউ উচ্চবাচ্চ্য করলো না।
হায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান অনেক মানুষের উপকারে লাগছে ঠিকই, কিন্তু তা কেবল আজ অবধি সম্পদশালীদের কাছেই উপলদ্ধ,সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ যে অন্ধকারে সেই অন্ধকারেই। অথচ তাদেরও সেটা পাওয়া কাম্য।
তার মধ্যেও এরকম ফেলে-দেওয়া সন্তানরাও অনেকের কাছে আশার আলো হ’য়ে দেখা দ্যায়। এখানে আইনকানুনও খুব নিষ্ঠুর হ’য়ে দাঁড়ায় অনেক সময়। যদিও কমলি-নিয়ামত আরশাদ মন্ডলের বদান্যতায় ও গ্রামবাসীর সহযোগিতায় আইনের কোপে পড়েনি। ফিরোজা আর কমলি দুজনেই দু’ভাবে কোলে বাচ্চা পেয়েছে ,তাই আরশাদ মন্ডল খুব খুশী। সে আশা করে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই অভাবনীয় আইভিএফ পদ্ধতি ভবিষ্যতে যেন সকলের নাগালের মধ্যে উপলদ্ধ হয়, বিজ্ঞানীরা যেন সেই সাধনাও করেন।
দুই মা ছোট গল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভরুয়া
উদ্বর্তিনী
নীলবাস্প