ঢেউয়ের সংসার ভৌতিক গল্প – সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
গোবিন্দ ঢোল জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধে করতে পারে না।তাই ওর পেশার ধরণও বদলাতে থাকে। ওর জীবন সঙ্গীনি কুড়ানিকে ও পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু এই ঝোড়ো ভালোবাসার প্রকৃত মূল্য ও দিতে পারে না। না সংসার ধারণ না আগলানো কোনটাই ও করতে পারে না। তবে ছোটবেলা থেকে ও সাপ ধরায় পটু। প্রাণের মায়া না থাকা আর অসীম সাহসের জন্য প্রায় শ চারেক সাপ ওর ধরা হয়ে গেছে। এলাকায় সাপের উপদ্রব বাড়লে ওর ডাক পড়ে। বিষধর সাপের বিষ সংগ্রহেও ও সিদ্ধহস্ত। কখনও সাপ ধরে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসে,কখনও বা পোষ মানায়। এই যেমন এখন ও গাঁয়ে গাঁয়ে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। ছেলেবুড়োর দল ওর সাপ দেখবে বলে যখন ভিড় জমায় তখন ও নিজের আধ পেটা থাকার কথা ভুলে যায়। দাঁত বের করে হেসে ঝুড়ি থেকে চন্দ্রবোড়া বের করে বলে-“আজানি বাজানি,আয় বাপ,
আমার বান্দারের সেরা সাপ।”
এমন গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে যে মনে হয় ওরা সাপ নয়,ওরা ওর একেকটা সন্তান, বুকের পাঁজর। এরকম বেখেয়ালি জীবনযাত্রায় যে অভ্যস্থ তার সংসার যাত্রাও সেরকম হয়। সেখানে না পায় সম্মান, না পায় আদর।বাড়ি ফিরে ভাত খেতে চাইলে বউ কুড়ানি গজগজ করে ওঠে-“হ্যাঁ, কত রেখেছ জানি ভাতের জোগাড়। মাসের বাজার,কেরোসিন সবই তো গতর খেটে পাঁচ বাড়ি কাজ সেরে আনি। যাও মুরুব্বি আগে চান সারো।”
এই খেঁচানি,উপেক্ষাগুলো গোবিন্দ মেনে নেয়,কারণ সংসারের দায়দায়িত্ব বিশেষ নিতে পারে না বলে অধিকার বোধও দুর্বল। খেতে বসে তাই অনায়াসে বলতে পারে-“কলমিটা বেড়ে রেঁধেছিস কুড়ানি,ঠিক তোর মতো ঝাল ঝাল।” কুড়ানি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই পাশের বাড়ির জটি পিসী এসে বলল-
“ও কুড়ানি,দোকানের চাল,গমগুলো ঝেড়ে রেখেছিস তো,ওরা নিতে এয়েছে।” কুড়ানি ঝাড়াই মাল দিয়ে নিজের শ্রমের পয়সা গুনে নিল। গোবিন্দর দিকে উপেক্ষার দৃষ্টি হেনে ছিটে বেড়ার গেটটা লাগাতে যাবে,হুস করে উদয় হল বিনু ঠাকুরপো। এই হয়েছে কুড়ানি বউদির এক ভক্ত। কতকগুলো পাকা কয়েদ বেল দাওয়ায় রাখতে রাখতে গোবিন্দকে পরামর্শ দিল-“এবার একটু সমসারী হও গোবিন্দ দাদা।কুড়ানি বউদি খাটতে খাটতে নাকাল হল যে।”
গোবিন্দর মুখে এসে যাচ্ছিল,” সে আমাদের সোয়ামি স্ত্রীর ব্যাপার, তু নিজের চরকায় তেল দে।” তবে সদ্য কয়েদ বেল পাওয়া বউয়ের তুষ্ট মুখটা অসন্তোষে ভরাতে ইচ্ছে হল না। মুখে বলল-“কী করি বল ঐ সাপগুলোর সঙ্গে আমার জেবন বাঁধা পড়েছে,ওদের হুট করতে ছাড়ি কি করে বল। দেখি সন্ধ্যেমানে কোন কামকাজ পাই কিনা।” বিনু স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে গঞ্জে ওর এক বন্ধুর ঠিকানা দিল গোবিন্দকে।এরপর চলল ওর কুড়ানি বউদির সঙ্গে মান’অভিমানের পালা। বিনুর এই গায়ে পড়া ভাব গোবিন্দের একেবারে পছন্দ হয় না।তবে প্রতিবেশী বলে কথা,বিপদেআপদে দাঁড়াতে তো ওরাই। বিশেষত কুড়ানি যখন মুখ ফুটে কিছু বলে না। খেয়েদেয়ে আম গাছের ছায়ে বিশ্রাম নিয়ে সাপের ঝাঁকা নামাতে গেলে কুড়ানি বলল-“তুমি একন ঘর ট বাগালি কর আমি কাম থেকে ঘুইরে আসি।” স্নো,পাউডার মেখে কুড়ানি তার বিনু ঠাকুরপোর সাইকেলে হেসে খেলে কাজে চলে গেল। গাল বেয়ে নেমে আসা ঘাম মুছে গামছা মাথায় দিয়ে মাটির শানেই শুয়ে পড়ল গোবিন্দ। ঘুম কি আসতে চায়,মাথার মধ্যে শতেক চিন্তার কিলিবিলি। সেই যে দুয়ারে দাঁড়িয়ে মায়ের খনখনে গলাটা মনে পড়ে-“খোকনা পাঠশালাকে যা,দুকলম লিখা শিখ,মুখ্যু হয়ে থাকিস না। মুখ্যু মানষের অনেক দুঃখ।” বাবা সংসারী ছিল না,গোবিন্দও সে পথে গেল।শুনল না মায়ের কথা, বনে বাদারে,শশ্মানে মশানে কাটিয়ে দিল জীবনটা।কেউ যেন ওর ভেতর থেকে কথা কয়-“খোকনা ওঠ,এখনো তোর অনেক কিছু করবার আছে।”গরিব ঘরের ছেলে এমন বেভুলো স্বপ্নে মাতে কেন। সেও তো বিনুর মতো কেজো বুদ্ধি নিয়ে দুপয়সা করতে পারত।তাহলে তার কুড়ানিও ওরকম গরম নিঃশ্বাস ফেলে ফেলে তার বুকে নেপ্টে থেকে অমন খলবলানি হাসি হাসতে পারত। হতাশা আর গরম দুইয়ে মিলে গোবিন্দর চোখে ঘুম নামল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখল। গাঁ ভর্তি লোক একটা মেলায় খলবলাচ্ছে আর ও একটা নাগরদোলায় চেপে বসেছে। সেখান থেকে দেখে বিনু কুড়ানিরে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কুড়ানি বিনুর সঙ্গে লেপ্টে থেকে কোথায় জানি চলে যাচ্ছে। ও হাঁক পাড়ছে,”দোলা থামাও..দোলা থামাও,” কিন্তু সে মরণ দোলা থামবার নাম করছে না। এমন সময় হাঁকপাক করে ওর ঘুমটা গেল ভেঙে। ঢকঢক করে এক ঘটি জল খেয়ে গোবিন্দ ভাবল,এ স্বপ্ন যদি সত্যি হয়,যদি কেউ তারে এমন মরণদোলায় চড়িয়ে দেয়। ও ঘেমেনেয়ে উঠেও স্বপ্নটাকে আত্মস্থ করতে পারল না।ওর হাঁকপাকের মধ্যে ফিরে এল কুড়ানি,হাটে সামান্য বাজারও করেছে। ঝপাং করে ব্যাগটা দাওয়ায় নামিয়ে বলল-“হা আমার পুড়া কপাল,সে হতে ঘুমায়ে আছ, হাঁসগুলো যে পুকুরে একনো ন্যাদায়ে আছে,ককন কুকুরের পেটে যায়,এট্টু দেকবানি।পারও বটে।” মুখ আর হাত দুইই সমানে চলছে কুড়ানির। হাঁসগুলো ঠিক সময়ে ঘরে না আনার জন্য গোবিন্দর অনুশোচনা হল। তবু সুখের ভাবনায় ভাবল একটু চা পেলে ভাল হয়,খেয়ে চণ্ডীতলায় কীর্তনের রেওয়াজে যাবে। যতটা পারে মিষ্টি করে বলল-“ও বউ এট্টুস চা দিবি?” কুড়ানির চোখ আগুন ঝরাতে গিয়েও শান্ত হল প্রতিবেশী ইন্দু পিসী এসে যাওয়াতে। “কী রে কাম থেকে কখন ফিরলি? তোদের ভালোমন্দের খবর নিতে এইলুম। কুড়ানিরে, তোর শাউড়ির সই আমি, গোবিন্দর উপর টানটা একটু বেশীই।” “তা তোমার ভাইপো সুপুত্তুরকে বল না কেন কাম কাজে মন দিয়ে সমসারটা সামলায়।”কুড়ানির খরখরে জিভের সঙ্গে পরিচিত ইন্দু পিসী, তাই পাড়াতুতো ভাইপোর হয়ে প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়ে বলে উঠল-“যাই বিকেলের চা’টা নিয়ে আবার ছেলের বউটা বসে থাকবে,আমি যাই গিয়া।”
তবে যেতে যেতেও ইন্দু পিসী শোনাতে ছাড়ে না-“বউটা আমার ভাল হয়েছে বলে ছেলের জেবনটা দেখে আমার ভারী সুখ। আর পাঁচ জনের মতো ঢলানি হলে তো আর রক্ষে ছিল না।”
গোবিন্দের মাথায় নাগরদোলার চিন্তাটা এসে পড়ে কিন্তু কুড়ানির মুখের ভয়ে তা বলতে পারে না। শরীরটাকে টেনেটুনে বাজারের দিকে চলল ও,সেখানে ফাইফরমাস খেটে যদি দুটো পয়সা আসে।
কপালে থাকলে দিনু বোষ্টমের দোকানে এলাচ দেওয়া মাটির ভাঁড়ের চা জুটে যাবে। কিছু রোজগার করে কুড়ানির হাতে দিতে পারলে ওর মনটা যদি নরম হয় তো সেই কিশোরী বেলার লজ্জা পাওয়া নতুন বউকে ফিরে পাবে। আপাতত ঘরে চায়ের সুখ ছেড়ে সাথে করে গামছাটা নিয়ে নিল,ওটাকেই বিড়ে করে মাল বইতে পারবে।
শিস দিতে দিতে সাইকেল চালাচ্ছে বিনু। মনটা বড় ফুরফুরে আজ। বাজারে লাভ ভালোই হয়েছে। কুড়ানি বউদিকে নিয়ে ভালোবাসার বহরটা ভালোই জমবে। ভেবেই এক হাত লম্বা জিভ বার করল,আরে বউদি কোথায়?কুড়ানি তো এখন ওর ঘরের লক্ষ্মী। চট করে অবশ্য লক্ষ্মী বানাতে পারে নি। বেধবাকে বিয়ে করা নিয়ে বিস্তর হাঙ্গামা পোয়াতে হয়েছিল। গাঁয়ে সালিশি সভা বসেছিল,সেখানে গিয়ে ইন্দু পিসী আবার বলেছিল-” কুড়ানির সঙ্গে তো বিনুর গোবিন্দ বেঁচে থাকতেই ইন্টুমিন্টু ছিল। সেই শোক নিয়েই তো বাছা আমার মোলো।” যে যতই বলুক,পকেটে নগদ নারায়ণ থাকলে আবার কাজ হয় না।সব কটাকে টাকা খাইয়ে হাত করতেই সব চুপ। তারপর থেকে বুক জুড়ে শুধু কুড়ানি আর কুড়ানি। আজকাল গাঁয়ের শেষের এই বেল গাছটার কাছে এলে বিনুর কেমন গা ছমছম করে। মনে হয় যেন সব কটা ডালে একজোড়া করে চোখ,ওকেই ড্যাবডেবিয়ে দেখছে। একদিন তো এক আঁধার পারা মূর্তি ওর পেছু তাড়া করেছিল। সাইকেল খানা ফেলে চোঁচা দৌড় দিয়ে বাড়ি পৌঁছেছিল বিনু। বীরত্বে হানি ঘটবে বলে বেলগাছে ভূত দর্শনের কথাটা প্রথমে কুড়ানিকে বলতে ইতস্তত করেছিল। পরপর কয়েকদিন একই ঘটনা ঘটতে থাকায় বিনু ওর ভয়ের কথাটা কুড়ানিকে একদিন বলেছিল,শুনে তার সে কী হাসি। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বলেছিল-“আমার কপাল দেখ,এক নাগর ছিল গরিব,মরে গিয়ে আমায় বাঁচিয়ে গেল। আর এই নাগর হয়েছে ভীতু, হা…হা..”
“আমি ভীতু”-বলেই বিনু কুড়ানিকে কোলে তুলে এলোপাথাড়ি আদর করতে থাকে। দূর থেকে একটা স্বর ভেসে আসে-“আ! বড় কষ্ট,জল।” আওয়াজটা কুড়ানি না শুনলেও বিনু পরিস্কার শুনতে পায়। খোলা জানলার কাছে গিয়ে বলে-“কে?” ওর “কে”তাল,নারকেলের জঙ্গলে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল।কতকগুলো প্যাঁচা পুকুরের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। কুড়ানিকে জড়িয়ে ধরা ওর হাতটা ক্রমশ শিথিল হল। কুড়ানি বিনুকে ঝাঁকিয়ে বলল-“আজ পাঁচ বছর হল সে চলে গেছে,তোমার এখনো কিসের ভয় তাকে? সে তো অপঘাতে মোলো নিজের দোষে। কোন কাজে মন ছিল কি তার? অন্যের দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে কষ্ট পাচ্ছ কেন? এই যে এখন আমায় গায়ে গতরে খাটতে হয় না,রোজগারের লেগে কুথাও যেতে হয় না। সে সব তো তুমার আদর,ভালোবাসার জন্য। কি দিয়েছিল সে আমায়? সমসারের বোঝা। তুমি ওসব ভাবনার ছাড়ন দাও।” বিনুর বুকের ঢিপঢিপানি তবু যায় না,মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে থাকে। মুখে সান্ত্বনা দিলেও কুড়ানির মনেও থেকে থেকে অপরাধ বোধ কাজ করে। ভয় যে তারও লাগে না এমন নয়। কিন্তু আনন্দে বাঁচার জন্য সে ভয়কে মাছি তাড়ানোর মতো তাড়িয়ে দেয়। লোকটার ওপর আর একটু মনোযোগ দিলে,যত্ন নিলে হয়তো অতটা উদাসী হয়ে থাকত না। বেঘোরে প্রাণটাও দিত না। গোবিন্দর বড় খুকুর শখ ছিল,বাবা ডাকও শোনার ইচ্ছে ছিল। সামর্থ্যের নাম করে সে ইচ্ছেও কুড়ানি পূরণ করে নি। বিনুর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি ঢলাঢলি সে তো মিছে কথা নয়। মানুষটা অপছন্দ করলেও জোরের সঙ্গে সে প্রতিবাদও করে নি। এখন জিন ভূত হয়ে বিনুর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। পাপ তো কুড়ানিও করেছে,তাহলে কি তাকেও ছাড়বে না। মানুষটা তো তাকে খুব ভালোবাসত। মরার পরেও কি একই ভালোবাসা আছে। একটা অজানা আশঙ্কায় কুড়ানিরও বুক দূর দূর করতে থাকে। রূপ গাঁয়ে এ খবর রটে যায় গাঁয়ের শেষের বেলগাছে গোবিন্দর ভূত থাকে। বিনু নিজের চোখে ওর জোড়া জোড়া চোখ দেখেছে। কত ওঝা,গুণীন আসে,বিনুর পয়সার শ্রাদ্ধ হয় কিন্তু ভূতের ভয় আর ঘাড় থেকে নামে না। পুকুর,মাঠ,ঘাট সর্বত্র জল পড়া,সরষে পোড়া ছেটানো,তাবিজ-কবচ চলতেই থাকে। গাঁয়ের পাঁচজনে পরামর্শ দিল-“ও কুড়ানিকে তুমি ছেড়ে দাও,ওর সঙ্গে ঘর করা গোবিন্দর আত্মা পছন্দ করছে না। গাঁয়ে কি মেয়ের অভাব,অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার কর। এই যে প্রতি রাতে গোবিন্দ তোমাকে ভয় দেখাতে আসে,তা কি এমনই এমনই। তুমি কুড়ানির সঙ্গে ঘর করছ তাই গোবিন্দ তোমার ওপরে প্রতিশোধ নিতে চায়।” বিনু মনে মনে ভাবল যার জন্য এত কাঠখড় পুড়ানো তাকেই হাতছাড়া করে ফেলবে। মৃত্যু ভয় যে একেবারে নেই তা নয়,তবু কুড়ানিকে ও অস্বীকার করতে পারে না। ওকে ভালোবাসার প্রতি মুহূর্ত বড় জীবন্ত ওর কাছে। একজন মৃত মানুষের জন্য ও ঐ মুহূর্তগুলো হারাতে পারবে না। একদিন যা নিষিদ্ধ ছিল তা এখন ওর হকের পাওনা। কুড়ানির মরদ হয়ে ওকে সব বিপদ থেকে কে আগলে রাখে বিনু ছাড়া। গোবিন্দ এমন খেয়াল রাখত কুড়ানির? গাঁয়ের পাঁচজনে নিশ্চয়ই এ কথা মানবে। বেঁচে থাকতে যখন গোবিন্দ ওর সঙ্গে টক্কর দিতে পারেনি তখন মরে গিয়েও পারবে না।
শহর থেকে নতুন এক পুলিশ ইনস্পেকটর এসেছে থানায়। গাঁয়ের সব অপরাধ টেনে টেনে বের করছে। এলাকার লোকজন ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। হীরু ডাক্তার ডিসপেনসারি ছেড়ে পালিয়েছে,সে নাকি কোয়াক ডাক্তার, মানে পাশের ডিগ্রী নেই। ধলা মোদক ভেজাল তেলের ক্যান পাচার করে দোকানে সাধু সেজে বসে আছে। বিনুর দুপয়সাও তো পাচার করা মালের দালালি করে আসছিল,তাই ওর আমদানি পুরো না কমলেও কিঞ্চিৎ কমেছে। আবার কাকা,জ্যাঠারা গায়ে পড়ে উপকার করতে এল।
“বিনু,ও মেয়ে তোর জন্য পয়া নয়,নইলে অমন নিষ্কন্টক ব্যবসায় উটকো কাঁটা।” বিনু মুখ ভার করে বলল-“গাঁয়ের কেউই খপর দিয়ে এনেছে অমন কড়া পুলিশকে। ঐ ধলা মোদক আর হীরু ডাক্তারই ষড় করে তাড়াবে ওকে,আমায় কিছু করতি হবে না।” “না এই তোর ভালোর জন্যই বলছিলাম আর কি।” বিনু ফুঁসে উঠল-“আমার ভাল আপনেদের করতে লাগবে না। ও আমি বুঝে নেব। ঘরের লক্ষ্মীরে ত্যাগ দিতে বলে। ত্যাগ দেব বলে কি তারে ঘরে এনেছি। ও আমার সোহাগ রাতের তারা।যান যান সব নিজের চরকায় তেল দেন ক্যানে।” ওরাও গজগজ করতে করতে গেল-“নিজের ভাল পাগলেও বোঝে,এ একেবারে বেবাক গাধা হয়েছে পরস্ত্রীরে পেয়ে।” ফাইল দস্তাবেজ ঘেঁটে পুরনো ঘটনা খুঁচিয়ে তোলে পুলিশ ইনস্পেকটর রামগোপাল। কেমন করে গোবিন্দর মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে জল ঘোলা হল। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যাওয়ায় লকআপে ঘা কয়েক মারও খেল বিনু। কুড়ানি হাউমাউ করে থানায় কেঁদে পড়েও বিশেষ সুবিধে করতে পারল না। অপরাধের সন্দেহের তীর ওর দিকেও ঘুরে যাওয়াতে ঐ চেষ্টায় ক্ষান্ত দিল। ক্রমশ উপযুক্ত সাক্ষী সাবুদ,প্রমাণাভাবে ছাড়াও পেয়ে গেল বিনু। অতদিন আগের ঘটনাকে কোন প্রামাণ্য ছকেই ফেলা গেল না। ধলা মোদক নাকি স্থানীয় পঞ্চায়েতের চেষ্টায় জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা সম্ভব হল না রামগোপালের। বদলির নোটিশ পেয়ে বিনু,হীরু ডাক্তার ও ধলা মোদককে নিশ্চিন্ত করে এলাকা ছাড়ল সৎ পুলিশ ইনস্পেকটর। গাঁয়ের ক্লাবে বাজি ফাটল,মিষ্টি বিতরণ হল বিনু,হীরু আর ধলার টাকায়। শুধু সেদিন রাতে বিনুদের পুকুর পাড়ের অজানা শব্দগুলো ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেল অশরীরী প্রতিবাদে। বিনুর হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে ভৌতিক শোরগোল বেড়ে চলল।এতসব আজব ভৌতিক সংকীর্তনের মধ্যে কুড়ানি গর্ভবতী হয়ে পড়ল। কুড়ানির গর্ভসঞ্চার করে মনে হল বিনুর দোষস্খালন হল। বেলগাছের বেলকাঠ বেবাক চেয়ে রইল,কোন উপদ্রব করল না।পুকুর পাড়ের প্যাঁচার ডাক কমে এল। হঠাৎ হঠাৎ বজ্রপাত, কানফাটা চিৎকার বন্ধ হল। বিনুও খুশী ওর নিষ্কন্টক দাম্পত্যে। কমলার কোয়া, ছানা, টাটকা মাছ খেয়ে কুড়ানির ঢলঢলে মাতৃরূপে লাবণ্যের ঢল নামল। কুড়ানি আর বিনু নতুন বাবা-মা হওয়ার আনন্দে বিভোর হল।
দু পয়সার মুখ দেখায় বিনু ওর আদরের কুড়ানির জন্য সরকারি হাসপাতাল বাদ দিয়ে নার্সিংহোমের ব্যবস্থা করল। মায়ের কোল আলো করে এল কুসুম,একেবারে রাজকন্যার রূপ নিয়ে জন্মেছে। তবে সংসারে এক নতুন উপদ্রব শুরু হল। কোন একটা অদৃশ্য হাত কুসুমের দেখাশোনা শুরু করল। মেয়ের দোলা নিজের থেকেই দুলতে থাকে। কুসুম শূন্যে ভাসে। বাটির দুধ ঝিনুক দিয়ে আপনিই ঢুকে যায় ওর গলায়। কুসুমকে ঘিরে একটা ভৌতিক সুরক্ষা বলয় থাকে যেখানে বিনুর প্রবেশ নিষেধ। মা হওয়ার পর কুড়ানির মানসিকতারও পরিবর্তন হয়েছে। নিজের খেয়াল ভুলে কুসুমকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কুসুমের কাছ ঘেঁষলেই বিনু হাওয়ার থেকে রামধাক্কা পায়। মেয়েটাও হয়েছে সে রকম,বিনু কোলে নিলেই মড়া কান্না জুড়ে দেয়। তখন ওকে চুপ করাতে গিয়ে কুড়ানির সব কাজ পণ্ড হয়। সংসারের জন্য উদয়স্ত খেটেও বিনু না কুড়ানিকে না কুসুমকে কাছে পায়। নিজের কপালের দোষ দিয়ে রাগে মাথার চুল ছেঁড়ে। কিন্তু কী করবে ভূতকে তো আর টাকা দিয়ে বশ করা যায় না। ভূতেদের ক্লাব,পঞ্চায়েত থাকলে সেসব চেষ্টা বিনু ছেড়ে দিত না। রাতে শুয়েও কি ঘুমের জো আছে,মনে হয় গোবিন্দর ঝাঁকার চন্দ্রবোড়া,কেউটে, শাঁখামুটি সব বেরিয়ে পড়েছে। হিসহিস গর্জনে আত্মা খাঁচা ছাড়া করে ছাড়ে। একদিন দিনেমানে একটা জাত কেউটে কুসুমকে জড়িয়ে ধরেছিল। মেয়ের মুখে কী হাসি,মনে হচ্ছিল কেউটেটা ওর আপনজন কেউ। দুজনে মিলে যেন খেলায় মেতে উঠেছে। ঐ দৃশ্য দেখে বিনু আর কুড়ানির মুখ ফ্যাকাসে, বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল। আস্তে আস্তে কেউটেটা নিজের থেকেই কুসুমকে ছেড়ে পুকুর পাড়ের জঙ্গলে চলে গেল। এসব দেখে বিনুর নেতানো পৌরুষ ফিরে এল, হঠাৎ যেন একটা আসুরিক শক্তি ভর করল ওর ওপর। ও ঠিক করল গাঁয়ের শেষ প্রান্তের ঐ বেলগাছটা যে করেই হোক ও কাটবে। কুড়ানি এই প্রথম কাকুতিমিনতি করে বিনুকে আটকাতে চাইল। কুড়ানির মনে শঙ্কার মেঘ,গোছানো সংসার বুঝি বা ভেসে যায়। কুড়ানির বারণ না শুনে বিনু চলল কুড়ুল নিয়ে গাছটা কাটতে। রাগের মাথায় এলোপাথাড়ি কয়েকটা ডাল কেটেই ও হাঁপিয়ে পড়ল।এদিকে দিনের আলো পড়ে এসেছে। সেদিকে হুঁশ নেই মাথায় খুন চেপে যাওয়া মানুষটার। হঠাৎ শেষ কোপটা দিতে যেতেই বেলগাছটা ওকে নিয়ে চরকির মতো ঘুরতে শুরু করল। অমনই পাঁচ বছর আগের চড়কের দিনটা মনে পড়ে গেল বিনুর। গোবিন্দ খুকু পাওয়ার জন্য মানত করে শিবের ব্রত রেখে সন্ন্যাসী ভক্ত হয়েছিল। কদিনের প্রায় উপোসী শরীর বিনুর বেঁধে দেওয়া নড়বড়ে বেল কাঠে পিঠের চামড়ায় বাণে ফুঁড়ে ঝুলতে ঝুলতে কাঠসহ দড়াম করে পড়েছিল মাটিতে। শক্ত করে বাঁধা কাঠ কখন আলগা করে দিয়েছিল বিনু গোবিন্দ তা টেরও পায় নি। শেষ মুহূর্তেও চিৎকার করেছিল-“দোলা থামাও, থামাও দোলা।” পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পাঁঠা কাটার মতো ছটপট করে সেই যে চোখ বুঁজেছিল গোবিন্দ, সে চোখ আর খোলে নি। মাস ঘুরতেই কুড়ানিকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিল বিনু। থানা,পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ যেটুকু শুরু হয়েছিল বিনুর ছড়ানো টাকায় তা থেমে গেছিল। আজ এই ভীষণ ঘূর্ণিতে বিনুর কান,মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। ওর অচৈতন্য প্রায় শরীর এলিয়ে পড়ল। এলাকার সব বাস্তু সাপেরা ওর চারদিকে হিস হিস শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ তো কারুর তৈরী করা চড়কের কাঠ নয়,এ তো স্বয়ং গোবিন্দ। আত্মার সঙ্গে লড়াই করবে এমন সাহস কার আর আছে।গোবিন্দর আত্মার কাছে হাজার অনুনয়বিনয় করেও কোন ফল হল না। বিনুর চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণির বেগ ভীষণভাবে বেড়ে গেল। প্রাণ বাঁচানোর জন্য সর্ব শক্তি দিয়ে বেল কাঁটাকে উপেক্ষা করে জড়িয়ে ধরল বিনু।খড়কুটো ধরার চেষ্টা কোন কাজে এল না।ডাল সমেত নীচের কাঁটাঝোপে আছড়ে পড়ল ও। লোক জড়ো হলেও কেউ এগোতে সাহস করল না।গাঁয়ের সকলের ভিড়ের মধ্যে আলুথালু বেশে কুড়ানিকেও দেখা গেল। গোবিন্দর মতো একই কায়দায় মাথা থেঁতলে মাটিতে পড়ে আছে বিনু। চারদিক রক্তে মাখামাখি কাণ্ড,বিনুর দেহকে ঘিরে গোবিন্দর ঝাঁকার পোষা সাপেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাঁয়ের লোকেদের চোখ আতঙ্কে স্থির। বেঁচে থাকতে নিরীহ গোবিন্দের যে তেজ তারা দেখেনি মৃত গোবিন্দের আত্মার তাণ্ডব দেখে সকলে নির্বাক হয়ে গেছে।কুড়ানি স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারল না,ঐখানেই অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল। বিনুর শ্রাদ্ধশান্তি মিটতে কুড়ানি কুসুমকে নিয়ে নিথর হয়ে দাওয়ায় বসে থাকে। পরকীয়ার সাজা যে এমনভাবে পেতে হবে তা ওরা কল্পনাও করে নি। কুড়ানি জানে কুসুমের জন্য গোবিন্দ ওর কোন ক্ষতি করবে না,তবে বাকি জীবন ওকে গোবিন্দর আত্মার সঙ্গেই সংসার করতে হবে। সশরীরে যার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করেছে তার কায়াহীন ভুবনকেই আপন করে নিতে হবে।
ঢেউয়ের সংসার ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন