কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

দেশদ্রোহী

দেশদ্রোহী সায়েন্স ফিকশন গল্প – সৌমল্য শীল

রাত প্রায় ১টা। দুঁদে পুলিশ অফিসার রবীন্দ্র রাজকুমার টেজ়ার বন্দুটির সুরক্ষা নব ঘুড়িয়ে সক্রিয় করে নিলেন। হাতের মনিটর জানাচ্ছে অপরাধী নিজের শয্যায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন, বাড়িতে তার পরিবারও আছে, তারাও নিজ নিজ শয্যায় ঘুমন্ত। অন্ধকার বাড়িটির বাসিন্দাদের সম্পূর্ণ অজানা যে তাদের বাড়িতে হতে চলেছে পুলিশি অভিযান।

সহকারী রোবট ততক্ষণে হ্যাক করে ফেলেছে বৈদ্যুতিন তালা, খুলে গেছে দরজার পাল্লা। রাজকুমার চোখে পরে নিলেন ইনফ্রারেড চশমা, অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পাবেন সব কিছুই। এই অভিযানে তিনিই একমাত্র মানুষ, তার সাথে আছে তিনটি এন্ড্রয়েডের একটি টিম। এন্ড্রয়েড অর্থাৎ মানব-রুপি রোবট। তিনটি এন্ড্রোয়েড তার নির্দেশ পেতেই পরিবারের বাকিদের ঘরের দিকে চলে গেল, তাদের দরজার বৈদ্যুতিন তালা যাতে কোনোভাবেই খুলতে না পারে নিশ্চিত করতে। নিঃশব্দে তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অপরাধীর ঘরের বাইরে, দরজা খোলাই আছে। আলতো করে ঠেলে খুলে দিলেন দরজা, তারপরেই অবয়ব লক্ষ্য করে চালিয়ে দিলেন টেজ়ার। বৈদ্যুতিক জাল জড়িয়ে গেল অপরাধীর গায়ে।

“কে! কি! উহঃ! বাঁচাও!” অকস্মাৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অপরাধী। উঠে বসার চেষ্টা করতেই তার উপর চেপে বসেছে বৈদ্যুতিক জাল। ১৮ বছরের একটি তরুণ। কিশোর বললেই চলে। কিন্তু অপরাধ গুরুতর, দেশদ্রোহিতা। কোনো রকম সহানুভূতি জায়গাই নেই। আর রবীন্দ্র নিবেদিত পুলিশকর্মী, করুণা বা কৃপা শব্দগুলি তার অভিধানে নেই।

রাজকুমারের নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি এন্ড্রয়েড এসে পাকড়ে ধরেছে ছেলেটিকে। পাশের ঘরে তার পিতামাতা ঘুমাচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটির আর্তনাদ শুনে ঘুম ভেঙে গেছিল তাদের। বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতেই তারা বুঝতে পারে তাদের ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকানো, বেরুনোর উপায় নেই। অস্থিরভাবে দরজা পিটিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু অপরাধীকে গাড়িতে তুলে তবেই রাজকুমার দরজা খুলবেন। ছেলেটি কিন্তু চুপচাপ নেমে যাচ্ছিল না, ছটপট করছিল, বারবার দাবি করছিল সে নিরপরাধ, কিছু করেনি, কোন আইনভঙ্গ করেনি। রাজকুমার সেইসব অনুনয় কান দিলেন না, ডেকে নিলেন স্বয়ংচালিত প্রিজন-পড। একটি ভাসমান গাড়ি এসে দাড়ালো বাড়িটির দরজায়, এন্ড্রোয়েড অপরাধীকে তুলে দিতেই বন্ধ হয়ে গেল গোলাকার গাড়িটির দরজা, উড়ে গেল কারাগারের দিকে।

“আমার ছেলের কি দোষ? কি করেছে ও? কেন আটক করছেন ওকে? ও একটা বাচ্চা ছেলে, ও খুব ভালো ছেলে! আমার সন্তান!” ছেলেটির মা জানলা খুলে বিলাপ করে উঠল। ছেলেটির বাবা তখনও বিফলভাবে দরজা ভেঙে বেরিয়ে এসে তার পুত্রকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে চলেছে।

“আপনার ছেলে বিশ্বাস করে নোভারার মানুষেরা আমাদের থেকে বেশি সুখী, বেশি মুক্ত! এরকম দেশদ্রোহী চিন্তাভাবনা যে কতটা বিপদজনক সেটা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না। আপনারা যত তাড়াতাড়ি পারুন ওর কথা ভুলে যান, দেশদ্রোহীর প্রতি আত্মীয়তা দেখানো কিন্তু দেশদ্রোহিতার সমান।” রাজকুমার কেটে কেটে উত্তর দিলেন।

ভাবলেই তার শরীর চিড়বিড় করছে! এই স্বর্গরাজ্যের থেকে কিনা ওই অরাজক নোভারার মানুষেরা বেশি সুখী! ছিঃ ছিঃ! এমন চিন্তাভাবনা কেবল দেশ এবং সমাজের প্রতি বিদ্রোহী নয়, পাপ! ঘোরতর পাপ! এদের মা বাবা কি ঠিক করে শিক্ষাও দেয়েনি?

সময়টা দ্ববিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। শান্ত সুন্দর দেশ ইন্দ্রপুরী, তার রাজধানী অমরাবতী। শহরের আকাশ ঢেকে আছে আকাশচুম্বী অট্টালিকায়, মাঝখানের জায়গা দিয়ে উড়ে চলেছে স্বয়ংচালিত গোলাকার পডগুলি। দূষনহীন, চালকহীন গাড়িতে উঠে শুধুমাত্র নিজের গন্তব্য টিপে দিলেই উড়িয়ে নিয়ে যাবে সেখানে। নিজেকে কিনতেও হয়না, ডাকলেই এসে হাজির হবে, আবার গন্তব্যে পৌঁছানো মাত্র চলে যাবে। নিজে থেকেই ভাড়া কাটা হয়ে যাবে ব্যাংক থেকে।

পডটিতে উঠে রাজকুমার শরীর এলিয়ে দিলেন। আজ এত রাত হয়ে গেছে, গভীর রাতে তলব পেয়ে যেতে হয়েছিল। বাড়িতে ঐশী নিশ্চই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। মা-মরা মেয়েটি তার বাবার আদরের রাজকুমারী।

এটা একটা অপরাধমুক্ত সমাজ। মাত্র বছর ত্রিস আগে যখন অরাজকতা পৃথিবীর প্রতিটি দেশে অধিক থেকে অধিকতর হয়ে এক চরম পর্যায় পৌঁছেছিল, তখন OverseerAI নামক একটি বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থা বানিয়েছিল একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র। যেটি কেবলই মানুষের লেখা, ইন্টারনেটের খোঁজাখুঁজি বা উচ্চারিত কথা নয়, বরং মস্তিষ্কের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে ধরে ফেলতে পারে তাদের চিন্তা। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকারের কাছে তারা একটি আবেদন জানিয়েছিল। তাদের দেশের বসবাসকারীদের উপর এই নজরদারি করার অনুমতি পেলেই তারা শেষ করে দিতে পারবে সবরকমের অপরাধ। কারণ বাস্তবে ঘটার অনেক আগেই যে কোনো অপরাধ সংগঠিত হয় মানুষের মনের ভিতর, তাদের চিন্তা-ভাবনায়। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি চিন্তার উপর যদি নজরদারি থাকে, তাহলে অপরাধ সংগঠিত হবার আগেই চিহ্নিত হয়ে যাবে অপরাধী। দেশ অপরাধমুক্ত হবে।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকার সেই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে প্রয়োগ করেছিল তাদের দেশে। রাজকুমার তখন নেহাতই যুবক ছিল, প্রথম ঢুকেছিল পুলিশের চাকরিতে। এখনও মনে পড়ে, সেই সব তামাদি হয়ে যাওয়া অপরাধ। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন। পুলিশকর্মীদের দিন কাটত সেই সব অপরাধের কিনারা করতে, অপরাধীদের ধরতে। অপরাধ প্রতিহত করা ছিল অমূলক কল্পনা।

কি দ্রুতই না সবকিছু পাল্টে গেল। দেশের কোনায় কোনায় থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা, মানুষের হাতের মোবাইল ফোন, মাথার উপর কৃত্রিম উপগ্রহ, সব কিছুর তথ্য সেই বুদ্ধিমান যন্ত্র নিমেষে বিশ্লেষণ করে বলে দিতে লাগল কোথায় কোন অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, কোথায় লুকিয়ে আছে অপরাধী। পুলিশকর্মীরাও এক সময় তামাদি হয়ে গেল, এল রোবোপুলিশ। শুধু রয়ে গেছে তার মতন গুটিকয়েকজন, রোবোপুলিশকে নেতৃত্ব দেবার জন্যে।

মনে পড়ছে সেইদিনটার কথা। যেদিন প্রথম চালু হয়েছিল এই ব্যবস্থা। একটুও অবসর ছিল না। কারাগার উপচে পড়ছিল অপরাধীতে। এক সপ্তাহ দিনরাত অপরাধী ধরতে ধরতেই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। যারা বেশ কিছু দিন, মাস বা কয়েক বছর লুকিয়ে ছিল পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে, মুহূর্তের মধ্যে ধরা পড়তে লাগল।

আইনের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো অপরাধীদের ধরার পালা শেষ হতেই শুরু হল নতুন অধ্যায়। যারা তখনও অপরাধ করেনি, করার কথা ভাবছে। পুরোনো অনেক পুলিশকর্মী প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের বরখাস্ত করে আনা হয়েছিল রোবোপুলিশ। রবীন্দ্রের মতন তরুণ তুর্কিরা নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই সব অভিযানে, আটক করেছিল অপরাধ পরিকল্পনা করছিল যারা। থানার দেয়ালে টানানো নতুন বৈদ্যুতিন বোর্ডে জ্বলজ্বল করছিল ঠিক কতগুলো অপরাধ তারা প্রতিহত করেছে, কত মানুষের জীবন তারা বাঁচিয়েছে, কত কোটি টাকার সম্পত্তি রক্ষা করেছে।

রবীন্দ্র জান লাগিয়ে দিয়েছিল কাজে। বোর্ডের একদম উপরেই থাকত তার নাম। এখনও আছে। ত্রিশ বছর ধরে। একটা দিনের জন্যেও গোটা দেশে কেউ তাকে টেক্কা দিতে পারেনি। স্মারক পেয়েছেন, পুরস্কার পেয়েছেন। পুলিশ কমিশনারের থেকে, দেশের রাষ্ট্রপতির থেকে।

হয়ত সেইজন্যেই পূরণ করতে পারেননি পতি হিসেবে নিজের দায়িত্ব, থাকতে পারেননি স্ত্রীর পাশে তার মৃত্যুশয্যায়, তাদের সন্তান ভূমিষ্ট হবার মুহূর্তে। ডাক্তার বলেছিলেন উন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমন মৃত্যু বিরল, কোটিতে এক। রোবোসার্জেন ভুল করে না, ধমনীতে প্রবেশ করা ন্যানোবটগুলি প্রতিটি সেকেন্ডে শরীরের প্রতিটি কোনা থেকে জানায় শারীরিক অবস্থা। তবুও শেষরক্ষা হয়নি, কেন হয়নি তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ডাক্তার। শুধু বলেছিলেন তার মনে হয়েছিল রবীন্দ্রের স্ত্রী বাঁচতে চাননি। সে কথায় অবশ্য কোন গুরুত্ব দেননি রবীন্দ্র। আত্মহত্যা মহাপাপ, এমনকি সে চিন্তা করাও পাপ, OverseerAI নিশ্চই জানতে পারত এমন চিন্তা উদয় হলে।

রবীন্দ্র ভাবছিলেন সেই ছেলেটার কথা যাকে এক্ষুনি কারাগারে চালান দিয়ে এলেন। কি হাস্যকর চিন্তা! নোভারার মানুষেরা নাকি তাদের থেকে অধিক খুশি, তাদের থেকে মুক্ত! গোটা পৃথিবীতে ওটাই একমাত্র দেশ যেখানে ওই কৃত্রিমবুদ্ধির নজরদারি বসানো হয়নি, একমাত্র দেশ যেখানে এখনও অপরাধ বিদ্যমান। অপরাধ থাকলে জীবনে সুখ আসে? শান্তি আসে? কেবল ত্রস্ত হয়ে থাকতে হয়ে এই বুঝি কেউ আমার জিনিস চুরি করল, কেড়ে নিল, এই বুঝি কোন ক্ষতি করে দিল? ওরকম আতঙ্কে মানুষ বাঁচে কি করে?

সত্যি তো? ওরকম আতঙ্কে মানুষ বাঁচে কি করে? কৌতূহল হল রবিন্দ্রের। নোভারাতে সত্যি এখনও মানুষ বেঁচে আছে? কিভাবে? ইন্দ্রপুরীর সরকার মাঝে-মাঝে ভিডিও দেখায় বটে নোভারার মানুষদের চরম দুর্ভোগের কথা, সেখানকার দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভিতর হানাহানি কিংবা দুর্নীতির ব্যাপারে। সত্যিই কি তার মধ্যে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব?

আচ্ছা, এরকম উদ্ভট খেয়াল হল কেন ছেলেটার? রবিন্দ্রের মেয়ের থেকে বয়সে হয়ত কিছুটাই বড়, যখন এই ব্যবস্থা ছিল না, তখনকার পৃথিবী দেখেনি। তাহলে? তার মাথায় এরকম উদ্ভট কল্পনা কি করে এলো যে এই নজরদারির বাইরে থাকা একটি দেশে মানুষ সুখী থাকতে পেরে? ঠিক কি দেখে, কি শুনে, কি কল্পনা করে? রবীন্দ্র আতঙ্কিত হলেন, সেই দৃশ্য যদি আর কেউ দেখে, বা সেই কথা আর কেউ শোনে, তার মনেও যদি এরকম অপরাধমূলক চিন্তা উদয় হয়? না! একজন সৎ এবং দক্ষ পুলিশকর্মী হিসেবে তিনি এই অপরাধের মূল উৎপাটন করেই ছাড়বেন!

বিষয়টা শক্ত না। চাইলেই দেখতে পাবেন ছেলেটি তার সারা জীবনে কি কি পড়েছে, কি কি শুনেছে, কি কি দেখেছে, এমনকি কি কি ভেবেছে। সব। প্রতিটা মুহূর্ত। তাই করলেন তিনি। হাতের ডিভাইসে নামিয়ে নিলেন সব তথ্য ক্লাউড থেকে।

যতই দেখছিলেন ততই স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিলেন রবীন্দ্র। ছেলেটি কোন ভাবে নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেটের বাইরে বেরিয়ে ছবি জোগাড় করেছিল নোভারার। সেই সব ছবি যদি সত্যি হয়, তাহলে সরকারের প্রচার করা নোভারার চিত্র মিথ্যা।

ছিঃ! কি অলক্ষুণে কথা! নিশ্চই ছবিগুলি মিথ্যে! সর্বাংশে মিথ্যে! ডিপ ফেক। এআই দিয়ে বানানো ছবি। কিন্তু কে বানিয়েছে দেশের তরুণদের বিভ্রান্ত করার জন্যে? আর কেনই বা সেই কিশোরটি সেই সব চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে? সেটার যে উত্তর পেলেন, তাতে আরই চমকে গেলেন তিনি। একটি শতাব্দী প্রাচীন নাটক! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাশের দেশ। রবীন্দ্রের যেন ক্ষীণ মনে পড়ল ছোটবেলায় সেই নাটক সেও দেখেছিল, সেও শুনেছিল কিভাবে এক রাজকুমার মুক্ত বাতাস এনেছিল তাশের দেশে।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে রবীন্দ্রের কাছে স্পেশাল ক্ষমতা ছিল। সেই সুবিদার্থে ছবিগুলো পরীক্ষা করলেন। সেই বিশ্লেষন তাকে আরই অবাক করল। ছবিগুলি মিথ্যে নয়। ওগুলো সত্যিই নোভারার বাস্তব চিত্র। সেখানে যে চরম দারিদ্র্যের কথা প্রচার করা হয়, সেই দারিদ্র্য নেই। বরং তারা পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সাথেই বাণিজ্যে যুক্ত, এমনকি ইন্দ্রপুরীর মতন দেশের সাথে যারা নোভারাকে শত্রুদেশ বলে প্রচার করে। বরং পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে নোভারার সাথে ইন্দ্রপুরীর গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক!

সে দেশে যে সার্বিক দুর্নীতি এবং অরাজকতার কথা প্রচার করা হয়, তাও মিথ্যে! তারা নিজেদের দেশেই নাকি স্বতন্ত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বানিয়েছে। তবে সেটা কেবলই আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করতে, চিন্তাভাবনা, কল্পনার উপর নজরদারি করতে নয়। বরং এমন এক সমাজ সৃষ্টি করেছে যেখানে অভাব কম, উচ্চনিচ ভেদাভেদ নেই! আর অভাব না থাকায় অচিরেই অনেক অনেক অপরাধের মূল নির্মূল হয়েছে। সব অপরাধের অবশ্যই নয়, কারণ সব অপরাধের মূলে অভাব থাকে না, থাকে ঈর্ষা কিংবা ক্ষোভ।

এইসব পড়তে পড়তে, চিত্র দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে গেছিলেন রবীন্দ্র। কখন যে মনের অলিন্দে সন্দেহ উদয় হয়েছে, কখন যে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে ইন্দ্রপুরীর সযত্নে লালিত সামাজিক চিত্রের উপর, তিনি নিজেই জানতে পারেননি। যখন টের পেলেন, তখন অনেক দেরি করে ফেলেছেন। তখন তিনি ভেবে ফেলেছেন যে ইন্দ্রপুরীর প্রচার মিথ্যে, নোভারার মানুষ মুক্তির আস্বাদ পায়, হয়ত তারা বাকি বিশ্বের ভাবনা-নিয়ন্ত্রিত মানুষের থেকে সুখী।

বুঝতে দেরি হল না, সেই ভাবনা এতক্ষণে নিশ্চই টের পেয়ে গেছে OverseerAI এর কৃত্রিম-বুদ্ধির যন্ত্র। তিনি চিহ্নিত হয়ে গেছেন দেশদ্রোহী হিসেবে। তাকে আটক করতে আসছে রোবোপুলিশ। হয়ত তারই ব্যবহার করা রোবট। নির্মম, সহানুভূতিহীন, আদেশ পালনকারী রোবট। যার কাছে কোনরকম অনুনয়-বিনয় দেয়ালের উপর মস্তক প্রহারের মতনই নিষ্ফল। আর তিনি কারাগারে অবরুদ্ধ হলে কি হবে তার একমাত্র কন্যার? যদি সে তার পিতার শাস্তির বিরোধিতা করে, যদি তার মনেও উদয় হয় রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ? সেই দেশদ্রোহিতার জন্যে তারও শাস্তি হয়ে যাবে। আজীবন কারাবাস অথবা থট-রিট্রেইনিং! মাথার ভিতর ইলেকট্রোডের মাধ্যমে তীব্র বিদ্যুৎ প্রয়োগ করে স্বতন্ত্র চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট করে দেবার শাস্তি, বাকি জীবন কাটবে জড়ভরতের মতন। প্রায় এন্ড্রয়েড রোবোটগুলির মতন অন্য কারুর অঙ্গুলিহেলনে। এই চিন্তা তার মনে আসতেই তীব্র আতঙ্ক তাকে গ্রাস করল, জেগে উঠল নিজের সন্তানকে রক্ষা করার এক উদগ্র বাসনা।

নিজের পরবর্তী করণীয় দ্রুত স্থির করে নিল রবীন্দ্র। ছেলেটির তথ্যের মধ্যে তিনি জানতে পেরেছিলেন নোভারা পালানোর এক গোপন রাস্তা। তাকে পালাতে হবে, তার কন্যাকে এই দেশের রুদ্ধ কারাগার থেকে মুক্তি দিতেই হবে। সে দ্রুত তৈরি করে নিল ঐশীকে, দুজনে নেমে এলো পথে। আর এক মুহূর্ত দেরি করলে তাদের পলায়ন রহিত হত, রাস্তায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা শুনতে পেল তাদের গৃহের প্রতিটি দরজার তালা সয়ংক্রিয়ভাবে রুদ্ধ হচ্ছে। রোবোপুলিশ নিশ্চই বেশি দূরে নেই।

রবীন্দ্র জানেন যে এতক্ষণে তার প্রতিটি ব্যাংকের একাউন্ট ব্লক হয়েছে, টাকা তোলার করার চেষ্টা করা মাত্র তাদের অবস্থান চিহ্নিত হয়ে যাবে। তাই তারা পালাতে লাগলেন পায়ে হেঁটে, রবীন্দ্রের দীর্ঘ পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সিসিটিভির নজরদারি এড়িয়ে। তার কান খাড়া মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ড্রোনের জন্যে। ভাগ্যিস এই ইনফ্রারেড কোটগুলি তিনি বাড়িতেই রেখেছিলেন। অনেককাল আগে একবার এক সন্ত্রাসবাদী দলকে দমন করার সময় পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে দিয়েছিল, শরীরের তাপের ফলে যে ইনফ্রারেড তরঙ্গ বেরোয়, এই কোট ধরা পড়তে দেয়ে না সেন্সরে। ঠিক যে সেন্সর ব্যবহার করে ইন্দ্রপুরীর সরকার।

অমরাবতীর চারিদিকে ঘন জঙ্গল, তারপর কেবলই বিস্তৃত চাষভূমি এবং কারখানা। সেখানে কোন মানুষের বাস নেই, চাষাবাদ এবং কারখানা সবই চালায় রোবটরা। ওখানে অত নজরদারি নেই, রেখেই বা কি লাভ? যেখানে মানুষ থাকে না, কার উপর নজরদারি করবে? এখনকার মানুষ পায়ে হেঁটে কোথাও যায় না, যেতে জানেই না। তাদের পুরো জীবনটাই কাটে পডে চড়ে, মেদ ঝরানোর জিমের উপরেই ভরসা রাখে। সাধারণ কায়িক পরিশ্রমের কথা তারা ভুলেই গেছে।

অন্ধকার সরু সরু গলির মধ্যে দিয়ে তারা দৌড়ে চলেছে শহরের প্রান্তরের দিকে। এটি পুরোনো শহর, পরিত্যক্ত। এইসব সংকীর্ণ গলিপথ ট্রাভেল-পডের পক্ষে অনুকূল নয়, ড্রোনের পক্ষেও এই রাস্তায় আসা সম্ভব না। শহরের বেশির ভাগ মানুষই এই পথ চেনে না, কেবল রবীন্দ্র বহুকাল আগে এই পথে আসতেন অপরাধীদের সন্ধানে। এখন সেই পথ ধরেই তিনি পালাচ্ছেন, অপরাধীর তকমা নিয়ে।

রাতের অন্ধকার কেটে যখন ঊষার সূর্য উদয় হচ্ছে, তখন তারা এসে পৌঁছেছে শহরের উপকন্ঠে। ঐশী এই অস্বাভাবিক শারীরিক ধকলে পরিশ্রান্ত, এই অদ্ভুত নৈশ অভিযানে বিভ্রান্ত। সে কিছুই জানে না, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, শুধু পিতার উপর পরম ভরসা করে অনুসরণ করছে। রবীন্দ্র দিনেরবেলা ঘন জঙ্গলেই আশ্রয় নেওয়া শ্রেষ্ঠ মনে করল। দিনের আলোয় মাথার ওপর উপগ্রহের চিত্রে, উড়ে যাওয়া ড্রোনের থেকে রক্ষা পাওয়ার এটাই শ্রেষ্ঠ উপায়।

রবীন্দ্র আর ঐশীর পরবর্তী পাঁচদিন হেঁটে চলল সীমানার দিকে। দিনেরবেলায় আত্মগোপন এবং রাতের অন্ধকারে যাত্রা। নির্জন প্রান্তরের উপর হেঁটে যাওয়া, কখনও দূরে কোন কারখানা বা চাষজমিতে রোবট দেখতে পেলে তাদের নজরদারি এড়ানো। কখনও দূর থেকে ভেসে আসা ড্রোনের আওয়াজ পেলে জঙ্গলের ভিতর লুকানো।

“বাবা! আর কত দূর? কোথায় যাচ্ছি আমরা?” ঐশী জিজ্ঞেস করল।

“আমার সোনা মেয়ে! আজ রাতটাই কেবল। তার পরেই আমরা মুক্ত। এলেম এক নতুন দেশে!” রবীন্দ্র জবাব দিলেন।

কাঁটাতারের নিচ দিয়ে গোপন সুড়ঙ্গ দুই দেশের যোগাযোগ স্থাপন করেছে। সীমান্তে রোবোরক্ষীর অতন্দ্র পাহারা ফাঁকি দেবার একটাই সুযোগ। প্রতিদিন মধ্যরাত্রে, যখন বাণিজ্যিক মালবোঝাই ট্রাক পাড়ি দেয়ে তখন রোবো-রক্ষীগুলো ট্রাক পরীক্ষা করতেই ব্যস্ত থাকে।

রবীন্দ্রের হিসেবে কিছুটা ভুল হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন একবার অমরাবতীর চৌহদ্দি পেরুনোর পর, রোবোপুলিশ তাদের নাগাল পাবে না, ড্রোন এবং এন্ড্রোয়েডগুলির নজরদারি এড়াতে সক্ষম হলেই। কিন্তু তার জানা ছিল না সীমান্ত বরাবর বসানো এন্টেনা, তার পঞ্চাশ কিলোমিটারের ভিতর প্রবেশ করা মাত্র তাদের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ধরা পড়ে গেল। সীমান্তরক্ষী রোবোগার্ড বাহিনী সচকিত হয়ে অপেক্ষায় রইল তাদের। নেতৃত্বে দক্ষ মেজর জলিল শেখ। তার দৃষ্টি মনিটরে ফুটে ওঠা দুটি বিন্দুর উপর নিবদ্ধ। এগিয়ে আসছে তার পাতা ফাঁদের দিকে। সাবধানী মাকড়সার মতন তিনি জাল বিছিয়ে রেখেছেন। একটি মাছিও তার জাল ফসকে পালাতে পারবেনা।

বড় ধীরে ধীরে এগুচ্ছে বিন্দু দু’টি। একটি কিশোরী এবং তার পিতা। কিশোরীটি দীর্ঘ পথ চলায় ক্লান্ত, তাই এত ধীরলয়ে তারা এগুচ্ছে। মেজর চাইলেই টিম পাঠিয়ে তাদের এক্ষুনি তাদের পাকড়াও করতে পারেন। কিন্তু তারা পালাবার চেষ্টা করলে ধাওয়া করার ঝামেলা, তাই তিনি ফাঁদ ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করলেন।

OverseerAI কর্মকর্তাদের উদ্ভাবনী চিন্তার তারিফ না করে পারলেন না মেজর। কি সুন্দর টোপ। দেশদ্রোহীদের জন্যে। সঠিক তথ্যের মাঝে সুড়ঙ্গের নকল তথ্য এমনভাবে পরিবেশন করা হবে, শিকার বুঝতেও পারবে না শিকারী টোপ ফেলে অপেক্ষা করছে। সুড়ঙ্গের ভিতর অপেক্ষা করে আছে এন্ড্রয়েড টিম। আর পলায়নকারী সুড়ঙ্গে প্রবেশ করলেই তাদের পিছন দিক থেকে ঢুকে পড়বে আরেকটি এন্ড্রোয়েড টিম।

রাজকুমার কি সুড়ঙ্গের এই বিপদ সম্পর্কে অবহিত নন? সেখানেই তিনি খুঁজছেন মুক্তির আলো? কারাবাস থেকে বেরিয়ে আসার পথ? তাই ঐশীকে প্রায় কোলে করে, কখনও বয়ে এগিয়ে চলেছেন সেদিকেই? যত দ্রুত সম্ভব। মধ্যরাত্রির বিশেষ সময়টুকু ছাড়া সুড়ঙ্গে প্রবেশ করা অসম্ভব। সেই সুযোগ কোনোভাবেই হারানো চলবে না।

রাত পৌনে বারোটা। মেজর দেখতে পাচ্ছেন দু’টি বিন্দু এসে পৌঁছেছে একদম সুড়ঙ্গের কাছাকাছি। একটি ঘন জঙ্গলের একেবারে প্রান্তে। সেই জঙ্গলেই লুকিয়ে আছে তার দ্বিতীয় অর্থাৎ বিটা এন্ড্রোয়েড টিম। প্রথম বা আলফা টিমটি লুকিয়ে সুড়ঙ্গের ভিতর।

বিটা টিমলিডারকে পিং করলেন মেজর। অপরাধীদের কি দেখা যাচ্ছে? না, কোন ভিজুয়াল নেই। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ইনফ্রারেড ক্যামেরা লাগানো তাদের শরীরে। মানুষের শরীরের তাপ তরঙ্গ অনুভব করতে সক্ষম সেই সেন্সরগুলো। একটু চিন্তিত হলেও তিনি বিশেষ উদ্বিগ্ন হলেন না। সুড়ঙ্গের ভিতর পলায়নের দ্বিতীয় পথ নেই।

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে। রাত ঠিক বারোটা। সীমান্তের গেটে এসে দাঁড়িয়েছে একটা ট্রাক। মেজর বারণ করেছিলেন আজ কোন পণ্যবাহী যান সীমান্ত না পেরোয়, কিন্তু এই ট্রাকের কূটনৈতিক পাসপোর্ট আছে। মেজর সাধারণ অনুসন্ধানের পর ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি দিয়ে মনোসংযোগ দিলেন আসল অভিযানে।

বিন্দু দু’টি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এক ছুটে এসে পৌঁছেছে সুড়ঙ্গের মুখে, তারপর ভিতরে ঢুকে পড়েছে। মেজর টিম দু’টিকে জানিয়ে দিলেন প্রস্তুত থাকতে। বিটা টিম জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে পিছন থেকে রুদ্ধ করবে পলায়নকারীদের পথ। সামনে অপেক্ষমান আলফা টিম।

মেজর এতক্ষণে বুঝতে পারছেন পলায়নরতদের নিশ্চই ইনফ্রারেড ক্লোক আছে, তার ফলেই আলফা টিম আর বিটা টিম তাদের দেখতে পাচ্ছে না। যদিও তাদের অবস্থান তার জানা, মনিটরে। তিনি বোতাম টিপে বিশেষ মিস্ট স্প্রে করে দিলেন সেই বিন্দু দু’টির অবস্থান লক্ষ্য করে। সরু সুড়ঙ্গের ভিতর মিস্ট স্প্রে হতেই ফুটে উঠল দু’টি অবয়ব। আলফা টিমলিডার খবর পাঠালো, তারা দেখতে পাচ্ছে। অবয়বদু’টি তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। একইরকম ভাবে, নিশ্চিন্ত ভাবে। কোন অস্ত্র নেই তাদের কাছে।

মেজর অবাক হলেন। তার টিম যদি দেখতে পায়, তাহলে পলায়নকারীরাও নিশ্চই দেখতে পাচ্ছে সামনে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এন্ড্রোয়েড টিমটিকে? তাদের কি উচিৎ না উল্টোদিকে পালানোর চেষ্টা করা? যদিও সেখানে তাদের রাস্তা প্রতিরুদ্ধ করে আছে বিটা টিম।

তিনি বিটা টিমকে সুড়ঙ্গের ভিতর প্রবেশ করতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু প্রবেশ করতেই ঘটে গেল বিস্ফোরণ। মেজরের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না সেটা। তিনি ভাবেননি তারই পাতা ফাঁদের ভিতর তার জন্যেই অপেক্ষা করে আছে কোন চমক, তারই অধীন রোবটদের পড়তে হতে পারে কোন ফাঁদে। অবশ্য মেজর নিজের জায়গায় এমনি এমনি পৌঁছান নি। একটি তৃতীয় টিম বানিয়েই রেখেছিলেন ইমারজেন্সিতে মাঠে নামার জন্য। সেই টিম চার্লি এবার প্রবেশ করল সুড়ঙ্গে, বিটা টিমের ছড়িয়ে থাকা যন্ত্রাংশ মাড়িয়ে।

টিম চার্লি এগিয়ে গেল দ্রুত, আলফা টিমের সাথে তাদের দূরত্ব মাত্র কয়েক গজ। ঠিক তারই মাঝখানে দাড়িয়ে দুটো অবয়ব, তারা এক এক পা করে এগোচ্ছে। মেজর অবাক হলেন, নির্দেশ দিলেন গুলি চালাতে। গুলি বলতে অবশ্য বারুদ টোটা নয়, এই অত্যাধুনিক গুলি যার শরীরে লাগবে, তাকে বেঁধে ফেলবে বৈদ্যুতিক জালে।

আশ্চর্যের কিছু বাকি ছিল। অবয়বগুলো যেন ধোঁয়াশা। আলফা টিমের গুলি তাদের ভেদ করে গিয়ে লাগল টিম চার্লির গায়ে। অপরদিকে আলফা টিম ও আহত হল চার্লি টিমের গুলিতে। মেজর রাগে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। দেখলেন তার অত্যাধুনিক রোবটবাহিনী তীব্র বৈদ্যুতিক শকে অকেজো হয়ে গেছে। ডেলটা ফোর্স অর্থাৎ তার সব থেকে অত্যাধুনিক রোবটদের নিয়ে নিজেই চললেন সুড়ঙ্গের দিকে। সুড়ঙ্গের ওপর প্রান্ত কারাগারের ভিতর। তার ভিতর দিয়ে কেউ এগিয়ে গেলেও পৌঁছাতে পারবেনা কাঁটাতারের ওপারে। l

সুড়ঙ্গের ভিতর পৌঁছে অবশ্য তিনি কিছুটা হতচকিত হলেন। অবয়ব দুটি যেন তার অপেক্ষমান। তারা কোন দিকেই পালানোর প্রচেষ্টা করছে না।

“ইউ আর আন্ডার আরেস্ট! প্রতিরোধ করার করলে ফল ভালো হবে না!” গর্জে উঠলেন মেজর।

হাহা করে হেসে উঠল ছায়ামূর্তিগুলো। “আমরা এখানে নেই, তাহলে ধরবেন কি করে? এগুলি আমাদের কোয়ান্টাম ছায়া। আমরা কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট মেশিনের ভিতরে। সেই মেশিনশুদ্ধ ট্রাকটি অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে চেকপয়েন্ট। OverseerAI আসল মানুষ আর তার কোয়ান্টাম ছায়ার তফাৎ করতে পারেনা! আর সেই যন্ত্রের ভিতর থাকলে মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গও ধরতে পারেনা।”

রবীন্দ্র রাজকুমার বেরিয়ে এলেন কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট যন্ত্রটি থেকে। বের করে আনলেন ঐশীকে। মেজরের চোখের সামনে থেকে মুছে গেল ছায়ামূর্তি দুটি। মেজর রাগে মাথার চুল টানছিলেন, এই বিজ্ঞানের ভূত ধরা তার কম্ম নয়।

“বাবা, এই দেশটা নিরাপদ?” ঐশী জিজ্ঞেস করল। তারা এখন নোভারার মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিচ্ছে। চিরন্তন চিন্তাপুলিশীর বাইরে বেরিয়ে কেমন একটা আশ্চর্য্য মুক্তি বোধ করছে তারা, মাথাটা যেন কম ভারী ঠেকছে।

“নিরাপদ অবশ্যই। কিন্তু যে নিরাপত্তা স্বাধীন চিন্তার অধিকার দেয়ে না, সেই নিরাপত্তা মূল্যহীন! সেই মানুষ যে খাঁচার পাখি, চিড়িয়াখানার জন্তু, সংগ্রহশালার মূর্তি। মুক্তি বিনা জীবন অর্থহীন। আমরা এখন মুক্ত!”

রবীন্দ্র রাজকুমার জড়িয়ে ধরলেন তার কন্যাকে। তাকে হয়তো অনেক চিন্তিত হতে হবে তার কন্যার সুরক্ষার জন্যে, তার সুস্থ সবল জীবনের জন্যে। তবু সেই উদ্বেগ, সেই চিন্তা যেন তার পিতা হবার পুরস্কার। তার কন্যাকে চিন্তা-নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার পুরস্কার।

দেশদ্রোহী সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!