স্বৈর তান্ত্রিক রহস্য গল্প – মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়
ফেব্রুয়ারি তেরো, ২০২৩-সকাল ৯-৩০
বীরভুম জেলার একটি প্রত্যন্ত অখ্যাত গ্রাম- বিধি বাম। পশ্চিমবঙ্গের ভ্রমণ মানচিত্রে এই গ্রামটির ঠিকানা খুঁজে পাওয়া এককথায় বাঘের দুধ খুঁজে পাওয়ার মতো ব্যাপার। তো এই গ্রামেই অবস্থিত জাগ্রত মা বামাকালীর মন্দির। কথিত আছে সাধক বামাক্ষ্যাপা নাকি তার প্রথম জীবনে একবার এই মন্দিরে স্বশরীরে এসেছিলেন। অবশ্য তখনো তিনি মা তারার সন্তান রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেননি। আর বামচরণ চট্টোপাধ্যায় সিদ্ধি লাভ করে বামাক্ষ্যাপা হওয়ার পর থেকেই এই মন্দিরের নাম লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পরে বামাকালীর মন্দির বলে। তার আগে এই মন্দিরের নাম ছিল জগৎকালী মন্দির। তবে মন্দিরের নাম বা তার ইতিহাস যাই হোকনা কেন এই মুহূর্তে আরেকটি কারনে এই মন্দিরে প্রায় প্রত্যেক দিনই আশপাশ ও দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে লোকে এসে ভিড় করে মায়ের পুজো দেয়, মায়ের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য। বিশেষ করে মঙ্গল ও শনিবারের ভিড় রীতিমতো চোখে পরার মতো। আর অমাবস্যার দিনগুলোতে তো মন্দির চত্বরে তিল ধারণের জায়গা থাকেনা। এবং যার জন্যে এই মন্দিরের এত নামডাক বা প্রসিদ্ধি, তিনি হলেন বছর পঞ্চাশের উমাপতি। এনার উপাধি কেউ জানেনা, জানতে চায়ও না। সবাই এনাকে তান্ত্রিক ঊমাপতি বলেই জানে। যিনি নিজেকে স্বয়ং শিবের অবতার হিসেবে সর্বসমক্ষে প্রচার করেন। এবং এলাকার লোকজনও এই কথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে। তাদের কাছে বটবৃক্ষের ন্যায় জটাধারী তান্ত্রিক উমাপতি একজন যোগসিদ্ধ, মহাজ্ঞানী, মায়ের আশীর্বাদপুষ্ট অসীম ক্ষমতার অধিকারী দিব্য প্রাণের আধার। সমস্ত প্রকারের সমস্যাকে তুরিতে উড়িয়ে দিয়ে ভক্তদের মুখে হাসি ফিরিয়ে দিতে সক্ষম এই উমাপতি, ভক্তরা এমনটাই বিশ্বাস করে। তাদের কথা মতো তারা বিভিন্ন সমস্যার হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে এই মন্দিরে মানত করে পুজো দেওয়ার জন্য। মা বামাকালী দারুণ জাগ্রত এবং ভক্তি সহকারে প্রাণভরে ডাকলে মা সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন না। শনি কিংবা মঙ্গলবার কেউ যদি এসে পুজো দেওয়ার লাইনে দাড়ায় তাহলে এই মন্দিরের মাহাত্মের অজস্র প্রায় অবিশ্বাস্য কাহিনী বিভিন্ন ভক্তদের নিজেদের মধ্যকার আলোচনায় কান পাতলেই আকচার শোনা যায়।
এইতো আজকেই তান্ত্রিক বাবার সাথে দেখা করতে আসা বুল্টির মা-ই তার পেছনে দাড়ানো একজন অল্প বয়সি সুদর্শনা ছিপছিপে আধুনিক পোশাকে সজ্জিতা মহিলাকে বলছিল,
“আর বলো নাগো দিদি, তোমরা তো হচ্চো শহরের সব লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মানুষ। তোমাদের বললে তোমরা বিশ্বাসই করবেনা।এই যে আমার একমাত্র মেয়ে, বুল্টি, সবে ছয় বছর বয়স। গত বুধবার গ্রামের প্রান্তে বড় সলাগড়ের মাঠে আমাদেরই গ্রামের অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে গিয়ে আর বাড়ি ফিরে আসেছে না। কি হলো? সেই কখন সূর্যদেব অস্ত গেছেন। খোঁজ খোঁজ। পাশের বাড়ির শ্যামল খুড়োর নাতি সজলের মুখ থেকেই জানা গেল যে ওরা বিকেলে অনেকেই বড় সলাগড়ের মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে গিয়েছিল কিন্তু সন্ধ্যার আগ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বুল্টিকে আর দেখতে পায়নি। ও বাচ্চা ছেলে, ধরেই নিয়েছিল বুল্টি হয়তো আগেই কারোর সাথে বাড়িতে ফিরে এসেছে। গ্রামের অনেকে মিলেই টর্চ আর হ্যারিকেনের আলোয় অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে সকলের অগতির গতি এই মন্দিরের তান্ত্রিক বাবার কাছে এসে ওনার শরণাপন্ন হলাম। তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় রাত এগারোটা। আসলে সন্ধ্যার পরে তান্ত্রিক বাবার এই মন্দিরে সাধারণ মানুষের আসা বারণ। কারণ সেই সময় উমাপতি তান্ত্রিক তন্ত্র সাধনায় মনোনিবেশ করে মা কালীর সাথে কথা বলেন। তখন এই মন্দির চত্বর প্রেতাত্মাদের অবাধ বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয়।
সকলের সমবেত ডাকাডাকিতে ও অনুনয়-বিনয় শুনে মন্দিরের দরজা খুলে বাইরে না এসে পারলেন না তান্ত্রিক উমাপতি। আলো আধারিতে তার সেই এলোকেশী ভয়ঙ্কর রূপের সাথে এর আগে এই গ্রামের কেউই পরিচিত ছিলনা। তার বজ্র নিনাদের মতো মেদিনী দ্ধিখন্ডিত আওয়াজে উপস্থিত সকলেরই হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু মেয়েটা যে আমার। আমার মাথায় তখন একটাই প্রচেষ্টা যে কি করে আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে খুঁজে বার করবো। আমি সোজা দিকভ্রান্ত অবস্থায় প্রবল ঝড়ে উপরে পরা বৃক্ষের মতো একদম ওনার পায়ের উপরে হুমড়ি খেয়ে পরে ওনার পা জড়িয়ে ধরে মাটিতে ক্রমাগত মাথা ঠুকতে শুরু করলাম। মুখে একটাই কথা, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন ঠাকুর বাবা। ও বড় সলাগড়ের মাঠে সবার সাথে দল বেধে বিকেলে গিয়েছিল বড়দের ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে। সবাই ফিরে এলো, শুধু আমার মেয়ে বাদে। দয়া করে আপনার পায়ে পরি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিন। আপনি মা’কে যা বলবেন মা কালী তাই শুনবেন। আপনি তার জন্য আমাকে যা যা করতে বলবেন আমি সব করে দেবো, আমার একমাত্র বুল্টিকে শুধু আমার কাছে এনে দিন ঠাকুর বাবা। উনি শুধু বললেন এতো রাত্রে এখানে এসে তোরা মোটেই ঠিক করিসনি। এখানে এই মুহূর্তে শয়ে শয়ে বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর সব প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোরা এইভাবে দল বেধে এসে আমার সাধনা কে বিঘ্নিত করে ভালো করলিনা। আমি জানিনা মা এতে করে অসন্তুষ্ট হয়েছেন কিনা। আর সেটা যদি হয়ে থাকেন তাহলে তোদের সবার কিন্তু সমূহ ক্ষতি হতে বাধ্য। এতটা উতলা হওয়ার মোটেও দরকার ছিলনা। কালকে সকালে সূর্যোদয়ের পরেইতো আসতে পারতিস। আর ঐ বড় সলাগড়ের মাঠে তোদের বাচ্চাদের পাঠিয়েছিস কেন? কতবার করে তোদেরকে ঐখানে যেতে বারণ করেছি। ওখানে সন্ধ্যা নামলেই অশুভ শক্তিরা ঘুরে বেড়ায়। তারপরেও যদি তোরা আমার কথাকে মান্যতা না দিস তাহলে এরকমের ঘটনা কিন্তু দৈনিকই ঘটবে এবং আমার পক্ষেও তোদেরকে রক্ষা করা আর কোনমতেই সম্ভব হবেনা। এরপর তিনি দু-চোখ বন্ধ করে মনে মনে মা মা বলে কি সব মন্ত্র উচ্চারণ করে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বামাকালী মায়ের মুর্তির পেছন থেকে আমার বুল্টিকে হাত ধরে যেন জোর করে প্রায় টেনে বের করে আনলেন। উপস্থিত আমরা সবাই তো একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মেয়ে পুরো ক্লান্তিতে সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারছিল না। ওর শরীরের উপর দিয়ে অশুভ আত্মাদের যে ভীষণ অত্যাচার বয়ে গেছে আমি মা হয়ে হাড়ে হাড়ে সেটা টের পাচ্ছিলাম। বাবা আমাকে আজকে এখানে আস্তে বলেছিলেন মেয়েকে একটু ঝাড়ফুঁক করে ওর শরীরে কোন প্রেতাত্নার কালো ছায়া পরলে সেটাকে দূর করে মেয়ের হাতে মা বামাকালীর একটা মন্ত্রসিদ্ধ রক্ষাকবচ পরিয়ে দেবেন। তা তুমি দিদি এখানে কি জন্যে এসেছো গো? তোমরা শহরের লোকেরা তো এইসব কিছুকে বিশ্বাসই করতে চাওনা। সবটাই বুজরুকি বলে মনে করো।“
পেছনে দাড়ানো মহিলাটি মুখে কিছু না বলে শুধুই একগাল চাপা হাসি হাসলেন।
নভেম্বর তিন, ২০২২-সকাল-১০টা।
সিউড়ি থানার প্রথম মহিলা ইন্সপেক্টর ঠিক ঘড়ির কাটা ধরে সকাল দশটায় থানার দায়িত্ব বুঝে নিলেন। উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির কাছাকাছি হবে। বাঙালি মহিলা হিসেবে যথেষ্টই লম্বা। ছিপছিপে টানটান চেহারা। চোখে বাজ পাখির মতো চঞ্চল অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি। একবারের চাহনিতেই যেন উপস্থিত এক-একজনের ঠিকুজি কুষ্ঠি সব পড়ে নিচ্ছেন।
“মালটা বেশ খাসা। একবার বিছানায় শোয়াতে পারলে যা স্বর্গলাভ হবেনা !! ঠোঁট তো নয়, যেন পাহাড়ের গভীর খাদ। একবার চুষতে শুরু করলে পুরো আঠা হয়ে যাবে।“
“মেজো বাবু, আস্তে কথা বলুন, সব শোনা যাচ্ছে। সবে তো এসেছে, মেপে নিতে একটু সময় দিন। এই মাল কিন্তু মনে হচ্ছেনা খুব একটা সুবিধার হবে। দেখে তো মনে হচ্ছে এবার থেকে আমাদের সুখের দিন শেষ। সবকটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে, মিলিয়ে নেবেন। তাই বেশি না উড়ে নিজেকে একটু সামাল দিন।“
“ আপনি তো রজত কর, থানার মেজবাবু। অ্যাম আই রাইট? আপনার সম্মন্ধে অনেক খবর, অবশ্যই এক সে বার কর এক, আমাকে ইনফর্মেশন দেওয়া হয়েছে ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে। শুরুতেই ভাবছি এবার একটু সাফ সুতরো করে নিতে হবে নিজেদের থাকার জায়গাটা। সস্তার ডিটারজেন্টে এলার্জি থাকলে বলবেন, সেক্ষেত্রে দামিটাই ব্যবহার করবো। খরচা হয়তো একটু বেশিই হবে, কোই বাত নেহি, দেবে তো ডিপার্টমেন্ট। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাই আমার পছন্দ। আই থিঙ্ক ইউ অল ক্যান আন্ডারস্ট্যাড হোয়াট আই একচুয়ালি মিন টু সে।”
“ আরে না না ম্যাডাম। এরা সব বাচ্চা ছেলে। গাল টিপলে সবকটারই দুধ বের হবে। আমি গত প্রায় আড়াই বছর ধরে এই থানায় বড় বাবুর পোষ্ট সামলাচ্ছি। এখানে কখনও আমার স্টাফদের নিয়ে কোনরকম সমস্যা হয়নি।“
“ নির্মল বাবু, নাম আর কাম দুটোই এক হলে সমস্যার কিছু ছিলোনা। আপনি একাই তো এখানে এইসব ধেড়ে খোকাদের নিয়ে ফূর্তি করতে পারতেন। সেক্ষেত্রে আমার আর এখানে আসার দরকার পরতো না। কিন্তু পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নিশ্চই আপনাদের নিয়ে রংগোলি মানানোর জন্যে আমাকে এখানে পাঠায়নি। আমার রেকর্ড বুক বোধহয় এখনো আপনাদের পড়ে দেখবার ফুরসত হয়নি। যাকগে, যখন এসেই গিয়েছি তখন আর কষ্ট করে পাতা উল্টিয়ে পড়ে দেখার দরকার নেই। ভালো বই পড়তে গেলে নরম সুন্দর শ্রদ্ধাশীল মনের প্রয়োজন হয়। আর সেটার ব্যাপারে আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বাজারে একটু বেশিই বদনাম আছে। যাকগে, কপাল খারাপ না হলে আমার সাথে বেশ কিছুদিনই থাকার সৌভাগ্য হবে আপনাদের। ধীরে ধীরে সব প্র্যাক্টিক্যাল করে বুঝিয়ে দেব। রিলাক্স, একদম চাপ নেবেন না। “
“ম্যাডাম বলছিলাম যে, আপনার কোয়ার্টার-এ গিয়ে একটু, যেটা একটু আগে বলছিলেন আর কি, সাফসুতরো হয়ে নিলে হতোনা? সেই মুর্শিদাবাদ থেকে সিউড়ি, এতটা পথের ধকল একজন,শত হলেও মহিলার পক্ষে যথেষ্টই কষ্টকর জার্নি।“
“ রজত বাবু, আমাকে মহিলা যত কম ভাববেন জীবনে তত দ্রুত উন্নতি করতে পারবেন। গত দেড় বছরে এখানে আশেপাশের অঞ্চলে প্রায় ছ’শোর মতো চাইল্ড ট্রাফিকিং হয়েছে এবং এদের প্রায় শতকরা নব্বই শতাংশ বারো বছর বা তার নীচের বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে। আপনার তো একটি তিন বছরের ছোট আদরের কন্যা সন্তান আছে। কি যেন খুব মিষ্টি একটা নাম, ইয়েস ইয়েস রঞ্জিতা, রজতের মেয়ে রঞ্জিতা। ঠিক বললাম তো? তো একজন মেয়ের পিতা হিসেবে আপনার কখনও মনে হয়না যে এই অঘটনটাই যদি আপনার ঐ ফুটফুটে আদরের তিন বছরের একমাত্র মেয়ে সন্তানটির সাথে ঘটে তাহলে আপনার কেমন লাগবে? তবে আমরা যেহেতু পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সাথে যুক্ত তাই এইধরনের ঘটনা যে আমাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে চট করে ঘটবে না, সেটার ব্যাপারে বোধহয় আমরা শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিন্ত থাকতে পারি, কারণ সরষের মধ্যেই তো ভূত লুকিয়ে থাকে,তাই না? কি হলো সবাই চুপ মেরে গেলেন কেনো, খুব কি ভুল কিছু বলে ফেললাম? একদম ঘাবড়াবেন না। আমি এখানে ক্রিমিনাল ধরতে এসেছি, পুলিশ সহকর্মীদের ধরতে নয়“
“ না ম্যাডাম, ব্যাপারটা সত্যিই খুব লজ্জাজনক আবার দুঃখজনকও বটে। আসলে যে এলাকায় এই ঘটনাগুলো প্রধানত ঘটছে ঐ অঞ্চলটা ঝাড়খন্ডের সাথে যুক্ত। ফলে শিক্ষিত মানুষের বসবাস প্রায় নেই বললেই চলে। বেশিরভাগই ভাগ চাষি। অন্যের জমিতে প্রধানত তুলা ও রেশমকীটের চাষ করে। এছাড়া কিছু মানুষ দূরের চালকল বা তেলকলে শ্রমিকের কাজে যায়। মজদুরি খুবই কম। যা আয় করে তাতে করে সংসার চলে না। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। কোনরকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকা। এবং বছরের সবসময় ঠিকমতো দুবেলা ভরপেট খাওয়াও জোটেনা। আর সেই সুযোগেরই সদব্যবহার করে কিছু দালাল গোছের মানুষ। এবং এদের বেশিরভাগই ঐ এলাকাতেই বাস করে। ঐসব অঞ্চলে প্রচুর পরিবার আছে যেখানে বাবা মা’রাই জেনে শুনে টাকার বিনিময়ে মেয়ে সন্তান বিক্রি করে দেয়। এছাড়া আছে ঝাড়গন্ড এলাকার বিভিন্ন পাথরের খনিতে কাজ পাইয়ে দেবার প্রলোভন। আর শিশু শ্রমিকদের খুব সহজেই অল্প পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। তাছাড়া মেয়েদের প্রতি চাহিদা বেশি হওয়ার কারণটাও নিশ্চই ম্যাডাম আপনাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলতে হবেনা। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই মেয়েরা আর মূল স্রোতে ফিরে আসেনা, চিরদিনের মতোই হারিয়ে যায়। আর সেখানেই মূল সমস্যা। “
“ কিন্তু সমস্যা থাকলে তো তার সমাধানের রাস্তাও থাকবে। গৃহ নির্মাণের সময় যে কোন বাড়িতেই জানালা দরজার সাথে দেওয়ালের উপরের দিকে ভেন্টিলেশনেরও ব্যবস্থা থাকে। অর্থাৎ বেরোনোর রাস্তা। শুধুই ঢুকবে অথচ বেরোবে না এটা তো হতে পারেনা। সেক্ষেত্রে আইন ফেল। এখানেও বেরোনোর রাস্তা আছে। আর সেই ভেন্টিলেশনের পথটাই আমাদেরকে খুঁজে বার করতে হবে।“
ফেব্রুয়ারি তেরো,২০২৩; দুপুর-১২-২৩
“ভেতরে আসতে পারি?”
নরম মেয়েলি সুমধুর গলা শুনে তান্ত্রিক উমাপতি একটু নড়েচড়ে বসলেন। নিজেকে অতি ক্ষিপ্রতার সাথে ঠিকঠাক করে গুছিয়ে নিলেন। মুখমন্ডলে একটা দিব্যকান্তি ভাবের সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা করলেন যাতে করে শহুরে পাখি খুব সহজেই খাঁচায় প্রবেশ করে বশ্যতা স্বীকার করে।
“ আঃ কি উগ্র অথচ মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ। শরীরটা যেন পুরো জুড়িয়ে গেলো। আর এখানকার গ্রাম্য মহিলা গুলোকে দেখো, ঘামে ভেজা পোশাকের বোটকা গন্ধে পাশে বেশিক্ষণ বসে থাকা দায়। তারপরে ঐ ভেজা শরীরে হাত দিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করে? উপায়ও নেই। একটু গায়ে পিঠে হাত না ছোঁয়ালে মেয়ে মানুষ গুলোর ভক্তিতে বিশ্বাস কিংবা শক্তি কোনটাই আসেনা। আজকে যে কার মুখ দেখে ভোরবেলা উঠেছি মা’গো। এত সুখ প্রাণে সইলে হয়।“
“ভেতরে কে আছেন? একটু দয়া করে ভেতরে প্রবেশ করতে দিন না।“ আবারও সেই সুরেলা গলার মধু ঝরে পরা শীতল অনুভূতি।
গলায় একটু নাটকিয়তা এনে ভরাট গলায় ভেতর থেকে তিনি বললেন,” বাইরে আর না দাড়িয়ে শীঘ্র ভেতরে প্রবেশ করো।“
মহিলাটি ঘরের ভেতরে পর্দা সরিয়ে প্রবেশ করতেই তান্ত্রিক উমাপতি গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ”তোর পরিচয়। দেখে তো শহরের লোক বলেই মনে হচ্ছে। আগে তো কখনো এখানে দেখিনি। তা হঠাৎ করে কি মনে করে এই মা কালীর সন্তানের কাছে এলি? সঙ্গে কেউ আছে নাকি একাই এসেছিস?আর এখানকার খবরই বা পেলি কোথা থেকে?”
“ আমি এক এক করে সব খুলে বলছি আপনাকে তান্ত্রিক বাবা।“
উমাপতি মনে মনে বললেন,” আরে সব খুলে বলার প্রয়োজন নেই। এতে করে আমার বিন্ধ্য
পর্বত উচ্চতায় এভারেস্ট কে ছাড়িয়ে যাবে।“
“বাবা, আপনি কি কিছু বললেন?” সুদৃশ্য মহিলাটি জিজ্ঞেস করলো।
“ আরে না না তুই বলে যা, আমি সব মন দিয়ে শুনছি। তুই বল তোর বাসস্থান কোথায় ?”
“ গুরুদেব, আমি কোলকাতার টালিগঞ্জ এলাকায় নেতাজি নগর পল্লীতে থাকি।“
“ ও, নেতাজি!! মানে সেই মহান গুম্মামি বাবা। নেতাজি সেজে গোটা বিশ্বকে ঠকিয়েছেন। ছদ্মবেশ ধরার একজন মহান শিল্পী বলা যেতে পারে।“
“ আপনি তার নাম শুনেছেন?”
“শুনবো না? এরাই তো আমার ইন্সপিরেশন। কাজ করার শক্তি। তুই কি ভাবছিস আমি কিছুই জানিনা। কোন কিছু জানবার জন্যে আমাকে এই ঘরের বাইরে বের হতে হয়না। আমি চোখ বুঝেই এই সম্পূর্ণ জগত সংসারের প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাকে স্বচক্ষে দেখতে পাই।“
“ ঠিক বুঝলাম না গুরুদেব।“
“কিচ্ছুটি বোঝার দরকার নেই। তুই এখানে তোর আসার আসল উদ্দেশ্য টা বিস্তারিত আমার কাছে খুলে বল।“
“ গুরুদেব, প্রায় দেড় বছর হতে চললো আমার স্বামী নিরুদ্দেশ। কোনও বিবাদ নেই, কথা কাটাকাটি নেই অথচ আচমকা পুরোপুরি ভ্যানিশ। সকালে ব্রেকফাস্ট করে আমাদের হার্ড-ও্য়ারের দোকানে আর পাঁচটা দিনের মতো হাসি মুখে গেলো। কিন্তু আর বাড়ি ফিরলো না। থানা পুলিশ করেছি, বিভিন্ন মন্দিরে গিয়ে মানত করেছি, কত জ্যোতিষীকে দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করিয়ে তাবিজ কবচ হাতে গলায় কোমরে পড়লাম কিন্তু স্বামী ফিরে এলোনা।“
“তাহলে অত দূরে বসে আমার ঠিকানা পেলি কোথা থেকে?”
“ আসলে গুরুদেব, আমি তারাপীঠের মহান তান্ত্রিক শঙ্কর শর্মার কাছে এর আগে এই একই কারণে দু-বার এসেছি। উনি আমাকে কথাও দিয়েছিলেন যে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু গত সোমবার উনি নিজেই হার্ট এটাক হয়ে মারা গেলেন। তো ওনার আশ্রমেই লোকমুখে আপনার কথা জানতে পেরে আর কোলকাতায় না ফিরে সোজা আপনার পায়ে আশ্রয় নিয়েছি গুরুদেব। যে করেই হোক আপনি আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন। আমার পুরো বিশ্বাস আছে যে আপনি পারবেন।“
“ আরে পারবো কিরে, ধরে নে তোর স্বামী ফিরে এলো বলে। শুধু এরজন্য একটা নরশুদ্ধি যজ্ঞ করতে হবে যার জন্যে ঐ ধর হাজার পঞ্চাশের মতো খরচা হবে। তুই রাজি কিনা বল।“
“ আমি রাজি গুরুদেব। তাহলে এখুনি চলুন আমরা যজ্ঞটা শুরু করি। আমি আর এক মুহূর্তও আমার স্বামীকে ছেড়ে থাকতে পারছি না গুরুদেব।“
বছর বত্রিশের সুঠাম দেহসৌষ্ঠবের অধিকারীনী স্ময়ং কাম দেবীর ন্যায় কামরস পরিপূর্ণ নারীর পুরুষ সঙ্গ পাওয়ার এহেন উদভ্রান্তের ন্যায় ব্যকুলতা উমাপতির ভেতরের পুরুষ প্রবৃত্তিকে আগামীতে এক বিপুল তরঙ্গে ভরা নারী শরীরের সম্পদ আহরণে ডুবুরি তুল্য পারদর্শিতা অর্জনে প্রলুব্ধ করলো। কিন্তু তার অন্তরের জ্বালামুখীর উদগীরণের অধীর প্রচেষ্টাকে আপাতত নিবৃত্ত করে পরম শান্ত স্বরে তিনি মহিলাটির উদ্দেশ্যে বললেন-
“ আরে শোনো মেয়ের কথা। যজ্ঞ তো খেয়াল খুশি মতো যে কোনও দিন করা যায়না। সামনের বুধবার, অর্থাৎ সতেরো তারিখ অমাবস্যা আছে। ঐদিন ঠিক রাত বারোটায় যজ্ঞ শুরু হবে। যজ্ঞ শেষ হতে ধরে নে ভোর সাড়ে চারটে। সকালে আকাশে সূর্য ওঠার আগেই ঐ সামনের জমির আলপথ ধরে দেখবি তোর স্বামী তোর দিকে দীপ্ত পায়ে হেটে এগিয়ে আসছে। তুই এই তিন দিনের জন্য কোথায় আর যাবি, আমার এখানেই তোর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আগামী বৃহস্পতিবার একেবারে স্বামীর হাত ধরেই না হয় এখান থেকে নিজের বাড়ি ফিরে যাস।“
প্রকৃতি ভক্ত, সিউড়ি থানার নতুন মহিলা পুলিশ ইন্সপেক্টর, উমাপতির কথায় রাজি হয়ে গেল মন্দিরের লাগোয়া গেষ্ট হাউসে থাকার জন্যে। তার প্রথম পরিকল্পনা সাক্সেসফুল। এই ক’দিনে সবটা খবরাখবর জোগাড় করতে হবে।আর তারপরে দেখ তোর ধর্মকর্মের আড়ালে মেয়ে পাচারের ঘৃণ্য ব্যবসার অবসান ঘটিয়ে কিভাবে তোকে জেলের ভাত খাওয়াই। আইনের এমন ধারায় তোর বিরুদ্ধে কেস সাজাবো যে বাকি জীবনটা তোকে শ্রী ঘরেই কাটাতে হবে। তান্ত্রিক, মা কালীর ভক্ত!! গ্রামের সরল সোজা মানুষগুলোকে ঠকিয়ে কোটি কোটি কালো টাকার ব্যবসা করে নিজেকে স্বয়ং শিবের অবতার হিসেবে প্রচার করার অসাধু উদ্দেশ্য কে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে হবে।
ফেব্রুয়ারি চোদ্দ, রাত- 1-35
বামাকালী মন্দিরের লাগোয়া গেষ্ট হাউসের দোতলার পশ্চিম দিকের ঘরে প্রকৃতির থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। উমাপতির বিশেষ অতিথি বলে কথা। খাওয়া দাওয়া, আদর আপ্পায়নে কোন কার্পণ্য নেই। উমাপতি নিজে এসে দুবার ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে খবর নিয়ে গেছেন।
“ শয়তান পুরুষটার শরীরে প্রচুর রস জমেছে। কিন্তু ও তো জানেনা কার পাল্লায় পরেছে। রস নিঙরে বের করে নেওয়ার সবরকমের দাওয়াই-ই আমার কাছে রয়েছে। কিন্তু সেগুলো এখনই প্রয়োগ করা যাবেনা। প্রথমে ওর বিরুদ্ধে জোড়ালো প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। নাহলে এর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য কেস দেওয়া যাবেনা। কারণ এতবড় একটা চক্রের মূল পান্ডা শুধুমাত্র মন্দিরে বসে সবটা সাম্রাজ্য পরিচালনা করছে এটা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। একটা বড় মাথাতো আছেই যে একে মূল যোগানদার হিসেবে কাজ করাচ্ছে। আর সেই ব্যক্তিটিকেই যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। অবশ্য এই লোকটাকে উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে সিউড়ি থানায় নিয়ে গিয়ে আঠারো দফা ধোলাই দিলেই প্রত্যেকটা নাম ওর মুখ দিয়ে লাভার স্রোতের মতো অবিরাম বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সময় হাতে মাত্র তিন দিন। যা কিছু এরমধ্যেই করতে হবে, নাহলে পঞ্চাশ হাজার টাকাটা পুরো জলে। এখন রাত একটা পঁয়ত্রিশ। আর ঘরে বসে থাকলে চলবে না। লুকিয়ে মন্দিরের চারপাশের পুরো এলাকাটা একবার ঘুরে দেখে নিতে হবে।“
প্রকৃতি সকালের পোশাকটা ছেড়ে একটা কালো পোশাক পরে নিয়ে ধীর পায়ে অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে এলো। তবে সামনের দরজা দিয়ে নয়।কারণ ঐদিকটায় একটা বাল্ব ঝোলানো আছে সিড়ির মুখটায়। তাই পেছনের দিকের জানালাটার দুটো লোহার সরু রড ছোট করাতের মতো ব্লেড দিয়ে কেটে মেঝেতে নামিয়ে রেখে দুটো হালকা লাফ দিয়ে সোজা নীচের নরম ঘাসে। দরজাটায় ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া আছে, সুতরাং এতো রাত্রে কেউ আসলেও দরজা ঠেলে খুলে ঘরে ঢুকতে পারবেনা। আর তাছাড়া একমাত্র পালের গোদাটা ছাড়া কারোর এই ব্যাপারটায় উৎসাহ আছে বলে তো মনে হলোনা। ওটারই যত লিঙ্গের দোষ।
সকালেই চারপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা করে রাখা হয়েছে। মন্দিরের সামনের খোলা জায়গাটায় ভক্তরা সমবেত হয় লাইন দিয়ে।তার পেছনে একটা প্রায় চার কাঠার মতো জায়গা জুড়ে কলা বাগান আর সেগুলোর মাঝে গোটা চারেক কার্পাস গাছ। মন্দিরের পেছনেও অনেকটা ফাকা জমি আর তার ভেতরেই ইতস্তত ছড়ানো গোটা তিনেক টিনের শেডের শৌচাগার এবং একটি লাগোয়া টেপা কল। মন্দির এলাকাটির চারপাশে কোন প্রাচিরের ব্যবস্থা নেই। ফলে আসার পথে বহু দূর থেকে মন্দিরটিকে সহজেই দেখা যায়। বড় পিচ বাধানো জাতীয় সড়ক থেকে মন্দিরে আসার লাল কাঁকুড়ে মাটির রাস্তাটি প্রায় আট ফুট চওড়া। অর্থাৎ ছোট চার চাকার গাড়ি সহজেই ঢুকে আসতে পারে।
প্রকৃতি খুব সাবধানে পা টিপে টিপে রাস্তাটির দিকে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ করেই মনে হলো কারা যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সে আর না এগিয়ে একটা কচু বনের ছোট ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পরলো। ঐদিকে মন্দিরের দিকেই মাঝের রাস্তাটা ধরে পাশাপাশি দুটো আলো দূর থেকে এগিয়ে আসছিল। ওটা আসলে একটা কালো রঙের মারুতি ভ্যান। গাড়িটা এসে মন্দিরের পেছনের দরজার সামনে দাড়ালো। পেছনের দরজাটা এবার পুরোপুরি খুলে গেলো এবং একজন টাক মাথার প্রায় ছ’ফুট লম্বা একটা গেরুয়া আলখাল্লা পড়া লোক মন্দিরের দরজা জুড়ে দাড়ালো। এটা তো উমাপতি। তাহলে ওর মাথায় চুল নেই কেন? তার মানে মাথার জটাটা আসলে পরচুলা। ওখানে মন্দিরের বাইরে মোট চারজনকে অস্পষ্টভাবে দেখা গেল। ওদের মধ্যে হালকা স্বরে কিছু কথা হলো এবং এরপরে গাড়ির ভেতর থেকে মোট জনা আটেক ছোটো ছোটো বাচ্চাকে নামানো হলো। প্রত্যেকের পরনেই ছিল ফ্রক। তার মানে এরা প্রত্যেকেই মেয়ে। কিন্তু কেউ একটু শব্দও করলোনা কেন? তারমানে এদের হাত এবং মুখ দুটোই কোন কিছু দিয়ে বাঁধা ছিল। এই পুরো ঘটনাটার ভিডিও প্রকৃতি তার ডিপার্টমেন্টের দেওয়া উচ্চমানের নাইট ভিশন ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে তুলে তৎক্ষণাৎ লালবাজারের ক্রাইম ব্রাঞ্চের চিফ ইনভেস্টিগেটিং অফিসার লালমোহন কে মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ করে পাঠিয়ে দিল। আসলে এর নাম সৌমেন সেনগুপ্ত, প্রকৃতির রিয়াল লাইফ প্রেমিক। লালমোহন আসলে ওর ছদ্মনাম। সৌমেন এই মুহূর্তে ঘটনাস্থল থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে আরো আটজন বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আর্মড পুলিশের সাথে ন্যাশানাল হাইওয়ের উপর অপেক্ষা করছে। এদিক থেকে একটা ইন্টিমেশন পেলেই মিনিট পনেরোর মধ্যেই মন্দির চত্বরে পৌঁছে যাবে।
কিন্তু এই মুহূর্তে প্রথমে দেখা দরকার মন্দিরের ভেতরে এরা বাচ্চাগুলোকে কোথায় নিয়ে গেল।
প্রকৃতি তার সার্ভিস রিভলবারটি ডান হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে সোজা পেছনের দরজার কাছে চলে গেল। আশপাশে কেউ নেই। দরজার ফাক দিয়ে সে ভেতরের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। সোজাসুজি কোনও প্যাসেজ নেই। দু-ফুট এগিয়েই একটা সিড়ি ধাপে ধাপে আন্ডারগ্রাউন্ডের দিকে নেমে গেছে।
“ নীচে নামাটা কি ঠিক হবে। সৌমেনদের জন্য অপেক্ষা করলেও চলবেনা। বাচ্চাদের সাথে কি ঘটছে সেটা স্বচক্ষে দেখা দরকার। তার আগে বরঞ্চ ওদেরকে এখানে আস্তে বলে দি। যাতে করে বড় ধরণের কোন বিপদের সম্মুখীন হলে ওদের সাহায্যটা পাওয়া যাবে। কারণ এই মুহূর্তে এখানে ক’জন আছে সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। সংখ্যায় বেশি থাকলে আমি একা বেশিক্ষণ লড়ে পেরে উঠবো না। ওরা নিজেরা কতটা তৈরি আছে সেটাও আমার জানা নেই।“
প্রকৃতি দ্রুত সৌমেনকে চলে আসতে বলে ডান হাতে রিভলবারটিকে শক্ত করে ধরে ধীরে ধীরে একটা একটা করে সিড়ি নামতে শুরু করলো। মোট এগারোটা সিড়ি পার হয়ে একটা বিশাল বড় হলঘর। হলঘরের ঠিক মাঝখানে এই একইভাবে এগারোটি সিড়ি দিয়ে উপরে ওঠার ব্যবস্থা আছে। তারমানে এই সিড়ি গুলো দিয়ে উপরে উঠলেই মা কালীর মুর্তি। বুল্টিকে গতদিন ভুল করে এরাই ধরে নিয়ে এসেছিল। এবং পরে বুঝতে পেরে এই পথেই মায়ের মূর্তির পেছনে কেউ পৌঁছে দেয় এবং উমাপতি নিজের কেরামতি দেখিয়ে মা কালীর মূর্তির পেছন থেকে বুল্টিকে খুব নাটকিয়তার সাথে বের করে এনে নিজের ক্ষমতা সকলের কাছে জাহির করে। এবং গভীর রাতে এখানে এইসব অপকর্ম চলে বলেই গ্রামের সবাইকে ভয়ানক সব প্রেতাত্মাদের মন্দির চত্বরে ঘুরে বেড়ানোর ভয় দেখানো হয় যাতে করে ঐ সহজ সরল লোকগুলো ভুলেও এদিকে না আসে এবং সেক্ষেত্রে নিশ্চিন্তে মেয়ে পাচারের ব্যবসাটা করা যায়।
“ এখন প্রশ্ন দুটো।প্রথমত এই উমাপতির আসল পরিচয় কি? এবং এই ক্রাইমের সাথে জড়িত মূল মাথাটি কে?”
হঠাৎ করেই কিছু লোককে মাঝের সিড়িটি দিয়ে নীচে নেমে আসতে দেখা গেল। প্রকৃতি চোখের পলকে অ্যাক্রোবেটিক দক্ষতায় নিজেকে সিড়ির নীচে রাখা একটি ড্রামের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল।
“ যে দুজন গাড়ি চালিয়ে এসেছিল তারাই ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু খুব যেন চেনা চেনা লাগছে। আরে, এরা তো নির্মল বাবু আর রজত। এদেরকে পালিয়ে যেতে দিলে হবেনা। এরাই দিনের বেলা সিড়ড়ি শহরের আইন শৃঙ্খলা সামলাচ্ছেন আর রাতের অন্ধকারে এরাই রক্ষক থেকে ভক্ষক!!”
প্রকৃতি দ্রুত ড্রামের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে।
“হ্যান্ডস আপ। সামান্য চালাকির চেষ্টা করলেই গুলি চালিয়ে দেব।“
ওদিকে সৌমেনের বাহিনীও ততক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। দুজন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার ঐ দুজনকে পিঠ মোরা করে বেঁধে নীচে দাড়িয়ে থাকে। বাকি ছ-জন প্রকৃতি ও সৌমেনের সাথে মাঝের সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়। সেখানে মোট বারো জন মাদকাগ্রস্ত অসহায় বাচ্চা মেয়ের উলঙ্গ শরীর নিয়ে বস্ত্রহীন অবস্থায় আদিম যৌন কলার ব্যবহার ও উপভোগে নিজের ধী-শক্তি পুরোপুরি লোপ পেযে বসে আছে উমাপতি ওরফে ‘কুঞ্জলাল মুন্ডা’র, ঝাড়খন্ডের কুখ্যাত ডন। এবং সিউড়ি থানার ক্রিমিনাল রেকর্ড বুকের বয়ান অনুযায়ী প্রায় দশটি খুনের কেসে জড়িত এই দাগী আসামী গত প্রায় বছর দুয়েক হলো নাকি ফেরার ছিল সিউড়ি থানার বড় বাবু নির্মল মান্নার লিখিত বিবৃতি অনুযায়ী। আর এই একই রিপোর্টের হুবহু পুনরাবৃত্তি তিনি বারংবার পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের প্রধান কার্যালয় কলকাতার লালবাজারের ক্রাইম ব্রাঞ্চের এনকোয়ারি ডিপার্টমেন্টের প্রধান সৌমেন সেনগুপ্তকে ই-মেইল করে পাঠাতেন ‘কুঞ্জলাল মুন্ডার অন্তর্ধান রহস্যের’ সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত করার জন্য।
মানুষ কতখানি মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে নিজেকে পাঁকের গভীরে এইভাবে নামাতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই ‘কুঞ্জলাল মুন্ডার অন্তর্ধান রহস্য’এর সফল পরিসমাপ্তি। একজন পঞ্চাশোর্ধ মানুষের যৌন চাহিদার পরিতৃপ্তির জন্য কত যে নিষ্পাপ, প্রায় দুধের শিশুর জীবন এইভাবে আহুতি দিতে হয়েছে তার কোনও সঠিক গোনাগুনতি হিসাব নেই। কারণ এই ঘৃণ্য পাপ চক্রের সাথে যে জন্মদাতা মা-বাবারাই স্ব-ইচ্ছায় জড়িত। আর বাকি রইলো সমাজের সুরক্ষা রক্ষার দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক আধিকারিকদের মহানুভবতার কথা। চাকরিতে বহাল হওয়ার সময় তারা যে শপথ বাক্য পাঠ করেন ভারতীয় সংবিধান এবং পবিত্র গীতাকে সাক্ষী রেখে, সেই অঙ্গীকার পরবর্তীতে অনৈতিক পথ অবলম্বন করে সামান্য কিছু লাভের আশায় এত সহজে তারা কিভাবে বিসর্জন দিতে পারেন সেটা ভাবতে গেলেই স্বাভাবিক বুদ্ধিও যেন মনে হয় লোপ পেয়ে যাবে। আবার ‘প্রকৃতি’ বা ‘সৌমেন’ দের মতো ডাকাবুকো অফিসারেরা আজও আছেন বলে শেষপর্যন্ত অন্যায় এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্য এবং ন্যায়-এরই জয় হয়।
স্বৈর তান্ত্রিক রহস্য গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
বরফের ছুরি
নক্ষত্রকন্যা
এলিয়েন সাইকোভেগাসের গল্প