গল্প হলেও সত্যি ছোটগল্প – সুপর্ণা আচার্য্য চক্রবর্ত্তী
প্রায় বারো ঘণ্টা পর দিপালীর জ্ঞান ফিরলো।হাসপাতালে শুয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে রইল সে, জানালা দিয়ে দেখা যায় ওই খোলা আকাশ। কত মেঘ ভেসে বেড়ায়; কত মেঘের আনাগোনা ওই নীলাকাশে। আজও দিপালীর মনে পড়ে যায় সেই দিনটির কথা মনে পড়ে যায় আজ থেকে ঠিক বছর আটেক আগে এমন ভাবেই খোলা আকাশের নিচে বসে তারা দুজন দুজনকে কথা দিয়েছিল পাশে থাকার সাথে থাকার কিন্তু তা হলো কই? এসব ভাবতে ভাবতে সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। এখানে ” বলতে বোঝানো হয়েছে দিপালী আর সোমনাথের কথা সোমনাথ অর্থাৎ দিপালীর ভালোবাসার মানুষ।
দিপালীও সোমনাথ একে অপরকে ভালোবাসতো দিপালী ছিল বাগদী মেয়ে আর সোমনাথ উচ্চ বংশীয় ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। ফলে পারিবারিক স্ট্যাটাস এক না হলেও তাদের ভালোবাসার স্ট্যাটাসটা ছিল যথেষ্ট মজবুত। একটু হাস্যরস মিশিয়ে বলা যেতে পারে এই মজবুত ভালোবাসার প্রমাণ দিপালীর মরণ ডাক দিল।
সম্পর্কে সোমনাথ দিপালীর গৃহ শিক্ষক ছিল দিপালী সবে তখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলেজে ভর্তি হয়। দিপালীকে দীর্ঘদিন ধরে পড়াতে পড়াতে না জানি কখন দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলে। মুখে কেউ কাউকে কখনো না বললেও তাদের একে অপরের প্রতি কথা বলার ধরণ দেখে কারোরই আর বোঝার বাকি ছিল না যে তারা একে অপরকে ভালোবাসে। এরপর দেখতে দেখতে সাতটা বছর কিভাবে পেরিয়ে গেল, দীর্ঘ সাত বছরের প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও একে অপরের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও সে বন্ধন ভবিষ্যতে স্থায়ীত্ব লাভ করতে পারেনি। সেটা কিভাবে এবার তা শুরু করা যাক কিভাবেই বা দিপালীর জীবনের মর্মান্তিক অবনতি ঘটেছিল তা সত্যি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল।
গল্পের পূর্বেই বলা হয়েছে সোমনাথ ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে ছিল আর দীপালী বাগদী তাই এই জাত পাতের বিষয় নিয়ে দুই পরিবারের ভীষণ রকম আপত্তি ছিল বাড়ির লোকের সব বিরোধিতা উপেক্ষা করেও দুজন দুজনের সম্পর্কে অটুট থাকে।
এদিকে দিপালীর বাবার একটি কথা যে সোমনাথ যতই ব্রাহ্মণ পরিবারের হোক না কেন ও তো বেকার। এখন অব্দি সে কোন রকম চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। দিপালীর বাবার কথায়, “দুটো টিউশন করিয়ে কত টাকাই বা সে আয় করে দীপা! আমি তোদের দুই ভাই বোনকে অতো সুখ স্বাচ্ছন্দ দিতে না পারলেও দুবেলা দুমুঠো খেতে দিতে পারছি কিন্তু সোমনাথ সে কি করতে পারছে এই বাজারে? এই বাজারে রোজগার করাটা যে কত কষ্টের তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। আগে নিজের যোগ্যতা একটা চাকরি পেয়ে দেখাক তারপর নয় বিয়ের কথা নিয়ে ভাবা যাবে”।
দিপালীর বাবার এই কথায় সোমনাথের আত্মসম্মানে খুব আঘাত হানে। সে (সোমনাথ) সেই মুহুর্তে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় দিপালী সম্পর্কে। দিপালীকে সে পরিষ্কার জানায়, “যতদিন না সে চাকরি পাচ্ছে ততদিন সে তার মুখ দেখাবে না আর দিপালীর মুখদর্শন সে করবে না”। দিপালী কাঁদতে কাঁদতে বলে, “সোমনাথ আমি তো কোন অভিযোগ করিনি তবে কেন আমায় এতো বড় শাস্তি দিচ্ছ? ফিরে এসো তুমি”। কিন্তু সোমনাথ একটি বারের জন্যেও পেছনে ফিরে তাকায় না এরপর বেশ কয়েকটা বছর কেটে যায়। মোটামুটি স্বাভাবিক ছন্দেই জীবন চলতে থাকে দুজনের। দিপালী এই বছরই গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করেছে এখন থেকেই সে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে থাকে এবং কিছুদিন পর একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি পায়। এদিকে দিপালীর বাবা তাকে বিয়ের জন্য ভীষণভাবে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই সে সব সম্বন্ধগুলো নাকোচ করে দেয়।
এর দিন কয়েক পর দিপালীর জীবনে চরম দুঃখের দিন এসে উপস্থিত হয়,এটাই হলো জীবনের দুঃখের সূত্রপাত। অফিস ফিরতি পথে সে তার বাবা ও অসুস্থ পিসির জন্য কিছু ঔষধ ও ফল কিনতে গেল একটি মার্কেটে, আসলে তার এক কলিগ একটি জায়গার ঠিকানা দিয়েছে যেখানে ফলের দাম অন্য জায়গার তুলনা অনেকটাই কম এবং ওইখানে কিছু দোকান আছে যেখানে কষ্ট করে দু’পা হাঁটলে কিছু কম শতাংশ হারে ঔষধ পেতে পারে। সেজন্য সে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিল । রাস্তার ফুটপাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ তার মুখোমুখি পরে সেই মানুষটি যার হাতটি ধরে সে সাত আট বছর পথ চলেছে অর্থাৎ সোমনাথ। সে দেখছে যে হাত ধরে এতো দিন সে তাকে( দিপালী)কাছে টেনে নিতো আজ সেই সোমনাথ অন্য কারো সাথে সোহাগ করছে,শুধু তাই নয় মেয়েটিকে খাইয়েও দিচ্ছে আর মেয়েটি ও তাই করছে…..।
দৃশ্য দেখে দিপালীর বোঝার আর বাকি থাকে না যে সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলেছে। সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। শত লোকের মাঝখানেতে দাঁড়িয়েও কান্নায় ভেঙে পড়ল আর রাস্তার মধ্যেই পা মুড়ে হতভম্বের মতো বসে পরলো । তার মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়েছে। এ কি হলো তার সাথে? কেন হল? কি অপরাধ তার ?এসব ভাবতে থাকে আপন মনে কিন্তু এর উত্তর তার নিজেরও অজানা।
তবে কি সে মানুষ চিনতে ভুল করেছে? তার ভালোবাসার টানে সে তো নিজের সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়েছে তার আভ্রু যে নষ্ট হয়ে গেছে। নিজেকে আজ বড় অপবিত্র বলে মনে হচ্ছে তার। সে ঠিক করে আজ থেকে সে না তো আর ঠাকুর ঘরে যাবে; না কোন পূজা পাঠ করবে, ঠাকুর বলে আসলে কিছুই নেই নাহলে এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পরিণতি কি এরকম হয়!!দিপালী ভাবলো একবার সোমনাথ কে ফোন করবে,দেখবে ওর মানসিকতার কেমন পরিবর্তন হয়েছে, ভাবা মাত্রই সেই কাজ করলো সে অর্থাৎ সোমনাথ কে সে ফোন করে দেখলো ফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু বারবার কল ডিসকানেক্ট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাও সে বুকে পাথর চেপে ফোন করল শুধু একটি বার তার সাথে কথা বলার জন্য ।সবকিছু যে শেষ হয়ে গেছে অর্থাৎ তার ভালোবাসার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে…. আশা ভরসা ভালোবাসা বিশ্বাস এসব কিছু নিয়ে সে একবার চায় সোমনাথের সাথে কথা বলতে সেজন্য সে আবারও ফোন করল এরপর অপর প্রান্ত থেকে বিরক্তিপূর্ণ গলায় ভেসে উঠলো “হ্যাঁ বলো ,বারবার ফোন করছ কেন? আমি ব্যস্ত আছি এখন, আজ থেকে আমায় আর কখনো ফোন করো না।”দিপালী বলল, “কেন?” সোমনাথ বলল,” ভালো লাগছে না তাই ;আর আমি তোমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না, আমি আমার জীবন নিয়ে একটু সুখে শান্তিতে বাঁচতে চাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই”। দিপালী বলল,” আমি কি তবে তোমার শান্তির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি?
সোমনাথ বলল,” অতো আমি জানিনা দীপা; তোমায় আমার মুখ দেখাবো না চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত,তুমিও আমার কোনো খবর নাও নি এতদিনে আর আমি আমার কথা রেখেছি ।আরেকটা কথা আমি অন্য সম্পর্কে যুক্ত তাই আশা করব তুমি আমাকে আর বিরক্ত করবে না আমার
জন্য অপেক্ষা করে আর কোন লাভ নেই…. ভালো থেকো “….বলে ফোনটা রেখে দিল।
তাদের মধ্যে এই কথোপকথনের জেরে দিপালী ভুলে গিয়েছিল বলতে যে, সোমনাথ বলেছিল দিপালী যেনো তার মুখদর্শন না করায় তাই সে তাকে (সোমনাথ) সময় দিয়েছিল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তার সময়ের অপচয় করা নয়।
দিপালী বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে সে নিজের পবিত্র ভালবাসার এ হলো অসম্মান সে মেনে নিতে পারছিল না কিছুতেই। এদিকে তার এরকম চিৎকারে তার বাবা-মা এমনকি পরিবারের অন্যান্য রা ছুটে আসে দিপালীর ঘরে ঢুকে তারা দেখেন তাদের একমাত্র মেয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তার চুলগুলো এলোমেলো দুচোখে ভর্তি জল বই খাতা ছড়ানো একটা ছেঁড়া ডায়েরী। পৃষ্ঠা গুলো ছেঁড়া, সেই ছেড়া ডাইরি টার ভেতরে রাখা একটি শুকনো গোলাপ ফুল বেরিয়ে এসেছে।
মেয়ের এই অবস্থা দেখে তার পরিবারের লোকজন বিশেষত তার বাবা-মায়ের কষ্টের সীমা থাকেনা মেয়ে কি হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরে যখন তার জ্ঞান আসে তখন কাউকেই সে চিনতে পারেনা। দিপালী বাবা-মা অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তারা দিপালী বাবা-মা হন কিন্তু দিপালী তা মানতে নারাজ। সে এতটা উত্তেজিত হয়ে ওঠে যে চারজন নার্স মিলে তাকে শান্ত করতে পারে না তখন তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হলে সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার মানসিক বা শারীরিক অবস্থার উন্নতির কথা জানতে চাইলে ডাক্তার সাফ্ জানিয়ে দেন এই মুহূর্তে এসব কথা ভাবা তো দূরের কথা তাকে বাঁচানোটাও খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের কাছে।
এর দুদিনপর ডাক্তার জানায় দিন দিন দিপালীর অস্বাভাবিক আচরণ যেরকম হয়ে উঠছে তাকে মেন্টাল অ্যাসাইলেমে পাঠানো ছাড়া আর অন্য কোন উপায় তারা দেখতে পাচ্ছেন না।
এরপর দিপালী কে সেখানে পাঠানো হয়। নিজের মেয়ের প্রতি নিজের আচরণের জন্য অনুতাপ করতে থাকে দিপালীর বাবা। তাদের সারা বাড়ি জুড়ে যেন শোকের ছায়া নেমে আসে। দিপালীর মা কাঁদতে কাঁদতে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন বারবার।
এসব কিছু আর সহ্য করতে না পেরে দিপালীর বাবা আত্মহত্যা করেন সেদিন রাতেই। এই ঘটনা পরিবার তথা এলাকার লোকজন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না সকলের মনে একই প্রশ্ন কি এমন হলো যে এই বাড়িতে এইরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটছে।
এরপর যথারীতি বাড়িতে পুলিশ এলে সমস্ত খোঁজখবর করা, পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি শুরু হলো। স্বামীর মৃত্যু শোকে দিপালীর মা পাগলের মতো আচরণ করতে থাকে। যাই হোক এভাবেই গেল কিছুটা সময়।
এরপর সন্ধ্যের সময় দাহকার্য করার জন্য শ্মশানে নিয়ে গেলে কিছুতেই তার(দীপালীর বাবার)চিতার আগুন জ্বলে না; কেউ এর কারণ বুঝতে না পারায় শ্মশানের এক পুরোহিত বললেন,”এটা তো আত্মহত্যা!! তাই হয়তো ওনার আত্মা অন্য কারো কাছ থেকে মুখাগ্নি চাইছে; ওনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? অর্থাৎ তাকে তিনি সব থেকে বেশী ভালবাসতেন? বাড়ির লোকেদের মধ্যে থেকে উত্তর এলো, “ওনার মেয়ে” অর্থাৎ দিপালী। উনি মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসতেন। পুরোহিতের কথামতো দিপালীকে অ্যাসাইলেম থেকে আনতে গেলে সেখানে ঘটলো এক অলৌকিক ঘটনা মানসিক ভারসাম্যহীন এই মেয়ে দিপালী; কেমন যেন সুস্থ আচরণ করছে “বলছে তোমরা আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? বাবা, তুমি তো কিছু বলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সকলে আমায়?”। তখন তাদের মধ্য থেকে একজন উত্তর দিল, “তোমার বাবা মারা গেছেন মা ওনার দাহকার্য সম্পন্ন করার জন্য তোমাকে আমরা শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছি। উনি হয়তো চান তুমি ওনার মুখাগ্নি করো “।
দিপালী তাদেরকে বলে,” কি সব বলছো ! আমার বাবা মারা গেছে? বাবা তো এখানে; এই যে আমার পাশে ,এই জলজ্যান্ত লোকটা কে বলছো মারা গেছে!! তখন সকলে একে অপরের মুখ চাওয়া চাই করে বলতে লাগলো ও তো মানসিক ভারসাম্যহীন তাই যা খুশি বলছে।
এরপর তাকে শ্মশানে নিয়ে গেলে দিপালী সত্যিই নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না যে তার বাবা চিতার ওপর শুয়ে আছে, তখন তার মাথায় এলো যে সে এতক্ষণ কার সাথে ছিল ?কে তার মাথায় আশীর্বাদের হাত দিয়েছিল? এরপর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখে দিপালী বাবার মুখাগ্নি করল এবং অলৌকিকভাবে চিতাও সুন্দরভাবে জ্বলে উঠলো। চিতা নিভু নিভু অবস্থায় এলে দিপালী আবারো অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার মুখ থেকে নানা রকম কণ্ঠস্বরে কথা বেরোতে থাকে। লোকজন ভয় পেয়ে তাকে আবারো অ্যাসাইলেমে ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়। সেখানে নাকি সারারাত সে চিৎকার করতে থাকে এবং তার মুখে একটিই বাক্য , “দিপালীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার শাস্তি তুই পাবি, ওর জীবন ওর সম্মান ওর পরিবারের সম্মান সবকিছু ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে যে অপরাধ তুই করেছিস তার ফল তোকে ভুগতে হবে। আমি তোকে ছাড়বো না আমার মেয়ের কষ্টের শাস্তি তুই ভোগ করবি”।
বেশ কয়েকদিন পরে শোনা যায় সোমনাথের মা মারা যায় ছাদ থেকে পড়ে। কিন্তু ছাদ থেকে উনি কিভাবে পড়লেন? ওখান থেকে পড়ে যাবার মত কোন জায়গাই তো নেই এরপর একদিন সোমনাথ মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল দিপালীর বাবা বলছে,” আমার মেয়ের তথা আমার পরিবারের এই দুরবস্থার জন্য যে দায়ী তাকে আমি ছাড়বো না”।
সোমনাথ ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে বসে। তার ঘরের বিছানা লাগোয়া একটি জানালা ছিল, সে দেখল সে জানালার কাঁচের মধ্যে একটি কালো ছায়া আর কে যেন সেখানে করুণ স্বরে কাঁদছে। সোমনাথ চিৎকার করলো ‘কে ওখানে? কে আছে এত রাতে?’ সঙ্গে সঙ্গে সেই কান্নার আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়।
একদিন রাতে সোমনাথ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হতে গেল কিন্তু বাথরুমে ঢুকেই সে চিৎকার জুড়ে দিল তার চিৎকারে বাড়ির সবাই ছুটে এল তারা জিজ্ঞেস করলে সে বলল বাথরুমে একজন লোককে সে দেখেছে যার চোখ দুটি রক্ত বর্ণ চোখে মুখে হিংসার ছাপ স্পষ্ট। বাড়ির সকলে ওর মনের ভুল অফিসের ক্লান্তি বলে কথাটা উড়িয়ে দিল।
প্রায়দিন রাতেই সে শুনতে পায় কে যেন কাঁদে গুমড়ে গুমড়ে.. যেন অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলেছে সে । এদিকে আবার অ্যাসাইলেম থেকে দিপালীর বাড়ি খবর যায় মানসিক অবস্থার ক্রমাবনতি সেই সম্পর্কিত আরো অনেক কিছু করা হয়েছে তার চিকিৎসার জন্য আর সেখানেই ইলেকট্রিক শক দেবার সময় সহ্য করতে না পেরে দিপালী মারা যায়।
যেদিন দিপালী মারা যায় সেদিন তাদের এলাকাবাসীর মুখে অন্য ওঠে না এমন কোন লোক নেই যাদের চোখে জল আসেনি এই পরিবারের এমন করুন ঘটনায়। এরপর এলো সেই দিনের পালা যেদিন সোমনাথ বাড়ি ফিরতি পথে ট্রেনে আসছিল। সোমনাথ যে কম্পার্টমেন্টে ছিল সেখানে দু একজন লোক ছিল বটে কিন্তু তারাও নেমে গিয়েছিল তাদের গন্তব্যে সুতরাং দূরের পথে সে একা, সোমনাথ অনুভব করলো কারো উপস্থিতি তার শিরদাঁড়া দিয়ে যেন ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তার কানে কানে কে যেন বলে উঠলো “কি করেছিলাম আমি? কি বা অপরাধ ছিল আমার? শুধু ভালোই তো বেসেছিলাম আর তো কিছু নয়”। সোমনাথ বলল, “আমায় ছেড়ে দাও ভুল হয়ে গেছে আমার ” এর ঠিক উল্টো দিক থেকে কে যেন বলে উঠল, “ছেড়ে দেবার জন্য কি ফিরে এসেছি? না আমাদের আত্মা শান্তি পেয়েছে? তোকে না মারা অবধি আমাদের আত্মা শান্তি পাবে না”।
এদিকে ট্রেন ও যেন দুরন্ত গতিতে ছুটতে লাগলো তার থামার যেন নামই নেই সারা কামরার লাইট ফ্যান জ্বলতে নিভতে লাগলো। কি যে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি; চারিদিকে যেন অট্টহাসির বন্যা হয়েছে। দিপালী বাবা সোমনাথের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো আর সোমনাথের পেছনে দিপালী দীপালির বাবা সোমনাথ এর হাত দুটো ধরে মোচড়ে দিল এবং ঘাড়টা ধরে শূন্যে তুলে দিল। কান্না ভেজা গলায় বলল, “আমার সন্তানটাকে মেরেই ফেললি !! আমি না হয় তোকে মানতে চাইনি কিন্তু ও(দিপালী) কি অন্যায় করেছিল?” “ভালবাসলে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হয় যা তোর মত মানুষের মানসিকতায় নেই।” “আমার মেয়ে যেমন তোকে পায়নি সেরকমভাবে আমিও তোকে অন্য কারো হতে দেব না” কথাটি বলেই সোমনাথকে ছুঁড়ে ফেলতে যাবে ট্রেন থেকে ঠিক তখনই দিপালী বাবাকে দিয়ে বলে,” বাবা; ও যেমন মানসিকতার যদি ওর সাথে আমরা তেমন আচরণ করি তবে ওর সাথে আমাদের পার্থক্যটা কোথায়?
এটা তো তুমি আমাদের শিখিয়েছিলে তুমি সেটা ভুলে যাচ্ছো!!”
“সোমনাথ এতদিন তুমি তোমার কর্তব্য করেছ এখন আমার কর্তব্য আমি করি” – কথাটি বলে দিপালী সোমনাথ কে বলে “বাবা মানেনি ঠিকই কিন্তু তুমি যখন অন্য সম্পর্কে জড়ালে তখন তোমার আমার সম্পর্কটা ছিন্ন করার কথা আগেই বলে দিতে পারতে তাহলে তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম না হয়তো আমার জীবনও পূর্ণতা পেতো ঠিক তোমার মতো।
তবে যাইহোক “আমরা তোমার কোন ক্ষতি করব না ; ক্ষতি চাইও না। কিন্তু তুমিও কথা দাও আর কোন মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করবে না”।
দিপালী আরো বলে, “মৃত্যু হয়েছে আমার শরীরের কিন্তু আত্মা আজও বেঁচে আছে। তাই আমাদের এই অতৃপ্ত আত্মার শান্তি কামনার্থে তুমি যদি আমাদের নামে অর্থাৎ বাবা ও আমার নামে পিন্ডদান করো তবে আমাদের আত্মা শান্তি লাভ করবে…. এটাই তোমার কাছে আমার শেষ চাওয়া। বিদায়….”
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সোমনাথের চোখ খুললে সে দেখলো ও তখনও ট্রেনে বসে ওর গন্তব্য তখনও আসেনি সোমনাথ তখন মনে মনে ভাবলো আমি কি তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম!! সোমনাথ অনুভব করলো তার সারা মুখ হাত-পা এমনকি শার্ট ঘামে ভিজে গেছে, হাতের কিছু জায়গায় কেটে যাবার চিহ্ন রয়েছে। এর মধ্যে আবার এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন “কোথায় যাবেন মশাই কখন থেকে ডাকছি ঘুমের মধ্যে কি সব বিড় বিড় করছিলেন , শরীর টরীর খারাপ নাকি?”সোমনাথ বলল, “আমি পরের স্টেশনে নামবো ব্যারাকপুর, আপনি বসুন আমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলাম” ।
নিজের সিট ছেড়ে উঠতে যাবে ঠিক তখনই তার চোখ পরল ঘামে হাতের মুঠোয় করা হাতের ভেতরে গোঁজা রয়েছে কিছু টাকা। তাতে লেখা আছে দুজনের নাম একজন হল দীপালী দুলে এবং তার বাবা শুভদেব দুলে।
তখন সোমনাথের বুঝতে আর বাকি রইল না এতক্ষণ তার সাথে যা যা ঘটেছে তা ‘স্বপ্ন হলেও সত্যি’।
গল্প হলেও সত্যি ছোটগল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
গল্প হলেও সত্যি
প্রচ্ছদ
কায়দায় জীয়ন কায়দায় মরণ