কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » সায়েন্স ফিকশন গল্প » নক্ষত্রকন্যা

নক্ষত্রকন্যা

নক্ষত্রকন্যা সায়েন্স ফিকশন গল্প – রমেন্দ্র নাথ মিশ্র

সুমন ভাই কফিতে চুমুক দিয়েই বিকৃত গলায় বললেন‚ “এই হাসপাতালের চা-কফি দিন দিন এমন বিস্বাদ হচ্ছে কেন লো তো?”

আমি মৃদু হেসে বললাম‚ “কফি ঠিকই আছে‚ সম্ভবত আপনার মেজাজ আজ খারাপ সুমন ভাই! আমি লক্ষ্য করেছি‚ মেজাজ খারাপ থাকলে আপনি খাদ্যবস্তুকে গালাগালি করেন।”

গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন সুমন ভাই‚ “একদম ঠিক। বুঝলে অপু‚ তুমি যতটা আমায় বোঝো‚ আমার স্ত্রীও বোধহয় এতটা বোঝে না। ধরো আমার মেজাজ খারাপ‚ বউকে বললাম‚ ‘এটা কি বানিয়েছ? একদম বিচ্ছিরি স্বাদ।’ তবেই সেরেছে‚ সেদিন আর খাবার জুটবে না কপালে। হা হা হা…!”

“এখানে ভাবীর দোষ নেই। আপনার মেজাজ যেমনই থাক‚ সে কারণে আপনি অন্যের রান্নার নিন্দা করতে পারেন না।

রান্না যেমনই হোক‚ সংসার টিকিয়ে রাখার অন্যতম শর্ত- রান্না খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা!”

“বাহ! অসাধারণ বলেছ‚ গ্রেট বলেছ! লাইক!!” লাইক দেয়ার ভঙ্গীতে আঙুল তুলে দেখালেন তিনি। ঠিক তখনই মার্থা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসল।

আমি আর সুমন ভাই আমেরিকার একটা হাসপাতালে কাজ করি‚ মার্থা আমাদের সহকর্মী। আমার ডিউটি আওয়ার শেষ‚ সুমন ভাইয়ের শুরু‚ ঘরে ফেরার আগে একটু আড্ডা দিয়ে নিচ্ছিলাম। প্রতিদিনই কাজটা করি আমরা অবশ্য।

মার্থার চেহারা দেখে বুঝলাম যে কোন সিরিয়াস পেশেন্ট এসেছে‚ সুমন ভাইকে যেতে হবে। আজ আমাদের আড্ডার এখানেই সমাপ্তি।

মার্থা বলল-“ড. আহমেড‚ সড়ক দুর্ঘটনার একজন ভিক্টিম এসেছে‚ ব্রেইন হেমোরেজ হয়েছে বোধহয়। অবস্থা গুরুতর। জলদি আসুন।”

সুমন ভাই কালক্ষেপন না করে উঠে দাড়ালেন এবং মার্থার মতোই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেরোলেন কেবিন থেকে। সুমন ভাইয়ের পুরো নাম সুমন আহমেদ‚ এখানকার লোকেরা ডাকে ড. আহমেড। আমার নাম অপু তানভীর‚ এরা ডাকে ড. টানভীর।

আমারও ঘরে ফেরার সময় হয়েছে‚ অফিস ব্যাগটা হাতে

নিয়ে উঠে দাড়ালাম আমি। বড় বড় কয়েকটা চুমুক দিয়ে শেষ করলাম কফিটুকু। তারপর বেরিয়ে এলাম বাইরে।

বেরিয়ে যাবার সময় রিসেপশনিস্ট মেয়েটা অন্যান্য দিনের মতোই আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি হাসল। তার হাতে আইডি কার্ড জাতীয় একটা কিছু দেখতে পেয়ে আগ্রহী হয়ে কাছে গেলাম।

“এটা কার পরিচয় পত্র লিন্ডা? টিভিতে দেখা এস্ট্রোনাটদের আইডি কার্ডের মতো দেখাচ্ছে!”

“ঠিকই ধরেছেন ড. টানভীর‚ গাড়ি দুর্ঘটনায় যে পেশেন্ট এসেছে‚ সে ফাইবার সিক্সটি এইটের এক কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার ছিল।”

“কি বললে? ফাইবার সিক্সটি এইট? সেই বিখ্যাত স্পেসশিপ? সেটা তো তিন বছর পর আজই পৃথিবীতে ফিরেছে বোধহয়। তাই না?”

“হ্যা। এই লোকটাও তাতে ছিল সম্ভবত।” লিন্ডা পেশেন্টের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল।

“এটা কি? লগবুক মনে হচ্ছে? স্পেসশীপেরও কি লগবুক থাকে নাকি! একটু দেখতে পারি লিন্ডা?”

সাধারণত পেশেন্টের জিনিসপত্র এভাবে কাউকে দেখতে দেয়ার নিয়ম নেই‚ নিয়ম না থাকলেও লিন্ডা কি ভেবে

লগবুকটা দিল আমাকে।

বাসায় যাবার পরিবর্তে নিজের কেবিনে ফিরে এলাম আমি‚ লগবুকের মতো দেখতে খাতাটা নিয়ে বসলাম। এস্ট্রোনাটদের জীবন নিয়ে আমার ভীষণ আগ্রহ।

লগবুকটা খুলতেই বুঝলাম‚ এটা মোটেই লগবুক নয়‚ ব্যক্তিগত ডায়েরি। অন্যের ডায়েরি পড়া গর্হিত কাজ। কিন্তু বাঙালী কৌতূহলের কারণেই কি না জানে‚ আমি ডায়েরির ভিতরটায় উঁকি দিলাম।

প্রথম পেইজে নীল কালি দিয়ে প্যাঁচানো হাতে কয়েকটা লাইন লেখা-

“আমার নাম জেমস ফার্নান্দেজ । ২১৩২ সালে প্যারিসের অত্যন্ত শস্তা একটা হাসপাতালে আমার জন্ম। এটা আমার ব্যক্তিগত ডায়েরি। কোন শালা যদি এই ডায়েরি হাতে নিয়ে থাকো তাহলে এখনই রেখে দাও‚ নইলে কষে একটা লাথথি মারব তোমার পশ্চাৎদেশে!”

পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এই ধরনের কথা একদমই আশা করিনি। তবে জেমস ফার্নান্দেজের লাথি খাবার ভয়ে দমে গেলাম না আমি। পাতা উল্টে পড়ে যেতে লাগলাম ডায়েরিটা।

বুঝলাম‚ জেমস অনিয়মিত লেখক ছিল। কখনো ঘন ঘন লিখত‚ কখনো অনেকদিন পর পর। তারিখগুলো তার প্রমাণ। তবে‚ বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটনা ছিল সেখানে। আমি পড়ায়

ডুবে গেলাম।


জেমস ফার্নান্দেজ এর ডায়েরি থেকে

২১-৩-২১৬৩
পত্রিকায় অনেক নাম শুনেছিলাম ফাইবার সিক্সটি এইট নামক স্পেসশীপের। বিভিন্ন গ্রহে প্রাণী অনুসন্ধানের জন্য নির্মিত বিজ্ঞান কাউন্সিলের তৈরি এটা দ্বিতীয় স্পেসশিপ‚ অনেক আধুনিক এবং উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন।

প্রাথমিকভাবে আমি অনেক গর্বিত হয়েছিলাম এই স্পেসশীপের সদস্য হবার সুযোগ পেয়ে। আমার গর্ব পরদিনই উবে গেল‚ যখন জানলাম যে স্পেসশীপটিতে সবচেয়ে নিচু শ্রেণীর কর্মকর্তা হলাম আমি। নিম্নশ্রেণীর কিছু রোবট আছে বটে ফাইবার সিক্সটি এইটে‚ কিন্তু আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন নিম্নশ্রেণীর কর্মী নেই।

২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৪ ঘন্টাই আমাকে কাজ করতে হয়। দিনরাত বসে থাকতে হয় কমিউনিকেশন রুমে। স্ক্রীনের আঁকাবাঁকা রেখার গাণিতিক বিশ্লেষণ করতে করতে আমার সময় পার হয়।

মাত্র এক সপ্তাহ হলো আমি এখানে এসেছি‚ এরই মধ্যে দম বন্ধ হবার যোগার হয়েছে আমার। দিন রাত কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকার অভ্যেস এবং প্রশিক্ষণ আমার আছে‚ কিন্তু ফাইবার সিক্সটি এইটে যে পরিমাণ কাজ করতে

হয়‚ তাতে একটি প্রথম শ্রেণীর রোবটও বোধহয় বিদ্রোহ করে বসবে। সবচেয়ে ভয়ংকর যে বিষয় আমার জন্য‚ সেটা হলো পুরো কাজের ভেতর কোন বৈচিত্র্য নেই। একই রকম ডাটা প্রসেসিং করতে হয় সারাক্ষণ‚ একঘেয়েমি কাটিয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। কোন কুক্ষণে এই স্পেসশিপে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কে জানে!

৩-৪-২১৬৩
আমি মোটামুটি রোবট হয়ে গেছি। একটি তৃতীয় শ্রেণীর রোবট এবং আমার মধ্যে ফিজিওলজিক্যাল পার্থক্য ছাড়া আর কোন ধরনের পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। দিনগুলো কাটছে অমানুষিক ব্রেইন ওয়র্ক এবং একঘেয়েমির মধ্য দিয়ে।

৪-৭-২১৬৩
মা কে মনে পড়ছে। মা কে হারিয়েছি খুব ছোটবেলায়। দু’বার হারিয়েছি মা কে। প্রথমবার‚ যখন সে বিয়ে করল আমার সৎ বাবাকে। দ্বিতীয়বার যখন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ওপারে পারি জমাল সে।

প্রায়ই আকাশের তারা দেখি আজকাল। স্বর্গ কিংবা নরক‚ যেখানেই থাক জিনিসগুলো‚ নক্ষত্র কিংবা গ্রহের ফাঁক-ফোঁকরে‚ অথবা গ্যালাক্সির চূড়োয়‚ কৃষ্ণ গহবরের অভ্যন্তরে‚ যেখানেই থাক‚ খুঁজে পেতে ইচ্ছে হয় ভীষণ।

১৩-৮-২১৬৩
এখানে কাজের চাপ বেশ কমেছে। আমরা কেপলার ১১৯ সি নামক একটা গ্রহে অবতরণ করেছি। এক সপ্তাহ এখানেই

থাকব। টিকটিকির মতো দেখতে কিছু ক্ষুদ্র প্রাণী পাওয়া গেছে এখানে। সে সব নিয়ে প্রাথমিক গবেষণা এবং উচ্চতর অনুসন্ধান চলছে।

স্পেসশিপ নিশ্চল থাকলে আমাকে তেমন কোন কাজ করতে হয় না। প্রায় শুয়ে বসেই দিন কাটাই। এতদিন কাজের চাপে থেকে থেকে অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় এখন অবসরও সহ্য হচ্ছে না‚ কেমন যেন বিদ্ঘূটে অনুভূতি হচ্ছে।

রোবটদের সাথে আজকাল আমি বেশ গল্প করি। এখানকার মানুষগুলো সবাই এত ব্যস্ত যে‚ কাজের বাইরে তেমন কথা বলার সুযোগ নেই। কেউ বিরক্ত করতে ভালোবাসে না‚ বিরক্ত হতেও না। রোবটগুলোই যা ভরসা।

এখানে ইরি নামের একটা রোবট আছে। আমি প্রথম প্রথম রোবটটির সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করতাম‚ কারণ এটাই একমাত্র মেয়েলি নামের রোবট স্পেসশিপে। তবে সেই সঙ্গে মাথামোটাও‚ তাই বন্ধুত্ব তেমন এগোয়নি।

১৬-৭-২১৬৩
আজ উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে। আমি যে এতটা বুদ্ধিমান আমার নিজেরও ধারণা ছিল না।

এই গ্রহে টিকটিকিসদৃশ প্রাণীগুলোকে সেদিন স্পেসশিপে মুক্ত অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল‚ এদের জীবন যাপন সম্পর্কে জানার জন্য। এরা কোন ভাষায় কথা বলে‚ আদৌ ভাব আদান প্রদান করে কি না‚ এসব জানার চেষ্টা চলছিল।

একদিন আমার কমিউনিকেশন রুমের ফ্রিকোয়েন্সি রেগুলেটর যন্ত্রের উপর বসে পড়ল একটা জন্তু। বসেই টিকটিকির মতো‚ তবে অন্যরকম ফ্যাসফ্যাসে গলায়‚ নির্দিষ্ট বিরাম নিয়ে আওয়াজ করয়ে লাগল-

“ক্যাক কোক কোক কোক কোক!”

“ক্যাক কোক কোক ক্যাক কোক কোক।”

প্রাণীগুলো এ ধরনের আওয়াজ করে সেটা আমরা জানতাম‚ কিন্তু কথাগুলোর অর্থ বের করতে পারেনি এখানকার জীববিজ্ঞানীরা।

আমি পারলাম।

যেসব প্রাণী একই রকম শব্দ উচ্চারণ করে‚ তারা সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্ক ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এই প্রাণীগুলোর ক্ষেত্রে সেটা একদমই ভুল প্রমাণিত হলো। এরা সব শব্দ সমান কম্পাঙ্কে উচ্চারণ করে থাকে।

কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম যে‚ প্রাণীগুলো দু’ভাবে শব্দ উচ্চারণ করে; ক্যাক এবং কোক। একটিকে এক এবং অপরটিতে শূন্য ধরলে কিছু বাইনারি রাশি পাওয়া যায়। যেমন-

১০০১১১১
১১০০১১০
১১০০০
১১১১১
১১০০০১
১১০১১

কয়েক বছর আগে প্রাণীবিজ্ঞানী উইলিয়াম রবার্ট বলেছিলেন উন্নত শ্রেণীর প্রাণীরা বাইনারি সংখ্যায় নিজেদের মধ্যকার ভাব আদান প্রদান করে থাকে। তার এই মতবাদ বেশ শক্তপোক্ত হলেও ছিল প্রমাণহীন। কিন্তু এই টিকটিকি সদৃশ প্রাণিগুলোর ক্ষেত্রে এই মতবাদ প্রযোজ্য হতে পারে বলে ধারণা হলো আমার।

বিষয়টা জীববিজ্ঞানীদের কানে তুললাম। তারা বেশ গুরুত্বের সাথেই নিল বিষয়টা এবং নতুন করে গবেষণা শুরু করল। গবেষণার ফলাফল হলো বিস্ময়কর‚ প্রাণীগুলো সত্যিই বাইনারি নিয়মে ভাবের আদান প্রদান করে। এমনকি সে সব কথার দুয়েকটা বুঝতেও শুরু করল গবেষকরা।

এ কারণে‚ আজ শুধু আমাকে সংবর্ধনা দেয়ার উদ্দেশ্যে ফাইবার সিক্সটি এইটে একটা ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমার ক্ষুদ্র জীবনে এটা বোধহয় সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। জীবনে প্রথম আমার মতো ব্যক্তিত্বহীন একজন মানুষ আসরের মধ্যমণি হতে পারল।

(এ পর্যন্ত পড়ার পর আমাকে ক্ষ্যান্ত দিতে হলো। কারণ জেমস ফার্নান্দেজের ডায়েরির বাকী পৃষ্ঠাগুলো জুড়ে আছে অনেকগুলো টেকনিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ।

এমনিতেও ডায়েরিটা খুব বেশি বড় নয়। ফাঁকা ফাঁকা করে লেখা। পুরোটা শেষও হয়নি।

এরপরও ইংরেজি কিছু লেখা আছে যেগুলোতে কোন দিন তারিখ দেয়া নেই। লেখাগুলোর বাংলা অনুবাদ করলে অনেকটা এমন দাড়ায়-)

লেখা-১
আমি প্রেমে পড়েছি। আমার প্রেমে পড়ার বিষয়টা মোটেও সরল সহজ নয়। খুব একটা জটিলও নয়‚ তবে অদ্ভুত।

আমরা চলতে শুরু করার দু বছর পরের কথা‚ একটা এশিয়ান স্পেসশিপ আমাদের সঙ্গে একই পথে যাচ্ছিল‚ সেখানকার কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার একটা মেয়ে‚ যার নাম টিনা। সেই স্পেসশিপ হতে আমাদের স্পেসশিপে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলো। টিনা নামের মেয়েটাই কথা বলল-

“পাথভিউয়ার থেকে কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার টিনা বলছি‚ ফাইবার সিক্সটি এইটের সহযোগিতা প্রয়োজন আমাদের।”

এই নির্জন নক্ষত্রদেশে এমন সুললিত‚ সুমিষ্ট কন্ঠের একটা মেয়ের কন্ঠ শুনতে পেয়ে আমি মুহুর্তেই তার প্রেমে পড়ে গেলাম। হয়তো দীর্ঘদিন নিঃসঙ্গ এবং নারীসঙ্গবঞ্চিত থাকার ফল।

“কি ধরনের সহযোগিতা দরকার তোমাদের টিনা?”

“আমাদের স্পেসশিপের ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা ধরতে পারছে না সমস্যাটা‚ তোমাদের ওখানে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার আছে‚ তোমরা আমাদের সহযোগিতা করতে পারবে?”

“আমি আমাদের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলে জানাচ্ছি তোমাকে।”

আমাদের স্পেসশিপের ক্যাপ্টেনের নাম নিকোলাস মারভিন। তিনি ৭ম পর্যায়ের বিজ্ঞানী। বিজ্ঞান একাডেমিতে ৬ষ্ঠ পর্যায়ের বিজ্ঞানী আছে মাত্র ৪ জন। ৭ম পর্যায়ের একজনই আছে ‚ নিকোলাস মারভিন। এর চেয়ে উঁচু কোন পদ বিজ্ঞান একডেমিতে নেই। ফাইবার সিক্সটি এই কারণেই বিখ্যাত যে‚ তার মতো বড় বিজ্ঞানী এই স্পেসশিপের নেতৃত্ব দিচ্ছে।

মহাশূন্যে অন্য কোন স্পেসশিপের সাথে যোগাযোগ হলে অবশ্যই সেটা ক্যাপ্টেনকে জানাতে হবে‚ এটাই নিয়ম। আমি ক্যাপ্টেনের কক্ষের কমিউনিকেশন মডিউলটি অন করলাম।

“মি. ফার্নান্দেজ‚ কি চান আপনি?”

কথা বলল ক্যাপ্টেনের ব্যক্তিগত রোবট মিডিকাস। ৭ম শ্রেণীর কোন বিজ্ঞানী স্পেসশিপের কারো সাথে সরাসরি দেখা করেন না‚ কথাও বলেন না‚ নিয়ম নেই। বিজ্ঞান একাডেমি তাদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর আগেও কয়েকবার মহাশূন্যে স্পেসশিপের ক্রুরা ক্যাপ্টেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে-এমন ঘটনা ঘটায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজ্ঞান একাডেমি।

আমি মিডিকাসকে পাথভিউয়ার স্পেসশিপটির কথা খুলে বললাম। মিডিকাস একটু কঠিন সুরে বলল-

“ক্যাপ্টেন মারভিন এই বিষয়ে অনেক আগেই বলে রেখেছেন‚ চলমান অবস্থায় বিদেশী কোন স্পেসশিপকে এই ধরনের সহযোগিতা পাঠানো যাবে না। ফাইবার সিক্সটি এইট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল স্পেসশিপ‚ আমরা কোন ধরনের ঝুঁকি নেব না আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে।”

“কিন্তু মিডিকাস‚ আমরা যদি সহযোগিতা না পাঠাই‚ ওরা হয়তো মারা পড়বে।”

“সেটা আমাদের মাথাব্যাথা নয়।”

এই সুমিষ্ট কন্ঠধারিনী নক্ষত্রকন্যা আমাদের সহযোগিতা না পেয়ে মহাশূন্যে বিপদে পড়বে‚ এমনকি মারাও পড়তে পারে‚ এ বিষয়টা আমি এত সহজে মেনে নিতে পারলাম না।

“মিডিকাস‚ আমি ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলতে চাই।”

“বোকার মতো কথা বলবেন না ফার্নান্দেজ। আপনি জানেন স্পেসশিপের নিয়ম‚ জানেন না?”

“হ্যা জানি‚ আমি নিয়ম ভেঙে হলেও পাথভিউয়ারকে সহযোগিতা করতে চাই।”

“আপনার প্রতি আমার নির্দেশ‚ পাথভিয়ারকে জানিয়ে দিন যে আমরা তাদের সহযোগিতা পাঠাতে পারব না।”

“তুমি আমাকে নির্দেশ দেয়ার কে? তুমি একটা গর্দভ রোবট ছাড়া কিছুই নও।”

মিডিকাস হুংকারের মতো করে বলল-
“আপনার এই আচরণের জন্য আপনাকে এক দিনের কারাদণ্ড দেয়া হলো ফার্নাদেজ!”

লেখা-২
স্পেশশিপে কারাবাস মোটেও সুখকর নয়। কয়েদীকে সম্পূর্ণ অন্ধকার একটা কক্ষে আটকে রাখা হয় পুরোটা সময়‚ একবিন্দু আলো আসতে পারে না কোন জায়গা হতে। ঘুমোতে দেয়া হয় না‚ বিশেষ গ্যাস ছেড়ে দেয়া হয় রুমের ভেতর; এই গ্যাসের প্রভাবে চাইলেও কেউ ঘুমোতে পারবে না।

মজার বিষয়‚ এই একদিনের কারাবাস আমার কাছে মোটেও

দুঃসহ লাগেনি। এমনকি কিছুক্ষণের জন্য আমার হালকা তন্দ্রামতোও এসেছিল। হ্যালুসিনেশন কিংবা স্বপ্ন‚ কিছু একটা দেখেছিলাম আমি সেই সময়ে।

দেখেছিলাম কেউ একজন আমার খুব কাছে এসে‚ গা ঘেঁষে বসেছে। নরম নারীদেহের ছোঁয়া অনুভব করেছিলাম তখন। তারপর ফিসফিসে মিষ্টি গলায় সেই কেউ একজন বলেছিল-“মন খারাপ কোরো না‚ আমি জানি তুমি চেষ্টা করেছ। দেখো‚ আমার কিছু হবে না। পৃথিবীতে নেমেই আমি তোমায় নিয়ে কোন সমুদ্র তীরে বেড়াতে যাব। খুব ভালোবাসাবাসি করব আমরা।”

আমার একদিনের কয়েদজীবন শেষ হতেই আমি কম্পিউটারে ডাটাবেজ নিয়ে বসলাম। পাথভিউয়ারে যে সব বিজ্ঞানীরা কাজ করছে তাদের তালিকা বের করতেই টিনাকে খুঁজে পেলাম। টিনাও আমার মতোই কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার। সোনালী চুলো‚ রূপসী এক মেয়ে। আমি মুগ্ধ হলাম ওকে দেখে।

লেখা-৩
পাথভিউয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা ছোট গ্রহে আছড়ে পড়েছে‚ কেউ বাঁচতে পারেনি পুরো স্পেশশিপে‚ টিনাও নয়। আমরা পাথভিউয়ারের ধবংসাবশেষের ছবি বিজ্ঞান কাউন্সিলে পাঠিয়ে দিয়েছি।

এই মুহূর্তে অসহ্য রাগে আমার সারা শরীর জ্বলছে। আমি এককভাবে ক্যাপ্টেন মারভিসকে দায়ী করছি পাথভিউয়ারের

পরিণতির জন্য। ক্যাপ্টেন মারভিস অনেক বড় বিজ্ঞানী কিন্তু একই সাথে অনেক বড় অমানুষও। আমি ঠিক করেছি আজ রাতে (যদিও এখানে দিনরাত বলে কিছু নেই‚ কিন্তু ঘুমানোর জন্য একটা সময় আমরা বেছে নিয়েছি; এটাকেই রাত বলি) এই অমানুষকে গলা টিপে হত্যা করব। তারপর যা হয় হবে।

কাজটা সহজ হবে না। ক্যাপ্টেন মারভিসের কক্ষের বাইরে সারাক্ষণ কয়েকটি প্রহরী রোবট পাহাড়া দেয়। রোবটগুলো ভয়ানক ধবংস ক্ষমতা সম্পন্ন। কিন্তু আমি পরোয়া করি না। বিপদে আত্মরক্ষার জন্য স্পেশশিপের সবার কাছেই একটি করে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। আমার কাছেও আছে। সেটা ঠিকমতো চালাতে পারলে রোবটগুলোকে কাবু করা সম্ভব। কিন্তু গোলাগুলি শুরু হলে নিরাপত্তা বিভাগের কর্মী এবং রোবটও ছুটে আসবে। সবাইকে কাবু করা সম্ভব নয়। তাই প্রথমে ক্যাপ্টেনের কক্ষ থেকে বাকী স্পেসশীপের যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। ক্যাপ্টেনের কক্ষ স্পেশশিপের একদম শেষ মাথায়‚ তার কক্ষের বাইরের করিডোরের দরজাটা কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখা সম্ভব‚ কিছু টেকনিক্যাল কাজ সেরে নিতে হবে সে জন্য আগে থেকে। এই সময়ের মধ্যেই আমি ক্যাপ্টেনকে হত্যা করব।

এটাই হয়তো আমার শেষ লেখা‚ কি জানি!

লেখা-৪
আমি হতবাক‚ বিস্মিত‚ স্তব্ধ! ফাইবার সিক্সটি এইটে কোথাও বড় ধরনের সমস্যা আছে‚ খুব গভীর কোন ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে! আজ যা হলো‚ তার কোন ব্যখ্যা নেই আমার কাছে।

সংক্ষেপে বলি-

আমি স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ক্যাপ্টেনের কক্ষে গেলাম। প্রহরী রোবট জিজ্ঞেস করল-

“ফার্নান্দেজ‚ আপনি যাচ্ছেন কোথায়?”

“আমি ক্যাপ্টেনকে খুন করতে যাচ্ছি। কোন সমস্যা?”

বলেই আমি আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রিগারে আঙুল চেপে ধরলাম। গুলি করার জন্য প্রস্তুত আমি পুরোপুরি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রোবটটা বলল-

“ঠিক আছে‚ যান।”

আমি ভয়াবহ বিস্মিত হলাম। কিন্তু বিস্ময় চেপে‚ দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম ক্যাপ্টেনের কক্ষে। এরপর বিস্ময়ের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলাম।

পুরো কক্ষটা খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কেউ নেই‚ কিছুই নেই। কোন আসবাবপত্র কিংবা কম্পিউটারও নেই‚ সম্পূর্ণ শূন্য।

“আপনি কিছু বুঝতে পেরেছেন ফার্নান্দেজ?”

“কে? কে কথা বলে?”

“আমি মিডিকাস। ক্যাপ্টেনের কম্পিউটার।”

“ক্যাপ্টেন? ক্যাপ্টেন কোথায়?”

“ফাইবার সিক্সটি এইটের কোন ক্যাপ্টেন নেই‚ ক্যাপ্টেন নিকোলাস মারভিন একটি কাল্পনিক চরিত্র!”

“মানে? একটা কাল্পনিক চরিত্রকে কেন বিজ্ঞান কাউন্সিল সপ্তম পর্যায়ের বিজ্ঞানী হবার মর্যাদা দেবে? কেন ফাইবার সিক্সটি এইটের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা স্পেসশিপের ক্যাপ্টেন বানাবে?”

“আমার জানা নেই। বিজ্ঞান একাডেমিই ক্যাপ্টেন মারভিসকে সৃষ্টি করেছে। কেন‚ তারাই ভালো জানে।”

আমি দুর্বল পায়ে নিজের কক্ষে ফিরে এলাম। বিজ্ঞান একাডেমি বড় ধরনের কোন খেলা খেলছে‚ আমরা সবাই বোধহয় সেই খেলার ঘুটি।

লেখা-৫
ক্যাপ্টেনের অস্তিত্বহীনতার কথা ফাইবার সিক্সটি এইটের সবাই জানে। আমিই জানিয়েছি।

ফাইবার সিক্সটি এইট পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছে। কারণ আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল কেপলার ২২৯ বি গ্রহটি। এই গ্রহটিকে মহাশূন্যের সবচেয়ে অজানা এবং বিপদসঙ্কুল গ্রহ মনে করা হয়। এমন একটা গ্রহে ক্যাপ্টেনবিহীন স্পেশশিপ নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

তাছাড়া‚ আমাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন হবার যোগ্যতাও নেই কারও। কারণ ক্যাপ্টেন হতে হলে কমপক্ষে ৫ম পর্যায়ের বিজ্ঞানী হতে হয়। আমাদের মধ্যে কোন ৫ম পর্যায়ের বিজ্ঞানী নেই; সবাই ৩য়-৪র্থ শ্রেণীর।

লেখা-৬
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৃথিবীতে ফিরব। জানি না কেন‚ পৃথিবীটাকে কেন যেন নিরাপদ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওখানে কোন ভয়ানক নিপদ ওৎ পেতে আছে আমার জন্য।


অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরোতেই আমি সুমন ভাইয়ের হাত চেপে ধরলাম‚

“সুমন ভাই‚ পেশেন্টের কি অবস্থা?”

সুমন ভাই মুখ থেকে মাস্ক নামিয়ে উদাস গলায় বলল-
“বাঁচানো গেল না।”

আমি দুঃখী হলাম‚ আশাহত হলাম। জেমস ফার্নান্দেজের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন নিকোলাস মারভিনের রহস্য সমাধানহীন অবস্থায় শেষ হয়ে গেল। তবে বোধহয় ফার্নান্দেজের মৃত্যু এক্সিডেন্ট নয়‚ খুন।

বিজ্ঞান একাডেমি কিছু একটা করতে চাইছে‚ খুব বড় মাপের

কোন ষড়যন্ত্র চলছে ভেতরে ভেতরে। আমার মতো ছাপোষা ডাক্তারের পক্ষে সেটা ভেদ করা বোধহয় সম্ভব নয়।

দুঃখী মনে যখন গাড়ি ড্রাইভ করে ঘরে ফিরছিলাম‚ ঠিক তখন বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল মাথায়। সাথে সাথে আমি গাড়ি থামালাম।

হ্যা‚ এভাবে চিন্তা করলে সব মিলে যায়। আমি প্রচন্ড উত্তেজিত হলাম ক্যাপ্টেন নিকোলাস মারভিনের রহস্য ভেদ করতে পেরে!

আমি ঠিক করলাম বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করব। তবে তখনকার মতো ঘরে ফিরে এলাম।

সেদিন রাতেই আমি বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্টের কাছে ইমেইল পাঠালাম‚ ইমেইলে এমন কিছু লিখলাম‚ যে পরদিন সকালেই একাডেমি থেকে গাড়ি পাঠানো হলো আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।


আমি এই মুহুর্তে বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্টের কক্ষে বসে আছি। বেশ সুসজ্জিত কামরা। একটা ক্রে ওয়ান সেভেন্থ জেনারেশন কম্পিউটার ছাড়া আর কোনো মডার্ন ইকুইপমেন্ট নেই। জানালার কাছে একটা টবে জেসমিন ফুল ফুঁটেছে। গন্ধে ম ম করছে কামরাটা।

প্রেসিডেন্টের চেহারাও হাসিখুশি। বয়স খুব বেশি বলে মনে হচ্ছে না। ৪০ এর আশেপাশে হতে পারে। পরিপাটি পোষাক পরা নিপাট ভদ্রলোক; বিজ্ঞানীর চেয়ে ব্যবসায়ী ভাবটা প্রবল।

গলা খাঁকড়ি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ভরাট গলায় বললেন-

“ডক্টর টানভীর, আপনি একটা মেইল পাঠিয়েছেন আমাকে। বলেছেন দেখা করতে চান। কারণ হিসেবে বলেছেন যে আপনি জেমস ফার্নান্দেজের মৃত্যু রহস্য জানেন। ঠিক বলেছি?”

“হ্যা, ঠিক বলেছেন। আমি জেমস ফার্নান্দেজ রহস্যের সবকিছু জানতে চাই।”

“তার আগে বলুন, আপনি ফার্নান্দেজের বিষয় কেমন করে জানেন?”

“সে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। একটা ডায়েরি পেয়েছি তার কাছে‚ যেখানে ফাইবার সিক্সটি এইটের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লেখা আছে।”

“আপনি ছাড়া আর কেউ পড়েছে ডায়েরিটা?”

“না!”

“গুড! ডায়েরিটা সঙ্গে এনেছেন?”

“হ্যা।”

আমি দিলাম তাকে ডায়েরিটা। তিনি আগ্রহের সাথে পড়া শুরু করলেন।

“আপনার জন্য কফি আনতে পাঠিয়েছি ডক্টর টানভীর। আপনি কফি খেতে থাকেন‚ ততোক্ষণে আমি পড়তে থাকি।”

কিছুক্ষণ পর ডায়েরি পড়া শেষ হতে প্রেসিডেন্ট বললেন-“আমার কেন মনে হচ্ছে যে আপনি এমন কিছু জানেন যা এই ডায়েরিতে নেই?”

আমি হেসে বললাম-
“কারণ আমি এমন কিছু জানি যা এই ডায়েরিতে নেই।”

“আচ্ছা বেশ!”

তিনি প্রশ্ন না করে আমার বলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমি গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম-

“আমি জানি যে জেমস ফার্নান্দেজ ভুল ভেবেছিল। ক্যাপ্টেন নিকোলাস মারভিন কোন কাল্পনিক চরিত্র নয়‚ কাল্পনিক চরিত্র হলো জেমস ফার্নান্দেজ। ফার্নান্দেজ একজন অস্তিত্বহীন মানুষ। প্রকৃতপক্ষে জেমস ফার্নান্দেজ এবং নিকোলাস মারভিন একই ব্যক্তি।”

“সাবাশ! আপনার তো ডাক্তার না হয়ে ডিটেক্টিভ হওয়া উচিত ছিল! যাই হোক‚ আপনার ধারণার পক্ষে যুক্তি দিন।”

“এক‚ আপনাদের ওয়েবসাইটে ফাইবার সিক্সটি এইটের সব যাত্রীর নাম আছে‚ ক্যাপ্টেন মারভিনেরও। কিন্তু জেমস ফার্নান্দেজের নাম নেই। দুই‚ জেমস ফার্নান্দেজ যেভাবে বাইনারি সংখ্যা আর ভাষার সম্পর্ক আবিস্কার করল‚ সেটা তার বুদ্ধিমত্তা অনুযায়ী বেশ অস্বাভাবিক। তাছাড়া বাইনারি ভাষার গবেষক উইলিয়াম রবার্ট এবং নিকোলাস মার্ভিনের বন্ধুত্বের কথাও শোনা যায়। মারভিন আর ফার্নান্দেজ যে একই ব্যক্তি‚ এই ধারণাটা আরো শক্ত ভিত্তি পায় এ তথ্য হতে। যুক্তি তিন- ফার্নান্দেজ এবং মারভিন; দু’জনের কারো ছবিই ইন্টারনেটে নেই। বিজ্ঞান একাডেমি যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে দু’জনকে গোপন রাখার চেষ্টা করেছে সেটা পরিস্কার। এসব ছাড়াও‚ আমার ইনটিউশান বলছিল যে ফার্নান্দেজ এবং মারভিন- দু’জন একই মানুষ।”

“আপনার মাথা পরিস্কার। কিন্তু বলুন তো‚ আপনি এই রহস্য সমাধানের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন কেন? আপনার স্বার্থটা কি?”

“কোন স্বার্থ নেই। স্রেফ কৌতূহল!”

“ভেরি স্ট্রেঞ্জ! যাক‚ বলুন তো আপনি কি কি জানতে চান?”

” ফার্নান্দেজকে খুন করা হয়েছে? নাকি গাড়ি চাপা পড়েই মারা গিয়েছে সে?”

“খুন করা হয়েছে। আমিই নির্দেশ দিয়েছিলাম তাকে খুন করার জন্য।”

“কেন?”

“এটা প্ল্যানের অংশ ছিল।”

“কিসের প্ল্যান?”

“সেটা আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই। তারপরও বলি।

সবকিছু শুরু হয় তিন বছর আগে। যখন প্রেসিডেন্ট জোনাথন ক্ষমতায় আসেন। কেপলার ২২৯ বি গ্রহটিতে প্রচুর পরিমাণে এক ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল‚ যা দিয়ে ইউরেনিয়ামের চেয়েও শক্তিশালী পারমানবিক বোমা বানানো সম্ভব। বিজ্ঞান একাডেমি যখন সেই গ্রহে প্রাণী অনুসন্ধানের পায়তারা করছে‚ ফাইবার সিক্সটি এইটকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে‚ প্রেসিডেন্ট জোনাথন তখন বিজ্ঞান একাডেমীকে নির্দেশ দিলেন যে কেপলার ২২৯ বি থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থও নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু আমি সেটা হতে দিতে চাইনি। কারণ যদি একবার প্রেসিডেন্ট জোনাথন সেটা পেয়ে যায়‚ তাহলে গায়ের জোরেই দুনিয়ার বাকী রাষ্ট্রগুলো দখল করে নিতে চাইবে‚ লাখো কোটি মানুষ মারা যাবে তখন‚ বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাবে। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। কারণ বিজ্ঞান একাডেমির

প্রেসিডেন্টের চেয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট অনেক ক্ষমতাশালী।

তখন একটা কাজ করলাম আমরা। নিকোলাস মারভিনের মস্তিস্কে জেমস ফার্নান্দেজ নামক একজন মানুষের কাল্পনিক স্মৃতি ঢুকিয়ে দিলাম। একই সাথে নিকোলাস মার্ভিনের কৈশোর বয়সের প্রেমিকা‚ যার সাথে পরে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে‚ সেই টিনার সঙ্গে যোগাযোগ করানোর ব্যবস্থাও করলাম। বাকীটুকুও পূর্বপরিকল্পিত ছিল; নিকোলাস মারভিনের অস্তিত্বহীনতা জেনে যাওয়া‚ পাথ ভিউয়ারের ধবংস হয়ে যাওয়া‚ সব। মানবজাতির মঙ্গলের কথা ভেবে এ ব্যাপারে আমাদে সাহায্য করেছে এশিয়ান বিজ্ঞান একাডেমীও। ফার্নান্দেজ ওরফে মারভিনকে হত্যা না করলে রহস্যটা ফাঁস হবার সম্ভাবনা ছিল।”

“কিন্তু‚ আপনি কেন সোজাসুজিভাবে ফাইবার সিক্সটি এইটকে ফিরিয়ে আনেননি? জেমস ফার্নান্দেজকে যখন মারবেনই‚ মহাশূন্যেই তাকে না মেরে কেন এত লম্বা নাটক করতে গেলেন?”

“কারণ আমি যদি সোজাসুজিভাবে কাজটা করতাম‚ প্রেসিডেন্ট জোনাথন বিজ্ঞান একাডেমিকে ধবংস করে দিত‚ কিংবা আরেকটা স্পেসশীপ পাঠাত একই উদ্দেশ্যে। দু’টোই মানবজাতির জন্য ভয়াবহ! নাটক করার লাভটা হলো‚ রহস্য তৈরি। ক্যাপ্টেন মারভিন কেমন করে গায়েব হলো‚ এই রহস্যের সমাধান করার আগেই সামনের নির্বাচনে দাড়াতে হবে প্রেসিডেন্ট জোনাথনকে। আর এবারের নির্বাচনে যাতে সে এবং তার পার্টি জয়ী না হয় ‚ সেদিকটাও আমরা দেখছি।”

“প্রেসিডেন্ট জোনাথনকে খুন করলেই কি সমাধানটা সহজ হতো না? পাথ ভিউয়ারের ৫০ জন অভিযাত্রীকে মারলেন‚ ফার্নান্দেজকে মারলেন‚ কেন?”

“প্রেসিডেন্ট জোনাথনকে মারলেও তার দলের অন্য কেউ একই উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করতে পারত! জোনাথনকে মারাও চাট্টিখানি কথা নয়। তার সিকিউরিটি ব্যবস্থা অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের। তাছাড়া বিজ্ঞান একাডেমীর গোপন সভায় তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নাকোচ করা হলে আমার সামনে এই নাটকটুকু করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।”

“যদি আপনার প্ল্যান কাজ না করত? যদি মারভিনের অস্তিত্বহীনতা কেউ টেরই না পেত?”

“টের ঠিকই পেত। একটা প্ল্যান কাজ না করলে আরো কয়েকটা ব্যাক আপ প্ল্যান রেডি ছিল।”

“লিস্টে ফার্নান্দেজের নাম নেই‚ তারপরও তাকে ঢুকানো হলো স্পেসশিপে। ফাইবার সিক্সটি এইটের অন্য কেউ এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি?”

“না‚ কারণ যে কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারের যাওয়ার কথা ছিল‚ সে হঠাৎ করে ফাইবার সিক্সটি এইট পৃথিবী ত্যাগ করার আগের দিন মারা যায়। ফার্নান্দেজ তার জায়গায় এসেছিল।”

“তার মানে আপনাকে ৫১ টা নয়‚ ৫২ টা খুন করতে হয়েছে?”

“নাহ‚ ৫২ টাও নয়‚ ৫৩ টা। আপনাকে সহ।”

“মানে?”

“অকারণ কৌতূহল একটা বাজে জিনিস ড. টানভীর!!”

মূহূর্তের মধ্যে কয়েকটা প্রহরী রোবট আমাকে ঘিরে ফেলল। একই সঙ্গে অবাক এবং ভীত হলাম আমি। তারপরও প্রশ্নটা করলাম-

“এতগুলো মানুষ মারলেন‚ আপনার আর প্রেসিডেন্ট জোনাথনের মধ্যে তো কোন পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি না আমি!”

“ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জনের মাধ্যমেই বৃহৎ স্বার্থ অর্জন হয় ডক্টর।”

প্রহরী রোবটদের আগ্নেয়াস্ত্রের নল আমার দিকে বিদ্ঘুটেভাবে তাকিয়ে আছে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও আমার মস্তিষ্ক বিদ্রুপ করতে ছাড়ল না; একটা বাংলা প্রবাদ মনে করিয়ে দিল-যাহাই বায়ান্ন‚ তাহাই তেপ্পান্ন!

নক্ষত্রকন্যা সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!