সেবার বিজয়া ভৌতিক গল্প – গৌতম ঘোষ-দস্তিদার
এতো বয়স হয়ে গ্যাছে , রীতিমতো ক্লাস ফোরে পড়ি ।আসছে বছর প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে সটান ডে স্কুলে গিয়ে হাজির হবো । অথচ ক্লাসের আর ছেলেদের মতো ভূত দেখিনি কোনোদিন আজ পর্যন্ত । আমিই একমাত্র অড ম্যান আউট যাকে বলে । এই আক্ষেপে নিজের উপর ক্ষোভ দুঃখ অভিমান সেই হাফপ্যান্ট বয়সেই আমায় পেয়ে বসেছিলো । ঠিক এমনি এক দুঃসময়ে উপেন্দ্রনাথের আবির্ভাব । ক্লাসের কেউই ওকে পারতপক্ষে উপেন বোলে ডাকতে চাইতো না । ভূত বোলে খ্যাপাতো । উপেনকে তাই বোলে কোনোদিন খেপে যেতে দেখি নি । উপেন বলতো , “যারা ভূত নয় , তাদের ভূত বললে রাগ করারই কথা , কিন্তু আমি তো সত্যি সত্যি ভূত ; মানুষকে মানুষ বললে তো আর কেউ রাগ করেনা ; তাই আমায়ও ভূত বোললে রাগ কোরি না” ।
নিজেই নিজেকে ভূত বলছে শুনে এবার ক্লাসের প্রায় সব্বাই খানিকটা বেশ ঘাব্ড়েই গ্যালো । ভাবলো, এ ভূত যদি বা না-ও হয় , নিদেনপক্ষে মাথাটা খারাপ । কিন্তু রোজই প্রায় কিছু না কিছু ঘটনায় আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠিত হোয়ে গ্যালো যে, উপেনের মধ্য়ে কোনো একটা ভৌতিক রহস্য যে ভাবেই হোক লুকিয়ে আছে ।
আমাদের ইংরেজি পড়াতেন সুশীলবাবু । বহুবিধ গুণের অধিকারি ছিলেন এই সুশীলবাবু । সবগুলো অবশ্য এই পরিসরে বলা যাবে না । কিন্তু তিনি কথায় কথায় খালি বলতেন, “চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য হয়না” । তারপর সেই মহোত্তম উক্তিটি যথোপযুক্ত দৃষ্টান্ত সহকারে প্রমাণ করার যাবতীয় গুরুদায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিতেন । চল্লিশ মিনিটের ক্লাস এভাবেই অতিবাহিত হোতো । নিজেকে বলতেন, স্বামি বিবেকানন্দের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্য । তাই তিনি প্রত্যেককে কর্মযোগী হবার প্রায় একটা বাধ্যতামূলক পরামর্শ দিয়ে বেড়াতেন । কাউকে তিনি কখনো কোনোভাবেই বাথরুমে যেতে দিতেন না । ওঁর ভার্শনে টয়লেট যাওয়ার কোনো কারণই নেই, ওটা একটা সময়নষ্টের আর জলনষ্টের জায়গা । জল মানে জীবন । বাথরুম যাওয়া তাই জীবনের অপচয় ছাড়া কিছু নয় । বাথরুম যাওয়ার বাসনাকে ত্যাগ না কোরতে পারলে মানবজাতির সমূহ বিপর্যয় । টয়লেটে যাওয়ার সমস্ত আবেদনকে তছনছ কোরে তিনি শুধু বোলতেন, “দ্যাখ আর যা-ই কোরিস, চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য করার চেষ্টা থেকে নিজেকে সবসময় সরিয়ে রাখবি । একবার-ই আমি জীবনে চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য কোরতে গেছিলাম । আমার কী হাল হোয়েছিলো পরে, সে কথা তোদের কী আর বলি…” ব্যস, চললো । আমরা বোলতাম, তেত্তিরিশের ভাঙ্গা রেকর্ড –তা-ও আবার দু-পিঠ শুনতে হবে – একবার নয় , একাধিক বার ।
এহেন সুশীলবাবুকেও একদিন আমাদের সুযোগ্য সতীর্থ উপেনের কাছে হার মানতে হোলো । স্যরের মহৎ কার্যাদির ইতিবৃত্ত তখন ফুল সুইং । উপেন কোত্থেকে টয়লেট দর্শনের দরখাস্ত কোরলো । সুশীলবাবু ওকে যথারীতি ওর প্যান্ট থেকে বেল্টটা খুলে স্যরের কাছে যেতে বোললো । উপেন বেল্টটা নিয়ে স্যরের হাতে দিয়ে নিজে ক্লাস থেকে বেরিয়ে চলে গ্যালো । অদ্ভুত ঘটনা যেটা সেদিন নিজের চোখে দেখলাম , আজ এতোগুলো দশক পরেও মনে পড়লে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় । আমরা সবাই উপেনকে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম ; ব্যতিক্রম রোয়ে গেলেন স্যর একা । তিনি উপেন ওরফে ভূতকে বেল্ট দিয়ে মারতে থাকলেন । ক্লাসের কম কোরেও জনা পয়তিরিশ পুরোপুরি সুস্থ-মস্তিষ্ক ছেলে লক্ষ্য কোরলাম , স্যর উপেনের বেল্ট দিয়ে স্যরের সামনে থাকা টেবিলের উপর কষে কষে বেল্টের বাড়ি দিচ্ছেন আর চিৎকার কোরছেন, “যা, যাবিনা টয়লেটে, যা যা, টয়লেট যাবার জন্যই যখন বাপ-মা স্কুল পাঠিয়েছে , যাচ্ছিস না কেন এখন, যা যা, কী হোলো, বোলছি তো যা” ! অথচ উপেন নিশ্চিন্তে টয়লেট থেকে রিটার্ন ট্রিপ দিয়ে এসে স্বচ্ছন্দে ক্লাসের সেই লাস্ট বেঞ্চে বসে আমাদের সঙ্গে মুচকি মুচকি হাসতে থাকলো । সুশীলবাবুর কিন্তু কোনোদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই । তিনি বেল্ট দিয়ে টেবিল-পেটা কোরেই চলেছেন । শেষকালে নিজেই হাঁপাতে হাঁপাতে বোললেন , এটার তো গণ্ডারের চামড়া পুরোপুরি । আমারই দম ফুরিয়ে গ্যলো , যাহ্ !
টিফিনের ঘণ্টা পড়ে গ্যালো । সুশীলবাবু স্টাফরুমের দিকে হনহন কোরতে কোরতে বেরিয়ে গেলেন । এর দেরি হোলে আর চা পাবেন না । আমরা টিফিন খাবো কি, বিস্ময়ের ঘোর-ই কাটাতে পারছি না ।
উপেন কিন্তু তাই বোলে পরীক্ষায় টুকলি কোরতে জানতো না বা বলা ভালো কোরতো না । চাইলে পারতো কিনা জানি না । সব বিষয়ে-ই উপেন শূন্য পেতো । ওই কেবল ইতিহাস ছাড়া । কোত্থেকে কীভাবে সমস্ত সাল তারিখ আর বংশ পরম্পরায় রাজা-রাজড়ার নাম উপেনের মুখস্থ ছিলো । ইতিহাস পড়াতেন অলোক-বাবু । অলোক-বাবু উপেনকে খুব ভালোবাসতেন । বলতেন , “তুই বিরাট বড় ঐতিহাসিক । তুই আমাদের স্কুলের ইতিহাস পাল্টে দিবি” । উপেন মিচকি মিচকি হাসতো শুনে ।
হ্যাঁ , উপেনকে কেউ কোনোদিন কাঁদতে দ্যাখেনি । ক্লাসের সব পরীক্ষায় ফেল কোরে কোরে ও যাকে বলে একেবারে ইমিউন হোয়ে গেছিলো যেন । শুধু ওই একবার ছাড়া । যেবার উপেনের মা মরে গ্যালো । তারপর বছর না ঘুরতেই উপেনের নোতুন মা এলো । কয়েক মাস যেতে না যেতেই নোতুন মায়ের কোল আলো কোরে উপেনের বোন এলো । উপেনকে ওর বাবা নিয়ে রেখে এলো ওর নিজের মামাবাড়িতে । স্কুল থেকে খুব দূরে নয় । তবু মামাবাড়ি যেদিন গ্যালো সেদিনই স্কুলে এসে উপেন কেঁদেছিলো । হাউহাউ কোরে কেঁদেছিলো । অনেক সান্ত্বনা দিয়েও প্রবীর ওকে শান্ত কোরতে পারলো না ।
কয়েকদিনের মধ্যে পুজো এসে গ্যালো । তখন আমরা টেন-এ । মহালয়ার আগের দিন স্কুল হোয়ে ছুটি পড়ে গ্যালো । উপেন সবাইকে বোললো, যাহ্ তোদের সঙ্গে আর দ্যাখা হবে না , মা দুর্গার সঙ্গে আমিও ভাসান যাবো এবার । আমরা ভাবলাম , ভূত ছিলো ঠিক ছিলো ; এখন তো দেখছি – কেমন জানি পাগোল পাগোল হোয়ে গ্যাছে । ক্লাসের সবাই মিলে বোললাম – এমন কথা ভুলে মুখেও আনবি না – অনেক পুণ্য কোরেও অনেকে মা দুর্গার সঙ্গে ভাসান যেতে পারে না , তুই ভূত হোলি গে এই সেদিনকার ছোকরা । উপেন বোললো , তাহোলে শুনে রাখ – মন চায় তো লিখে রাখ – “এই বিজয়া দশমিতে আমি মরে যাবো । কীভাবে কী হবে , এখুনি বোলতে পারবো না , তবে তোরা সবই জানতে পারবি ,নিশ্চিত থাক একদম” !
সপ্তমির বিকেলে আমরা সবাই একজোট হোয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম । শর্তই ছিলো, ওই শুধু সপ্তমিতে আর কারো সঙ্গে – বিল্ডিঙের বন্ধুদের সঙ্গে – কোচিং ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে – এমনকি বাবা-মা ভাইবোন মানে বাড়ির কারো সঙ্গেও কোনো রঁদে-ভু চলবে না । সপ্তমির সন্ধে শুধু স্কুলের ক্লাসের বন্ধুদের জন্য যাকে বলে রীতিমতো প্রিবুক্ড । গড়িয়াহাটের মোড় থেকে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিকে যেতে প্রথম বাঁদিকের রাস্তার মুখে ছিলো ব্যাম্বিনো-র দোকান । সপ্তমির বিকেলে ব্যাম্বিনো খুলতো না । তাই ঠিক হোতো – ব্যাম্বিনোর সামনে কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় সব্বাইকে পৌঁছে হাজিরা দিতে হবে । কেউ গড়িয়া খালপার, কেউ বা বেহালা পর্ণশ্রী, কেউ বা আরো দূর থেকে চলে এলো ঠিক সময় মতো । এলো না শুধু একজন । সে উপেন – আমাদের সবার প্রিয় ভূত । অবস্থা অনুযায়ী সময় পিছিয়ে সাড়ে পাঁচটা করা হোলো । আর দেরি করা যায় না। কারণ পদব্রজে দেবতাদর্শন । উপরি পাওয়া পথিমধ্যে সাক্ষাৎ দেবীদর্শন – জিবন্ত সে সব দেবীরা – প্যান্ডেলের আলোয় চারিদিক ঝলমল কোরে ওঠা একটা স্বপ্নালু পরিবেশের মধ্যে সেই প্রতিমাদের রাজপাট ।
সাড়ে পাঁচটা পিছিয়ে পোনে ছটা হোলো ! কেন জানি না – সে তো এলো না – কেন এলো না জানি না ! উপেন শেষ অব্দি বাঙ্ক কোরলো । কোনোদিন যা হয়নি এই গ্যালো অর্ধ দশকের ইতিহাসে , তাই হোলো – উপেন এলো না । ভূত-বিহীন আমরা সবাই একটু না একটু দমে গেলাম । পার্কসার্কাস ময়দানের ঠাকুর দেখে ফুচকা খেয়ে প্রোগ্রামে ছাঁটকাট কোরে বেশ মনমরা হোয়েই বাড়ি ফিরে এলাম সেরাতে । ডিনার না কোরেই শুয়ে পড়লাম । অষ্টমি নবমিতে-ও সপ্তমির হ্যাংওভার চললো । হঠাৎ দশমির দিন সকালে মিলন সবার বাড়িতে ফোন কোরে জানালো – সব ঠিক হ্যায় –আজ বিকেলে আবার পাঁচটায় ব্যাম্বিনোর সামনে দাঁড়ানো ! আজ ভূত আসছে ।
মুগাম্বো খুশ হুয়া । সপ্তমির কম্পেন্সেশন আজ । ভালো কোরে মাথায় শ্যাম্পু কোরে মুখে ফেয়ার অ্যান্ড লাভ্লি মেখে বেলবটম পরে বেরোলাম । ব্যাম্বিনো পৌঁছেই দেখি , উপেন দাঁড়িয়ে গ্যাছে সবার আগে । একরাশ হাসিতে মুখ ভর্তি কোরে সেই চিরাচরিত উপেন । খুব ঘোরা হোলো সেদিন । একদম টানা হরিশ মুখার্জি রোড পর্যন্ত সব কভার হোয়ে গ্যালো – স্থাবর অস্থাবর সব প্রতিমা দর্শন হোয়ে গ্যালো সে যাত্রা । আলু কাব্লি – ভেল্পুরি – সব যে যার জায়গা মতো চলে গ্যালো ।
পরদিন ঘুম থেকে বেশ দেরি হোয়ে গ্যালো উঠতে উঠতে , ফিরেছিই রাত বারোটা পার কোরে । একাদশিতে বাবার অফিস খুলে গ্যালো । বাবা যখন অফিস যাবে বোলে বেরোতে যাচ্ছে , আবার মিলনের ফোন – শিগগিরি স্কুলে আয় – উপেনের বডি নিয়ে ওরা আসছে ; গতকাল দশমির সকালে ওর মামাবাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে উপেন আত্মহত্যা কোরেছে । তন্ন তন্ন কোরে খুঁজেও পুলিশ কোনো সুইসাইড নোট পায়নি । পোস্টমর্টেম কোরে পুলিশ জানাচ্ছে – অবসাদ থেকে আত্মহত্যা ।
হেডস্যার উপেনের গলায় মালা পরিয়ে দিলেন । আমরা যারা কাল উপেনের সঙ্গে সন্ধেয় ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম, একে অপরের মুখের পানে চেয়ে রইলাম…
সেবার বিজয়া ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন