উল্টো স্রোতে সাঁতার ছোট গল্প – রানা জামান
আজ বাসায় ফিরতে শবনমের আধাঘন্টা বিলম্ব হলো। সে চেষ্টা করে এগারোটার মধ্যে ফিরতে। রাত বারোটায় এপার্টমেন্টের কলাপসিবল গেট বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকার বাসাগুলোতে এই সমস্যা-প্রধান ফটকের চাবি ভাড়াটের হাতে দিতে চায় না মালিক। এ নিয়ে বেশি তর্কাতর্কি করলে হারাতে হয় বাসার ভাড়াত্ব! তখন আরেক বিড়ম্বনা। সুবিধাজনক স্থানে সবসময় বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না।
বরাবরের মতো দরজা খুলে দেয় শবনমের মা শাহেদা খাতুন। তিনি দরজা খুলে দিলেও পারতপক্ষে মেয়ের মুখের দিকে তাকান না। শবনম বাসায় ঢুকে সরাসরি নিজের কক্ষে এসে ঢুকে যায় ওয়াশরুমে। একটা গোসল নিলে বেশ আরাম লাগে এবং মনে হয় সমস্ত ময়লা সাফ হয়ে গেছে ধূয়ে। এই ফাঁকে শাহেদা খাতুন মেয়ের জন্য চা করে নিয়ে আসেন-লেবু চা।
আজও এর ব্যতিক্রম হলো না।
শবনম ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে জড়াতে জড়াতে মাকে বললো, চা খেতে ইচ্ছে করছে না মা। বেশ ক্লান্তি লাগছে আজ।
শাহেদা বেগম ব্যাকুল হলেন মেয়ের কথায়। কান্নাটা গিলে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে মেয়ের কাছে এলেন।
মেয়ের গায়ে স্নেহের হাত বুলাতে চাইলে শবনম একটু রুক্ষ কণ্ঠে বললো, তুমি আমার গায়ে হাত দিবা না মা।
শাহেদা খাতুন থমকে যান মেয়ের কথায়। শবনমের বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যাবার পর শবনম উপার্জন শুরু করলে মাকে আর গায়ে হাত দিতে দিচ্ছে না শবনম। মেয়ের এমন কথায় মা রাগতে গিয়েও চুপসে যান। নিজেকে তখন খুব অসহায়ও লাগে। লেখাপড়া করেও স্বামীর আপত্তির কারণে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়েছে। চাকরিটা থাকলে এখন লেখাপড়া বন্ধ করে উপার্জনের পথে নামতে হতো না মেয়েটাকে। ওদিকে বাজে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ছেলেটাও হয়ে গেছে বখাটে-সংসারের কোন খোঁজ রাখে না। শাহেদা খাতুন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে সরে এলেন মেয়ের কাছ থেকে।অব্যক্ত কষ্ট কারো কাছে প্রকাশও করতে পারছেন না শাহেদা বেগম।
শবনম মাকে জিজ্ঞেস করলো, শরীফ ফিরেছে মা?
শাহেদা খাতুন স্বাভাবিক স্বরেই বললেন, তুই জানিস শরীফ বাদাইম্যা হলেও বেশি রাত করে না।বাড়ি ফেরার বিষয়ে আমার ছেলেটা খুব পাংচুয়াল।
শবনম একটু ঝাঁঝের সাথে বললো, ও বাধ্য হয়ে পাংচুয়াল হয়েছে। কারণ, রাত বারোটার পর আর বাসায় ঢুকতে পারবে না।
শাহেদা খাতুন কথার সত্যতা বুঝতে পেরে আর কিছু বললেন না।
শবনম ফের বললো, ওকে একটু ডেকে দাও মা।
শাহেদা খাতুন ম্লান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ও আজ আবার কী করলো?
শবনম বললো, তুমি সবসময় ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলো কেনো মা? তোমার লাই পাওয়ায় ও লেখাপড়া শেষ না করে বখাটে হয়ে গেলো। আমি হাত খর্চা বন্ধ করে দিলে তোমার লাই পাওয়া ছেলে ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে যাবে-ক্রস ফায়ারে মারাও যেতে পারে।
শাহেদা খাতুন এবার রাগলেন একটু। বললেন, তুই এভাবে কথা বলছিস কেনো? শরীফ কি তোর বৈমাত্রেয় ভাই?
বলেই শাহেদা খাতুন ঝরঝর করে কাঁদতে গিয়ে মুখে আঁচলচাপা দিলেন। শবনম দ্রুত খাট থেকে নেমে মায়ের কাছে এলো। মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি ইদানিং খুব সিচ-কাঁদুনে হয়ে গেছো মা। কান্নার কথা আমার। কিন্তু আমি কাঁদি না মা। আমি কি কাঁদি?
এবার মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন শবনমও মাকে জড়িয়ে রেখে কাঁদতে লাগলো। মা-মেয়ের সমস্বরে কান্না। মা জানে মেয়ের কষ্ট কোথায়। তারপরও মেয়েটা কী শক্ত থাকছে। আর মেয়েটা শক্ত থাকছে বলেই সংসারটা চলছে পা বিহীন উটের মতো।
হঠাৎ কান্না থামিয়ে শবনম বললো, যথেষ্ট কান্নাকাটি হয়েছে মা। এবার কান্না থামিয়ে আমার একমাত্র ছোট ভাইটাকে ডাকো। ওর সাথে আমার জরুরী কথা আছে। ভয় পেয়ো না মা, ওকে আমি বকবো না।
শাহেদা খাতুন আঁচলে অশ্রু মুছে বেরিয়ে গেলেন। একটু পর মা ও ছেলে একসাথে ঢুকলো কক্ষে। শরীফ শবনমকে একবার দেখে মাথা নিচু করলো।
শবনম মার দিকে তাকিয়ে বললো, মা চেয়ারটায় বসো। শরীফ বিছানায় বস। তোর কাজের কিছু হলো?
শরীফ বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে বললো, না বুবু। অল্প শিক্ষায় চাকরি হবে না বুবু। তোমারও হয় নাই। তোমাকে বলেছিলাম কিছু পূজি পাইলে একটা ব্যবসা শুরু করতে পারবো। এখন চাকরির চেয়ে ব্যবসায় লাভ।আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যায়!
কী ব্যবসা? চায়ের দোকান?
জ্বী বুবু। চা’র দোকানের নাম দেবো অনলি গৃন টি।
তারপর?বল্।
আমি নিজে মৌলভিবাজার গিয়ে বাগান থেকে পাতা তুলে শুকিয়ে সেই পাতায় চা বানাবো।এ নম্বর চা হবে সেটা!
ছেলের কথায় মা’র মুখজুরে বিস্তৃত হচ্ছে হাসি। শবনম কিছু না বলে বালিশের তলা থেকে এক বান্ডিল টাকা বের করে ছোট ভায়ের হাতে দিলো। শরীফ টাকাটা হাতে নিয়ে গুণে বুবুকে একবার দেখে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। মা ছেলের কাছে এসে পিঠে রাখলো স্নেহের হাত।
শবনম আবেগ সামলে নিয়ে বললো, এটা খুব কষ্টের টাকা। মন লাগিয়ে ব্যবসা করছি। ব্যবসা মার খেলে আর দিতে পারবো না।কথাটা মনে রাখতে চেষ্টা করিস।
শাহেদা খাতুন ছেলেকে বললেন, আর বাদাইম্যাগিরি করিস না বাপ। মন লাগিয়ে ব্যবসাটা করিস।
শরীফ মা ও বোনকে কদমবুচি করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। তখনই সে ট্রেনে চড়ে চলে এলো মৌলভীবাজার। হিলটপ চা বাগানের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে করে ফেললো চা-পাতা কেনার ব্যবস্থা। বাগান থেকে সরাসরি চা-পাতা তুলে সেখানেই শুকিয়ে নিয়ে আসবে ঢাকা; তাহলেই হবে অনলি গৃন-টি এর বিশেষ চা।
এই চা-এ হবে না কোন চিনি ও দুধ। ইদানীং কোন কোন পাঁচতারা হোটেলে গৃন-টি এ-ও টিনের গুড়ো দুধ দিয়ে বলা হচ্ছে গরুর দুধের বিশেষ গৃন টি।
বিশেষ ব্যবস্থার গৃন-টি অনেক স্বাদের হয়ে গেলো কেনো জানি না। যে-ই পান করে সে-ই হয়ে যায় হতবাক। এবং দ্বিতীয় কাপ চা তো চাবেই! এর উপর জিভ থেকে লালা ঝরার জন্য চা সরবরাহের জন্য রেখেছে একজন বেশ সুন্দর মেয়ে এটেন্ডেন্ট।
অল্প দিনেই জমে উঠলো শরীফের চা-এর ব্যবসা। এ খবর বাসায় পৌঁছে গেলে এক রাতে মা ছেলেকে ডেকে গদগদ কণ্ঠে বললেন, শুনছি তোর চা-ব্যবসা বেশ জমে গেছে। কিন্তু আজো আমাদের এক কাপ চা খাওয়ালি না।
আমাদের চা খাওয়ালে কি টাকা নিবি? তোর স্টলের এক কাপ চা’র দাম কত?
শরীফ ভাত চিবুতে চিবুতে বললো, মাগনা কোন চা নাই মা। আমি খুব তাড়াতাড়ি বুবুর টাকাটা ফেরত দিতে চাই। বুবু তো এখনো আসে নাই। তাই না মা?
শাহেদা খাতুন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, তোর বুবুর উপার্জনে এই সংসারটা টিকে আছে। তোর আয়টা আরেকটু জমে উঠলে তোর বুবুর বিয়ে দিতে হবে। তুই আবার আগেবাগে বিয়ে করে ফেলিস না!
শরীফ দাঁড়িয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, কী যে বলো না মা! এখন আমি একটা প্রেম করবো। আমার একটা প্রেম করার খুব শখ মা! স্কুলে একটা মেয়েকে খুব ভালো লাগতো। কিন্তু আমি ছাত্র খারাপ থাকায় আমাকে পাত্তাই দিলো না মেয়েটা।
শাহেদা খাতুন শরীফের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে বললেন, আহা রে বাচা আমার! মেয়েটা এখন কোথায় রে? বিয়ে-থা হয়ে গেছে?
শরীফ এবার একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, কলেজে ভর্তি হয়ে রাত্রী গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া এক ছাত্রের সাথে প্রেম করে চলে গেলো হানিমুনে।
লেখাপড়া শেষ না করতেই মা-বাবা ওদের বিয়ে দিতে রাজি হলো?
আজকাল হানিমুনে যেতে বিয়ে লাগে মা।
ও। তারপর?
রাত্রী প্রেগনেন্ট হয়ে গেলে কায়সার ওকে অস্বীকার করলো।
কী আশ্চর্য!
কায়সার ঠোঁট উল্টে বললো কার না কার বাচ্চা ওটা কে জানে!
শাহেদা খাতুন বললেন, বিয়ের আগে ওসব করলে এমন পরিণতি হতেই পারে। তারপর?
ইদুর মারার ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো রাত্রী।
চেয়েছিলো মানে? মেয়েটা আত্মহত্যা করতে পারে নি! পরাবেই বা কিভাবে! ইদুরের বিষে তো ইদুর-ই মরে ন! মেয়েটা সমাজে মুখ দেখাচ্ছে কিভাবে? তারপর?
ওকে মুমূর্ষু অবস্থায় ভর্তি করা হলো হাতপাতালে। এ খবর শুনে কায়সার হোস্টেল থেকে পালাতে গিয়ে পা ফসকে সিড়ি থেকে নিচে পড়ে হাত-পা ভেঙে সেও ভর্তি হলো হাসপাতালে।
শাহেদা খাতুন হাততালি দিয়ে উচ্ছল কণ্ঠে বললেন, বাহ! খেলা তো জমে উঠেছে! এরপর কী হলো রে শরীফ?
পাম্প করে রাত্রীর পেট থেকে বিষ বের করতে পারলেও বিষক্রিয়া রয়ে গেলো পেটে। শুরু হলো ডায়রিয়া। এই ডায়রিয়া আর থামে নি মা!
কী বলছিস তুই? দুই বছর হয়ে গেলো এখনো মেয়েটা ডায়রিয়ায় ভুগছে?
না মা।
তাহলে?
ঐ ডায়রিয়ায় রাত্রী চলে গেলো সবাইকে ছেড়ে। শরীফ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।
ইন্না-লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। আর পাজি ছেলেটা? ওর কী হলো?
ওর ডান পা-টা হাটু অব্দি কেটে ফেলতে হয়েছে। ও এখন ক্রাচে ভর দিয়ে হাটে।
পাজিটার সাজা পুরাপুরি হয় নাই। ওর দুটা পা-ই কেটে ফেলে দেয়া উচিত ছিলো!
আচ্ছা মা, বুবু প্রতিদিন এতো রাত করে বাড়ি ফেরে। রাত্রীর মতো বুবুও ওরকম কিছু করে ফেলবে না?
তোর বুবু কারো সাথে প্রেম করে না। প্রেম না করলে ওরকম অঘটন ঘটে না।
শরীফ একটা হাই তুলে বললো, আমি এখন ঘুমাতে গেলাম মা।গুডনাইট মা!
শরীফের গৃন-টির নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চারদিকে। দোকান বড় করতে না পারলেও জানবল বাড়ালো-আরো এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়োজিত করলো কাজে। মেয়ে দুটোকে সর্বক্ষণ কাছ থেকে দেখে এবং মাঝে মাঝে অসর্তক মুহূর্তে ওদের ক্লিভেজে দৃষ্টি পড়লে শরীফের শরীরের লোম যায় দাঁড়িয়ে।
একদিন সন্ধ্যায় শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ওর এক বখাটে বন্ধুর দেয়া একটা মোবাইল ফোন নম্বরে ফোন করলো। লোকটা ওকে রাত দশটায় একটা জায়গায় যেতে বললো। জায়গাটা আফতাবনগরে। সে দোকানের ভার স্টাফদের উপর ছেড়ে দিয়ে উবার নিয়ে চলে এলো আফতাবনগর। বাড়িটা খুঁজে পেয়ে উঠে গেলো তিন তলায়। কলবলে টিপে দিলে ঐ লোকটা দরজা খুলে ওর পরিচয় জেনে নিয়ে গেলো ভেতরে।
লোকটা শরীফের কাছ থেকে অগ্রীম টাকা নিয়ে একটা কক্ষ দেখিয়ে বললো, আপনি ঐ রুমে যান। নো টেনশন। আমি এখানে আছি।
শরীফ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো কক্ষটার দিকে। দরজার কাছে গিয়ে পেছনে তাকালে লোকটা ইতিবাচক সায় দিলে দরজা ঠেলে ঢুকে গেলো ভেতরে। কেউ নেই ভেতরে। ঘুরতে যাবে তখন সংলগ্ন ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো শবনম।
উল্টো স্রোতে সাঁতার ছোট গল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভরুয়া
উদ্বর্তিনী
নীলবাস্প