জীবনের অঙ্ক অণুগল্প – পিনাকী দত্ত
দুপুর বারোটা ।ত্রস্ত হাতে সৌরজা বিলে চোখ বোলাচ্ছে আর খাবারের প্যাকেটগুলো ডেলিভারি বয়ের হাতে তুলে দিচ্ছে ।’স্বয়ংপ্রভা হোমডেলিভারি’র মালকিনের এখন নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই।প্রতিদিন এইসময়ে তাকে দেড় থেকে দুঘণ্টা তুর্কী নাচন নাচতে হয়। সে অবশ্য এটাই চেয়েছিল।দীর্ঘ কুড়ি বছর এর জন্য তাকে কম পরিশ্রম করতে হয়নি।পাঁচ -দশটা মিল দিয়ে শুরু করে আজ তাকে প্রায় আড়াইশো-তিনশোটা মিল হোম ডেলিভারি দিতে হয়।এর জন্য তাকে অনেকগুলো কর্মচারীও রাখতে হয়েছে ।এটাও তার একটা তৃপ্তির জায়গা ।
অর্ডার মিলিয়ে খাবার দিতে গিয়ে একটা ঠিকানায় এসে সৌরজা থমকাল ।ভালো করে দেখল- নীহারেন্দু রায়-ঘোষপাড়া,দুর্গাপুর।দুটো মিল অর্ডার করেছে এবং মান্হলি প্যাকেজ নিয়েছে।সৌরজাএকটু থমকাল ও স্মৃতির সরণী বেয়ে একটু যেন পিছনে হাটল। ঠোঁটে একটা বিদ্রুপের হাসি খেলে গিয়েই মুখটা কঠিন হয়ে গেল। সে চিৎকার করে মিনুকে ডেকে খাবারের প্যাকেটগুলো খুলে বেশি বেশি করে ভাত-ডাল -মাছ দিতে বলল।মিনু গজগজ করতে করতে খাবারের প্যাকেটগুলো খুলতে লাগল ।
দুই ।
দুপুর তিনটে ।’স্বয়ংপ্রভা হোম ডেলিভারি’র ব্যস্ততা এখন অনেকটাই কম।মালকিনও চেয়ারের পেছন দিকে হেলান দিয়ে শরীরটাকে একটু টানটান করে নিচ্ছে ।এমন সময় বেরসিকের মত ফোনটা বেজে উঠলো ।
হ্যালো-‘স্বয়ংপ্রভা হোম ডেলিভারি ‘ থেকে বলছি।
ওপাশ থেকে কাঁপা-কাঁপা গলা ভেসে আসল- মা আমি কিন্তু দুটো মিল অর্ডার করেছি অথচ খাবার পাঠিয়েছ তিনজনের ।ডেলিভারি বয় ভুল করে অন্যের খাবার দিয়ে যায় নি তো?
না স্যার, ওখানে দুটো মিলই আছে।
তা কি করে হয়! তিনপিস মাছ ,এত্ত -এত্ত সবজি, ডাল-ভাজা।তুমি এভাবে ব্যবসা চালাতে পারবে তো মা ?যদিও তোমার দোকানের আজকাল খুব নামডাক ।
কেন পারব না স্যার?সকলের আশীর্বাদে –কথাটা শেষ করে না সৌরজা।
“সৌরভ কেমন আছে স্যার?”
এই প্রশ্নে নীহারবাবু একটু থমকালেন ।হাতের মুঠোয় রাখা মোবাইলটার সাথে তার গলাটাও যেন একটু কেঁপে গেল।
জীবনে ফিজিক্সের জটিল-জটিল অঙ্কের সমাধান তিনি অনায়াসে করে দিতেন।অথচ নিজের জীবনের অঙ্ককেই তিনি মেলাতে পারেন নি।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নীহারবাবুর গলা থেকে ।
আছে, ভালোই আছে।তবে বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজন সে আজকাল আর বোধ করে না। কিন্তু মা ,তুমি সৌরভকে চিনলে কি করে?নীহারবাবুর গলায় বিস্ময়!
-সৌরভ তাহলে আজ সৌরভহীন-‘কথাটা নিজের মনে একবার আউড়ে নিল সৌরজা।
ফোনের ওপাশে তখন তীব্র ব্যাকুলতা।
সৌরজা বলতে শুরু করে -আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগে আমি সৌরভকে পড়াতাম ।আপনার তখন বিরাট নাম-ডাক ।নাওয়া খাওয়ার সময় নেই।সৌরভ তখন মনে হয় ক্লাস ফাইভ ।ক’দিন পড়াতে যাইনি মানে যেতে পারিনি। বাবা মারা গিয়েছেন শুনে (দাদার কাছে)বলেছিলেন-‘তার জন্য আমার ছেলের ক্যারিয়ার তো নষ্ট করতে পারি না ।’দাদা শ্রাদ্ধ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলেন।কিন্তু আপনি বলেছিলেন-‘জান ,পনের দিনে নিউটন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের দিকে , ,আইনস্টাইন রিলেটিভিটি ‘র সূত্রের দিকে কতটা এগিয়ে গিয়েছিল ?’
তারপরই চিবিয়ে -চিবিয়ে বলেছিলেন-‘পনের দিন–Just Impossible .
অথচ দেখুন, আজ আপনার প্রতি আপনার ছেলের কোন আকর্ষণ নেই।এর পেছনে ফিজিক্সের কোন সূত্র কাজ করছে যদি একটু বলেন?
মা, তুমিও এভাবে বলছ?-নীহারবাবুর গলায় স্পষ্টতই ভেঙ্গে পড়ার সুর।
না স্যার,আপনাকে দুঃখ দেওয়ার কোন উদ্দেশ্যই আমার নেই। আসলে কেন জানি না হঠাৎ করেই নিউটনের Third Law টার কথা মনে পড়ে গেল ।
জীবনের অঙ্ক অণুগল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
দমকা হাওয়ায়
চা বাগানের জালিয়াত
পথশিশু