রোল কেক প্রেমের গল্প – সুমিতা নন্দী দে
২০১০ সালে মাধ্যমিক পাস করার পর ইলেভেনে ভর্তি হলাম। তারপর স্কুল আর পড়া। বাবা কৃষকের কাজ করে, আর মা ঘরের কাজ, এভাবেই চলে যায় আমাদের অল্প আয়ের সুখের সংসার।
পুজোর ছুটির পর ক্লাস শুরু হলো। একদিন স্কুলে তাড়াতাড়ি চলে গেছি, তখনও স্কুলের ঘণ্টা পড়েনি। ক্লাস দুতলার ঘরে, ঘরের সামনে বারান্দা। সেখানে দাড়ালাম, তারপর বান্ধবীরা এলো, ওরাও ক্লাসে ব্যাগ রেখে বারান্দায় এলো। গল্প করছি হটাৎ করে আমার চোখ গেলো নীচে, স্কুলের বিপরীতে সারিবদ্ধ বন্ধ দোকানের দিকে, কারণ একটা দোকানের সামনে বাইশ – তেইশ বছরের একটা ছেলে পরনে কালো জিন্সের ফুলপ্যান্ট, লালচে রঙের শার্ট, কালো সানগ্লাস, একটা কাঁধে ব্যাগ আর টিটো জুতো পরে দাড়িয়ে আছে। হটাৎ ওকে দেখে আমার চোখটা একটু থেমে গেল।
বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেখছিলাম বলে আমার বান্ধবী বুঝতে পারেনি, আর মনে হয় ছেলেটাও কিছু বুঝতে পেরেছে বলে।
মিতা বলল – নিচে দাড়িয়ে ছেলেটাকে দেখেছিস, সম্পা।
সম্পা – ঐ ছেলেটা!
মিতা – হ্যাঁ রে! ওখানে একজনই দাড়িয়ে আছে!
ঐ মধুজা, তুই তো অনেক আগে থেকে এখানে দাড়িয়ে আছিস, তুই কি ছেলেটাকে চিনিস বা আগে দেখেছিস ?
আমি বললাম – হ্যাঁ, ছেলেটা তো অনেকক্ষন ধরে এখানে দাড়িয়ে আছে।
মিতা – ওঃ!
সম্পা – এই মিতা, তোর ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে!
মিতা – নিচে গিয়ে একবার ভালো করে দেখেতে হবে। চল না, দেখে আসি।
তারপর আমাকে বললো তুইও চল।
আমি, সম্পা আর মিতা গেলাম, ছেলেটার সামনে দিয়ে একবার হেঁটে যাওয়া – আসা করে এলাম। তারপর উপরে এসে, বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম।
মধুজা বললো – কি রে, সবাই কেমন দেখলি।
মিতা – ( মুখ বেজার করে) ধুস্ !
সম্পা – মুখটা কেমন চৌকো টাইপের !
আমি কিছুই বললাম না, শুধু হাসলাম।
মধূজা – ছেলেটা কাকে পছন্দ করছে বলে মনে হচ্ছে।
মিতা – উপরের দিকে তাকিয়ে আছে দেখছি, মনে হয় সম্পাকে , ওকেই তো দেখতে ভালো।
আমি বললাম – যাকেই পছন্দ করুক,আমি বাবা প্রেম করবো না, আর পালিয়ে বিয়েও করবো না।
মধুজা – ( আমাকে উদ্দেশ্য করে) তোকে কি একেবারে দেখতে, ওই তো চোখের উপরটা কেমন।
সাথে সাথে মিতাও তাল মিলিয়ে বললো- হ্যাঁ , যা বলেছিস।
আমি চুপ করে গেলাম।
স্কুলের ঘণ্টা পড়লো, সবাই যে যার ক্লাসে চলে গেল, কারণ ৫ মিনিট পর ক্লাসের ঘণ্টা পড়বে। মিতা আর সম্পা ভূগোলের ক্লাস করার জন্য অন্য রুমে চলে গেল। আমাদের অর্থনীতি ভূগোল এই রুমেই হয়। অনেকক্ষণ পর একটা শিক্ষক বলে গেলো এই ক্লাসটা হবে না। আমার তো একটু আনন্দ হলো, ক্লাস হবে না, আর একবার ছেলেটাকে দেখতে পাবো বলে। কিন্তু সে কি আর বসে আছে? বারান্দা দিয়ে এদিক ওদিক দেখছি, হটাৎ চোখ গেলো একটা দোকানের বেঞ্চে বসে, আর আমার চোখে চোখ পড়ে গেছে। আমি তো মাথা নিচু করলাম। ওই ছেলেটার চোখ গুলো একটু মায়াধরা , কোথায় বাড়ি? আর কেনই বা এখানে এমন করে অপেক্ষা করছে কিছুই জানি না। কিছু খেয়েছে কিনা ইশারা করলাম, সে ইশারা করে জানালো, না। তারপর মাঝে মাঝেই চোখে চোখ পড়ছে। এবার ছেলেটা আমাকে ইশারা করে জানালো, ফোন আছে কি না। আমিও ইশারা করে জানলাম, আছে। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়লো, কিছু পরে মিতা আর সম্পা চলে এলো। এরপর আমি মিতাকে বললাম, এই একবার নিচে যাবি ছেলেটা ডাকছে কি একটা বলবে বলে। মিতা তো এই কথা শুনে আনন্দে ডগমগ করতে করতে নিচে চলে গেল, এবার হটাৎ ছেলেটা আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল, আর একটা বাসে উঠে চলে গেল। তখন মিতার মুখটা একেবারে ছোট হয়ে গেছে।
অন্যদিনের মতো আজকেও রাত ৯ টার মধ্যে খাওয়া হয়ে গেছে। বাবা – মাও আলাদা ঘরে চলে গেল।আর দিদির বিয়ের পর এই পাশের ঘরে থাকি, পড়াশোনা করি, ঘুমাই। আজকে আর পড়ায় মন বসছে না, একবার ফোন নম্বরটায় মিসকল করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন এলো, তারপর থেকেই কথা শুরু, রোজ ২-৩ বার ফোন হতো, বেশি কথা হতো রাতে।
ওর নাম বিবেক কুন্ডু। বাড়ি রামপুর, ওর বাড়িতে মা, বাবা, বোন , ঠাকুমা আছে। বিবেক একটা কেকের দোকানে কাজ করে, ওর খুব ইচ্ছা একটা বড় কেকের দোকান করবে। সেদিন একটা কাজে এখানে এসেছিল।
পনেরো দিন ফোনে কথা বলার পর, এবার সরাসরি দেখা হওয়ার কথা জানালো বিবেক। এই প্রথম কারও সাথে দেখা করবো, তাও লুকিয়ে, খুব ভয় করছিল। বাড়ি থেকে বিকেলবেলায় বেরোলাম, আমাদের এখানেরই একটা পার্কে। গিয়ে দেখি বেঞ্চে বসে আছে, ঐ বেঞ্চেরই শেষে বসলাম। বিবেক একটা মোড়ক দিল আমায়, মোড়কের ভিতর থেকে একটা কাগজের বক্স, আর খুলতেই দেখলাম দুটো রোলকেক। এবার আমার একটু লজ্জা করছিল, কারণ ওকে বলেছিলাম, রোল কেক আমার প্রিয়। আর ও এটাই নিয়ে এসেছে।
পার্কে ৫-৬ জন বাচ্ছা খেলাধুলা করছে। এমন সময় বিবেক আমার হাত ধরে বললো – আমি তোমায় ভালোবাসি। সারাজীবন তোমায় পাশে পেতে চাই। ওর এই কথা শুনে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো, নিজেকে কোনো রকমে সামলে বললাম – কি করে সম্ভব হবে, তুমি তো তেমন ভালো কাজ করেনা। আর কেকের দোকানে কতই বা বেতন।
বিবেক – সব সম্ভব করবো, তুমি আমার পাশে থাকবে তো?
আমি – হ্যাঁ, থাকবো।
তারপর বেশ কিছুক্ষন ওখানে ছিলাম।
এভাবেই কেটে গেলো, একমাস পর আবার ওই পার্কে দেখা করার কথা বললো। বিবেকের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে অনেকদূরে প্রায় দের ঘণ্টা, তাই রোজ রোজ দেখা হওয়া সম্ভব নয়, ওর সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ছুটি। বিবেক বলেছে আজ একটা সারপ্রাইজ দেবে, সেটা কি হবে ভাবছি ….
এমন সময় দেখি একটা বাইক চালিয়ে এলো, বললো – অনেকদিনের শখ ছিল এটার, আসলে আমার কিছু জমানো টাকা ছিলো, আর এইমাসে নিজে কয়েকটা কেক বানিয়ে সেল করেছি, সেই সব দিয়ে কিনলাম।
আমি – ভালো হয়েছে, কিন্তু জমানো টাকাটা খরচ করে……।
বিবেক – (একটু হেসে বললো) শখটা এ বয়সেই মিটিয়ে নিই।
বাইক কেনার পর থেকে মাসে প্রায় ৩-৪ বার দেখা হতো। আমাদের পাশের গাঁয়ের মেলায় ওকে আসতে বললাম, সেদিন ১৪ ই ফেব্রুয়ারি। মেলায় অনেকরখম দোকান বসেছে, একটা ফুলের দোকান থেকে লাল, সাদা আর হলুদ গোলাপ কিনলো বিবেক। তারপর আমার কাছে এসে বললো, তোমায় আমি সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ভাবী তাই হলুদ গোলাপটা (আমার হাতে দিল), সাদা গোলাপটাও তোমার কারণ আমাকে বিশ্বাস করার জন্য, আর লাল গোলাপ টা?
আমি – কি? লাল গোলাপ টা?
বিবেক – (মুখটা বেজার করে) আসলে লাল রং তো ভালোবাসার রং! তাই ভাবছি , তুমি কি আমায় ভালোবাসো ?
আমি – কি! ঠিক আছে, আমি গেলাম বলে যেই মুখটা ঘুরিয়েছি অমনি আমার হাত ধরে মৃদু টানলো, আর আমার মাথার খোঁপার মধ্যে গোলাপটা গুঁজে দিল।
বিবেক – দারুন মানিয়েছে।
এবার আমি হাসলাম, ও হাসলো।
মেলার মাঝে হটাৎ আমার বান্ধবী মিতাকে দেখলাম, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে ওর মুখটা অন্যরকম লাগছে, বেশ হাসিখুশি। ও আমাদের দেখে খুশিই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বললো – কতদিন চলছে এসব?
আমি – এই তো….. (বলে হেসে ফেললাম, আবার লজ্জাও করছিল, কারণ সামনাসামনি আমাকে আর বিবেককে দেখে ফেলেছে )।
আমাদের পরীক্ষা শুরু হবে ১৬ ই মার্চ, সব পরীক্ষা শেষ হতে এপ্রিল মাস। পরীক্ষার সময় একদমই ফোন করে বিরক্ত করতো না, মাঝে মধ্যে একটা দুটো এসএমএস।
২৯ শে মার্চ পঞ্চম পরীক্ষা, ওইদিন পরীক্ষা দিয়ে বের হচ্ছি, মুখোমুখি দেখা হল। ও চোখের ইশারা করে এগিয়ে যেতে বললো। আমি হেঁটে এগোচ্ছি, ও গিয়ে বাইক নিয়ে গাছের নিচে দাড়ালো। আমি বললাম – কি ব্যাপার এখানে, তাও আবার বিনা ফোনে।
বিবেক – আজ তোমার জন্মদিন। তাই এলাম, ভাবলাম একটা ছোট উপহার দিই।
আমি – তোমার মনে আছে?
– থাকবে না, কেনো?
দেখি, জুয়েলার্সের ব্যাগ, একটা সুন্দর নাকছাবি।
– তুমি এটা অবশ্যই পড়বে।
বাড়ি গিয়ে শুনলাম আমার একটা বিয়ের সমন্ধ এসেছে, ওরা নাকি পরীক্ষা শেষ হলে যোগাযোগ করবে। এটা শুনে আমার চোখে জল চলে এল। আমি শুধু মাকে বললাম, আগে পরীক্ষাটা শেষ হোক।
পরীক্ষা শেষ হল ৫ ই এপ্রিল। বিয়ের সমন্ধের কথাটা ফোনে জানালাম বিবেককে। সব শুনে
বললো – উপায় একটাই, যদি পালিয়ে বিয়ে করা যায়। কারণ কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। আর অন্য কাউকে বিয়ে করে কেউই সুখী হতে পারবো না।
কথা গুলো শোনার পর নিজের মনকে শান্ত করলাম, মাকে বললাম ১৬ ই এপ্রিল মধুজার জন্মদিন, যাবো কি না, মা অনুমতি দিল।
১৬ ই এপ্রিল পালিয়ে বিয়ে করলাম বিবেককে। সেদিনই জানিয়েছিলাম, মা – বাবা, দিদি – জামাইবাবুদের। কিন্তু কেউই আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি।
দুমাস পর আমাদের নতুন কেকের দোকান “রোল কেক” উদ্বোধন করা হলো। সেদিন মা, বাবা, দিদিরা সকলে মিলে এসেছিল, আনন্দও করেছিল। আমাদেরকে অনেক আশীর্বাদ করলো আর অভিমান ভুলে মেনেও নিল।
রোল কেক প্রেমের গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
জ্বর
ভুবন যায় ভুবন আসে
প্রেম চিরন্তন