প্রফেসর প্লুটো ও সময় গোলক রহস্য সায়েন্স ফিকশন গল্প – এস সি মন্ডল
১।।
২৭শে জুন।
নিজের বাড়িতে একটা পার্টির আয়োজন করেছেন প্রফেসর প্লুটো। বসার ঘরে টেবিলের উপর সুসজ্জিত কেক, নানান পদের মিষ্টি থেকে শুরু করে দামি শ্যাম্পেন, সব কিছুরই বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ঘরের এক কোণে একটা চেয়ারে বসে চায়ের কাপ হাতে অতিথিদের জন্য অপেক্ষা করছেন প্রফেসর প্লুটো স্বয়ং। তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে তিনি কিছু একটার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
প্রফেসরের এই পার্টির নিয়মটা একটু অদ্ভুত। পার্টিটার নাম তিনি দিয়েছেন টাইম ট্রাভেলর্স পার্টি। আর এই আয়োজনের কথাটা তিনি এখনো পুরো বিশ্বের কাছ থেকে সযত্নে গোপন রেখেছেন। তবুও তিনি আশা করছেন কোন অতিথি হয়ত আসবেন এই পার্টিতে যোগ দিতে।
শুনে হয়ত মনে হতে পারে প্রফেসরের মাথায় গোলমাল আছে। কারণ যে আয়োজনের কথা কেউ জানেই না সেখানে যোগ দেবার জন্য কেউ কিভাবে আসবে?
কিন্তু বাস্তবিক ব্যাপার সেটা নয়। আসলে প্রফেসর প্লুটো তার অন্যান্য অদ্ভুত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মত এটাও একটা পরীক্ষা করছেন। কিরকম?
ধরুন আপনার একজন প্রিয় বন্ধুর জন্মদিন ছিল গতকাল। এই খবরটা আপনি জেনেছেন একদিন পরে। এখন আপনি যদি চান তার জন্মদিনের পার্টিতে উপস্থিত হবেন, সেটা কি সম্ভব? সাধারণ অবস্থায় সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু আপনি যদি টাইম ট্রাভেল করতে পারতেন তবে কিন্তু ব্যাপারটা অসম্ভব হত না।
প্রফেসর প্লুটো ঠিক এই আশাটাই করছেন। তার আশা, ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে যদি টাইম ট্রাভেল আবিষ্কার হয়, আর তার এই পার্টির খবরটা যদি সেই সময় পর্যন্ত পৌছায় তবে কোন টাইম ট্রাভেলর হয়ত তার এই পার্টিতে যোগ দিতে আসবেন।
এক কাপ চা শেষ করে আরেক কাপ চা ঢালতে যাচ্ছেন প্রফেসর, এমন সময় ঘরের ডোরবেল বেজে উঠল। চমকে উঠলেন প্রফেসর প্লুটো। হাতের ফ্লাক্স থেকে খানিকটা চা মেঝেতে ছলকে পড়ল। কোন রকমে সেটা সামলে নিয়ে দ্রুত পায়ে গিয়ে ঘরের দরজা খুললেন তিনি।
কিন্তু দরজা খুলে তাকে খানিকটা হতাশ হতে হল। দরজার বাইরে কেউ নেই! প্রফেসর একটু এগিয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকেই দেখতে পেলেন না। কেউ কি মজা করল তার সাথে?
হতাশ হয়ে ফিরে আসতে যাচ্ছেন, এমন সময় প্রফেসরের চোখ পড়ল দরজার সামনে সিঁড়িতে পড়ে থাকা খামটার দিকে।
খামটা তুলে নিয়ে প্রফেসর দেখলেন এক পিঠে লেখা “প্রাপক, প্রফেসর প্লুটো নাথ বসু, ২৭শে জুন ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ”। আর অন্য পিঠে লেখা ‘প্রেরক, সত্যজিৎ সেন, ২২শে জানুয়ারি, ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ”।
প্রফেসরের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। খামের গায়ের তারিখটা প্রায় এক শতাব্দী পুরানো! সেটা কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে না ভেবে কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুলে ফেললেন তিনি। খামের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো পুরনো হতে হতে হলদে হয়ে যাওয়া একটা চিঠি।
চিঠির প্রথম লাইনেই লেখা, “প্রিয় প্রফেসর প্লুটো নাথ, আমি জানি এই চিঠি পেয়ে তুমি বিস্মিত হয়েছ। সময় ভ্রমণের পরীক্ষায় তোমার উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।” বাক্যগুলো পড়ার সাথে সাথে প্রফেসরের মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন জাগতে লাগল। এই চিঠি কি সত্যিই অতীত থেকে এসেছে? সত্যজিৎ সেন-ই বা কে?
তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে চিঠিটি পড়তে শুরু করলেন। চিঠির প্রতিটি বাক্য যেন তাকে রহস্যের এক অদ্ভুত জগতে টেনে নিয়ে চলেছে। এই চিঠি যেন খুলে দিচ্ছে এক অনন্ত রহস্যের দরজা, যার পিছনে লুকিয়ে আছে সময়ের সব অজানা গল্প।
২।।
২৮শে জুন।
সকালে ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটোনে। ঘুম জড়ানো চোখে ঠিকমত নাম না দেখেই কল রিসিভ করতেই অন্যপাশ থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠ বলল
‘হ্যালো মন্ডল, জলদি আমার ল্যাবে চলে এসো। একটা বিশেষ ব্যাপার ঘটেছে।’
‘কী ব্যাপার প্রফেসর?’
‘সেটা ফোনে বলা যাবে না। তবে ব্যাপারটা টাইম ট্রাভেলের সাথে সম্পর্কিত।’
কলটা কেটে যেতেই তড়াক করে বিছানার উপর উঠে বসলাম। প্রফেসর প্লুটোর কণ্ঠে এমন একটা চাপা উত্তেজনা ছিল যা আগে কখনো দেখিনি। প্রফেসর প্লুটো নাথ বসু, জগৎবিখ্যাত আবিষ্কারক, যার ল্যাবে দুনিয়া কাঁপানো আবিষ্কার হয় হরহামেশা, তাকে উত্তেজিত করার মত কী এমন ব্যাপার ঘটতে পারে সেটা ভেবে পেলাম না।
টাইম ট্রাভেল নিয়ে প্রফেসরের একটা অবসেশন আছে, সেটা আমি আগে থেকেই জানি। বছরের পর বছর ধরে একটা কার্যকর টাইম মেশিন বানানোর পিছে লেগে রয়েছেন প্রফেসর। সেই চেষ্টায় সাফল্য না এলেও একগুঁয়ে স্বভাবের প্রফেসরের অবসেশন তাতে কাটেনি।
নানান ব্যস্ততায় অনেকদিন প্রফেসরের সাথে দেখা হয়নি, তা সে প্রায় মাস দুই তো হবেই। তবে কি প্রফেসর এরই মধ্যে অমন কিছু একটা বানিয়ে ফেলেছেন? মনের মাঝে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা নিয়ে দ্রুত প্রফেসরের ল্যাবের দিকে রওয়ানা হলাম।
প্রফেসরের ল্যাবে গিয়ে কিন্তু অবাক হতে হল। ল্যাবের মধ্যে একজন মোটা বয়স্ক লোক বসে আছেন। আমি খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রফেসর আছেন কি?’
লোকটা একটু হেসে ইশারায় আমাকে বসতে বলে বললেন, ‘তিনি আছেন। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।’
আমি প্রফেসরের ল্যাবে আমার প্রিয় চেয়ারটায় বসে লোকটার দিকে ভালো করে তাকালাম। এনাকে প্রফেসরের ল্যাবে আগে কখনো দেখিনি। ভদ্রলোক আমার কৌতূহল বুঝতে পেরে বললেন, ‘প্রফেসর আপনার জন্য একটা চিঠি রেখে গেছেন। দেখুন তো এটা।’
ভদ্রলোক আমার দিকে একটা খাম এগিয়ে দিলেন। এক পলক চোখ বুলাতেই দেখলাম খামের উপরে লেখা – ‘”প্রাপক, প্রফেসর প্লুটো নাথ বসু, ২৭শে জুন ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ”। আমি অবাক হয়ে ভদ্রলোককে বলতে গেলাম চিঠিটার প্রাপক তো আমি নই, কিন্তু সেটা আর বলা হল না। কারণ তার আগেই সামনে বসে থাকা ভদ্রলোকের দিকে চোখ পড়তেই আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম।
আমার সামনের চেয়ারে বসে আছেন আর কেউ নয়, স্বয়ং প্রফেসর প্লুটো। ব্যাপারটা কিভাবে ঘটলো আমি ভেবে পেলাম না। প্রফেসরের মুখ দেখে বোঝা গেল আমাকে চমকে দিতে পেরে তিনি ভীষণ উৎফুল্ল হয়েছেন। বললেন
‘কি মন্ডল, কেমন চমকে দিলাম বলো?’
‘তা চমকে সত্যিই দিয়েছেন, কিন্তু কিভাবে সেটা বুঝতে পারছি না।’
‘শোন এটা হল আমার সাম্প্রতিকতম আবিষ্কার – “প্রোটিওনেটর” । গ্রিক দেবতা প্রোটিয়াস এর নামানুসারে এর নাম রেখেছি। এই যে আমার হাতে ঘড়িটা দেখছো, এটার ভিতরে লুকিয়ে আছে সিলিকনের তৈরি লক্ষ লক্ষ ন্যানো রোবট। রোবটগুলোকে এমন ভাবে প্রোগ্রাম করা যে ঘড়ির বাটনে একটা চাপ দিলে ওরা হোস্টের শরীরকে ঘিরে ধরে হলোগ্রাফিক প্রজেকশন এর মাধ্যমে যেকোনো অবয়ব তৈরি করতে পারে।’
‘বাহ, প্রফেসর, সত্যিই অনবদ্য।’
‘ধন্যবাদ…ধন্যবাদ…মন্ডল। তুমিই হলে প্রথম ব্যক্তি যে আমার এই আবিষ্কারের সম্পর্কে জানলে।’
প্রফেসর সহাস্যে এমন ভাবে আমার অভিবাদন গ্রহণ করলেন যেন মনে হল কোন শ্রেষ্ঠ শিল্পী মঞ্চে নিজের সেরা অভিনয়টা দেখানোর পর অভিভূত দর্শকের সামনে ঝুঁকে অভিবাদন গ্রহণ করছেন। পর মুহূর্তেই কিন্তু তিনি হাসি থামিয়ে সিরিয়াস হয়ে বললেন
‘তবে শুধু এটা দেখানোর জন্যই কিন্তু তোমাকে এই রবিবারের সকালে ঘুম থেকে তুলে আনিনি।’
‘তাহলে? আরও কিছু আছে নাকি?’
‘অবশ্যই। টাইম ট্রাভেল বিষয়ক একটা জটিলতার মুখে পড়েছি। সেজন্যই তোমাকে দরকার।’
‘ওহ হ্যাঁ, আপনি বলেছিলেন বটে। তা সমস্যাটা কী?’
‘সেটা জানার জন্য তোমাকে আগে একটা ঘটনা বলি। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর নাম তো শুনেছ?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
‘২০০৯ সালের জুনে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হকিং একটা পার্টির আয়োজন করেছিলেন। পার্টিটা ছিল টাইম ট্রাভেলদের জন্য। কিন্তু এই পার্টির আমন্ত্রণ পত্র প্রচার করা হয়েছিল পার্টির পরদিন। মানে হকিং চাইছিলেন যদি ভবিষ্যতে কখনো মানুষ টাইম ট্রাভেল করতে পারে, তবে তাদের কেউ অতীতে এসে ওই পার্টিতে এটেন্ড করবে।’
‘অভিনব ব্যাপার বটে।’
‘হ্যাঁ, তা তো বটেই। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল সেই পার্টিতে কেউ এসেছিলো না। সেই থেকে হকিং ধারণা করেন যে ভবিষ্যতে কখনোই টাইম ট্রাভেল আবিষ্কার হবে না।’
‘দুঃখজনক ব্যাপার। কিন্তু এই ঘটনার সাথে আপনার সম্পর্ক কী?’
‘তুমি তো জানো টাইম ট্রাভেল নিয়ে আমার একটা অবসেশান আছে। সেই থেকে গতকাল সন্ধ্যায় আমিও হকিং এর মত একটা টাইম ট্রাভেলর পার্টির আয়োজন করেছিলাম।’
‘বলেন কী? জানলাম না তো!’
‘আবার বোকার মত কথা। যদি কাউকে আগে থেকে জানিয়েই দেই, তবে টাইম ট্রাভেলার্স পার্টি কী করে হবে? পার্টির কথাটা আজকে একটু আগেই সাংবাদিকদের জানিয়েছি।’
‘আচ্ছা, কিন্তু আপনি বলছেন কিছু ঘটেছে। তারমানে কী আপনার পার্টিতে কি কোন টাইম ট্রাভেলর এসেছিলেন?’
‘না, সেরকম কেউ আসেন নি। তবে একটা চিঠি এসেছে। তবে ভবিষ্যৎ থেকে নয়, অতীত থেকে। আবার নিকট অতীত ও নয়। এসেছে ১৯২৪ সাল থেকে।’
‘সেটা কিভাবে সম্ভব?’
‘অসম্ভবের কী আছে? তোমার আজকে লেখা একটা চিঠি যদি এক সপ্তাহ ভবিষ্যতে কেউ পেতে পারে, তবে একশো বছর পরেও পাওয়া সম্ভব। এখানে টাইম ট্রাভেলের কোন ব্যাপার নেই, আর পদার্থবিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলোর কোন ব্যত্যয়ও ঘটছে না।
‘ওহ, সেটাও ঠিক। তাহলে?’
‘কেন অবাক হয়েছি সেটা তুমি বুঝবে চিঠিটা পড়লে।’
‘কোথায় সেটা?’
‘আপাতত তোমার হাতেই আছে। খুলে পড়ে দেখ। তারপর বাকীটা বলছি।’
প্রফেসরের কথা শুনে হাতের খামের দিকে নজর দিলাম। খামটা খোলাই ছিল। তাই চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করলাম। চিঠিতে যা লেখা ছিল সেটা এরকম-
প্রিয় প্রফেসর প্লুটো নাথ,
আমি জানি এই চিঠি পেয়ে তুমি বিস্মিত হয়েছ। সময় ভ্রমণের পরীক্ষায় তোমার উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
আমাকে তুমি চিনবে না। আমার নাম সত্যজিৎ সেন। আমি কালসিন্ধুপুর গ্রামের বর্তমান জমিদার। এই চিঠিটা আমি তোমাকে লিখছি ১৯২৪ সালের ২২শে জানুয়ারি তারিখে। আমি জানি এখনো তোমার জন্মই হয়নি। কাজেই তুমি অবাক হচ্ছ এই ভেবে যে তোমার জন্মের আগে কেউ একজন তোমার উদ্দেশ্যে চিঠি কি করে লিখল সেই ভেবে। তারচেয়ে অবাক হচ্ছ কেন তোমার দেয়া সময় পরিব্রাজকদের আসরের দিনেই এই চিঠিটা তোমার হাতে এলো সেই ভেবে।
তবে তুমি বুদ্ধিমান মানুষ। কাজেই একটু মাথা খাটালেই তুমি বুঝতে পারবে এই চিঠিটা লিখতে হলে আমাকে ভবিষ্যৎ জেনে নিয়েই লিখতে হচ্ছে। হ্যাঁ, সত্যিটা সেটাই। আমি ভবিষ্যৎ দেখেই এই চিঠিটা লিখছি। তবে এই ভবিষ্যৎ দেখার জন্য আমাকে জ্যোতিষী হতে হয়নি।
আমি এখন জমিদার হলেও যখন আমার বয়স কম ছিল তখন একজন ভূপর্যটক হতে চাইতাম। সেই নেশাতে ঘুরেছিও প্রচুর। আমার সাতাশ বছর বয়সের সময় নেপাল ভ্রমণকালে আমি ঘটনাচক্রে এক গুম্ফার প্রধান লামার কাছ থেকে একটি যান্ত্রিক গোলক লাভ করি। সেই যন্ত্রটির মাধ্যমে অতীত এবং ভবিষ্যতের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব ছিল। আমার বিশ্বাস যন্ত্রটির সৃষ্টি আমাদের এই পৃথিবীতে নয়। যাহোক সেসব তুমি কালক্রমে জানতে পারবে।
আপাতত এইটুকু বলি আমার এই দাবি যেন তোমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় সেকারণেই এমন ব্যবস্থা করেছি যেন এই চিঠিটা তোমার দেয়া সময় পরিব্রাজকদের আসরের দিনেই তোমার হাতে পৌছায়।
আমার দুর্ভাগ্য যে তারিখটা জানা থাকলেও সশরীরে সেই আসরে পৌঁছানোর জন্য আমি বেঁচে থাকব না। কাজেই এই চিঠিই আমার শেষ ভরসা। সেই বিশেষ যন্ত্র গোলক এখনো আমার কাছেই আছে। আমি সেটা এক গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখে যাচ্ছি আর তার সূত্র রেখে যাচ্ছি আমার বাড়িতে। আমি চাই তুমি আমার সেই সময় গোলক খুঁজে বের করো।
আমি ভবিষ্যৎ দেখেছি, কাজেই আমি জানি এই চিঠি প্রাপ্তির পর কী কী হবে। কিন্তু সেই ভবিতব্যকে পাল্টে দেবার কোন ইচ্ছে আমার নেই। তাই ভবিষ্যৎ যাই হোক, প্রশান্ত মনে গ্রহণ করো। তোমার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
ইতি
তোমার অতীতের বন্ধু
শ্রী সত্যজিৎ সেন
৩।।
৩০শে জুন,
আজ সকালে আমরা তিনজন কালসিন্ধুপুর পৌঁছেছি। তিনজন মানে হলাম আমি, প্রফেসর আর প্রফেসরের প্রিয় বেড়াল নেপচুন। স্থানীয় ডাকবাংলোতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। সেখানেই উঠেছি।
প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ের ডাকবাংলো। এখানে লোক বলতে শুধু লক্ষণ নামের একজন। সে-ই এই বাংলোর কেয়ারটেকার, দারোয়ান, মালী সব। আমাদের পেয়ে সে যেরকম অবাক হয়েছে তাতে বুঝেছি বাইরের লোক এখানে খুব একটা আসে না। লক্ষণকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি এই গ্রামে সত্যিই সত্যজিৎ সেন নামের একজন জমিদার ছিলেন এবং তার জমিদার বাড়িটি এখনো আছে।
আমি আর প্রফেসর বিকেলে গিয়ে সেই বাড়ী দেখতেঁ গেলাম। জমিদার বংশের কোন বংশধর না থাকাতে বাড়িটা এখন বলতে গেলে পরিত্যক্ত। তবে বাড়ির মন্দিরে এখনো পূজো হয়। মন্দিরের বর্তমান ঠাকুরমশাই-ই বাড়িটির দেখভাল করেন।
সত্যজিৎ সেন তার চিঠিতে লিখেছিলেন যে লুকানো সময় গোলকের সূত্র এই বাড়িতেই লুকানো আছে। কিন্তু সেটা যে কী হতে পারে সেই ব্যাপারে আমাদের কোন ধারণা ছিল না। প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, ‘জিনিসটা একটা ম্যাপ হতে পারে, বা কোন জটিল ধাধাও হতে পারে। আমি তোমাকে কিছু কী-ওয়ার্ড দিচ্ছি। যেমন ধর আমাদের খুজতে হবে ম্যাপ বা নকশা, গোলক, ঘড়ি, ধাধা, ছবি, ডায়েরি, কো ওর্ডিনেটস এই রকমের কিছু। কাজেই বাড়ির কোথাও যদি এই ধরনের কিছু চোখে পড়ে তবে সেটাকে বিশেষ নজর দেবে।’
কিন্তু পুরো বাড়ি ঘুরেও অমন কিছু আমাদের নজরে পড়ল না। তবে শেষ বেলায় বাড়ির ছাদে এমন একটা জিনিস পাওয়া গেল যেটা প্রফেসরের দেয়া কি-ওয়ার্ড এর সাথে মিলে গেল। জিনিসটা একটা পাথরের তৈরি সূর্যঘড়ি। ঘড়িটায় সূর্যের আলো পড়লে ছায়া দেখে সময় জানা যায়। ঘড়ির সামনে একটুকরো সাদা মার্বেল পাথরের ফলকে সত্যজিৎ সেনের নাম দেখে বোঝা গেল এই ঘড়িও তারই সময়ে বানানো। ফলকে সত্যজিৎ সেনের নামের উপরে তিন লাইনের একটা ছোট্ট ছন্দ লেখা-
কালের খেলা রহস্যময়,
যার থাকার কথাই নয়,
তার কাছেই রইল সময়।
পুরো জিনিসটার সাথে সময়ের যে একটা সংযোগ আছে সেটা স্পষ্ট। তবে ছড়াটা আমার খানিকটা হেয়ালি বলেই মনে হল।
বাড়ি দেখা শেষ হলে আমরা আবার ঠাকুরমশাইয়ের সাথে দেখা করলাম। তার কাছ থেকে জানা গেল জমিদার বাড়ি ছাড়াও এই গ্রামে সত্যজিৎ সেনের প্রতিষ্ঠা করা একটি স্কুল এবং আরও বেশ কয়েকটি মন্দির আছে। জমিদার বাড়ি থেকে ফেরার পথে প্রফেসরকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলাম
‘কোন আশার আলো কি দেখতে পাচ্ছেন?’
‘আর একটু ভাবনা চিন্তা না করে এখনি বলতে পারছি না।’
‘তারমানে আপনি আশাবাদী?’
উত্তরে নেপচুনের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে প্রফেসর বললেন, ‘দেখ নিরাশাবাদী আমি কোনকালেই নই, বিশেষ করে টাইম ট্রাভেল এর ব্যাপারে তো একেবারেই নই।’
প্রফেসরের কথায় বুঝলাম আমাদের বৈকালিক ভ্রমণ সম্ভবত একেবারে বৃথা যায়নি। কিছু একটা জিনিস উনি পেয়েছেন যেটা এখনি বলতে চাচ্ছেন না।
ডাকবাংলোতে ফিরে দেখি আরেক ব্যাপার। দূর থেকে বাংলোর সামনে একটা জিপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আন্দাজ করেছিলাম যে অন্য কোন অতিথি হয়ত এসেছেন। লক্ষণের সাথে দেখা হতে সে বলল, ‘অবাক ব্যাপার বটে বাবু! এখানে পুরো বছরেও দুজন অতিথি আসে না। আর আজকে একদিনেই দুজন।’
খানিকক্ষণের মধ্যেই অবশ্য নতুন আগত ভদ্রলোকটির সাথে দেখা হল। আমরা তখন বাংলোর বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। ভদ্রলোক এসে নিজে থেকেই পরিচিত হলেন। নাম বললেন বীরেন ঘোষাল। পেশায় এন্টিক ডিলার। বললেন, ‘আমি এসেছি এখানকার জমিদার বাড়ি দেখতে। যদি সংগ্রহ করার মত কিছু পাওয়া যায় আরকি। বোঝেনই তো, পুরানো জিনিসের ভালোই দাম আছে আজকাল।’
প্রফেসর কিন্তু ভদ্রলোকের কথায় খুব একটা কর্ণপাত করলেন বলে মনে হল না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তিনি নেপচুনকে নিজের আবিষ্কৃত ফিস ক্যাপসুল খাওয়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। আমরা যে খানিক আগেই জমিদার বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছি সে কথাটা ভদ্রলোককে বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু প্রফেসরের অনীহা দেখে চেপে গেলাম।
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে শুনলাম বারান্দায় বসে বীরেন বাবু লক্ষণকে জমিদার বাড়ি নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন করছেন। ভদ্রলোককে কেন যেন খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছেনা। আমার মন বলছে ভদ্রলোকের মধ্যে এমন অস্বাভাবিক কিছু আছে, যেটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না।
৪।।
১লা জুলাই
আজকে সারাটা দিন খুব ব্যস্ত কেটেছে। সত্যজিৎ সেনের সময় গোলকের সন্ধান এখন পর্যন্ত পাওয়া না গেলেও প্রফেসরের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু একটা সূত্র পেয়েছেন। আর বীরেন বাবু আজকে যা করেছেন তাতে তার প্রতি সন্দেহটা আরও প্রবল হয়েছে। সব কিছু এক এক করে লিখছি।
সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে প্রফেসর বললেন তিনি সত্যজিৎ রায়ের প্রতিষ্ঠা করা মন্দিরগুলো একবার ঘুরে দেখতে চান। লক্ষণকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল গ্রামে সব মিলিয়ে নয়টি মন্দির আছে যেগুলো সত্যজিৎ সেনের বানানো আর সেগুলো পুরো গ্রাম এমনকি গ্রামের বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমাদের অনুরোধে পথ চিনিয়ে দেবার জন্য লক্ষণ নিজের বছর দশেকের ছেলে ন্যাপাকে আমাদের সাথে দিয়ে দিল।
আমরা ডাকবাংলোর সবচেয়ে কাছের মন্দিরটা থেকে শুরু করলাম। ডাকবাংলোর থেকে দক্ষিণে আধ মাইল দূরে একটা দিঘীর পাড়ে মন্দির। ছোট ছোট লাল পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি অর্ধগোলাকৃতির মন্দিরটা দেখে সেটাকে মন্দিরের বদলে এস্কিমোদের ইগলু বলেই মনে হল। ন্যাপাকে জিজ্ঞেস করে জানাগেল সত্যজিত সেনের বানানো সবগুলো মন্দিরই নাকি দেখতে এই রকম।
প্রফেসর প্রায় ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে খুব মনোযোগের সাথে বিগ্রহ, বেদি, মন্দিরের দেয়াল সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘চলো এবারে পরের মন্দিরটা দেখা যাক।’
আমরা ফিরতি পথ ধরছি, এমন সময় দেখলাম বীরেন বাবু দ্রুত পায়ে হেঁটে আমাদের দিকেই আসছেন। ভদ্রলোককে আসতেঁ দেখে আমি আর প্রফেসর দুজনেই বেশ অবাক হলাম। ভদ্রলোক কিন্তু আমাদের দেখতে পেয়ে এক গাল হেসে বললেন-
‘আপনাদের কাছেই যাচ্ছিলাম মশাই। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। উঠে শুনলাম আপনারা এদিকেই এসেছেন।’
‘আমাদের কাছে! কোন বিশেষ দরকার কী?’
‘না না, তেমন কিছু নয় সকালে উঠে শুনলাম আপনারা নাকি মন্দির দেখতে বেরিয়েছেন। তাই ভাবলাম আপনাদের সাথে যদি যোগ দেয়া যায় আরকি। একা একা ঘুরে কী আর মজা পাওয়া যায় বলুন?’
ভদ্রলোকের গায়ে পড়া ভাবটা আমার বা প্রফেসর কারোই পছন্দ হল না। তবু সরাসরি না বলে দিতে ভদ্রতায় বাঁধল। তাই বললাম, ‘দেখুন আমরা কিন্তু জমিদার বাড়িতে যাব না। সেটা আমরা কালই গিয়েছি। তাই আমদের সাথে থাকলে কিন্তু আপনি যে কাজে এসেছেন সেটা আর হবে না…’
ভদ্রলোক আমাকে বাঁধা দিয়ে বললেন, ‘তা সে আমি পরে কোন একসময় দেখে নেব। আর মন্দিরেও যে দামী জিনিস পাওয়া যাবে না, তার কী কোন গ্যারান্টি আছে বলুন?’
কাজেই ইচ্ছে থাকলেও ভদ্রলোককে ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। ভদ্রলোক আমাদের সাথেই রইলেন।
সারাদিনে আমরা সবমিলিয়ে পাঁচটা মন্দির ঘুরে দেখেছি। তবে কোন মন্দিরেই সত্যজিৎ সেনের সময় গোলকের সাথে সম্পর্ক থাকতে পারে এমন কিছু আমার চোখে পড়েনি। প্রফেসরকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারিনি, কারণ পুরোটা সময় প্রফেসর একদম চুপ করে ছিলেন।
আর বীরেন বাবু যে কী দেখেছেন তা শুধু তিনিই বলতে পারবেন। প্রত্নবস্তুর প্রতি তার টান যে শুধুই ব্যবসায়িক তা বুঝতে কষ্ট হয় না। আমাদের পিছে পিছে ঘোরা ছাড়া বারকয়েক শুধু তিনি আমাদের থেকে দূরে গিয়ে মোবাইল ফোনে কার সাথে যেন কথা বলেছেন।
রাতে খাবার পর প্রফেসর তার আদরের নেপচুনকে ঘুম পাড়ানোর জন্য দ্রুত নিজের রুমে চলে গেলেন। আমি একা একা আরো খানিকটা সময় বারান্দায় বসে থেকে যখন নিজের ঘরে ফিরছি তখনি দেখা হল বীরেন বাবুর সঙ্গে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম
‘কাল জমিদার বাড়ি দেখতে যাচ্ছেন তো?’
‘সে যাব। তবে আপাতত আপনাদের সাথে বাকী মন্দিরগুলো দেখে শেষ করি। হে হে।’
বুঝলাম ভদ্রলোক আগামীকালও আমাদের পিছু ছাড়ছেন না। তাকে বিদায় জানিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম, আর তিনি দেখলাম লক্ষণকে ডাকতে ডাকতে বারান্দার দিকে গেলেন। ভদ্রলোকের এই আচরণটাই সন্দেহজনক। যে জিনিসে দেখতে এসেছেন, সেটার প্রতি কোন আকর্ষণ আছে বলে মনে হয় না।
৫।।
২রা জুলাই
খুব উদ্বিগ্ন মনে লিখতে বসেছি। আজ বিকেলে প্রফেসর প্লুটো হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সম্ভবত এই বয়সে পরপর দুদিন দিনব্যাপি হাঁটাহাঁটির ধকল নিতে পারেননি। আমি এতক্ষণ প্রফেসরের কাছেই ছিলাম। এখন তিনি ঘুমচ্ছেন, সেই সুযোগে লিখছি।
গতকালের মত আজকেও ব্রেকফাস্ট শেষে প্রফেসর, আমি আর বীরেন বাবু, ন্যাপাকে নিয়ে বাকী চারটে মন্দির দেখার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। এই মন্দিরগুলো অপেক্ষাকৃত ভাবে গ্রামের বাইরের দিকে হওয়ায় আর যাতায়াতের জন্য পথ না থাকায় মাঠের মধ্য দিয়ে আমাদের অনেকটা হাঁটতে হয়েছে।
সেই সূত্রে অবশ্য কালসিন্ধুপুর গ্রামটাও অনেকটা দেখা হয়েছে। গ্রামটা এমনিতে ভারী সুন্দর। গ্রামের এক পাশে নদী আর এক পাশে ঘন জঙ্গল। মাঝের পুরোটা জায়গা জুড়ে সবুজ ফসলের ক্ষেত। প্রথম তিনটে মন্দির দেখা শেষ হতে হতে প্রফেসরকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কোন একটা অস্বস্তি বোধ করছেন। শেষ মন্দিরটা একদম গ্রামের বাইরে জঙ্গলের ধারে শুনে তিনি বললেন, ‘অনেকটা পথ, ওটা বরং কাল দেখি কি বলো?’ তারপর আবার নিজেই মত পরিবর্তন করে বললেন, ‘থাক চলো দেখি পারি কিনা।’
কিন্তু সেটা আর হলনা। আধ মাইল মত পথ হাটার পর প্রফেসর আচমকাই পথের এক পাশে একটা গাছের গুড়ির উপর বসে পড়লেন। তখন আমি আর বীরেন বাবু মিলে তাকে বহুকষ্টে ডাকবাংলোতে নিয়ে এলাম। ভুলটা আসলে আমারই। প্রফেসর প্রথমবার বলার পরেই যদি আমরা ডাকবাংলোতে ফিরে আসতাম তাহলে হয়তো এই ঝামেলাটা হত না।
ডাকবাংলোতে ফিরে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর প্রফেসর খানিকটা ভালো বোধ করায় তাকে তার ঘরে শুইয়ে দিয়ে আমি নিজের ঘরে এসেছি। এখন অবশ্য প্রফেসরের রুম থেকে জোরে নাক ডাকার শব্দ শুনে বুঝতে পারছি যে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
বাইরের বারান্দায় বীরেন বাবুর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। লক্ষণের সাথে তার কথা বার্তা শুনে মনে হচ্ছে এই ভর সন্ধেবেলায় ভদ্রলোক কোথাও বের হচ্ছেন।
৬।।
৩রা জুলাই
কাল রাতে যা হয়েছে তা বর্ণনা করা আমার দুঃসাধ্য। সে কথা ভাবতে গেলে এখনো শরীরে শিহরণ হচ্ছে। এমন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সত্যি বলতে এর আগে হয়েছে কিনা মনে করতে পারছি না।
কাল সন্ধ্যায় বীরেন বাবু বেরিয়ে যাবার পর আমিও লেখা শেষ করে নিজের বিছানায় শুয়ে ছিলাম। পাশের ঘর থেকে প্রফেসরের নাক ডাকার শব্দ শুনতে শুনতে আমার নিজের চোখও যখন প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে, ঠিক তখন আচমকাই দরজার কড়া নড়ে উঠল। প্রফেসরের কিছু হল কিনা ভেবে দ্রুত পায়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি স্বয়ং প্রফেসর প্লুটো দরজার দাঁড়িয়ে। তার চেহারায় অসুস্থতা বা ঘুমের ছাপ বিন্দুমাত্র নেই। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘প্রফেসর আপনি? আপনার শরীর ঠিক আছে তো?’
প্রফেসর আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চাপা স্বরে বললেন, ‘কোন কথা নয়। চুপচাপ আমার সাথে এসো।’
বাংলো থেকে বেরোনোর মুখ লক্ষণের সাথে দেখা। আমাদের এভাবে বেরোতে দেখে সে নিজেও অবাক। কোথাও যাচ্ছি কিনা জিজ্ঞেস করাতে প্রফেসর তাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন আমরা জমিদার বাড়িতে যাচ্ছি।
বাংলো থেকে বেরিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম,’প্রফেসর, আপনার কি হাঁটার মত অবস্থা আছে?’
উত্তরে হো হো করে হেসে প্রফেসর বললেন, ‘আরে মন্ডল, অতটা বুড়ো আমি এখনো হই নি। আর অসুস্থ হবার নাটক না করে ওই বেটা ঘোষালকে কোন ভাবেই পিছন ছাড়া করতে পারছিলাম না। কেমন চিপকে লেগে ছিল সেতো দেখেছোই।’
প্রফেসরের কথায় আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। সত্যি বলতে কি আমার এই বয়স্ক বন্ধুটি আমার কাছে বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা এখন কোথায় চলেছি প্রফেসর? জমিদার বাড়ি যে যাচ্ছি না সেতো বুঝতেই পারছি।’
‘আমরা যাচ্ছি সত্যজিত সেনের সময় গোলকটা উদ্ধার করতে।’
‘সেকি! তারমানে আপনি এরই মধ্যে আবিষ্কার করতে পেরেছেন যে সেটা কোথায় আছে?’
উত্তরে প্রফেসর খানিকটা হেঁয়ালি করে কবিতার মত করে বললেন-
“কালের খেলা রহস্যময়,
যার থাকার কথাই নয়,
তার কাছেই রইল সময়।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম
‘এটা-তো সেই জমিদার বাড়ির সূর্যঘড়ির ফলকে লেখা ছিল।’
‘হ্যাঁ মন্ডল। এটা পড়ে তোমার কী মনে হয়েছে বলতো শুনি?’
‘কী আর মনে হবে ? কিছুটা ভাববাদী ভাবনা। ভদ্রলোক হয়তো বোঝাতে চাইছিলেন যে যার বেঁচে থাকার কথা নয়, সেই বেঁচে গেল।’
আধো অন্ধকারের মধ্যে প্রফেসরের মুখ দেখে বুঝলাম তিনি আমার উত্তর শুনে মিটিমিটি হাসছেন। তারপর বললেন, ‘তোমার ভাবনাটা অস্বাভাবিক নয়। প্রথমে আমারও ওরকমই মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে ভালো করে ভেবে বুঝলাম এই কবিতার মধ্যেই আছে সত্যজিৎ সেনের সময় গোলকের হদিস।’
‘অ্যাঁ, তাই নাকি? কিরকম?’
‘আচ্ছা বলো দেখি এই গ্রামে সত্যজিৎ সেনের বানানো কয়টা মন্দির আছে?’
‘কয়টা আবার, দশটা?’
‘উহু, জমিদার বাড়ির মন্দিরটা ওনার বানানো নয়। ওটা ওনার পূর্ব-পুরুষের বানানো। আর ওনার বানানো মন্দিরগুলো গোলাকৃতির, সেই হিসেব করে বলো।’
‘ওহ, তাহলে নয়টা।’
‘হ্যাঁ, এবারে বল দেখি আমাদের সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা কয়টা?’
‘কয়টা আবার? নয়টা।’
‘ঠিক। তোমাকে বলেছিলাম সবগুলো মন্দিরের অবস্থান ম্যাপে মার্ক করে রাখতে। করেছো আশা করি?’
‘হ্যাঁ।’
‘বের করো।’
আমি পকেট থেকে মোবাইল ফোনে ম্যাপ বের করে প্রফেসরকে দেখালাম। প্রফেসর ফোনের পর্দায় আঙ্গুল দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এবারে দেখ, জমিদার বাড়ি বা জমিদার বাড়ির ছাদের এই সূর্য ঘড়িটাকে যদি সৌর জগতের কেন্দ্র বা সূর্য বলে ধরে নাও, তবে দেখ নয়টা মন্দির কিভাবে গ্রহগুলোর মত একে ঘিরে আছে। এই এইটা হল বুধ, এই শুক্র, এই পৃথিবী…। প্রতিটা মন্দির গোলাকার, আবার একেকটার আকার একেক রকম। কোনটা বড় কোনটা ছোট। বুঝতে পারছো?’
প্রফেসরের নির্দেশমতো ম্যাপে লক্ষ্য করতেই এবারে পুরো নকশাটা আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল। আমি বিষ্ময়মাখা গলায় বললাম, ‘তাই তো দেখছি! কিন্তু এই জিনিস আপনি কিভাবে আবিষ্কার করলেন প্রফেসর?’
‘আন্দাজ তো প্রথম দিনে নয়টা মন্দিরের কথা শুনেই করেছিলাম। কিন্তু নিশ্চিত হবার জন্য সবগুলো মন্দিরের অবস্থান জানা দরকার ছিল। আর এটুকু আবিষ্কার করতে পারলেও সময় গোলক কোথায় আছে সেটা তখনো বুঝতে পারছিলাম না।’
‘সেটা কিভাবে পারলেন?’
‘সূত্রটা আছে ওই কবিতার মধ্যেই।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, ওই শেষ দুলাইন ভালো করে ভাবলেই উত্তরটা পাওয়া যাচ্ছে।’
‘সেটা কীরকম?’
‘দেখ ওই লাইনদুটি যদি একটু অন্যভাবে ভাবি তবে বলা যায় একজনের কাছে সময়টা রাখা আছে, যার আদতে থাকার কথাই নয়। ঠিক কিনা?’
আমি খানিক ভেবে বললাম, ‘তা ঠিক।’
‘এবারে ভেবে দেখ এই যে নয়টা মন্দির, এরা যদি একেকটা গ্রহের প্রতিরূপ হয়, তবে এদের মধ্যে এমন একটা গ্রহ আছে যার এখানে থাকার কথা নয়।’
‘থাকার কথা নয়?’
‘না। হিসেব করে দেখো, আমার কাছে লেখা চিঠিটায় সত্যজিৎ সেন তারিখ দিয়েছিলেন ২২শে জানুয়ারি ১৯২৪। তার মানে এই মন্দিরগুলো ততদিনে তৈরি হয়ে গেছে। ১৯২৪ এর হিসেবে এখানে একটা গ্রহ সত্যিই বেশি আছে।’
‘সেকি?’
‘হ্যাঁ। সৌরজগতের শেষ গ্রহ, আমার নাম যার নামে, সেই প্লুটো। সে আবিষ্কার হয়েছিল ১৯৩০ সালে। কাজেই ১৯২৪ সালে প্লুটোর থাকার কথা নয়।’
‘আরিব্বাস প্রফেসর। তারমানে সময় গোলক আছে প্লুটোর কাছে?’
‘তাইতো মনে হচ্ছে।’
কথা বলতে বলতে আমরা এরই মধ্যে গ্রামের বাইরে জঙ্গলের কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম। ম্যাপ দেখে বুঝলাম জঙ্গলের ধারে যে মন্দিরটা দেখা বাকী রয়ে গিয়েছে সেটারই অবস্থান প্লুটো গ্রহের স্থানে। প্রফেসর বললেন, ‘চলো মন্ডল, দেখা যাক সত্যজিৎ সেন প্লুটোর কাছে আমাদের জন্য কী রহস্য লুকিয়ে রেখে গেছেন।’
৭।।
আমরা দুজন আধো অন্ধকারের মধ্যে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম। মন্দিরটা দেখে বোঝা যায় বহুকাল এখানে কারো পা পড়েনি। বাইরের দেয়াল জুড়ে অশ্বত্থ গাছের বাড় বাড়ন্ত। কোন এককালে কাঠের দরজা ছিল। সেটা এরই মধ্যে ভেঙ্গে পড়েছে।
এই মন্দিরে আমরা এর আগে আসিনি। তাই ভিতরে কী আছে সেটা আমাদের দুজনের কাছেই রহস্য। প্রফেসর সাথে করে নিজের আবিষ্কৃত হোভার ল্যাম্প নিয়ে এসেছিলেন। মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে সেটাকে জ্বালিয়ে ছেড়ে দিলে সেটা একা একাই বাতাসে ভেসে আমাদের পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো।
হোভার ল্যাম্পের আলোতে প্রথমেই চোখ গেল মন্দিরের বিগ্রহের দিকে। অন্য মন্দিরগুলোতে পাথরের বিগ্রহ থাকলেও এই মন্দিরের বিগ্রহ দেখলাম পোড়া মাটির তৈরি। মন্দিরের ভিতরের দেয়ালের কারুকার্যও অতি সাধারণ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল সত্যজিৎ সেন সম্ভবত চাননি এই মন্দিরটা বেশি লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করুক।
প্রফেসর বিগ্রহটা খানিকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। সেটা শেষ হলে একে একে মন্দিরের ভিতরের দেয়ালগুলোও দেখলেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখছিলাম, এমন সময় একটা কাণ্ড হল।
আমরা আসার সময় সাথে করে নেপচুনকে নিয়ে এসেছিলাম। এতক্ষণ সে আমার কোলেই ছিল। তবে লক্ষ্য করছিলাম কিছুক্ষণ ধরে সে কান খাড়া করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছে। তারপর হঠাৎ করেই কোল থেকে লাফিয়ে নেমে বিগ্রহের বেদির কাছে ছুটে গিয়ে নখ দিয়ে মেঝেতে আঁচড়াতে শুরু করল, আর সেই সাথে গলার ভিতর একটা গরগর শব্দ। প্রফেসর অবাক হয়ে বললেন,
‘নেপচুন সাধারণত ইঁদুরের আভাস পেলে এমন করে। কিন্তু এখানে আবার কী পেল?’
প্রফেসর এগিয়ে গিয়ে নেপচুনের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। তারপর মেঝেতে আঙ্গুল ঠুকে উল্লসিত হয়ে বললেন -‘মন্ডল, মনে হচ্ছে এখানে মাটির নীচে কোন একটা কিছু আছে। আর দেখ এখানে কিছু একটা খোদাই করাও আছে।’
এগিয়ে গিয়ে প্রফেসরের পাশে বসে দেখলাম মেঝেতে একটা জায়গায় সূর্যের নকশা আঁকা। আর তার চারপাশ ঘিরে নয়টা সরু গোল গর্ত। আমি বললাম
‘প্রফেসর, দেখেতো মনে হচ্ছে এটাও একটা সৌর মডেল। নয়টা গর্ত যদি নয়টা গ্রহ ধরা হয় তবে…’
‘মনে হওয়া নয়, এটা একটা সৌর মডেলই। আর সম্ভবত এর নীচে কোন গুপ্ত কুঠুরি আছে যেখানে আপাতত ইঁদুরের বসবাস। আর সেকারণেই নেপচুন বাবাজি এত রেগে গেছে।’
প্রফেসরের আন্দাজ ঠিক হলে মেঝের নীচের গুপ্ত কুঠুরিতে সময় গোলকটা থাকার খুব ভালো রকম সম্ভাবনা আছে বুঝতে পেরে আমি জিজ্ঞেস করলাম- ‘কুঠুরি যদি থাকেও তবে সেখানে প্রবেশের উপায়টা কী?’
প্রফেসর কোন উত্তর না দিয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগলেন। তারপরেই হঠাৎ আমার বাহু খামচে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘উপায় সম্ভবত এখানেই আছে। এসো এদিকে এসো।’
প্রফেসর উঠে দাঁড়িয়ে মূর্তির কাছে গেলেন। তারপর মূর্তির গলার মালাটার দিকে ইশারা করলেন। দেখলাম মার্বেলের মত মসৃণ দশটা গোল গোল পাথর দিয়ে মালাটা তৈরি হয়েছে। প্রফেসর বললেন
‘পাথরগুলোর আকার লক্ষ্য করো মন্ডল। একেকটা এক এক আকারের। সাধারণ দেখায় মনে হবে খুব কাঁচা হাতের কাজ। কিন্তু আসলে তা নয়। এগুলো একেকটা একেক গ্রহের আনুপাতিক আকারে তৈরি।’
এরপরে যা হল তা অনেকটা রঙ্গিন পর্দায় দেখা সিনেমার মত। প্রফেসর মূর্তির গলা থেকে মালাটা খুলে নিয়ে সেটা থেকে পাথরগুলো খুলে ফেললেন। তারপর মেঝের সেই গর্তগুলোর কাছে গিয়ে পাথরের বলগুলোকে একে একে সঠিক জায়গামত প্রবেশ করালেন। গড়গড় শব্দ শুনে বোঝা গেল বলগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে কোথাও যাচ্ছে, কিছু খুটখাট যান্ত্রিক শব্দ হল আর তারপরেই আচমকা মন্দিরের বিগ্রহ মূর্তিটা একদিকে সরে গিয়ে একটা গর্তের মুখ খুলে গেল।
আমরা দুজন ছুটে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম গর্তের মুখ থেকে একটা সিঁড়ি ধাপে ধাপে নীচে নেমে গেছে। উত্তেজনায় ততক্ষণে আমার কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। প্রফেসর একহাতে নেপচুনকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘ভিতরে যেহেতু ইঁদুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, তারমানে বিষাক্ত গ্যাস নেই। কাজেই চলো নীচে নেমে দেখা যাক।’
সিঁড়ি বেয়ে আমরা মন্দিরের মাটির নীচের যে কুঠুরিতে পৌঁছলাম সেটা বড় জোর দশ হাত বাই দশ হাত হবে। উচ্চতা যা তাতে একজন মানুষ দাঁড়াতে পারে। পরক্ষণেই চোখ পড়ল কুঠুরির এক কোনে পাথরের বেদির উপর রাখা মসৃণ কাঁচের তৈরি একটা গোলকের দিকে। বুঝলাম এটাই সত্যজিত সেনের সেই সময় গোলক। আনন্দ উত্তেজনায় আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে হল, কিন্তু প্রফেসরের দিকে চেয়ে দেখলাম তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।
ইশারায় আমাকে পিছনে থাকতে বলে প্রফেসর নিজে পায়ে পায়ে গোলকের কাছে এগিয়ে গিয়ে সেটার গায়ে একটা হাত রাখলেন। আর সাথে সাথেই গোলকটা মৃদু আলোক বিচ্ছুরণ করতে শুরু করল। প্রফেসর তখন ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আরেকটা হাত গোলকের উপরে রাখলেন। আর সাথে সাথে গোলকের আলোর পরিমাণ অনেকটা বেড়ে গেল। প্রফেসরের মুখ দেখে মনে হল তিনি গোলকের ভিতরে কিছু দেখার চেষ্টা করছেন। আসলেই কিছু দেখা যাচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য সামনে এগোতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটা আমাদের দুজনেই হতভম্ব করে দিল।
‘হ্যালো প্রফেসর’ – একটা ঠাণ্ডা শীতল কিন্তু চেনা কণ্ঠ পিছন থেকে আমাদের দুজনকেই চমকে দিল। ঘুরে তাকাতেই যা দেখলাম আমাদের বাংলোর প্রতিবেশী বীরেন বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তার মুখে সেই তেলতেলে হাসিটা আর নেই। বরং তার বদলে তার মুখের ভাবটা মিলে যাচ্ছে হাতে ধরে রাখা কালো পিস্তলের সাথে।
ভদ্রলোক হিস হিসে কণ্ঠে বললেন ‘এই দিনটা, ঠিক এই দিনটার জন্য এতবছর ধরে অপেক্ষা করে আছি। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সময় গোলকটা দ্রুত আমার হাতে তুলে দিন।’
‘সময় গোলক? কিসের কথা বলছেন?’
‘হা হা হা, প্রফেসর আমাকে বোকা বানাতে পারবেন না। আপনি কী ভেবেছেন আমি না জেনে এই পর্যন্ত এসেছি? আচ্ছা বলুন দেখি আপনার টাইম পার্টির দিনে চিঠিটা কে আপনার দরজায় রেখে এসেছিল?
জানেন না তো। রেখে এসেছিলাম এই আমি। ওই চিঠি আমি পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। বাবা পেয়েছিল তার বাবার কাছ থেকে। আমার প্রপিতামহ ছিলেন এই জমিদার বাড়ির নায়েব। সত্যজিৎ বাবু মারা যাবার আগে তার কাছে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন ঠিক সময়ে ঠিক স্থানে এই চিঠি পৌঁছে দেবার।
আমার বাবা, ঠাকুরদা বোকা ছিলেন। দায়িত্ববোধ তাদের অন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু আমি সেই ভুল করিনি। আপনাকে পৌঁছে দেবার আগে ওই চিঠি আমি পড়েছি। আপনাকে তো বলেছি, আমার কাজকারবারই পুরানো জিনিস নিয়ে, খাম অক্ষত রেখে চিঠি পড়ার বিদ্যা আমার জানা আছে।’
আমরা এতক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে বীরেন বাবুর কথা শুনছিলাম। তার কথা শেষ হলে প্রফেসর বললেন, ‘ওই জিনিস আপনি সামলাতে পারবেন না বীরেন বাবু। ওটা অমিত ক্ষমতাশালী যন্ত্র, এই মহাবিশ্বের গতিপথ বদলে দেবার ক্ষমতা আছে ওটার। আপনার টাকা দরকার তো, টাকা আমি আপনাকে দেব।’
প্রফেসরের কথা শুনে আবারো ঘর কাপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন বীরেন বাবু। তারপর হাতের পিস্তলটা বাগিয়ে ঘরে দাতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আপনার কী মনে হয় প্রফেসর? ওই যন্ত্র দিয়ে ভবিষ্যৎ দেখে আমি যত টাকার মালিক হতে পারব, তার সামান্যতম অংশ দেবার মত টাকাও আপনার আছে? কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ওটা দিন।’
‘যদি না দিয়ে এটা ভেঙে ফেলি?’
‘সেই ক্ষমতা আপনার নেই প্রফেসর। একজন বিজ্ঞানী হয়ে নিজের আরাধ্য বস্তুকে এভাবে নষ্ট করার মত সাহস আপনার নেই। ওটা এক্ষণি আমার হাতে দিন, নাহলে এই মূহুর্তে আপনার এই বন্ধুটির প্রাণ বায়ু বের করে দেব।’
বীরেন বাবু পিস্তলের মুখ আমার দিকে ঘোরালেন। আমার গলা তখন শুকিয়ে কাঠ। প্রফেসর কথা না বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে এসে কাচের গোলকটা তুলে দিলেন বীরেন বাবুর হাতে।
বীরেন বাবু একহাতে গোলকটাকে পাঁজাকোলে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে ধরা পিস্তল না নামিয়ে এক পা এক পা করে পিছিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। প্রফেসর তাকে অভয় দিয়ে বললেন ‘বীরেন বাবু, সাবধানে উঠুন, গোলকটা অমূল্য।’
বীরেন বাবু একটা ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে বললেন, ‘সে ভাবনা আপনাকে আর ভাবতে হবে না এই পাতাল কুঠুরিই হবে আপনার শেষ ঠিকানা।’
একটা অশুভ আশঙ্কায় আমি শিউরে উঠলাম। মনে মনে প্রস্তুত হলাম, উনি যদি প্রফেসরের দিকে গুলি চালায় তবে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রফেসরকে বাঁচাব বলে। আমার মনোভাব বুঝতে পেরে প্রফেসর ফিসফিস করে বললেন ‘আমাকে না, পারলে গোলকটাকে বাঁচাও।’
প্রফেসরের কথাটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওদিকে বীরেন বাবু ততক্ষণে সিঁড়ির প্রায় উপরে পৌঁছে গেছেন। এমন সময় যা ঘটল তা আমার দূরতম কল্পনাতেও ছিল না।
আচমকাই একটা ভয়ংকর গর্জনের সাথে সাথে বিশাল আকৃতির হলদে কালো ডোরাকাটা প্রাণী লাফিয়ে পড়ল বীরেন বাবুর দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বীরেন বাবু চিৎকার করে একদিকে লাফিয়ে পড়লেন, তারপরেই সব নিশ্চুপ।
আমি ততক্ষণে ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি। এক পলকের জন্য যা দেখেছি তাতে প্রাণিটা যে বাঘ সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আমি কোন রকমে বিড়বিড় করে বললাম ‘প্রফেসর, বাঘ। জঙ্গল থেকে…’
প্রফেসর আমার কথাটা পাত্তা না দিয়ে বললেন ‘গোলক, গোলকটা গেল’।
তারপরেই হুড়মুড় করে দৌড়ালেন সিঁড়ির দিকে। আমি তাকে থামানোর জন্য পিছু নিলাম। আমার একটু দেরি হয়েছিল, সেই সুযোগে প্রফেসর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলেন।
প্রফেসরের পিছন পিছন উপরে উঠে আমার কিন্তু হতবাক অবস্থা হল। দেখলাম বীরেন বাবু একপাশে মেঝের উপরে পড়ে আছেন। আর সেই ভয়ানক হলুদ কালো ডোরাকাটা বনের রাজা রয়েল বেঙল টাইগার চুকচুক করে প্রফেসরের গায়ে গা ঘষছে।
আমি বললাম ‘প্রফেসর, ওটা একটা বাঘ…’।
প্রফেসর আমার দিকে কপট ধমকের সুরে বললেন, ‘আরে ধুর, বাঘ না কচু। এটা আমাদের নেপচুন।’
‘অ্যাঁ’
‘আরে হ্যাঁ, তোমাকে আমার ল্যাবে বসে সেদিন যে প্রোটিওনেটর দেখালাম, সেটার একটা কপি করে নেপচুনের গলার বেল্টে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ওটার মধ্যে বিড়ালের সাথে মিল রেখে বেশ কিছু প্রাণীর অবয়ব প্রোগ্রাম করা আছে। জিনিসটা আমার ঘড়ি থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তুমি বোধহয় লক্ষ্য করো নি, বীরেন বাবু নীচে ঢুকে যখন আমাদের দিকে পিস্তল তাক করেছেন, তখনি একটা ইঁদুরের পিছু পিছু নেপচুন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছে। সেই দেখে আমার মাথায় বুদ্ধিটা চলে এসেছিল।’
কথা শেষ করে প্রফেসর কব্জির ঘড়িতে একটা বাটন চাপ দিলেন। সাথে সাথেই বাঘ মিলিয়ে গিয়ে ফিরে এলো নেপচুন। প্রফেসর তাকে আদর করে কোলে তুলে নিলেন।
আমি যুগপৎ বিস্ময় আর প্রশংসা মাখা সুরে বললাম ‘ধন্যি প্রফেসর, ধন্যি আপনার উপস্থিত বুদ্ধি।’
‘কিন্তু সেটা করে লাভটা কী হলো বলো? ওই দেখ, সত্যজিৎ সেনের সময় গোলক চুরচুর হয়ে পড়ে আছে।’
দেখলাম অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকা বীরেন বাবুর হাত তিনেক দূরে মন্দিরের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে একরাশ কাচের টুকরো। মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেল।
তখন প্রফেসরই আমার ঘাড়ে চাপড় দিয়ে বললেন, ‘মন খারাপ করো না মন্ডল। এখন বুঝতে পারছি সত্যজিৎ সেন কেন চিঠির শেষে লিখেছিলেন – যাই হোক প্রশান্ত মনে গ্রহণ করো।’
তারপর আর কি, বীরেন বাবুর মিনিট দশেক অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, জ্ঞান ফেরার পর তাকে ধরে নিয়ে স্থানীয় পুলিশের হেফাজতে দিয়ে আমি আর প্রফেসর আবার কলকাতার পথ ধরেছি। গাড়িতে বসে প্রফেসর বললেন – ‘ভেবে দেখলাম মন্ডল, ওই সময় গোলক আসলে না পেয়েই ভালো হয়েছে। ওই জিনিসের লোভ যে সত্যজিৎ বাবু কী করে সামলে ছিলেন সেটা একটা রহস্য বটে।’
আমি বললাম ‘আজ্ঞে প্রফেসর প্লুটো, আঙুর ফল টকই হয়ে থাকে।’
আমার কথা শেষ হতে দুজনেই প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠলাম। নেপচুন কী বুঝলো কে জানে। সে বলল ‘ম্যাও’।
প্রফেসর প্লুটো ও সময় গোলক রহস্য সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
স্বপ্নভঙ্গ
বেদ কথা
নতুন ভারত