কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

শাস্তি

শাস্তি ভৌতিক গল্প – ঈশিতা গঙ্গোপাধ্যায়

ক্রিং ক্রিং ক্রিং।   

শোভন বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। মাঝরাতের এই কলে ও এতটুকু অবাক হল না। এই কলের অপেক্ষাতেই ছিল যে। একবার শুধু দেখে নিল শাশ্বতীর ঘুম ভেঙে গেছে কি না। ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছে ঘুম ভাঙার কথা নয় তবু শোভন একবার চেয়ে দেখল। নাহ, ঘুম ভাঙেনি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শোভন। আজকাল ল্যান্ডফোনের প্রয়োজন তেমন নেই। সবাই মুঠোফোনেই যোগাযোগ রাখে তবু শোভনদের বসার ঘরে ল্যান্ডফোনটা চুপচাপ বসে থাকে কোণের এক টেবিলে। শাশ্বতী ওকে কতবার বলেছে ল্যান্ডফোনটা কাটিয়ে দিতে। তবে শোভন কাটাতে পারেনি। প্রত্যেক পয়লা ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে শোভনের একটা কল আসে। সেটা না ধরতে পারলে হবে কি করে?      

শোভন বসার ঘরে লাইট জ্বালিয়ে কোণের টেবিলটার দিকে ধীরে-সুস্থে এগিয়ে এল। ফোনটা ধরামাত্র ভেসে এল পরিচিত কন্ঠস্বর। আওয়াজ যদিও খুব স্পষ্ট নয়। মনে হচ্ছে লাইনটা ডিস্টার্ব করছে। যেন ঝড়ের মধ্যে দিয়ে কথাগুলো ভেসে আসছে। প্রত্যেকবারই এমন হয়।     

মহিলাকন্ঠ প্রশ্ন করল, ‘কেমন আছো?’ 

শোভন বলল, ‘কেমন আর থাকব? ঘরে কেউ অসুস্থ থাকলে মন ভালো থাকে?’ 

‘সেই!’ মহিলাকন্ঠ সামান্য থেমে বলল, ‘প্রেমিকা চলে গেলে বেশ ভুলে থাকা যায় তবে স্ত্রী অসুস্থ হলে খুব কষ্ট হয়, তাই না?’   

‘আচ্ছা এইসব ছাড়ো!’ শোভন বলল। ‘তুমি কেমন আছো বলো?’  

‘কেমন থাকব?’ নারীকণ্ঠ শান্তভাবে বলল, ‘প্রিয় মানুষকে ছেড়ে যেমন থাকা যায় তেমন আছি!’  

শোভন বলল, ‘শোন রেনুকা। আমি খুব ক্লান্ত।’

‘জানি।’

‘জানো?’

‘অবশ্যই জানি। আজকাল কিছুই অজানা থাকে না আমার।’    

শোভন কিছুটা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল, ‘তাই? আমার ব্যাপারে আর কি জানতে পারলে?’ 

রেনুকা খিলখিল করে সশব্দে হেসে উঠে বলল, ‘এই যেমন তুমি মস্ত বোকা!’

‘আমি বোকা? বেশ!’

‘শোন রাগ করো না।’ রেনুকা এবার অনুনয়ের সুরে বলল। ‘আমি নিজেই কি বোকামিটা না করেছিলাম!’   

‘রেনুকা, মানুষ যতক্ষণ বেঁচে থাকে ততক্ষণ বোকামি করে চলে। কেউ খুব বেশি করে, কেউ কম।’  

‘তা ঠিক! তবে তুমি আমায় কোনদিন বিশ্বাস করোনি। শুধু শাশ্বতীকে নিয়ে মাতামাতি করে গেছো! ওর কথাই বিশ্বাস করেছ! তাই আমি অমন বোকার মত কাজ করে ফেলেছিলাম!’   

‘তাই কি?’ শোভন ক্লান্তস্বরে বলে। ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি রেনুকা কিন্তু তুমি করতে পারনি। আমায় বিশ্বাস করলে অমন একটা স্টেপ কখনই নিতে না! একবার সামনা-সামনি কথা বলার চেষ্টা করতে।’ 

রেনুকা ফুঁপিয়ে উঠে বলে, ‘আমি চেষ্টা করিনি? তুমি তখন তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ডকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। তোমায় একটা চিঠিও লিখেছিলাম। তোমার শাশ্বতীকে কোনদিন জিজ্ঞেস করে দেখো!’ 

‘কোন চিঠি?’ শোভন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। ‘তুমি আবার আমায় কবে চিঠি লিখলে?’ 

‘আমি জানতাম শাশ্বতীর রকম-সকম ভালো না!’ রেনুকা বলে চলে। ‘তুমি কি বলতে? আমরা শুধুই বন্ধু!’       

‘রেনুকা শোন…’ শোভন বোঝানোর ভঙ্গীতে শুরু করল। ও স্থির করেই রেখেছিল আজ রেনুকার কল আসলে ওকে বোঝাবে, ওকে যে বোঝাতেই হবে!   

রেনুকা শুনল না। শোভনের কথা কেটে বলে চলল, ‘শোনার বাকি রেখেছ কিছু? আমি বলতাম, ও শুধু বন্ধু হিসেবে তোমায় মোটেই দেখে না। নয়ত অত আদিখ্যেতা করত? সারাদিন তোমার সাথে চিটে গুড়ের মত লেগে থাকত কেন? আর এখন তো…’ 

রেনুকার কান্নার শব্দ এল। শোভন বলল ‘রেনুকা, সত্যি বলছি আমি ওকে বন্ধু হিসেবেই দেখে এসেছি। আমাদের মধ্যে কিচ্ছু ছিল না। তুমি বিশ্বাস করো!’ 

রেনুকা কান্নাভেজা গলায় বলে চলল, ‘তুমি কি বলতে, ‘ডোন্ট বি জেলাস! আজকের দিনে একটা ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হতে পারে না?” 

‘বলতাম কারণ আমাদের তখন ওর বেশি কিছুই ছিল না!’ শোভন তাড়াতাড়ি বলল না হলে রেনুকা ওকে বলতেই দেবে না। নিজের কথা বলে ফোন কেটে দেবে।  

‘তখন ছিল না! এখন তো আছে?’ রেনুকা শ্লেষ মেশানো গলায় বেশ দৃৃঢ়ভাবে বলল। 

‘রেনুকা, প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও।’

‘তোমায় তো ক্ষমা করেই দিয়েছি তবে শাশ্বতীকে করব না। কোনদিন না!’  

‘ওর আজকের অবস্থা তো তোমার অজানা নেই, রেনুকা। ওর উপর তুমি রাগ করে থেকো না। ও তো ইচ্ছে করে তোমার আর আমার মাঝে চলে আসেনি!’ 

কিছুক্ষণ পুরো চুপচাপ। শোভনের ভয় হল রেনুকা ফোন কেটে দিয়েছে। ‘হ্যালো? হ্যালো রেনুকা?’ 

রেনুকা সামান্য হেসে বলল, ‘বেশ। তোমার যদি মনে হয় তোমার বেষ্টফ্রেন্ড ইচ্ছে করে কিছুই করেনি আমার আর কিছু বলার নেই! এই বিশ্বাস আগলে রেখে সুখী থেকো তুমি এটাই প্রার্থনা করি।’  

‘রেনুকা প্লিজ তুমি শাশ্বতীকে ভুল বুঝো না!’

‘আমি শাশ্বতীকে কোনদিন ভুল বুঝিনি।’ রেনুকা বলল। ‘ভুল তুমিই বুঝেছ!’ 

 ‘রেনুকা প্লিজ! আজ শাশ্বতী সম্পুর্ণ অসহায়। ওর অবস্থা দেখে অন্তত ওকে ক্ষমা করে দাও।’  

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর রেনুকার গলা ভেসে এল। এখন লাইনটা আর ডিস্টার্ব করছে না। স্পষ্ট গলায় রেনুকা বলল, ‘বেশ। শাশ্বতীকে ক্ষমা করলাম। আর শোন, এটাই তোমাকে আমার লাস্ট কল।’ 

শোভন হালকা সোয়াস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সামান্য কাঁপা গলায় রেনুকা আবার বলল, ‘আমার লাস্ট কল শুনে এতটা খুশি হবে ভাবিনি। যাক, শোভন ভালো থেকো…বিদায়! যাও তোমার শাশ্বতীর কাছে যাও।’ ফোন কেটে গেল।  

শোভন বিছানায় ফিরে এসে দেখল শাশ্বতী জেগে বসে আছে।    

‘এই রে, তোর ঘুমটা ভেঙে গেল! ফোনটা বাজল সেই আওয়াজে না? এবার ল্যান্ডফোনটা সত্যি কেটে দিতে হবে!’   

‘আর ঘুম!’ শাশ্বতী কোনমতে বলল। ‘যে অসুখ আমায় ধরেছে সে আমায় শেষ ঘুমে না নিয়ে যাওয়া অবধি আর আমার চোখে ঘুম আসবে না।’  

‘আহ শাশ্বতী এসব কথা বলিস না তো! দাঁড়া, তোকে একটা ওষুধ দিই!’ 

শাশ্বতী শোভনের একটা হাত চেপে ধরল। ‘আমার আর কিচ্ছু লাগবে না। লক্ষ্মীটি, আমার মাথায় একটু হাত রাখ। আর বেশিক্ষণ তোকে জ্বালাবো না। মনে হচ্ছে এই রাতই আমার শেষ রাত!’    

‘বাজে কথা বলিস না!’ শোভন শাশ্বতীর মাথায়-পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল। ‘এক তো বায়না করে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসলি! কত বার করে বারণ করলাম! কিছুতেই কথা শুনলি না। এত জেদি মেয়ে তুই শাশ্বতী! কেন?’ শোভন কান্নাভেজা গলায় বলল।    

‘শেষ কটা দিন তোর কাছে থাকার লোভ সামলাতে পারলাম না, শোভন! তুই আমায় এত ভালোবাসিস অথচ আমি তোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই! যোগ্য নই আমি!’ 

শোভন অবাক হয়ে বলল, ‘এসব কি বলছিস, শাশ্বতী! তোর চেয়ে বেশি আমি কোনদিন কাউকে ভালবাসিনি!’ 

এ কথা প্লিজ বলিস না শোভন! আগে হলে এই কথা শুনে আমি আনন্দে পাগল হয়ে  যেতাম কিন্তু যখন মৃত্যু এসে সামনে দাঁড়ায় তখন নিজের করা সমস্ত পাপ জলের মত স্বচ্ছ হয়ে চোখের সামনে ভাসতে থাকে!’ 

‘এসব কি বলছিস তুই?’  

‘অকপট সত্যি কথা। আমি চেষ্টা করেও যা এতদিন বলতে পারিনি! তবে আজকে বুঝেছি যদি না বলি আমার মৃত্যুও জুটবে না! সমানে কষ্ট পেয়ে ভুগে যেতে হবে! শোভন, আমি মুক্তি চাই!’

‘তুই প্লিজ এই ভাবে বলিস না! তুই চলে গেলে আমি যে পুরো একলা হয়ে যাব!’ 

‘আমাকে বলতে দে, শোভন! একমাত্র মৃত্যু পারে আমায় এই পাপের জীবন থেকে মুক্তি দিতে। আমার জন্য মৃত্যুই ভালো! আর তার জন্য আমায় সত্যি কথাগুলো এবার বলে যেতে হবে!’ 

‘কি কথা? এসব কি বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না যে!’ শোভন শাশ্বতীর দিকে চেয়ে থাকে।  

শাশ্বতী সারা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল। তবে অগ্রাহ্য করে ও  বলে চলল, ‘আমি তোকে আসলে কোনদিন বন্ধুর চোখে দেখিনি।’ 

‘এসব কথা এখন থাক না!’ শোভন বলল। ‘তোর এখন বিশ্রামের প্রয়োজন।’ 

‘আমায় থামাস না! জানিস রেনুকাকে আমি দু’চক্ষে সহ্য করতে পারতাম না! ইচ্ছে করে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে তোর উপর নিজের অধিকার জাহির করতাম।’

দূর, কি যা তা বলছিস!’ শোভন অবাক হয়ে এবার বলল।   

‘আমি সত্যি বলছি। রেনুকার নামে মিথ্যে কথা বানিয়ে তোকে বলতাম। তোর সামনে বন্ধু সেজে থাকতাম আর রেনুকার নামে তোর কাছে রঙ চড়িয়ে বলতাম। শেষে তোদের যে ঝগড়-অশান্তি হয়েছিল তার জন্য আমিই পুরো দায়ী ছিলাম। রেনুকাকে অনেক মানসিক যন্ত্রণা আমি দিয়েছি। তাই আজ আমি যে শারীরিক যন্ত্রণা পাচ্ছি…আই টোটালি ডিসার্ভ ইট!’ 

‘শাশ্বতী, এসব কি বলছিস?’ 

‘আজ অনেকদিন পর আমি সত্যি কথা বলছি শোভন। তোদের ভুল-বোঝাবুঝির জন্য আমি দায়ী ছিলাম। রেনুকা তোকে সব কথা এক্সপ্লেন করে একটা চিঠি লিখেছিল। সেটা আমি হাতে পেয়ে কুচিয়ে ফেলে দিই!’ কিছুক্ষণ থেমে শাশ্বতী বলল, ‘দেখতে গেলে রেনুকার সুইসাইডের জন্যে আমিই দায়ী।’ 

‘ওয়াট?’ শোভন এখন শাশ্বতীর হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওর সারা শরীর কাঁপছে।

‘ওকে তোর থেকে এত দূরে করে দিয়েছিলাম ও সহ্য করতে পারেনি। মেয়েটা তোকে পাগলের মত ভালবাসত যে! আজ স্বীকার করছি আমার জন্যই রেনুকা এত বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল। তোদের দুজনের মধ্যে আমি এসে পড়ায় ও নিজেকে শেষ করে ফেলে!’    

শোভনের সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। ওর চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ‘এতদিন আমি রেনুকাকে তাহলে ভুল বুঝে এলাম? এমন কি ওর মৃত্যুর পরেও বুঝতে পারলাম না ও আমায় সত্যি কতটা ভালোবাসে! আজ ও বলল এর পর আর কোনদিন আমায় কল করবে না তাও কিছু বললাম না! উলটে খুশি হলাম যে ওর থেকে অবশেষে আমি মুক্তি পেলাম! ছি ছি ছি ছিঃ!’   

শাশ্বতীর কানে এসব কথা ঢুকল না। ও বলে চলল,’ওর মৃত্যুতে আমি দারুণ খুশি হয়েছিলাম। জানিস? আমি যে পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলেছিলাম! একটা সুন্দর নির্দোষ মেয়েকে আমি তার প্রেমিকের থেকে চিরকালের মত সরিয়ে ফেলি। তোদের দুজনের মধ্যে এত দূরত্ব আমি তৈরি করে দিই যে সেটা রেনুকার মৃত্যুতেও মেটেনি!’ শাশ্বতীর মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠল। কাশতে কাশতে আবার বলল, ‘এই জন্যই তো ক্যান্সার আমায় ধরল। এটা শুধু অসুখ নয়, এটা আমার শাস্তি! আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দিস শোভন!’ কাশতে কাশতে বিছানা থেকে শোভনের দিকে ও হাত বাড়িয়ে দিল। ‘বন্ধু হিসেবে না হোক, স্ত্রী হিসেবে না হোক, এক জন মৃত্যুপথযাত্রী হিসেবে প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে—’  

‘শাট আপ!’ শোভন চিৎকার করে উঠল।  

‘শোভন প্লিজ…প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে!’ শাশ্বতী মিনতির সুরে বলল।    

শোভন  শাশ্বতীর বিছানা থেকে টলমল অবস্থায় সরে আসল। শাশ্বতীর স্পর্শ আর ও কিছুতেই নিতে পারবে না। নিজের হাত দুটো দিয়ে নিজের মাথাটা চেপে ধরল। অসহ্য এক যন্ত্রণায় ওর মনে হল মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে শোভনের মনে পড়ল কান্নাভেজা গলায় রেনুকা বলছে, ‘তুমি আমায় কোনদিন বিশ্বাস করোনি। শুধু শাশ্বতীকে নিয়ে মাতামাতি করে গেছো! ওর কথাই বিশ্বাস করেছ!’  

রেনুকা ছিল শোভনের প্রেমিকা যে পাঁচ বছর আগে পয়লা ফেব্রুয়ারির রাতে আত্মহত্যা করে বসে। শোভনের বিবাহিতা স্ত্রী শাশ্বতী এখন লাং ক্যানসারের অ্যাডভান্সড স্টেজে রয়েছে। 

শাস্তি ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!