চিংড়ির মালাইকারি গল্প – পাপিয়া বসু
“মা আ আ-
ও ও মা –“
“বলো না, কান দুটো তো খোলাই আছে, নাকি?”
“চিংড়ির মালাইকারি কি খুউব ভালো একটা খাবার?”
শুধোলো রজত।
একেবারে নিটোল গোল হয়ে ফুলে ওঠা রুটিটা ঝপ করে ডেকচিতে ফেলে চমকে ছেলের দিকে তাকাল মহুয়া।
চোখ মুখ কুঁচকে ছেলেকে ধমকে উঠল,
” বলি পড়া হচ্ছে, না কি ভালো মন্দ খাবারের চিন্তা হচ্ছে, খুউব নোলা না?
সামনে বই খোলা, আর উনি করছেন মালাইকারির ধ্যান”
রজত থতমত খেয়ে বলল,
“না, মানে কখন বলব?
তুমি তো সবসময় ব্যস্ত,
ওই সুজিত বলছিল গো, খুব ভালো খেতে ওটা।
একটু খানি দিয়েই একথালা ভাত খেয়ে ফেলা যায়”
মহুয়া আবারও কর্কশ স্বরে বলল,
“ভালো খেতে তো কি করব আমি? করে খাওয়াতে হবে তোমায়?
দাঁড়াও বাড়ি যাই, আজ হচ্ছে তোমার।
এখন দোকানে ভিড়”
গজ গজ করতে করতেই পাঁজা পাঁজা রুটি সেঁকতে থাকে সে।
পাশেই দুটো ডেকচিতে বানানো রয়েছে তড়কা আর আলুর দম।
মহুয়া রুটি বানিয়ে চলেছে আর ওর বর সুজন সেগুলোকে প্যাকেট বন্দী করে চাহিদা মত আলুর দম বা তড়কার সাথে কাস্টমারদের হাতে চালান করে পয়সাকড়ি বুঝে নিচ্ছে।
সুজনের কারখানা বন্ধ হবার পর থেকে এই ছোট্ট দোকানঘর ভাড়া নিয়ে রুটি তড়কা বিক্রি করেই ওরা চালিয়ে নেয় ওদের সংসার।
এখন বাড়ির বউদের অনেক রকম কাজ, রুটি বানানোর অনেক হ্যাপা, সময় হাতে থাকে খুব কম তাই দোকানটা তাদের ভালোই চলে। রুটির বিক্রি বেশ ভালো।
সুজন বাজার হাট করে আনে বেশ গুছিয়ে। দিনে সব মশলা টশলা তৈরী করে রাখা, কিছুটা আটা মেখে রাখা, এসব করে রাখে মহুয়া ।
সন্ধ্যা হলেই পুরো পরিবার এই দোকানেই।
ছেলের পড়ার ব্যাবস্থা করে রেখেছে এক কোণে, ছোট্ট টুলের ওপর বই রেখে রজত পড়ে।
ভাড়ার ঘরে একা রেখে আসতে ভরসা পায়না মহুয়া।
চোখের সামনে থাকাই ভালো,
তাছাড়া পড়ছে কিনা সেটারও নজরদারি করা যায়।
অসুবিধা শুধু একটাই, রাস্তার পাশে দোকান, বড্ড আওয়াজ।
তবু আশায় বুক বাঁধে মহুয়া,
এদেশেরই এক মহাপুরুষ যদি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পড়ে বিদ্যাসাগর হতে পারে, তার ছেলেটারই বা লেখাপড়া হবেনা কেন?
যতই বকুক মহুয়া, সে জানে ছেলেটার বুদ্ধি সুদ্ধি আছে, স্কুলের মাষ্টার দিদিমনিরাও সেকথা বলে।
ওই আশাটুকুই তো শক্তি যোগায়, সব রকম লড়াইয়ের অন্তরালে তার একান্ত আর গোপন অহংকার। এই অহংকার সে কারো সাথে ভাগ করেনা, নিজেকে লুকিয়ে রাখে এক শক্ত খোলসে।
চোখের কোণ দিয়ে ছেলেকে দ্যাখে একবার পরম মমতায়, নিজেকেও লুকিয়ে।
আ হা রে , বকুনি খেয়ে মুখটা কেমন ছোট্ট হয়ে গেছে। একমুঠো মায়ার পুঁটলি যেন,
টুলের ওপর বই রেখে বইয়ের উপর আঙুল রেখে এখন কেমন এক মনে পড়ে চলেছে।
এত আওয়াজ চারদিকে, কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।
আজ ঘরে ফিরে ওর বাবাকে বলতে হবে কাল যেন মাছ বাজারে গিয়ে একবার খোঁজ নেয়, এখন বড় চিংড়ির দাম কত?
মাসের খরচের থেকে কুলোবেনা সেটা সে জানে,
তার কাছে কিছু জমানো টাকা আছে,ওখান থেকেই না হয়…..
মহুয়ার মুখের কাঠিন্যটুকু দেখে বোঝার উপায় নেই যে ওর মনে কি চলছে।
এটা করতে হয়, মহুয়া এটাই বিশ্বাস করে যে ধমকে ধামকেই রাখতে হবে ছেলেকে, বেশি আদর প্রশ্রয় দিলে ওর বায়না আর চাহিদা বাড়তেই থাকবে।
আজ ওর ঘুম আসার সময়টাতে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেবে খন।
একটার পর একটা রুটি সেঁকে ডেকচিতে ফেলতে থাকে সে, সময় নষ্ট করা চলবেনা।
///////////////////
অফিস থেকে ফেরার পথে রেশমি ভাবলো,
আজ বরং রুটি কিনে নিয়ে যাই, কাল রাতের চিকেন কারি আছে খানিকটা। রাতের খাওয়া তো, ওতেই হয়ে যাবে।
রান্নার ঝামেলাটুকু না থাকলে সায়নকে একটু বেশি সময় ধরে পড়াতে পারে।
রুটির জন্য অপেক্ষা করতে করতে রেশমি শোনে, ওদের মা ও ছেলের সংলাপ।
একটু রাগই হয় রেশমির,
সে কিন্তু কখনোই এত রুক্ষ ভাবে ছেলের সাথে কথা বলেনা।
তবে ছেলের আব্দারগুলো বেশির ভাগই ভুলে যায়,
অফিসের কাজের চাপ, সংসারের উনকোটি ঝামেলা, ছেলের পড়াশোনার দায়িত্ব-
এতসব সামলাতে সামলাতে দিশেহারা সে।
শুভ্র তো নিজের অফিসটুকু ছাড়া কিছুই বোঝেনা।
রুটির দোকানে ওই মা ছেলের সংলাপ শুনতে শুনতে রেশমির এই মুহূর্তে হঠাৎই মনে পড়ল সায়নের একটা ছোট্ট আব্দারের কথা।
কিছু দিন আগে একদিন একটু আলুকাবলি বানিয়ে টিফিনে দিয়েছিল রেশমি।
সায়ন বাড়ি এসে বলেছিল, ” মা, একদিন একটু বেশি করে বানিয়ে বড় টিফিন বক্সে দিও তো,
আমার বন্ধুরা খেতে চেয়েছে।”
মনটা কেমন হয়ে গেল রেশমির।
ইইইস ! কবেএ বলেছিল ছেলেটা। নিজের ওপর ভারি রাগ হয়।
দেখি পারলে কালকেই —
সব কিছু আছে তো ঘরে?
মনে মনে উপকরণগুলো মেলাতে মেলাতে রুটি নিয়ে দ্রুত পায়ে এগোতে থাকে সে। সদ্য তৈরি হওয়া রুটির উত্তাপ ব্যাগের আস্তরণ ভেদ করে যেন স্পর্শ করে তাকে।
ডেকচিতে তখনও গরম রুটির ধোঁয়া, আর মহুয়া রুটি বেলেই চলেছে।
রাতের চাঁদ, তারাদের সাথে মিলেমিশে নরম আলোর আদর ছড়িয়ে দিচ্ছে এই নীল গ্ৰহের আনাচে কানাচে।
চিংড়ির মালাইকারি গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না