আমাদের জীবনে সম্পর্ক প্রবন্ধ – সুমন্ত বন্দোপাধ্যায়
সম্পর্ক বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো একে অপরর প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা মায়া মমতা স্নেহ জ্ঞাপনের একটি মাধ্যম। এটা হতে পারে বাবা মার সঙ্গে সন্তানের অকৃত্তিম সম্পর্ক , সেই সুর ধরেই তৈরী হয় সম্পর্ক, নানান আত্মীয়দের সাথে, কোনো ভালো লাগা জিনিসের সাথে । তাহলে বলা যেতে পারে সম্পর্ক হলো একটি সংযোগের মাধ্যম যা তৈরী হয় একটি মানুষের সাথে অন্য একটি মানুষের যোগাযোগের মাধ্যমে ।
আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন ওঠাপড়া লেগে আছে ঠিক তেমনি সম্পর্কেরও পরিবর্তন হয় প্রতিনিয়ত, যেখানে প্রতিদিন গঠিত হয় অনেক নতুন সম্পর্ক আবার ভালো পুরোনো অনেক সম্পর্ক নষ্টও হয়ে যায় , তবুও মানুষের সাথে মানুষের একটা সম্পর্ক থেকেই যায় , যা শুধু পরিস্থিতি ও সময়ের হাত ধরে পাল্টে ফেলে সম্পর্কের ধরনটা।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, উপনিষদের সব পুরুষ ঋষিদের জ্ঞানগম্ভীর বাণীর মধ্যে একটি নারীর ব্যাকুল বাণী ধ্বনিত-মন্ত্রিত হয়ে উঠেছে – যা কখনোই বিলীন হয়ে যায়নি ৷ তিনিও জানতেন,অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়…
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম৷
অর্থাৎ, হে সত্য, সমস্ত অসত্য হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও; হে প্রকাশ, তুমি একবার আমার হও, আমাতে তোমার প্রকাশ পূর্ণ হোক ৷
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি তাহলে তাঁর জীবনে এবং রচনার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার একটি বিশেষ সূত্র পাই? নাকি এক্ষেত্রে তাঁর চিন্তার ক্রমবিকাশ ঘটেছে? এখানে বলা যেতে পারে, ‘‘প্রথম যে কাব্যগ্রন্থটি যেখানে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তার একটা আভাস পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থে ৷ নৈবেদ্যের ঈশ্বর – কিছুটা বলা যেতে পারে ‘কর্পোরেট ঈশ্বর’৷ তার নিশ্চিত কর্তব্য আছে ৷ তিনি একজন দূরের মানুষ ৷ তার কাছে রবীন্দ্রনাথ দাবি জানাচ্ছেন – ‘আমাকে এভাবে গড়ে তোলো’৷ এবং ঈশ্বর, স্বদেশ, সমাজ – এই তিনটে মিলে একটা ত্রিভুজ তৈরি হচ্ছে ৷ সেখান থেকে আমরা দেখছি, তাঁর যে গীতপর্ব – গীতাঞ্জলী, গীতিমাল্য, গীতালি – তাতে তাঁর যে ব্যক্তিস্বত্ত্বা, তাঁর যে ক্ষুদ্র আমির জগত, তার সঙ্গে যে এই বিশ্ব-আমির সম্পর্ক – সেটাকে তিনি খোঁজার চেষ্টা করছেন, ছটফট করছেন এবং ধীরে ধীরে সেই দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ৷ গীতালিতে সেই পর্ব পুরো হয়েছে ৷
ভারতীয় যোগ গুরু ‘সদ্গুরু’, যিনি প্রায়শই জীবনের পাঠ সম্পর্কে কথা বলেন, সম্পর্ক নিয়ে একটি আকর্ষণীয় মতামত ব্যক্ত করেছেন । তিনি বলেন এই প্রায়শই দুর্বল সময়, যখন প্রতিটি দ্বিতীয় ব্যক্তির হৃদয় ভেঙে যায় কিংবা একটি রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতারিত হয়, ব্যক্তি বিষেশটি তখন তার সঙ্গীকে অভিশাপ দেয় এবং গোপনে ভাগ্যের কাছে তার সেই সঙ্গীর জন্য একটা ভালো শাস্তির কামনা করে । সদ্গুরু মতে,সম্পর্ক হচ্ছে একটি পরিবর্তশীল বাস্তবতা যাতে অনেক মনোযোগের প্রয়োজন হয় । তবে এটি একটি পরম বাস্তবতা নয় ।কাউকে শাস্ত্যি দেয়ার চেষ্টায় একজন শুধু নিজেকেই শাস্তি দিতে বাধ্য হয় ।
প্রত্যেক ব্যক্তি যখন একটু রোমান্টিক হয় সে ভাবতে শুরু করে এটি একটি পরম সম্পর্ক হতে চলেছে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সম্পর্ক যে সদাই পরিবর্তনশীল তাই এর যত্নের প্রয়োজন দৈনিক ভিত্তিতে । তাঁর মতে একদিনও যদি কেউ এর পরিচালনা ঠিকমতো না করে তাহলে সেই সম্পর্ক কোথাও চলে যেতে পারে অন্য কোথাও গিয়ে ঠেকতে পারে ।
দর্শন শাস্ত্রে, সম্পর্কের ধারণার একটি দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস রয়েছে। গ্রিক দার্শনিকদের আগ্রহের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট জিনিসের বর্ণনা করা যেতে পারে। তাঁদের আগ্রহের মধ্যে বহু সংখ্যক উপায় নিহিত ছিল যার মধ্যে একটি জিনিসের সাথে আরেকটির সম্পর্ক স্থাপন করা ছিল একটি । দ্বিতীয় আগ্রহটি ছিল এই সম্পর্ক এবং জিনিসের মধ্যের পার্থক্যটাকে নিয়ে । তবে এই জানার ব্যাপারটা সম্ভব ছিল শুধু সম্পর্কের মাধ্যম দিয়েই ।আধুনিক দর্শনে এই ধরনের বিতর্ক চলতেই থাকে যেমন সম্পর্কের প্রকার নিয়ে কিংবা সম্পর্ক কেবল মনে বা বাস্তব জগতে বা উভয়েই বিদ্যমান কিনা এবং এটা বোঝার জন্য প্রয়োজন বিশদ তদন্তের । মানুষ, সম্প্রদায় এবং বৃহত্তর বিশ্বের মধ্যে থাকা সহ অনেক কিছুর মধ্যে সম্পর্ককে বোঝার জন্য সম্পর্কের ধরন বোঝা খুবিই গুরুত্ব পূর্ণ । এগুলো বেশিরভাগই জটিল সম্পর্ক কিন্তু সরল বিশ্লেষণাত্মক সম্পর্ক যেগুলোর মধ্যে থেকে তৈরী হয় সেগুলো কে তিন ধরনের মনে করা হয়, যদিও সংখ্যা সম্পর্কে ভিন্ন মতামত থাকতে পারে । এই তিনটি প্রকার হলো ১) স্থানিক সম্পর্ক যার মধ্যে রয়েছে জ্যামিতি ও সংখ্যা ২) কারন ও প্রভাবের সম্পর্ক এবং ৩)মিল এবং পার্থক্যের শ্রেণী বিভাগীয় সম্পর্ক যা জ্ঞানের অন্তর্গত । বিজ্ঞান গণিত ও শিল্পকলাতেও অনুরূপ শ্রেণী বিভাগের পরামর্শ দেওয়া রয়েছে ।
‘ভালোবাসা’ মানুষের কাছে পরিচিত সবচেয়ে গভীর অবেগগুলির মধ্যে একটি ।প্রেম অনেক ধরনের হয় । কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশীদারদের সঙ্গে তাদের রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে একটি অভিব্যক্তি খোঁজে । এই রোমান্টিক সম্পর্কগুলো জীবনের সবচেয়ে অর্থপূর্ণ দিকগুলির মধ্যে একটি নিয়ে গঠিত, যাতে থাকে গভীর এক পূর্ণতার উৎসও বটে। যদিও মানুষের সংযোগের প্রয়োজন সহজাত, কিন্তু সুস্থ, প্রেমময় সম্পর্ক গঠন করার ক্ষমতা শেখা যায় সম্পর্কের মধ্যেই । কিছু প্রমান ইঙ্গিত দেয় যে একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক গঠনের ক্ষমতা শৈশব থেকেই শুরু হয়, একজন তত্বাবধায়কের সাথে একটি শিশুর প্রথম দিকের অভিজ্ঞতায় , যিনি নির্ভরযোগ্যভাবে শিশুর খাদ্য , যত্ন, উষ্ণতা, সুরক্ষা , উদ্দীপনা এবং সামাজিক যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেন । এই ধরনের সম্পর্কগুলো কোনো নিয়তি নয়, এগুলো অন্যদের সাথে সম্পর্কের গভীর ভাবে অন্তর্নিহিত নিদর্শন স্থাপনের জন্য তাত্বিক । একটি সম্পর্কের সমাপ্তি সে যেভাবেই হোক না কেন প্রায়ই এক বিশাল মানসিক যন্ত্রণার উৎস হয়ে ওঠে ।
যে কোন সম্পর্কেই থাকে একটি বিশেষ রকমের দায়বদ্ধতা। আর সেই দায়বদ্ধতা সঠিকভাবে পালন করতে পারলে একটি সম্পর্ক সুসম্পর্কে পরিণত হয় । বর্তমানের কর্মব্যস্ত জীবনে ছোটখাটো বিষয় গুলোকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন জটিল সমস্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।মানুষের মধ্যে ধৈর্য কমে যাওয়ার সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান বেড়ে চলেছে ইগো , অহংবোধ এবং অবিশ্বাস যা কিনা একটি সম্পর্ককে তৈরি হওয়ার আগেই বিনাশ করে দিচ্ছে।তাই প্রত্যেকটি মানুষ যদি জীবনের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যথা আত্মমর্যাদা, সততা, সম্মান, যোগাযোগ এবং স্পেস একটি সম্পর্ককে যথাযথ ভাবে দিতে পারে তাহলে সেই সম্পর্কে কখনো চিড় ধরে না ;দীর্ঘদিন ধরে তা সুস্থ এবং স্বাভাবিক থাকে।
আমাদের জীবনে সম্পর্ক প্রবন্ধ – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভরুয়া
উদ্বর্তিনী
নীলবাস্প