কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » সায়েন্স ফিকশন গল্প » পালানরা পালায় না

পালানরা পালায় না

পালানরা পালায় না সায়েন্স ফিকশন গল্প – গৌরাঙ্গ বন্দ্যোপাধ্যায়

৩১ শে মে ২০০৯

ছেলেটিকে প্রথম দেখি আরবেলিয়া গ্রামের শরণার্থী শিবিরে। তখন আমরা পাথরপ্রতিমা ব্লকের এই গ্রামটিতে আয়লা বিধ্বস্ত মানুষদের ত্রাণের কাজে ব্যস্ত। আমি সরকারি কাজ থেকে ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে আমার N.G.O. র দুজন সঙ্গীকে নিয়ে কাছেই একজন শুভানুধ্যায়ীর বাড়িতে ক্যাম্প করে আছি। আর দুজন সঙ্গী কলকাতা ফেরত গেছে ত্রাণের দ্বিতীয় দফার রসদ সামগ্রী আনতে। প্রথম দিন ত্রাণের কাজে ঐ গ্রামে গিয়েছিলাম বিকেলের দিকে। সব মানুষ লাইন করে সুশৃঙ্খলভাবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে গ্রামের স্কুলবাড়ির অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে নিজের নিজের জায়গায় চলে গেল। আর কেউ বাকি আছে কিনা দেখার জন্য আমি ছাদে গেলাম। দেখি বড় বড় ভাসা ভাসা বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু বেদনার্ত চোখদুটো মেলে ছেলেটি আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

“কি খোকা, তুমি একা উপরে কেন? নিচে তোমার বাড়ির লোকের কাছে যাও।”

“ওর বাবা মা নেই, আয়লার জলে ভেসে গেছে।” পিছন থেকে গ্রামের মোড়ল রতন সাঁপুইয়ের গলা পেলাম। “ও শুধু ওর স্কুলব্যাগ নিয়ে এখানে চলে আসতে পেরেছে। ওদের পুরো ভিটে চলে গেছে নদীর গভ্ভে। জানেন, ওর খুব মাথা, কেলাসে ফাস্ট হয়।”

এবার ভালোভাবে ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম। বছর বারো তেরোর ছেলেটি শৈশব থেকে সবে কৈশোরের আঙিনায় পা রেখেছে। জিজ্ঞেস করি – “কি নাম? কোন ক্লাসে পড়ো?”

“ক্লাস নাইন। পালান।” সংক্ষিপ্ত উত্তর, কিন্তু সোজা চেয়ে আছে আমার দিকে।

রতন সাঁপুইয়ের কথায় জানতে পারলাম, পালনের বাবার সংসার চলত মাছ ধরে। মাঝেমাঝে মাঝির কাজও করত। তবে তার নেশা ছিল ম্যাজিক দেখানো। মাঝেমধ্যেই ম্যাজিক দেখাতে দূরের গাঁ গঞ্জে যেত। বেশ কয়েকবার রায়দিঘিতে গেছে। একবার তো ডায়মন্ডহারবার এর হলেও শো করেছে। যদিও পয়সা কড়ি তেমন কিছু জুটতো না, তবু নেশার টানেই ছুটে ছুটে যেত।

বেলা পড়ে আসছে। সূর্য পাটে বসছে। আমি দ্রুত পালানের হাতে ফুড প্যাকেটস ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী ধরিয়ে দিলাম। ও বলে উঠলো, “তোমার কাছে খাতা আছে? আমার সব খাতা জলে ভেসে গেছে।”

“এখন তো নেই। পরে তোকে দিয়ে যাব’খন।” বলে আমি ওখান থেকে বিদায় নিলাম।

সেই রাতেই পালানকে স্বপ্নে দেখলাম। ও দুহাত বাড়িয়ে বলছে “দাদা আমাকে নিয়ে চল, আমি আরো পড়তে চাই।” পরের দিন আমার কলকাতার সঙ্গীকে জানিয়ে দিলাম সে যেন অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে এক ডজন খাতা ও পেন নিয়ে আসে।

দুসপ্তাহ ধরে অন্য সব গ্রামে ত্রাণ বিতরণের পর ফিরে আসার আগের দিন বিকেলে আবার গেলাম আরবেলিয়া গ্রামে। নৌকাতে দূর থেকে আমায় দেখতে পেয়ে পালান স্কুলবাড়ির দোতলা থেকে নেমে জলকাদা ভেঙে নদীর ধরে এসে দাঁড়ালো। ওর জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম “হ্যাঁ রে, তোর খাতা পেন সব এসে গেছে।” ও তখন আমার হাত শক্ত করে ধরে পাশে পাশে এগোতে লাগলো। স্কুলবাড়িতে পৌঁছতেই রতন সাঁপুই বললো “বিশ্ববাবু, আপনি কি ওরে শহরে নে যাবেন? ওখানে কোনও মিশন টিশনে ওরে যদি ঢুকায়ে দ্যান, তবে ওর একটা হিল্লে হয়।”

“আপনি আমার মনের কথাটাই বলেছেন রতনবাবু। এর জন্যই আমি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছিলাম। ওর যদি আপত্তি না থাকে তবে চলুক আমার সঙ্গে। আমি একলাই থাকি। বাবা চলে যাবার পর কোন পিছুটানও নেই। মিশনে ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ও আমার কাছেই থাকবে।”

“হ্যাঁ আমি যাবো। এই দাদার সঙ্গেই যাবো।” এককথায় ফয়সালা পালানের। তারপর পালানের স্কুলব্যাগ ও ত্রাণসামগ্রী হিসাবে পাওয়া জামা প্যান্ট নিয়ে ওর হাত ধরে ফিরতি পথ ধরলাম।

ফেরার পথে স্মৃতি মনে করিয়ে দিল পনের বছর আগে ১৯৯৪ সালের মে মাসের সেই ভয়ঙ্কর ঝড় বন্যা ও জলোচ্ছাসের কথা। যেটি আমাকেও এই পালানের বয়সে স্বজন ও গৃহহারা করেছিল সুন্দরবন এলাকার হিঙ্গলগঞ্জ থেকে। অবশ্য সৌভাগ্যবশত আমার পালক পিতা অকৃতদার দেবাশীষ জানার কাছে আশ্রয় পেয়ে আমি আজ রাজ্য সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। এমনকি গত ৩ বছর যাবৎ তিলতিল করে গড়ে তুলেছি এই N.G.O. ‘পথের সাথী’। বাবার অনুপ্রেরণায় এই কাজে এগিয়ে গেলেও এটির সূচনার সময় বাবাকে পাইনি। তার দু’বছর আগেই ২০০৪ এর সুনামির সময় ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে তিনি আর সুস্থ শরীরে ফেরেননি। তবে মৃত্যুশয্যায় আমাকে ওনার দেওয়া নামে ডেকে বলে গেছেন, “বিশ্বরূপ, মানুষের ভাল করিস। পৃথিবীর ভাল করিস।”

পলের কথা

১২ ই জানুয়ারী ২০২৪

আজ ল্যাব থেকে বেরোতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দ্রুত পা চালিয়ে চললাম আমাদের এপার্টমেন্টের দিকে। সঙ্গে আছে মিত্রোভিচ। ও সার্বিয়ার বাসিন্দা। এখানে M.I.T. তে আমার মতোই ডক্টর নিয়েলসেনের আন্ডারে রিসার্চ ফেলো। আমরা দুজনেই আজকের যুগান্তকারী সাফল্য নিয়ে যথেষ্ট উত্তেজিত। আমাদের রিসার্চের বিষয় হল MICRO-ALGAE, অর্থাৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শ্যাওলা। আমরা আজ MICRO-ALGAE সল্যুশন প্রোটোটাইপ সাফল্যের সঙ্গে তৈরী করে ফেলেছি। এবং সেটি খুব ভাল ভাবে কাজ করছে। গত ৮ ঘন্টায় আমাদের ল্যাবের অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেশন ০.০০২% বেড়েছে এবং সম পরিমাণে কমেছে কার্বন ডাই অক্সাইড। এখন পরীক্ষা করে দেখতে হবে এতটা অনুকূল পরিস্থিতি না হলেও এই সল্যুশনের কর্মক্ষমতা কতটা থাকে।

এপার্টমেন্টে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে চটপট ম্যাগী বানিয়ে ফেললাম। এই জিনিসটা কিন্তু মিত্রোভিচও বেশ পছন্দ করে, যদিও আমার কাছে এটা খিদের মুখে চলনসই খাদ্যের বেশি কিছু নয়। এরপর একদিন ওকে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াতে হবে। দেখি ওর কিরকম লাগে।

খাওয়া শেষ করে মিত্রোভিচকে কাঁটা প্লেটে নাড়াচাড়া করতে দেখে বললাম, “Hey Mister, Where have you lost? Are you still hungry?” ও চমক ভেঙে বলল, “No, No! Not at all!” তারপর মৃদুস্বরে বলতে লাগল, “জানো, আমার ছোটবেলা কেটেছে যুদ্ধের মধ্যে। শুধু ব্লাস্টের আওয়াজ, ঘরবাড়ি থরথর করে কেঁপে ওঠা, আর মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে আমি শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছি। একটু বড় হয়েই চলে গেলাম মিলিটারিতে। পেছনে রেখে গেলাম মা আর বোনকে। আড়াই বছর বাদে যুদ্ধ থামার পর ফিরে এসে ওদেরকে আর পেলাম না। তারপর জীবনের রথচক্রে পাক খেতে খেতে আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি। বিশ্বব্যাপী মানুষের এই যুদ্ধ আমাদের থামাতেই হবে। আচ্ছা পল, মানুষ এত লোভী কেন?”

আমি বললাম, “এখন আর ওসব কথা ভেবো না। ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে ল্যাবে গিয়ে অনেক কাজ আছে।” বলে বাসন ধুয়ে রুমের লোয়ার বেডে শুয়ে পড়লাম। আপার বেডে স্পেস বেশি, তাই ওটা ৬ ফুট লম্বা মিত্রোভিচের জন্য বরাদ্দ। আমাদের এই ২ রুমের এপার্টমেন্টের অন্য রুমের বাসিন্দারা আমাদের এখানে আসার আগেই ঘুমিয়ে গেছে।

শুয়ে তো পড়লাম, কিন্তু ঘুম আসে কই! ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। কলকাতায় এখন বেলা এগারোটা। দাদা হয় নবান্নে সবে ঢুকছে অথবা রাস্তায় আছে। দাদার সঙ্গে ত্রাণ শিবিরে প্রথম দেখার সময় থেকে পরের ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে উঠতে লাগলো। সেদিনের সেই পিতৃমাতৃহীন গৃহহারা পালান সাঁতরা কিভাবে আজকের বেস্ট রিসার্চ ফেলো ‘পল স্যান্টরা’ তে পরিণত হয়ে উঠলো সেটা যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু এটাই বাস্তব। তবে ‘দিল্লি এখনও বহু দূর!’ বিশ্বরূপ দাদার প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে, এই বিশ্বকে, বিশ্ব পরিবেশকে বাঁচাতে হলে এখনও অনেক পথ হাঁটতে হবে। সেই পথেই প্রথম ধাপটাতে হয়তো আজকে পা ফেলেছি। এই সল্যুশন যদি কমার্শিয়াল সাকসেস পায়, তবে এই বিশ্বের কার্বন ফুট প্রিন্ট কিছুটাও অন্তত কমবে। আর কে বলতে পারে – হয়তো এই পৃথিবীটা যত দ্রুত মানুষের বাসযোগ্য হয়ে উঠবে, তত দ্রুতই মানুষে মানুষে হানাহানি থামবে। মিত্রোভিচের ইচ্ছেটাও পূরণ করা যাবে। কিন্তু মানুষের লোভ? তাকে কি করে দমন করা যাবে? যে মহাপুরুষের জন্মদিন সবে পেরিয়ে এলাম তাঁকে স্মরণ করে মনে জোর আনলাম যে কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় আমরা করতে পারব, সেই আশায় বুক বেঁধে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়লাম।

বিশ্বরূপের কথা

৩১ শে জুলাই ২০২৪

আজ আমার খুব আনন্দের দিন। পালান তার কথা রেখেছে। যদিও বিদেশী নিউজ চ্যানেলগুলো দেখিয়েছে যে ডক্টর নিয়েলসন ও তাঁর টীম এই যুগান্তকারী ‘গ্রীন সল্যুশন’ আবিষ্কার করেছে ও তার পেটেন্ট রেজিস্টার করেছে, কিন্তু আমি জানি এই মৌলিক চিন্তাধারাটা পালানেরই। ও আর মিত্রোভিচ কো-রিসার্চার হিসেবে রেজিস্টার্ড হয়েছে। প্রথম লটের testing phase এ যে ১০ টা শহরে এই ‘গ্রীন সল্যুশন চেম্বার’ ইনস্টলেশন গুলো ৫ টি হাইরাইজে ও ৫ টি সবথেকে দূষণপূর্ণ ক্রসিংয়ের বাস স্ট্যান্ডের সীটের সঙ্গে লাগানো হবে, তার মধ্যে ভারতবর্ষের দিল্লি, কলকাতা ও সার্বিয়ার বেলগ্রেডও আছে। বাকি ৭ টি সাত আলাদা দেশের সবথেকে জনবহুল শহর। একটি দেশের দুটি শহরের ভাগ্যে এই শিকে ছেঁড়ার অন্যতম কারণ পালনের জেদ ও যুক্তির বেড়াজাল। আশা করা যায় এই টেস্ট পুরো সফল হবেই। তারপর এই বছরের শেষে বা সামনের বছরের গোড়ায় এটার কমার্শিয়াল প্রোডাকশন শুরু হয়ে যাবে। যথেষ্ট কম খরচেই এই জিনিস তৈরী হয়ে যাবে বলে জানানো হয়েছে।

পলের কথা

৩১ শে মে ২০২৫

আজ জেনিভায় এই তিনদিনব্যাপী ‘GREENER WORLD’ কনফারেন্সের শেষ দিন। এখানে আমাদের প্রেসেন্টেশন ছিল প্রথমদিন সেকেন্ড হাফে। তিনদিন হওয়া মোট ৬ টি প্রেসেন্টেশনের সবকটি পরিবেশের সরাসরি উন্নতিকল্পে নতুন নতুন আবিষ্কার। এর মধ্যে আমাদের আবিষ্কার করা (ইনভেনশন) ‘গ্রীন সল্যুশন চেম্বার’ এবং অস্ট্রেলিয়ার Macdermot ও চীনের চ্যাং লি – র যৌথ উদ্যোগে আবিষ্কার করা ‘ফ্লেক্সিবল সোলার সেল’ এর কমার্শিয়াল প্রোডাকশন শুরু হতে চলেছে সামনের মাসে। আমাদের গ্রীন সল্যুশন চেম্বার শহরের প্রতিটি অট্টালিকায় ও রাস্তার মোড়ে লাগালে বাতাসের কার্বন কন্সেন্ট্রেশন অন্তত ২৫% কমে যাবে। আর ‘ফ্লেক্সিবল সোলার সেল’, যেটি যে কোন সিমেন্টের, কাঁচের বা মেটালের সারফেসে আটকে দেওয়া যায়, সেটার থেকে ওই অট্টালিকার এয়ার কন্ডিশনার বাদে অন্য সমস্ত বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ হবে। অন্য যে ৪ টি প্রেসেন্টেশন হয়েছে, সেগুলো যদিও testing phase এ রয়েছে, তবে আশা করি এর মধ্যে অন্তত ২ টি commercially viable হয়ে উঠবে। সেই ২ টি হল –

১) River & Estuary Cleaner Boat: অর্থাৎ যে নৌকা নদী ও মোহনার দূষণ দূর করে। এই প্রেসেন্টেশনটি দিয়েছিল ব্রাজিলের Edmond ও বাংলাদেশের Aslam।

২) Glacier Melting Preventer: অর্থাৎ যেটি হিমবাহের গলন রোধ করে। এই প্রেসেন্টেশনটি

দিয়েছিল দুজন মহিলা কানাডার Nancy Bleak ও রাশিয়ার Ena Sursonesk।

অন্য দুটি ইনভেনশনের একটি হল ‘Artificial Photosynthesis’ (গবেষণাগারে সালোকসংশ্লেষ), যার ফলশ্রুতিতে ভবিষ্যতে পৃথিবীর খাদ্য সমস্যা মিটতে পারে। অন্যটি হল ‘Prophylactic Gene Therapy’, যাতে জিন থেরাপির মাধ্যমে যে কোন দুরারোগ্য রোগের নিরাময় ও প্রতিকার সম্ভব।

আমাদের প্রথমে উল্লিখিত এই ৪ টি টিমের ৮ টি কো-রিসার্চার সবাই প্রায় সমবয়সী। বয়স ২৮ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। প্রত্যেকেই পৃথিবীর কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের মানসিকতার এই মিলই আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে এই তিনদিনের মধ্যে।

আজ আমরা ৮ জন মিলে সেমিনারের পর বিকেলে জেনিভা শহর ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। লবিতে দুজন তরুণী আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এগিয়ে এল। তার মধ্যে একজনের মুখটা চেনা চেনা ঠেকল। আলাপ হতে জানতে পারলাম ও হল সুইডেনের Iceberg, যে গত ১৫ বছর যাবৎ পরিবেশরক্ষার জন্য রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে বারবার সরব হয়েছে। অনেকবার সেই প্রতিবাদ ছিল একাকী, সঙ্গীহীন। যে স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মুখের উপর UNO Council এ তাঁকে দোষারোপ করার সাহস দেখিয়েছে। শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়ে এল।

অপরজনকে দেখে মনে হল ইন্ডিয়ান অরিজিন, সত্যি তাই, সেই মেয়েটি হল পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত সর্বকনিষ্ঠ শান্তি নোবেল প্রাপক শবনম। ওদের সঙ্গে আমাদের গল্প জমে উঠল। আমরা একসঙ্গে জেনেভা শহর ঘুরতে বেরোলাম।

কালই এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে। আমরা ১০ জন্যে মিলে সেদিনই রূপরেখা তৈরী করলাম এক নতুন প্রতিষ্ঠানের। নাম ‘HEAL THE PLANET (HTP)’। প্রতিজ্ঞা করলাম যে আমরা আগামী তিনমাসে প্রত্যেকে অন্তত ১০ জন করে আরো ১০০ জনকে এই কাজে নামাব। তারাও এইরকমভাবে একই কাজ করবে। এইভাবে আমরাই আমাদের পৃথিবীকে, প্রকৃতিকে, পৃথিবীর সমস্ত জীবজগৎ, উদ্ভিদ, প্রাণীদের বাঁচাতে একবার শেষ চেষ্টা করে যাব। আমাদের সফল হতেই হবে। হবেই।

বিশ্বরূপের কথা

৩১ শে মে ২০৪০

আজ আমার চাকরিজীবনের শেষ দিন। ফুলের তোড়া, উপহারের বন্যায়, কলিগদের উচ্ছাসে ভেসে তারপর ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরছি। কিন্তু মনের মধ্যে বারবার দুশ্চিন্তার ঘুনপোকা কামড়াচ্ছে। আজ ভারতীয় সময় রাত ১০ টাতে পালানের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যতম ধনী শিল্পপতি DYLON TUSK এর মুখোমুখি সাক্ষাৎ। গত ১৫ বছরে ওদের টীম HTP (যার সভ্য সংখ্যা এখন প্রায় ৫০ কোটি) পৃথিবীর বেশ খানিকটা ভোলবদল ঘটিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সব বিখ্যাত ও ধনীতম শিল্পপতিদের যথা, DYLON TUSK, CIREN WAFE, DOREEN TAFT, BEN JACOBS কিংবা ভারতীয় শিল্পপতি সুকেশ ভিমানীদের সমস্যা বাড়িয়েছে সাংঘাতিক রকম। HTP র প্রতিষ্ঠাতা ওদের ১০ জনের জীবনে গুপ্তহত্যার ভয় যে ছিল না তা তো নয়, ওদের মধ্যে ৩ জন বিভিন্ন সময়ে অদ্ভুত ভাবে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু ওদের জনপ্রিয়তার জোয়ারে, সাধারণ মানুষের সহায়তায় ও প্রতিবাদে ওদের গায়ে শেষ অবধি আঁচড়টিও লাগেনি। ওদেরকে আলাদা আলাদা করে কিনে নেওয়ার চেষ্টাও ওনারা অনেক করেছেন, কিন্তু সফল হননি। শেষ অবধি ওদের সঙ্গে মিটিং করতে বাধ্য হয়েছেন ওনারা। আজকের মিটিং প্রকৃতপক্ষে HTP চেয়ারপার্সন এর সঙ্গে ‘World Industrialist Consortium’ এর চেয়ারপারসন এর ওই দুটি গ্রুপের মধ্যে একটা চুক্তিপত্রের চূড়ান্ত প্রস্তুতি, যেখানে সাংঘাতিক দর কষাকষির পর একটা সমঝোতার জায়গায় পৌঁছানো যাবে বলে আশা। এখন HTP র কর্ণধার হিসাবে পালান কতটা সফলভাবে গোটা ব্যাপারটা সামলে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারবে সেটাই দেখার।

পলের কথা

৫ ই জুন ২০৪০

“আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবসে HTP র পক্ষ থেকে আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে আমাদের ১০০ টি শর্তের ১ টি মাত্র শর্ত বাদ দিয়ে বাকি সব শর্তে ‘World Industrialist Consortium’ খুশিমনে রাজি হয়েছেন। সেজন্য এই বিশ্বের সমস্ত মানুষ তথা জীবজগতের পক্ষ থেকে তাঁদের সবাইকে জানাই আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। আমাদের মত এখন ওনারাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে (কবির ভাষায়) – ‘এ পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি / নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ “

হাততালির বন্যায় ভাসতে ভাসতে ডায়াস থেকে নেমে এল পল স্যান্টরা। ওর তখন মনে পড়ছে, MIT তে চান্স পেয়েও ও যখন দাদাকে ছেড়ে আসতে চাইছিল না তখন ওর দাদার সেই অমোঘ উক্তি – “তোর নাম পালান সাঁতরা। তুই হাওয়ায় সাঁতরে এখন থেকে পালা। এগিয়ে যা সামনের দিকে। তবেই বোঝা যাবে যে ‘পালান পালায় না।’ যা আমি পারিনি, আমার পালক পিতা পারেন নি, সেটা তোকে করে দেখাতেই হবে। আমি অপেক্ষায় থাকব।”

এর পরে পরেই মনে পড়ল সেদিনের সেই মিটিং রুমের কথা। কিভাবে DYLON TUSK কে রাজি করালো এই চুক্তিতে। এটা কিন্তু অনেকটাই তাই জন্মদাতা পিতার আশীর্বাদে ও শিক্ষায়। তাঁর কাছে শেখা সম্মোহন বিদ্যার অভ্যাস সে কিন্তু ছোট থেকে চিরকাল করে এসেছে। এবং পাশ্চাত্যে এসে নানা অন্যান্য সুযোগ সুবিধার মাধ্যমে সেটাকে আরও ধারাল করে তুলেছে। ধীরে ধীরে ঈশ্বরের আশীর্বাদে সে নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত ক্ষমতার অস্তিত্ব অনুভব করেছে। যা মানুষের মাথায় চিপ বসিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার থেকেও অনেকটা অন্যরকম। এই ক্ষমতার দ্বারা সে শুধু কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়েই যে কোন মানুষের মনকে আমৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়, এমনকি তার পরিচিত অপর ব্যক্তিকেও তার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যদিও কখনও এই ক্ষমতা প্রদর্শন করেনি বা ব্যবহারিক জীবনে এর প্রয়োগ করেনি। কয়েকবছর আগে যখন জানতে পেরেছিল যে তাদের ১০ জনের কাউকে অপহরণ করে তার মাথায় চিপ বসিয়ে প্রোগ্রাম করে তাকে বিশ্বাসঘাতক বানিয়ে দল ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে, তখনই সে তার এই বিশেষ ক্ষমতার কথা বাকি ৯ জনকে জানায়। মিত্রোভিচ অবশ্য আগেই কিছুটা জানত। এরপর ব্যবহারিক জীবনে এর প্রয়োগের ব্যাপারে নিজের প্ল্যানের কথাটা সবাইকে জানায়। তাই অবশেষে আজকের এই সাফল্য, যা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলবে।

পালানরা পালায় না সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!