সত্যি ভূতের গল্প ভৌতিক গল্প – সুদীপ ঘোষাল
মুন্সেফ মারা গেছেন কুড়িবছর আগে।কিন্তু এখনও তিনি ছাড়তে পারেন নি এই পৃথিবীর মায়া, অজয়নদের চোরাবালি আর ঘোলাজলের ভালোবাসা। অনেকের কল্পনায় এখানকার ভূত সেই মুন্সেফ ও তার হত্যাকারী দল। মুন্সেফ ভালো ভূত।সে এলাকার লোকের প্রাণ রক্ষার কাজ আজও করে চলেছে। সাদাবেগুনকোলার খেয়াপাড়ের পূর্বদিকের বাংলোঘাটের, মুন্সেফ কোয়ার্টারে রাতের দৃশ্য যে দেখেছে সেই জানে। চাঁদের আলো ফিরিয়ে দেয় পুরোনো মায়া। গোপনে শুনেছি এই স্থানে রাতে অতীতের কোর্টের মুন্সেফ, তার খাতাপত্তর বগলে নিয়ে ফাঁকা মাঠে কোর্টের কাজ সারেন। হয়ত তার পুরোনো অভ্যাস এখনও ভুলতে পারেন নি। এর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটি অজয়ঘাটে মিলেছে। অজয়ের রূপ এখানে এসে অপরূপ অথচ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলে চোরাবালি অনেকেরই প্রাণ কেড়েছে। তাই এখানে সাবধানবাণী লেখা আছে। বিপজ্জনক এই জায়গায় সহজে কেউ আসে না। সকলেই এড়িয়ে চলে। দুদিকে বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয় চোরাবালির এলাকা। এপাড়ার তান্ত্রিক জেঠু আমার বহুদিনের চেনাজেঠু।তিনি বলতেন,এদিকে অমাবস্যার রাতে একা অজয়ঘাটে যাবি না।তবে তারা চাইলে তোকে টেনে নিয়ে যাবে ছদ্মবেশে। আমার ছোটকাকু সঙ্গে ছিলেন।কাকু বললেন, শিবের অনুচর দেবযোনিবিশেষ । অশরীরী প্রেত বা পিশাচ জীব, প্রাণী । ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসমূহের মূল উপাদান পঞ্চভূত।পরিণত দ্রবীভূত, বাষ্পীভূত বিদ্যমান, রয়েছে যার বর্তমান অতীত কাল ভূতপ্রেতের দ্বারা আক্রান্ত । অমাবস্যা আর কার্তিক মাসের কৃষ্ণাচতুর্দশী তিথিতে উপদ্রব বাড়ে। জেঠু বললেন, ঠিক বলেছেন আপনি।তবে ভূত হলো অশরীরি পুরুষ আত্মা, আর পেত্নী অশরীরি মেয়ে আত্মা। অপঘাত, আত্মহত্যা প্রভৃতি কারণে মৃত্যুর পর মানুষের অতৃপ্ত আত্মা ভূত-পেত্নী হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারে। অন্যান্য জীবজন্তু বা প্রানীও তাদের মৃত্যুর পরে ভূতে পরিণত হতে পারে। বাংলায় ভূতকে মাঝে মাঝে প্রেতাত্মা হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। প্রেতাত্মার নারীবাচক শব্দকে পেত্নী হিসেবে এবং পুরুষবাচক শব্দকে প্রেত বলা হয়ে থাকে। আমি বললাম বাংলার সংস্কৃতিতে অনেক ধরনের ভূতের বিশ্বাস রয়েছে; তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো নারী ভূত যারা বেঁচে থাকতে কিছু অতৃপ্ত আশা ছিল আর অপ মৃত্যুবরণ করেছে। জেঠু বললেন, পেত্নী শব্দটি সংস্কৃত, প্রেত্নী, শব্দ থেকে এসেছে এসব ভূত সাধারনত যে কোন আকৃতি ধারন করতে পারে, এমনকি পুরুষের আকারও ধারণ করতে পারে। এসব ভূত সাধারনত বেঁচে থাকতে কোন অপরাধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে এবং মৃত্যুর পর অভিশিপ্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করে। পেত্নীরা সাধারনত ভীষণ বদমেজাজী হয়ে থাকে এবং কাউকে আক্রমনের পূর্ব পর্যন্ত স্পষ্টতই মানুষের আকৃতিতে থাকে। পেত্নীদের আকৃতিতে একটিই সমস্যা রয়েছে, তা হলো তাদের পাগুলো পিছনের দিকে ঘোরানো। সংস্কৃত শব্দ শাকচুন্নি থেকে এসেছে। এটা হলো অল্পবয়সী, বিবাহিত মহিলাদের ভূত যারা বিশেষভাবে তৈরি বাঙ্গালি শুভ্র পোষাক পরিধান করে এবং হাতে শাঁখা পরিধান করে। শাঁখা হলো বাঙ্গালি বিবাহিত মহিলাদের প্রতীক। লোকগাথা অনুসারে জলাভূমির ধারে আম গাছে বাস করে এরা এবং ছোট ছেলেমেয়ে দেখলে তাকে আকৃষ্ট করে ফাঁদে ফেলে। কখনো কখনো সে মানুষকে জলাভূমি থেকে মাছ ধরে দিতে বলে। কিন্তু সাবধান, শাঁকচুন্নিকে মাছ দেয়া মানে নিজের আত্মা তার হাতে সমর্পণ করা। মাছ পেলে তারা সেই মানুষকে মাছের মত কড়মড়িয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে করে দেয়। কিন্তু মানুষ তো একপ্রকার হয় না। কিছু মানুষ চেনা ছকের বাইরে ছক কষে। কি করে টাকা পয়সা বেশি করে অর্জন করা যায় তার মকসো কষার লোক আছে বই কি। আর এইসব লোক নিশাচরের মত। দিনে কোথায় থাকে দেখা যায় না। কিন্তু রাত হলেই ঘুরঘুর করে বিপজ্জনক এলাকায়। যেখানে সাধারণ মানুষ দিনের বেলা যেতে ভয় পায় সেখানে রাতের বেলায় নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করে নিশাচরের দল। আমি ভূতের কথা শুনেছি কিন্তু কোনোদিন চোখে দেখি নি। বাবা বলতেন, চোখে না দেখা জিনিস সত্যি হয় না। কথাটা অন্তরে গেঁথে ছিলো। ফলে কোনোদিন ভূত দেখা দূরের কথা ভয় পর্যন্ত পাই নি।
বাংলোঘাটের বদনাম আছে। এখানে নাকি ভূত বাঁশবাগানের ভিতর দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। একদিন ব্যাগপত্তর গুছিয়ে চলে এলাম বাংলোঘাট। গরমের সময়। নৌকাবিহার বেশ জমে উঠলো।হঠাৎ দুজন বন্ধু জুটে গেলো নদীর তীরে। তাদের একজন বুড়ো মদনদা আর একজন ছোকরা মরাদা। মরা নামটা শুনে আমার গা টা ঘিন ঘিন করে উঠলো। শ্মশানের সময় শবদেহ পোড়ার গন্ধ নাকে ভেসে এলো। আমি বললাম, মরাদা এরকম বোটকা গন্ধ কোথা থেকে আসছে? মরা দা বললো, সামনে শ্মশানে মরা পুড়ছে হয়ত। আর তাছাড়া আমার মুখে দুর্গন্ধ আছে। অনেকদিন রক্ত খায় নি তো? আমি বললাম, কি যে বলো। রক্ত আবার খায় না কি? মরাদা বললো, আমি কি তাই বললাম নাকি? মদনদা বললো , হ্যাঁ বললি তো। গাঁজার নেশা ধরেছে নাকি। মরাদা বললো, ঠিক বলেছ। আজ টানটা বেশি হয়ে গেল। দাও দিকিনি আর এক ছিলিম। তারপর আমার সঙ্গে দুইজনে গাঁজা খেয়ে গল্প করতে লাগলো। তারপর আমার দিকে কল্কেটা এগিয়ে দিয়ে বললো, দাও একটান। দেখবে কেমন হাল্কা মেজাজে গান আসবে অন্তরে। আমি বললাম, আমি ওসব খাই না। তারপর বললাম, মদনদা নৌকায় মাঝি কই। কি করে চলছে নৌকো। মরাদা বললো, সন্দে হয়েচে তো। অন্ধকারে দেখা যায় না।
তারপর মাঝ নদীতে নিয়ে নৌকায় গল্প শুরু করলো মদনদা। আমাকে বললো, তোমার খুব সাহস মনে হচে। বেশি সাহস ভালো নয়। আমরা মুন্সেফ ঘাটে এসে পড়েছি। মৃত মুন্সেফের আত্মা এখন মুন্সেফ কোয়ার্টার থেকে পায়ে হেঁটে বৈকালিক ভ্রমণ সাড়ে। এই ঘাটে এসে চোরাবালিতে ডুব দিয়ে চান করে। আমি বললাম, চোরা বালি থেকে তো উঠতে পারবে না। মদনদা বললো, আরে বোকা এ তো মানুষ নয় ভূত। ভূতরা সব পারে। রাত হয়ে এসেছে। মুন্সেফ ঘাটে মুন্সেফ চোরাবালিতে ডুব দিল। নিজের চোখে দেখলাম। মদনদা আর মরাদা আছে বলে আমার ভয় পেল না।
মরাদা বললো, কি গো ভয় লাগছে না? আমি বললাম, তোমরা আছো তাই। মরাদা বলল, আমি মদনদাকে ডাকি। দেখলাম মরাদা একলাফে নদীর পাড়ে নৌকা থেকে লাফ মেরেই আবার নৌকায় ফিরে এল। মদনদা বলল, এবার তোর রক্ত চাই। ভূত দেখবি নয়। এই মরা এখানে আয়। তারপর মদনদা মরার হাতটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো আর পা টা ধরে চিবোতে লাগলো। আমি ওদের রক্তমাখা মুখ দেখে নৌকার মধ্যে চিত হয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
পরেরদিন সকালবেলা আমি জ্ঞান ফিরে পেলাম। দেখলাম হাসপাতালে শুয়ে আছি। ভূত আমাকে মারতে পারে নি মুন্সেফের দয়ায়। আমার মনে আছে,মুন্সেফ কালোকোট পরেছিলেন।তিনি আমার একটা হাত ধরে বললেন,ভয় নেই মুন্সেফ আমি, আমি থাকতে তোমার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।শুধু দেহছাড়া কালোকোট দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।
ব্যাগপত্তরগুলো কোয়ার্টার থেকে লোক গুলো এনে দিয়েছিলো। তারা বললো, কি মশাই, মদনদা আর মরার খপ্পরে পড়েছিলেন নাকি। যাক খুব জোর প্রাণে বেঁচে গেছেন।
আমি বললাম, আপনারা তো লোকাল লোক। আচ্ছা ওদের আসল ঘটনাটা কি জানেন? একজন বললেন, হ্যাঁ জানি। মুন্সেফ কোর্টের কাজ সেরে, একদিন সান্ধ্য ভ্রমণ শেষে, স্নান করতে গিয়ে দেখেন মদনগুন্ডা ও মরাগুন্ডা একজন নিরীহ মানুষকে চোরাবালিতে ফেলে হাসছে। হঠাৎ ওরা মুন্সেফকে দেখে ফেলে। ফলে মুন্সেফ ওদের শত্রু হয়। তারপর সঙ্গে সঙ্গে ওরা মুন্সেফকে ধরে বেঁধে এনে চোরাবালিতে ফেলে। মুন্সেফ একা ছিলেন। ওদের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন নি। কিন্তু তিনি বদলা নিয়েছিলেন একমাসের মধ্যে। এক অমাবস্যার রাতে দু’জনকে মুন্সেফের আত্মা টেনে আনে চোরাবালির ধারে। তারপর তারাও ডুবে যায় পাপকর্মের চোরাবালিতে। তারপর থেকে ওদের দুষ্টু আত্মা আনাড়ি ভালো মানুষকে নিয়ে আসে চোরাবালির ধারে আর মুন্সেফ এসে লড়াই করে বাঁচান মানুষদের। মুন্সেফ তাই এখানকার লোকেদের কাছে শুভ আত্মা, দেবতাস্বরূপ। তাঁর জন্মদিন পালন করে এখানকার লোক। আর প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে মুন্সেফ নিজে চোরাবালি থেকে উঠে এসে তার কোয়ার্টারে বসেন অভ্যাসমত,আইনের কাজকর্ম সেরে রাখতে।বিস্তর তার কাগজের বান্ডিল এখনও ডাঁই হয়ে জমে আছে ধ্বংসস্তূপে।
সত্যি ভূতের গল্প ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন