মেলখুমের বিভীষিকা গল্প – সন্দীপ রায়
বাসের ঝাকুনিতে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম,একেই ভিড়ে ঠাঁসা বাস তারওপর কাল সাড়া রাত জাগা। এই মরার অপর খাঁড়ার ঘা হয়ে নেমেছে ভ্যাপসা গরম। কাল রাত ১২:১০ নাগাদ ঢাকা এসে পৌঁছেছি,ইচ্ছা ছিল রাতটা ঢাকায় কোনও একটা হোটেলে কাটিয়ে সকাল সকাল চট্টগ্রামে পাড়ি দেব। কিন্তু খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম সামনে ঈদের জন্য বাস কম চলছে,ভোর সাড়ে ৪ টেই একটা বাস আছে,তারপর আবার সন্ধ্যা৭ টায়,এর মধ্যে চট্টগ্রামগামী কোনো বাস নেই।অগত্যা ৪ টের বাসটা ধরায় নিশ্চিত করে বাস স্ট্যান্ডে রাত্রিটা কোনো প্রকার কাটানোর সিধান্ত নিলাম। সাইদাবাদ বাসস্ট্যান্ড বাস যখন ছাড়ল ঘড়িতে তখন ৪টে৪০,বাসে একটু ঘুমানোর ইচ্ছা থাকলেও প্রচণ্ড ভিড় আর তার ওপরে স্টপেজ মিস হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় চোখের পাতা বোজবার অবকাশ হয়নি। অবসন্ন শরীর নিয়ে যখন জোরালগঞ্জ নামলাম ঘড়িতে তখন সাড়ে ৯ টা।বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল বাবন,দেখা হতেই কলাকুলি করতে এলে আগে খানকতক শুদ্ধ বাংলা ভাষা শুনিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ব্যাগ দুটো নিয়ে আগে বাড়ি নিয়ে চল,টানা ঘুম দেব..তারপর কথা হবে’। সে কথা বাড়াল না,একগাল হাসি নিয়ে বলল ‘যো হুকুম জাঁহাপনা’। বাবনের সাথে আমার পরিচয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়।আমরা দুজনেই ছিলাম ফিজিক্স অনার্স এর ছাত্র। দুজনেরই স্বাধীন, বিজ্ঞানচেতা মানসিকতা ও আপসহীন চরিত্র হওয়ার জন্য বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। কলেজ শেষে ও নিজের দেশে চলে আসে আমিও চলে যায় দিল্লিতে উচ্চশিক্ষার জন্য। দীর্ঘ ১৩ বছর পর আবার দুজনের আলাপ। একবছর আগে আমি কলেজস্ট্রীট গেছিলাম কিছু বই এর সন্ধানে,বই কিনছি হটাত কে একটা ডাকল পিছন থেকে,ঘুরে দেখি বাবন। ব্যাস!, সেখান থেকেই বাংলাদেশে আমন্ত্রন,আর কলেজে পুজোর ছুটি থাকায় আমি এখন এপার বঙ্গে। বাবনের বাড়িতে ও আর ওর মা থাকে,বাবা মারা গেছে একাত্তরের যুদ্ধে। বাড়ি এসে বাবনের মায়ের সাথে আলাপ করে, ওদের পুকুর থেকে ধরে আনা বড় কই মাছের ঝোল আর ভাত খেয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি বেলা পড়ে এসেছে,কাকিমা আমায় দেখে বলল ‘বাবু একটু বাজারে গেছে,সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে দেখে ও আর ডাকেনি,কিছু লাগলে আমায় বোলো’। আমি সন্মতি জানিয়ে বাইরে গেলাম,বাইরে খুব সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। সত্যি কি অপরুপ এই বাংলার গ্রাম। কোনো কোলাহল নেই,কোনো দূষণ নেই,কেবলই শান্তি। একদিন এই বঙ্গদেশ একত্রে ছিল,তারপর ইতিহাসের কোন অভিসন্ধিতে আলাদা হয়ে গেল বাংলা,হয়ত এই বাতাসটাও আসছে ওপার বাংলা থেকে,ওরা তো কাঁটাতার মানে না।এসব ভাবতে ভাবতে সিগারেটটাতে শেষ টান দিয়ে ধুয়া ছাড়তেই ভেসে এলো একটা কণ্ঠ, ‘ সিগারেট ধরে নিয়েছেন দেখছি’। দেখি বাবন এসে দাঁড়িয়েছে, ‘ওই আর কি কাজের চাপ বাড়লে মাঝে মধ্যে একটা দুটো খায়,তা বাজার হল,কি আনলি কি?’ ‘দেশী মুরগি কেটেছিল বুঝলি,খবর দিতেই নিয়ে এলাম।মাকে বলেছি বেশ ঝাল দিয়ে রাঁধতে,রাতে দুই বন্ধু জমিয়ে খাব’। ‘বাহঃ!দারুন…..। তারপর,এখন কি করছিস বল’, ‘এই মাস্টার্স কমপ্লিট করে এখন চট্টগ্রামের একটা মাদ্রাসায় চাকরি করি’। এসব আলোচনার মাঝেই চাচি ডাকল সন্ধ্যার চা-জলখাবার খেতে।বাবনদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসলেও আধুনিকতার ছোঁয়া তখনও পুরোপুরি লাগেনি।চা-মুড়ি খেয়ে দুজনে বেরলাম বাজার ঘুরতে।বেশ জমজমাট বাজার নয়,দুটো চায়ের দোকান আর কিছু সবজি ও একটা মাংসের দোকান। আমরা গিয়ে বসলাম সালাম মিয়াঁ নামক এক বয়স্ক ভদ্রলোকের চায়ের দোকানে। বাবনের পূর্ব পরিচিত তিনি, সময় অতিবাহিত করার রসদ হিসাবে গ্রামের একমাত্র রেডিও তার দোকানে আছে।দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিটায় বসে,ওখানে থাকা মুরুব্বিদের সাথে আলাপ পরিচয় ও গল্প গুজব করছিলাম আমরা।সালাম মিয়াঁ,চা দিতে এসে বাইরে রেডিওতে বাজতে থাকা গানের চ্যানেল পালটে খবর চালাল। আমিও দোকানের ভিতরে গেলাম চায়ের দাম মেটাতে।বাবন গেল মুদির দোকানে। সন্ধ্যার পর থেকেই বেশ গরম পড়েছিল,আকাশে মেঘ করে এসেছে বোধকরি বৃষ্টি নামল বলে।দাম মিটিয়ে যখন বাইরে এলাম রেডিও থেকে একটা খবর ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দে কানে এলো, ‘মেলখুম ট্রেইল থেকে পুনরায় নিরুদ্দেশ ঘুরতে আশা দুই পর্যটক,এই নিয়ে নিরুদ্দেশের সংখ্যা বেড়ে চার। গ্রামবাসীদের দাবী সে ফিরে এসেছে।তবে পুলিশ এই বিষয়ে এখনও উদাসীন’।বিস্তারিত জানতে থমকে দাঁড়ায় আমি। বাবনের ডাকে চমক ভাঙে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হওয়ার জন্য আমিও তাড়াতাড়ি পা চালায়। বাড়ি গিয়ে সেদিন রাতে খেতে বসেছি, কাকিমা বলল, ‘অর্ক এসেছ,ওকে নিয়ে কাল কোনো জায়গা থেকে ঘুরে আয়’। ‘কোথায় যাবি বল’ আমায় জিজ্ঞাসা করল বাবন।’ও কি করে বলবে, ও কি চেনে কিছু!’আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘মেলখুম ট্রেইলে গেলে কেমন হয়!’, ‘মেলখুম যাবি? ওতো পাহাড়ি এলাকা।ট্রেক করতে পারবি ?’ আমি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম ‘এখনও অতটাও বুড়ো হয়ে যায়নি,হাড়ে এখন জোড় যা আছে হিমালয়ে চড়তে পারব’। আমার কথা শুনে হেসে ওঠে কাকিমা, তবে বাবনকে হাসতে দেখলাম না।সে গম্ভীর হয়ে বলল ‘মাঝে শুনছিলাম ওখানে কি একটা সমস্যা হয়েছে,এখন কি অবস্থা কি জানি’। সন্ধ্যেয় শোনা খবরটা আমি বললাম না ওকে,কারন ইতিমধ্যেয় রহস্য আর তা সমাধানের কৌতূহল ঘনীভূত হয়েছে আমার মনে।বিজ্ঞা্নমনস্ক বেপরোয়া মন পুনরায় জাগরিত হচ্ছে আমার তা ভালই বুঝতে পারছি। প্রথমে কতকটা অনিচ্ছা থাকলেও আমার জোড় জবরদস্তির সামনে নত স্বীকার করতেই হল বাবনকে। কাল সকাল সকাল বেরব আর বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব ঠিক হল।
২
সেদিন রাতে বিশেষ কথা হলনা আমাদের,পরদিন যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।সন্ধ্যায় একপশলা বৃষ্টি হওয়ার জন্য রাতে বেশ ঠাণ্ডা পরেছিল,তাই সকালে উঠতে একটু দেড়ি হয়ে গেলেও তাড়াহুড়ো আমরা যখন বেরলাম সূর্য তখন স্ব-মহিমায় প্রতীয়মান হয়ে গেছে। জোরালগঞ্জ থেকে চেপে বসলাম অটোতে,দুপাশে সবুজের শ্যামলতা আর বর্ষার মহিমায় পরিপূর্ণ সুবিশাল দিঘি দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌছালাম সোনাপাহাড় বাজার। বাবনের কাছে জানতে পারলাম পথে যে দিঘিটা পড়েছিল তার নাম নিশিকান্তের বাওর।সোনাপাহাড় বাজারে আমরা সকালের নাস্তা সেরে যখন বেরব,দোকানদার শুধোল ‘আজ্ঞে বাবু,চললেন কনে?’, ‘মেলখুম ট্রেইলে যাচ্ছি,কতক্ষণ লাগবে বলতে পারবেন?’;মেলখুমের নামটা শুনে লোকটার মুখটা ভয়ে কেমন একটা শুকিয়ে গেল,ব্যাপারটা বাবনের চোখ এড়ালেও আমার চোখ এড়ালো না।’বাবু, আপনারা কোনো খবর শোনেননি।ওইহান থেয়ে বেশ কয়েকজুনা হারায় গিছে’। আমি সাধারন এবং যুক্তির স্বরে বললাম ‘হ্যাঁ শুনেছি,কিন্তু পাহাড়ী অঞ্চলতো হয়ত পড়ে গিয়ে মারা গেছে কিংবা নিখোঁজ হয়ে গেছে’। লোকটা আরেকটা কিছু বলতে যাচ্ছিল আমি ধমক দিয়ে বললাম ‘ওসব আজঘুবি কথা ছাড়েন ভাই, দেখুন এটা একটা টুরিস্ট স্পট।এখানে লোকজন আসলে আপনাদেরই বিক্রি বাড়বে,এতে আপনাদের লাভ।আর কথা বাড়াবেন না দয়া করে’। এই বলে আমরা দুজন বাজার থেকে পূর্বমুখী রাস্তা ধরে গন্তব্যের দিকে যেতে লাগলাম। এখানে আশার পর থেকে বাবন কে বিশেষ একটা কথা বলতে শুনিনি,এই বারে নিস্তব্ধতা ভেঙে ও বলল ‘আচ্ছা ভূত,প্রেত কিংবা কোনো অপদেবতায় বিশ্বাস করিস তুই?’ ‘কি যে বলিস তুই,বিজ্ঞানের ছাত্রদের এসব মানায় নাকি।আর আমি যে এসব একদমই বিশ্বাস করিনা সেটা তুইতো কলেজে পড়ার সময় থেকেই জানিস’। রেললাইন পাড় করতেই পাকা রাস্তা ছেড়ে শুরু হল মাটির রাস্তা।’তুই কি এখন আবার এসবে বিশ্বাস করা শুরু করেছিস নাকি?’ ‘মাঝে মাঝে এমন ঘটনাও ঘটে যা অবিশ্বাসকেও,বিশ্বাস করিয়ে দেয়’। ‘কেন কি এমন ঘটলরে’ মজার ছলে জিজ্ঞাসা করি আমি।’না!কই,তেমন কিছু নই, এই কালবাট টা পেরলেই কিন্তু মেলখুম এলাকার শুরু’। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ও কিছু একটা এড়িয়ে গেল।প্রায় চল্লিশ মিনিট হাটার পর দূরে দেখা গেল মীরসরাই রেঞ্জ। আকাশ মেঘাছন্ন থাকাই রেঞ্জটা ছিল সম্পূর্ণ কুয়াশাবৃত।’জানিস এই ট্রেইলটার নাম মেলখুম কেন?’, ‘না,কেন রে কোন মেল ট্রেন যেত নাকি?’ ‘আরে না রে বড় ভাই’,হেসে ওঠে বাবন; কালকে রাতে, এখানে আসার নাম করার পর থেকেই ওর মুখে আর তেমন হাসি দেখা যায়নি। ও বলে, ‘এখানে ‘মেল’ শব্দের অর্থ এক বিশেষ প্রকার বিষাক্ত পাতা,যা জেলেরা আগে মাছ ধরার কাজে ব্যাবহার করত। আগে এই পাতার রস তারা জলে মিশিয়ে দিত,ফলে মাছেরা একপ্রকার অজ্ঞান হয়ে গেলে সহজেই জাল ফেলে প্রচুর মাছ ধরা যেত’।গল্প করতে করতে আমরা এসে পরলাম একটা ঝিরির সামনে,পরিস্কার স্বচ্ছ জলের এই ছোট নালা থেকেই মূল ট্রেইলের শুরু,বলল বাবন। অগত্যা জুতো ব্যাগে ঢুকিয়ে খালিপায়ে জলাকীর্ণ নালার মধ্যে দিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। গোড়ালি ডোবা জল পেরিয়ে অনায়াসে চলতে লাগলাম। চোখে পড়ল বাংলাদেশ বন বিভাগের একটি সতর্কী করন সাইন বোর্ড,তাতে লেখা ‘ এই ট্রেইলটি যথেষ্ট বিপদ সংকুল। এই সীমানার ওপাশে যাওয়া কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ বিশেষ করে সন্ধ্যের পর। এর শর্তেও যারা যাবেন,তাদের কোনো ক্ষতির জন্য বনবিভাগ দায়ী থাকবে না।ছাগল যেমন বেড়ার পরোয়া করে না,তেমন কৌতূহলী ও অনুসন্ধিৎসু মানুষেরাও সতর্কীকরনের ধার ধারে না,চলো এগিয়ে।
স্বচ্ছ জলের ঝিরি মধ্যে দিয়ে আমারা প্রবেশ করতে লাগলাম জঙ্গলের ভিতরে।সামনে ঈদ তাই এখন পর্যটকের চাপ নেই এছাড়া যে গুজবটা রটেছে,সেটাও এর জন্যে কিছুটা দায়ী।পাখীদের সুন্দর কলকতান আর মাঝে মাঝে দূরে বহু দূরে যেখানে জঙ্গলবেষ্টিত মীরসরাই রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে বজ্রপাতের শব্দও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে।ঝিরির জল ক্রমশ বাড়তে থাকাই বাবনকে বললাম, ‘এই,নালার জলতো বেড়ে চলেছে,আর অন্য কোনো পথ নেই যাওয়ার?’ বাবন একটু মুচকি হেসে বলল, ‘আরেকটু চল তারপরে দেখছি’। মিনিট দশেক হাঁটার পর আমরা এসে দাঁড়ালাম ঘন জঙ্গল প্রাচীরের সামনে।দেখে মনে হচ্ছে এপাশে একটা দুনিয়ার শেষ ওপাশ থেকে শুরু আরেকটা দুনিয়া।তবে আমার বিশেষ ভয় লাগল না,এর আগে কত এমন জঙ্গলে ঘুরেছি।বাবন বলল, ‘জঙ্গলের একটু ভেতরে গেলে একটা উঁচু ঢিবি পড়বে,সেখান থেকে আমরা ঝিরি ছেড়ে স্থলপথে হাঁটব’।এতক্ষণ যতটা পথ এলাম সেটা বাঁশ আর লতা-গুল্মে বেষ্টিত সমভূমি অঞ্চল ছিল,কিন্তু গভীরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল সুউচ্চ বৃক্ষরাজির,জঙ্গল এখানে বেশ গহীন।ঘড়িতে দুপুর ১ টা,আকাশ সম্পূর্ণ মেঘ মুক্ত না থাকলেও এতক্ষণ যে আলোছায়া খেলা করছিল,জঙ্গলে প্রবেশ করতেই তা সম্পূর্ণ রুপে অদৃশ্য হল পরিবর্তে নেমে এলো এক রাত পূর্ববর্তী অন্ধকার। ধীর চালে একটা ঠাণ্ডা বাতাস হটাত কোথা থেকে এসে আবার কোথায় চলে গেল,তার সাথে বয়ে আনল মাংস পচা একটা কটু গন্ধ।সেই সাথে লক্ষ্য করলাম ঝিরির জলটা আগের তুলনাই বেশ ঠাণ্ডা হয়ে উঠেছে আর পাখির কলতান হারিয়ে গিয়ে এক সুবিস্তৃত নৈশব্দের সৃষ্টি করেছে;তার মধ্যে কেবল বহু দূরে,যেখানে জঙ্গল আরও গভীর সেখান থেকে ভেসে আসছে থেমে থেমে পটকা ফাটার শব্দ,না!..মনে হচ্ছে কেউ যেন হাতে তালি দিতে দিতে জঙ্গলে ঢুকে যাচ্ছে।
খানিক হাঁটার পর বাবন ধীর শব্দে বলল, ‘চল এবার ঝিরি ছেড়ে জঙ্গলের রাস্তায় হাঁটা শুরু করি’।’যাক বাঁচালি বাবা, যা ঠাণ্ডা জল! পা টা অবশ হয়ে গেছে পুরো’।জল ছেড়ে রাস্তায় পা বাড়াতেই বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠল এক অজানা আতঙ্কে।কীসের আতঙ্ক বুঝতে পারলাম না। উঁচুনিচু পাহাড়ি দুর্গম পথ পেড়িয়ে আমরা সামনের দিকে এগোতে লাগলাম।বড় বড় বৃক্ষরাজির মধ্যে দিয়ে নীচ পর্যন্ত যেটুকু আলো এসে পৌঁছচ্ছে তা বড়ই ক্ষীণ, বলতে গেলে একপ্রকার আলো আঁধারির সৃষ্টি হয়েছে। এই আলো আধারির মধ্যে যা দেখলাম,তা আমার মধ্যে নতুন ভয়ের উদ্রেক করল আর তা হল এখানকার গাছ গুলোর পাতা সবুজ নয় বরং কালো।ব্যাপারটা বাবনকে বলাতে ও বলল, ‘আরে অন্ধকার তো তাই ওরম মনে হচ্ছে।তা তুই কি ভয় পেলি নাকি রে’। বাবনকে হঠাৎ এতটা স্বাভাবিক হতে দেখে অবাক হলাম বেশ। ‘না না,এমনি জিজ্ঞাসা করলাম,চল পা চালিয়ে বেলা বেলা ঘুরে আসি’। তখনও বুঝতে পারিনি ভেতরে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে। প্রায় ১ ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা গিয়ে পৌঁছলাম মেইন ট্রেইল এর সামনে।বিরাট উঁচু দুটো পাথর তার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে নালা,অনেকটা উপত্যাকার মতন। বাবন বলল, ‘ এটায় মেলখুম,এর মধ্যে দিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে’। অগত্যা কথা না বাড়িয়ে পুনরায় পা বাড়ালাম নালায়,আর ঠিক সেই সময় দুটো ঘটনা একসাথে ঘটে গেল।এতক্ষণ যে মাংস পচা গন্ধটা নাকে আসছিল সেটা তীব্র হয়ে উঠল,তার সাথে নাকে এলো একটা অজানা কটু গন্ধ, জ্ঞান হারালাম আমি।
৩
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা পাথরের চাতালের ওপর শুয়ে থাকতে।গলাই একপ্রকার নাম না জানা ফুলের মালাও দেখলাম,অবশ্য তখন আমার ঘোর সম্পূর্ণ কাটেনি। পচা গন্ধটা আগের তুলনাই এখন শত গুন তীব্র,গা ঠেলে বমির উদ্রেক হতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ঝাপসা চোখে অদূরে লাল বস্ত্র পরিধানকারী একজন কে বসে থাকতে দেখলাম,না ঠিক বসে নেই,পাথরে কি যেন একটা অনবরত ঘসে চলেছে। কোনো ক্রমে হামাগুড়ি দিয়ে তার কাছে গিয়ে কাঁপা স্বরে বললাম, ‘কে আপনি,আমার এরম অবস্থা কে করল?’ লোকটা কিছুক্ষণ থামল,তারপর আমার দিকে মাথা ঘোরাল।জঙ্গলের মধ্যে তখন সন্ধ্যা নামছে আর সন্ধ্যার সেই আলো-অন্ধকারে লক্ষ্য করলাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমারই বন্ধু বাবন। উন্মুক্ত লম্বা কেশ,পড়নে সবুজ আলখেল্লা,গলায় পুঁথির মালা চোখ তার জবা ফুলের মতন রক্তবর্ণ। ভাঙা ভাঙা ঠাণ্ডা স্বরে বাবন বলল, ‘অবাক হলি নাকি রে!,অবাক হ,শেষ বারের মত হয়ে নে। আর একটু পরে তোকে বাবার পায়ে অর্পণ করব,বাবা বড়য় দয়াময়,বড়য় ক্ষুধিত।রক্তের বিনিময়ে দেবে আয়ু,দেবে শক্তি।কথাটা বলার পর তীব্র কণ্ঠে হেসে উঠল। অর্ধনিমজ্জিত অবস্থায় আমি আবারও পড়ে গেলাম।মনে হল কেউ যেন আমার অর্ধেক শক্তি শোষণ করে নিয়েছে,আমি পুনরায় জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরল একটা তীব্র তালির শব্দে। চোখ মেলতেই দেখতে পেলাম সামনে নিভে যাওয়া একটা আগুনের সামনে বসে আছে বাবন,পিশাচের মত তার মুখমণ্ডল।মাথার ওপর দুহাতে খাঁড়াটা ধরে নিমজ্জিত চোখে বিড়বিড় করে পড়ে চলেছে অজানা এক মন্ত্র।আমাদের ঘিরে থাকা জঙ্গলের মধ্যে শুনতে পাচ্ছি একটা দাপাদাপির শব্দ, তীক্ষ্ণ তালির শব্দ। জঙ্গলে ঢোকার মুখে যে শব্দটা খুব অস্পষ্ট ভাবে শুনেছিলাম সেটা এখন স্পষ্ট। মনে হচ্ছে কেউ যেন,কিছু পাওয়ার আনন্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর ক্রমাগত হাততালি দিচ্ছে। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল,একটা বোটকা গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে চারিদিকের বাতাস। মন্ত্র উচ্চারণ থামিয়ে বাবন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আমার দিকে, আগুন জ্বলা চোখে যেন এক অবিরাম শান্তি।আমার দিকে এগিয়ে এলো সে, ভাঙা গলায় বলল, ‘ অপেক্ষার অবসান হল,চল এবার তোকে শান্তি প্রদান করি। বাবার খুব খিদা পেয়েছে যে, বেশি দেরি করা উচিত হবে না’। এই বলে সে আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল যজ্ঞ বেদির কাছে। সেখানে থাকা বিরাট একটা হাড়িকাঠের ওপর উল্টো করে শুয়ে দিল আমায়। কপালে লেপে দিল একতাল সিঁদুর,পুনরায় বিড়বিড় করে শুরু হল মন্ত্রোচ্চারণ। আশপাশে দাপাদাপির শব্দটা এবার বাড়ল।বহু যুক্তি খাটিয়েও আমি বুঝতে পারলাম না সেটা কী,অবশ্য সে ক্ষমতাও আমার বিশেষ ছিলনা। কেবল অনুভব করলাম এক প্রকার উগ্র গন্ধ যুক্ত চাপ তরল সে ছড়িয়ে দিচ্ছে আমার অবসন্ন শরীরে। সেটা যে রক্ত তা বুঝতে আমার বিশেষ চেতনার প্রয়োজন পড়ল না। এবার এলো সেই চরম মুহূর্ত,এক বিরাট অট্টহাসি হেসে খাঁড়াটা উঁচিয়ে ধরল আমার মাথার ওপর। নিজের শেষ পরিণতির কথা চিন্তা করে চোখ বুঝলাম আমি।কিন্তু তার আগে যা দেখলাম তা আমার পরিণতির থেকেও ভয়ঙ্কর। আশপাশে দাপাদাপির শব্দটা থেমে গেল,তার পরিবর্তে জঙ্গল ফুঁড়ে বেড়িয়ে এল একটা কালো অন্ধকার। না! অন্ধকার ঠিক না,একটা বিশাল দেহধারী নগ্ন মানুষ,উচ্চতা কম করে দশ ফুটের কাছাকাছি,বড় দুটি মাংসল হাত দুপাশে মেলে ধরছে তারপর সজোরে আঘাত করে তালি দিয়ে চলেছে ক্রমাগত। সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ,যজ্ঞের নিভু নিভু আগুনে যে আশ্চর্য জিনিসটা লক্ষ্য করলাম তা হল,অন্ধকারে নিমজ্জিত মূর্তিটার শরীরে কোনো মাথা নেই।তার পরিবর্তে সেখান থেকে ছিটকে পড়ছে চাপ রক্ত। ভয়াল,বীভৎস মূর্তিটা এবার নৃত্য শুরু করল।ভয়ে,নিজের সময় যে শেষ হয়ে আসছে সেটা ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি।আর কিছুক্ষণ পরে,পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাব,এই নির্জন অরন্য তার সাক্ষী থেকে যাবে। মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল,আমি চোখ বুজলাম। বাবন হিসহিসিয়ে বলে উঠল, ‘আয়রে আয় পাশে আয় ওরে আমার ভক্ত,খানিক পরে খেতে দেব তাজা নরের রক্ত’। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো সমবেত মানুষের মিলিত কণ্ঠস্বর।মনে হচ্ছে একটা জমায়েত দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। চোখ মেলে দেখতে পেলাম জ্বলন্ত মশাল হাতে বহু মানুষ এগিয়ে আসছে। বাবন স্থির,কালো অন্ধকারটাও সরে দাঁড়িয়েছে এক পাশে। জমায়েতটা ঘিরে ধরল আমাদের। সকলের চোখে-মুখে বিস্ময়,রাগ আরও নানা প্রকার অভিব্যাক্তি ফুটে উঠেছে।বাবন তখনও খাঁড়া হাতে স্থির।ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বেরিয়ে এসে কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘বাবন,তোমার জারিজুরি সব ফাঁস হয়েছে। বাঁচতে চাইলে খাঁড়াটা ফেলে দাও,আত্মসমর্পণ কর’। দেখলাম লোকটার হাতে একটা বন্দুক,তার নলটা তাক করা রয়েছে বাবনের দিকে।’এত সাহস তোদের,তোরা আমায় মারবি,দেখ তোদের কি অবস্থা করি’। এই বলে হেসে উঠে পাশে থাকা কালো অন্ধকারটাকে কিছু একটা নির্দেশ দিল। এতক্ষণ সবার চোখ বোধয় এড়িয়ে গেছিল,তীব্র তালির শব্দ সকলের কানে যেতে চোখ গেল বীভৎস মুণ্ডহীন পিশাচটার দিকে। তাকে প্রত্যক্ষ করেই সকলে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। পিশাচটা গোল করে থাকা ভিড়টার চারপাশে একবার পাক খেয়ে নিয়ে বাবনের পাশে এসে দাঁড়াল। বাবন অস্পষ্ট স্বরে তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলল। বুঝলাম সে আক্রমনের নির্দেশ দিচ্ছে। কিন্তু কি আশ্চর্য পিশাচটা আক্রমন করল ঠিকই কিন্তু আমাকে কিংবা ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে নয়, সে এগিয়ে গেল বাবনের দিকে। বাবন একটু হকচকিয়ে গেল কিন্তু কিছু বলার আগেই মুণ্ডহীন পিশাচটা দু হাত দিয়ে ফাটিয়ে দিল তার মাথা, গরম তাজা রক্ত ছড়িয়ে পরল চারিদিকে,বাবনের দেহটা বার কয়েক ছটফট করে ধীরে ধীরে নিথর হয়ে গেল। প্রচণ্ড ক্লান্তি আর ভয়ানক বীভৎসতায় আমি অজ্ঞান হয়ে যেতে যেতে দেখলাম সেই নিথর দেহ থেকে মাংস খুবলে খাচ্ছে পিশাচটা।
জ্ঞান ফিরলে নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বিছানায়,সেবারতা নার্স জানাল গত দুদিন আমি অজ্ঞান ছিলাম যদি আজ আমার জ্ঞান না ফিরত তাহলে ঢাকা মেডিক্যালে শিফট করত আমায়। শরীর সেই ধকলটা কাটিয়ে উঠলেও মন তখনও সে ভয়াবহতা থেকে মুক্ত হয়নি।চারদিন হাসপাতালে কাটিয়ে দেশে ফিরি আমি,সাথে করে নিয়ে আসি হাজার প্রশ্ন আর এক অবিশ্বাস্য ভয়ংকর ঘটনার স্মৃতি।
মেলখুমের বিভীষিকা গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না