কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪৩১ » লাটেমপুরের জঙ্গলে বিভীষিকাময় সেই রাত

লাটেমপুরের জঙ্গলে বিভীষিকাময় সেই রাত

লাটেমপুরের জঙ্গলে বিভীষিকাময় সেই রাত ভৌতিক গল্প – সমাদৃত দাস

প্রথমেই আগে আমি আমার পরিচয়টা দিয়ে রাখি। আমার নাম শুভ্র। পেশায় একজন সরকারি চাকুরিজীবি। আমি এখনও পর্যন্ত অ-বিবাহিত। কারণ বিয়ে করবার আমার ইচ্ছা বা শখ নেই এখনও পর্যন্ত। এইবারে আসি আমার একটা ভয়ংকর নেশা নিয়ে। জীবনে আমার তেমন কোনো বিশেষ শখ নেই। তবে বলতে পারেন একটা ভয়ংকর নেশা বা শখ রয়েছে। সেটা হল অ্যাডভেঞ্চার। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভূত দর্শন। যেখানে রয়েছে অ্যাডভেঞ্চার বা ভূত, সেইখানেই খুঁজে পাবেন এই শুভ্রকে। তবে হ্যাঁ, এইবারের যাত্রা তে কিন্তু বেশ কিছু চমক রয়েছে। তার মধ্যে একটা চমক বলি, সাধারণত অন্যবারের অ্যাডভেঞ্চারে, হয় অ্যাডভেঞ্চার না হলে ভুতুড়ে স্থান দুটোর মধ্যে যেকোনো একটা। কিন্তু এইবারে যে জায়গাটায় ভ্রমণ করতে যাচ্ছি, সেই জায়গাটাতে যেমন একদিকে অ্যাডভেঞ্চার রয়েছে তেমনই অন্যদিকে আবার ভৌতিক কান্ডকারখানাও রয়েছে। দিনের বেলায় জায়গাটি শান্ত স্নিগ্ধ বন। আর রাত্রি বেলাতে অশরীরীর আবির্ভাব। তবে আমি একটা জিনিস আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি সেটা হল, এইবারে আর স্করপিও তে করে বন-জঙ্গল ভ্রমণ নয়। জিপ গাড়িতে করে ভ্রমণ করব। এতে ভ্রমণের বৈচিত্র্য আরও বৃদ্ধি পায়। এবং এর পাশাপাশি অভিজ্ঞতাও সমান হারে বৃদ্ধি পায়। তো যাইহোক, আজ সকাল সকাল লাটেমপুরের জঙ্গলের উদ্দেশ্যে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। শুনেছি, এক বৃহৎ বন হল এই লাটেমপুরের জঙ্গল। আর জঙ্গলের একটু গভীরে মা কালীর একটা মন্দির রয়েছে। কথিত আছে, ডাকাত দল যখন ডাকাতি করতে যেত তার পূর্বে মা কালীকে তারা মন ও নিষ্ঠা সহকারে পুজো করত। পুজোতে কোনো ফাঁকি থাকত না। আর এও বলা হয়ে থাকে, মা কালীকে পুজো করার পর ডাকাতের দল আরও বেশি সফল হত। তাদের ডাকাতি খুব সহজেই ও ভালোভাবে হত। কেউ আটকাতে পারত না। এই সমস্ত কথা ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখতে পাওয়া যায়। লাটেমপুরে জঙ্গলে সকালবেলায় ওই দশটা নাগাদ পুরোহিত মশাই এসে পুজো করে দিয়ে যান ওই পোড়ো কালীমন্দিরে। আর সন্ধ্যার পর এই জঙ্গলে কেউ পা মাড়াতে সাহস পায় না। আর কালী মন্দির তো দূর অস্ত। বলা হয়ে থাকে দেবী কালী এই জায়গায় রণচন্ডী রূপে রাত্রে ঘুরে বেড়ান। রীতিমতো গা ছম ছমে পরিবেশ হয়ে ওঠে এই লাটেমপুরের জঙ্গল। আর তা ছাড়া বিভিন্ন রকম বন্য প্রাণী (বিশেষ করে বড়ো বড়ো সাপ) ঘুরে বেড়ায়। তবে বাঘ-ভাল্লুক এখনও পর্যন্ত এই জঙ্গলে দেখতে পাওয়া যায়নি। আর একটা কথা বলি, এখান থেকে লাটেমপুরের যে প্রধান শহর রয়েছে, সেটার দূরত্ব প্রায় কুড়ি কিলোমিটারের কাছাকাছি। অর্থাৎ এই জঙ্গলে যদি কারোর কোনো শরীর খারাপ হয় তাহলে তাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে যেতে ওইটুকু সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে, এমন কী প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাই এই জঙ্গলে আসতে গেলে সোজা কথা তাকে নিজের প্রাণকে হতে রেখে আসতে হবে। তবে এর আগে যে মানুষ এইখানে আসেনি তা নয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সন্ধ্যার মধ্যেই ভয়ে চলে গিয়েছে। অনেক অ্যাডভেঞ্চার পিপাসু মানুষ রয়েছে যারা আবার সারা রাত এই লাটেমপুরের জঙ্গলের ভাঙা মন্দিরে রাত কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছেন। কিন্তু এক অপার্থিব ভয় তাদের তাড়া করেছে। চোখ-মুখ ভয়ে ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে গিয়েছে। যাইহোক এই ঘটনাগুলো সবই শোনা ঘটনা অবশ্য। এর মধ্যে কতটা সত্যি ঘটনা আর কতটা জলমেশানো সেটা আমার জানা নেই। আর যখন আমি ওখানে যখন যাচ্ছি তখন আমি চেষ্টা করব সমস্ত রকম অভিজ্ঞতাই তোমাদেরকে  শোনাবো। শেষ পর্যন্ত বেড়িয়ে পড়লাম লাটেমপুরের ঘন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। জিপ গাড়িতে করে। জিপ গাড়িতে কিন্তু বেশ ভালোই লাগে ঘুরতে। আসলে গাড়িটা তো একদম খোলামেলা। তার ফলে চারিদিকের দৃশ্য খুব সহজেই চোখকে ধরা দেবে। দেখতে দেখতে জঙ্গলের মূল প্রবেশদ্বারের কাছ চলে এলাম। আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভিতরের দিকে যেতে লাগলাম। আকাশে সূর্য এখন বেশ কিরণ দিচ্ছে। রোদ বেশ জোরালো। তবে জঙ্গলটা কিন্তু বেশ সুন্দর। প্রাকৃতিক পরিবেশ টা বেশ মনোরম। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। দু-পাশে বড়ো বড়ো গাছ দিয়ে ঘেরা। যেন ওরাই এই শান্ত স্নিগ্ধ বনের প্রহরী। যেন ওরাই পাহারা দিচ্ছে এই লাটেমের জঙ্গল টাকে। পাখির মধুর কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পাখিগুলো আনন্দে ডানা মেলে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই লাটেমের জঙ্গলে। জঙ্গলের ভিতরে যতই যাচ্ছি ততই যেন গভীর হচ্ছে এই বন। এইবার আস্তে আস্তে দেখা যাচ্ছে ওই পোড়ো, ভাঙা কালী মন্দিরের চূড়াটা। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হল ওই ভাঙা কালী মন্দিরটা। মন্দিরের খুব কাছে জিপটাকে নিয়ে গেলাম না। একটু দূরেই জিপটাকে দাঁড় করালাম। তারপরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম সেই বহু প্রতীক্ষিত ও ভাঙা, পুরোনো, পোড়ো ও ঐতিহাসিক পূর্ণ মন্দিরটার দিকে। মন্দিরটাকে ভালোভাবে দর্শন করলাম। মন্দিরের গায়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য গুলোই বলে দেয় যে এটার অনেক পুরোনো ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। তবে এটা ঠিক মায়ের মূর্তির দিকে চোখে চোখ রেখে খুব বেশিক্ষণ যে তাকানো যায় না। হয়ত কোনো জাদু রয়েছে। কালী মন্দিরের যে সিঁড়ির ধাপ গুলো রয়েছে সেইখানে ঠ্যাং দুটোকে ঝুলিয়ে বসলাম। এখন সূর্য মধ্য গগনে। সূর্যের প্রখর তাপ আমার সারা শরীরকে উষ্ণ করে তুলেছে। এইভাবেই কেটে গেল দিনের লাটেমপুর দর্শন। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল যে জিনিসটা সেটা হল কত অদ্ভুত রকমের গাছ যেটা হয়ত শহর বা তার আশেপাশে নেই। দেখতে দেখতে সূর্য পশ্চিমে অস্ত গেল। এই সূর্যাস্তের দৃশ্যটাও কিন্তু বেশ মধুর লাগছিল। আস্তে আস্তে নেমে এল সেই আতঙ্কের লাটেমপুরের রাত। দেখতে দেখতে আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। জঙ্গলে যেন সন্ধ্যাটা দ্রুত নেমে আসে। ঘনিয়ে এল এক ভৌতিক রাত। হয়ত কতকিছু ঘটবে আমার সাথে এই রাতে। কত না কত হিংস্র প্রাণী রয়েছে এই জঙ্গলে যারা হয়ত খুঁজে চলেছে মানুষের গন্ধ। তবে এটা ঠিক রাতটা কিন্তু বেশ ছমছমে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে মনে হচ্ছে যেন এই শান্ত স্নিগ্ধ বনটা ক্রমে অশান্ত হয়ে পড়ছে। সেই বনের গাছগুলো এখন যেন তারা জেগে উঠেছে। তারাও যেন চলাচল করছে এই গভীর বনে। আমি কিছুক্ষণ পোড়ো মন্দিরটাতে বসেছিলাম। তারপরে বড্ড মশার উৎপাত। দিনে যেটা ছিল না। আমি মোবাইলটা খুলে দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতে এতটাই মোবাইলের প্রতি নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে কোনোদিকেই খেয়াল ছিল না আমার। হঠাৎই একটা শব্দ একটু নড়ে চড়ে বসলাম। ঝুম ঝুম ঝুম। নূপুরের শব্দ। তবে কোথা থেকে এই শব্দের উৎপত্তি সেটা অবশ্য আমার বোধগম্য হল না। মনে হল কোনো মহিলার নূপুরের শব্দ। আবারও ঝুম ঝুম ঝুম এই শব্দটা শোনা গেল। এইবার একটু আমার মনে কৌতূহল সৃষ্টি হল। আমি পিছন ঘুরে তাকাতেই চমকে গেলাম। এ যে সাক্ষাৎ মা কালী। এক হাতে খাঁড়া অন্য হাতে কাটা মুন্ডু। আর মায়ের বীভৎস দৃষ্টি আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। তিনি দ্রুত নূপুর পত্র আমার দিকে খাঁড়া নিয়ে এগিয়ে এলেন। এদিকে বনের সমস্ত গাছগুলো দিয়ে দ্রুত বাতাস বইতে লাগল। এক প্রকার ঝড় উঠে গেল। তার মধ্যে বিদ্যুৎ তের ঝলকানি দেখা গেল। মা এই দৃশ্য দেখে হাসতে লাগলেন এবং বললেন,”ওরে পা পিষ্ঠ নরাধম, তুই আমাকে পরীক্ষা করতে এসেছিস। আজ তোকে আমি নিজের হাতে শেষ করব।”

এই কথা ও দৃশ্য দেখার পর, আমার পায়ে যতটা শক্তি ছিল সেইটাকে কাজে লাগিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। আকাশ ভেঙে টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। অন্ধকারে খুব বেশি দূর

এবড়ো-খেবড়ো পথ দিয়ে ছুটতে পারলাম না। হয়তো কোথাও গর্ত ছিল, পা-টা ঢুকে গেল। এবং মুখ থুবড়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালাম। চোখটা যখন খুললাম, তখন দেখি আমি শুয়ে রয়েছি হাসপাতালের বিছানাতে। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ডান হাতের কবজিটাতেও ব্যান্ডেজ বাঁধা। কে, কোথায়, কখন আমকে হাসপাতালে ভর্তি করল? তবে গতকালের  বিভীষিকাময় ওই দৃশ্য ও ঘটনাটি এখনও আমার চোখে ভাসছে। এখন একটাই প্রশ্ন তখন কি আমি সব সত্যিই দেখেছিলাম? নাকি হ্যালুসিনেশনের মধ্যে ছিলাম? এর উত্তর আমার কাছে জানা নেই এখনও পর্যন্ত…

লাটেমপুরের জঙ্গলে বিভীষিকাময় সেই রাত ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!