সান্দাকফু-ফালুটের নীচের গ্রামগুলো ভ্রমণ – সাথী বল
শ্রীখোলা – রামাম – সামানদেন – গোর্খে – ভারিং
প্রথম দিনের গন্তব্য বিজনবাড়ি। দিদির সাথে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর শেয়ার গাড়িতে রওনা দিলাম ঘুম যাওয়ার জন্য। আবহাওয়া রির্পোট বলছে হাল্কা ঠান্ডা সাথে পরিষ্কার নীলাকাশ, শিলিগুড়ি এবং পাহাড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান। গাড়ি রোহিনীর রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দূরের একটা পাহাড়কে দেখে মনে হল হলুদ রঙের ফুলের বাগিচা, কাছে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ছোটো সুর্যমুখী ফুল ফুটে আছে পুরো পাহাড় জুড়ে। ঘুমে নেমে বিজনবাড়ির গাড়ির খোঁজ করতে জানলাম শেয়ার গাড়ি দার্জিলিং থেকে ছেড়ে আসে, সিট থাকলে জায়গা পাওয়া যাবে, ১ঘন্টার অপেক্ষায় গাড়ি পাওয়া গেল।
গাড়ি ঘুম থেকে মিরিক রোডে ১.৫/২ কিমি যাওয়ার পর ডানদিকের রাস্তা ধরল বিজনবাড়ির জন্য। উল্টোদিকের পাহাড় থেকে দার্জিলিং শহর দেখতে অপূর্ব লাগছিল, মনে হচ্ছিল কংক্রিটের চাদরে ঢাকা। রাস্তার প্রাকৃতিক দৃশ্য অতিমনোরম। পুলবাজার হয়ে বিজনবাড়ি পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় ২ ঘন্টা।
বিজনবাড়ি খুবই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম, পাশদিয়ে বয়ে চলেছে রঙ্গিত নদী। নদীর পাশে একদিকে গড়ে উঠেছে ছোট্ট স্টেডিয়াম, অন্যদিকে বিজনবাড়ি ডিগ্রী কলেজ। এখানে হোটেল/হোমস্টের সংখ্যাও হাতে গোনা। অনেক খুঁজে বাজারের উপরে শ্রীখোলা রোডে সাঁই বাবার মন্দিরের পাশে আরোগ্য হোমস্টে পাওয়াগেল। চেক-ইন করে গেলাম মন্দিরে সাঁই বাবার জন্মদিনের অনুষ্ঠান দেখতে। অনুষ্ঠান শেষে বেশ কিছু চকলেট পেয়ে খুশি হয়ে মনের আনন্দে রাস পূর্নিমার চাদের আলোয় এদিক ওদিক ঘুরে হোমস্টেতে ফিরেগেলাম।
দ্বিতীয় দিন, সকালে ৮.৩০ টে রওনা দিলাম শ্রীখোলা। হোমস্টেটে জানিয়ে রেখেছিলাম সকালে শ্রীখোলার গাড়ি ধরব, ওনারাই শেয়ার গাড়িতে ব্যাবস্থা করে দেন। শ্রীখোলার পথে পড়ল পাহাড়ি গ্রাম কালজারিয়া – ঝেপি – লোধমা – রিম্বিক। ঝেপিতে গাড়ি মাল নামানোর জন্য ৫মিনিট দাড়াতে আমি গেলাম কেক কিনতে। দোকানীর আমকে দেখে সরকারি কর্মী মনে হওয়ায় জিজ্ঞাসা করলেন কোন ডিপার্টমেন্ট, উল্টোপথে ঘুরতে যাচ্ছি শুনে খানিক অবাকই হলেন। রিম্বিকে কিছুক্ষণের কফি বিরতিতে বাংলার বর্ডারের শেষ পাহাড়ি বাজার ঘুরে দেখে নিলাম।
শ্রীখোলা অথবা শিরিখোলা – একটি জায়গার নাম সঙ্গে নদীরও। ছোটোবেলায় ক্যালেন্ডারের ছবির মত দেখতে পাহাড়ি গ্রামটি সান্দাকফু-ফালুট ট্রেকারদের কাছে অতিব পরিচিত । শ্রীখোলা পৌঁছালাম প্রায় ১১.৪০ মিনিটে। প্রথমেই পরিচর্যাহীন ট্রেকার্স হাটের জীর্নদশা দেখে মন কিছুটা আশাহত হল। চোখে পড়ল নতুন গড়ে ওঠা হোমস্টে। নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ ফোটোশুট আর রেডপান্ডা হোমস্টের পাহাড়ি স্বাদে ভরা waiwai খেয়ে রওনা দিলাম পরের গন্তব্য রামাম এ।
এবার গাড়ি ছেড়ে দুদিনের হাটাপথ শুরু হল সিঙ্গালিলা ন্যাশানাল পার্কের মধ্যে দিয়ে। পথে পাহাড়িঝোড়া, পাহাড়ের ধাপে ধাপে চাষের জমি, পাইন, ফার জাতীয় গাছের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে করতে চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টায় পৌঁছালাম রামামের প্রাইমারী স্কুলের গ্রাউন্ডে। রামাম হোমস্টে আর ১০০ মিটার। হোমস্টে তে জায়গা হবে কিনা খবর নিতে গিয়ে শুনি আমরাই আজকের একমাত্র অতিথি।
ব্যাগপত্তর রেখে স্কুল গ্রাউন্ডে ফিরে গেলাম সূর্যাস্ত দেখতে। প্রচন্ড ঠাণ্ডায় আমাদের দেখে স্থানীয় এক ব্যক্তি চাএর আমন্ত্রণ জানাতেই তার রান্নাঘরে গিয়ে আগুনের পাশে বসে গল্প জুড়ে দিলাম। গল্প শেষে বাইরে এসে দেখি পূর্ণিমা চাঁদের উঠেছে। অপেক্ষা শুরু হল অন্ধকার নামার, কারন পূর্ণিমারাতে পাহাড় দেখতে হবে। রাত ৮টার মধ্যে ডিনার শেষ করে বেরলাম বাইরে হাড় কাপানো ঠাণ্ডায়। দেখলাম একদিকে চাঁদনী রাতের আলোয় অস্পষ্ট বরফ পাহাড় ও আরেকদিকে দূরে আলোকঝলমল সিকিমের গ্রাম। বাইরে বেশিক্ষণ ঠাণ্ডায় থাকতে না পেরে এবং একমাত্র অতিথি হওয়ার সুযোগ নিয়ে অতিব ভিউ সাইড রুম খোঁজার অভিযান শুরু হল। অবশেষে মনের ইচ্ছা পূর্ণ হল, ভালো ক্যামেরার অভাবে সেদৃশ্য চোখ ও মনে বন্দি হয়েই থেকে গেল।
তৃতীয় দিন, সকালে দিদির ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে বাইরে তাকাতেই সূর্যোদয়ের প্রথম আলোয় রক্তাভ কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখেই দৌড় দিলাম দোতালার ভিউ সাইড রুমে। প্রান ভরে উপভোগ করলাম কাঞ্চন রূপী কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পাখির ডাক। সাড়ে সাতটার মধ্যে তৈরী হয়ে যাত্রা শুরু করলাম সামানদেনর জন্য। রামাম হোমস্টের ধ্রুব দাজু রাস্তায় খাবার জন্য সাথে দিয়ে দিল ভুট্টা ভাজা।
রামাম থেকে সামানদেন ৮ কিমি, রাস্তার দু’ভাগ চড়াই তিন’ভাগ উৎরাই। যারা উল্টো দিক থেকে আসে মানে ফালুট – গোর্খে – সামানদেন- রামাম – শ্রীখোলা তাদের তিন’ভাগ চড়াই হাঁটতে হয় ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে ভুট্টা ভাজা খেতে খেতে চলতে থাকলাম। রাস্তা চলেছে সিলভার ফার, ওক, ম্যাগনোলিয়ার গভীর অরণ্যের মধ্যে দিয়ে, অবিরাব ভেসে আসছে বিভিন্ন পাখির ডাক, মাঝে মাঝে আসছে নাম না জানা পাহাড়ি ঝোড়া। রাস্তায় দেখা হল শ্রীখোলা যাত্রীদের সাথে। ২.৫ ঘণ্টার পথ চলার পর দেখতে পেলাম ঝকঝকে নীলাকাশ হাতছানি দিচ্ছে, আর কিছুটা উঠতেই ঘিরে ধরল অদ্ভুত মুগ্ধতা, মনে হল কাশ্মীর বা হিমাচলের কোন গ্রামে চলে এসেছি। সুন্দরী পাহাড়ি ছোট্ট গ্রাম সামানদেন এ লোকবসতি হাতে গোনা, এরা শেরপা গোষ্ঠীর অর্ন্তভুক্ত, প্রধান জীবিকা কৃষি। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সামানদেন ফরেস্ট ভিলেজ হোমস্টেতে চা পান করে রওনা দিলাম ১কিমি দূরে গোর্খের উদ্দ্যেশ্যে।
এবার রাস্তা শুধুই উৎরাই, অল্প সময়েই দেখতে পেলাম গোর্খের সুন্দর ট্রেকার্স হাটটি। গোর্খে ট্রেকার্স হাটে থাকার ব্যাবস্থা বেশ ভাল, এখানেই দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে ঘুরতে বেরলাম। গোর্খেখোলায় পাথরের উপর কিছুক্ষণ বসে মুগ্ধ হয়ে চারিদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করে গেলাম ফালুটের রাস্তার প্রথম ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত। ফিরে এসে লাঞ্চ সেরে ২.০০ টে রওনা হলাম ভারিং, দূরত্ব ৫ কি.মি.।
ছোট্ট একটা কাঠের নীল সাদা ব্রীজ পার হয়ে আমরা বেঙ্গল ছেড়ে সিকিম ঢুকলাম। কিছুটা হাঁটার পর বুঝলাম এই রাস্তায় মানুষের চলাচল খুবই কম, রাস্তা চলেছে ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে। সময়াভাবে দু’দিনের ট্রেক একদিনে করায় রাস্তা মনে হচ্ছে “কত দূর আর কত দূর…… বল মা ?”
সাথে গাইড না থাকায় দু’এক জায়গায় কোন দিকে যাব বুঝতে না পেরে লোকাল মানুষের পথ চেয়ে কিছুটা সময় অতিরিক্ত ব্যয় হল। এই ভাবে অ্যাডভেঞ্চারের সাথে চলতে থাকলাম। বাঁ’দিকের উপরের লোকালয়টা দেখিয়ে দিদি বলল ঐযে ভারিং। সবে বা’দিকের রাস্তা ধরেছি উপরে যাওয়ার জন্য হঠাৎ নীচ থেকে মাতৃ ভাষায় আওয়াজ শুনে দিদিকে বললাম অপেক্ষাকরি মনে হচ্ছে রাস্তা ভুল হচ্ছে, কথার মাঝেই একজন লোকাল লোককে সঙ্গে একটা বাচ্চা নিয়ে উঠতে দেখে জিজ্ঞাসা করে জানলাম উপরেরটা আপার ভারিং, গাড়ি রাস্তা নীচের লোয়ার ভারিং এ।
নীচের সিড়িঁ রাস্তা যেন স্বর্গে থেকে পাতালে গেছে। প্রায় ৫টায় পৌঁছালাম ভারিং, সামনে একটাই বাড়ীর সাথে দোকান পেলাম। আগে কফির অর্ডার দিয়ে পিঠের ব্যাগ নামিয়ে খানিক জিরিয়ে হোমস্টের খবর নিতে জানলাম আরও ১কি.মি. দূরে হোমস্টে আছে, কিন্তু ওখানে ঘর না পেলে ৪কি.মি. দূরে রিবদি যেতে হবে। এই সব আলোচনার মধ্যে দেরজা শেরপা দাজু জোরথাং থেকে দিনের শেষ গাড়িতে দোকানির মালপত্র নিয়ে উপস্থিত। দোকানি ওনাকে দেখে আমাদের জানালেন দাজুর নিজের হোমস্টে আছে। দাজু মালপত্র নামিয়ে একেবারে আমাদের গাড়ি করে নিয়ে যাবেন বললে আমরাও নিশ্চিন্ত হলাম।
হোমস্টেতে ঢুকে হাত পা ছড়িয়ে সবে বসেছি লোডশেডিং হয়ে গেল। মোমবাতির খোঁজে বাইরে বেরিয়ে এক আকাশ তারা দেখে মনে হল “দেখো আলোয় আলো আকাশ, দেখো আকাশ তারায় ভরা, দেখো যাওয়ার পথের পাশে, ছোটে হাওয়া পাগলপারা। এত আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা আমায় ছাড়া..”। তবে ঠান্ডা হাওয়ায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে না পেরে মোমবাতি নিতে গিয়ে জানলাম ঘরে সোলার আলোর ব্যাবস্থা আছে। হাতমুখ ধুয়ে সান্ধ্য ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বাইরে এসে দেখি আকাশে তারাগুলোর মাঝে কেঊ যেন হ্যালোজেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। অতঃপর নিজের ভুল বুঝতে পারলাম, রাস পূর্নিমার প্রভাব চন্দ্র মামার উপর তখনও বর্তমান। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আলো নিভিয়ে, জানালার পর্দা সরিয়ে দিতে সারা ঘর ভরে উঠল জ্যোৎস্নার আলোয়।
চতুর্থ দিন, সকাল ৬.৩০ টায় দেরজা শেরপা দাজুর গাড়িতেই রওনা দিলাম জোরথাং, ওখান থেকে শিলিগুড়ি।
কিভাবে যাবেন : (i) শিলিগুড়ি থেকে দুপুর ১২ / ১ টায় শেয়ার গাড়িতে বিজনবাড়ি।
(ii) শিলিগুড়ি থেকে ঘুম / দার্জিলিং পৌঁছে শেয়ার গাড়িতে বিজনবাড়ি অথবা শ্রীখোলা ।
(iii) শ্রীখোলা থেকে হন্টন
(iv) জোরথাং থেকে গাড়িতে ভারিং পৌঁছে হন্টনে গোর্খে দিয়ে ঊল্টোপথেও যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন: (i) বিজনবাড়ি – আরোগ্য লজ (৯৮৩২১২৯৬০৩)
(ii) শ্রীখোলা – রেডপান্ডা হোমস্টে (৯৭৩৩০৬১৭৯৩ / ৯৫৬৪২৯৫০১৩)
(iii) রামাম – রামাম হোমস্টে (ধ্রুব দাজু – ৯৭৩৩১৭২৮৭১)
(iv) সামানদেন – সামানদেন ফরেস্ট ভিলেজ (৯৭৭৫৪১৮৯৩৪ / ৭৭৯৭৯৮৯৯৩৪)
(v) গোর্খে – গোর্খে ট্রেকার্স হাট / প্যারাডাইস হোমস্টে
(vi) ভারিং – PHENASHA HOME STAY (9547887492 / 8597642007)
সান্দাকফু-ফালুটের নীচের গ্রামগুলো ভ্রমণ – সমাপ্তি
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
অদৃশ্য সৈকত চাঁদিপুর
পরবাসী টুসুর দেশে
ভালোবাসার দেবালোকে