শুধু তোমারই জন্য প্রেমের গল্প – দেবযানি দত্ত প্রামাণিক
সাইরা একটি ছোট মেয়ে যে সুদুর সিরিয়ার হামা বলে একটি ছোট সহরে তার বাবা-মা ও ভাই এর সাথে থাকতো । অপূর্ব সুন্দর দেখতে ওকে । ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ , সোনালি চুল আর হাল্কা সবুজ চোখ । মনে হত ঠিক যেন কোন স্বর্গের পরি । আমাদের দেশ থেকে ওখানে চাকরি করতে গেল একটি বাঙালি পরিবার । তারাও চারজন , বাবা- মা, একটি ছেলে ও তার ছোট বোন । তারা ভাড়া নিল ওদের বাড়িতে । স্বাভাবিক ভাবেই বাঙালি পরিবারের পোশাক, ভাষা, রীতিনীতি সবিকিছু অন্যরকমের ছিল । ছোট সাইরার সেগুলো খুব ভাল লাগত । ও আর ওর ভাই মিলে ওই ভদ্রমহিলা কে নিজেদের ঘরে নিয়ে আসত আর ওদের শাড়ি পরিয়ে দিতে বলত । কপালের টিপটাও ওর খুব পছন্দের ছিল । ওর বাবা-মাও ভারতীয়, শান্তিপ্রিয় ভাড়াটে পরিবার কে পছন্দ করতেন । আস্তে আস্তে দুই পরিবারের মধ্য খুবই সখ্যতা গড়ে উঠেছিল । ওদের মধ্যে কথাবার্তা বেশির ভাগ ইংরেজি তেই হত , তবে দু পক্ষই একটু একটু করে আরবিক ও বাংলা শিখছিল।
বাঙালি ভাই-বন ওদের স্কুলেই ভর্তি হল । ওদের চার জনের মধ্য বেশ ভাল বন্ধুত্য হয়ে গেল । ওদেশে সবাই খুব হিন্দি সিনেমা দেখতে ভালবাসত , তাই ওরা দু পরিবার মিলে মাঝে মাঝেই সিনেমা দেখতে যেত । হিন্দি সিনেমা দেখেই হোক , অথবা বয়সের জন্যই হোক, সাইরা নিজের অজান্তেই রানার প্রেমে পরে যাচ্ছিল । রানা পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল, স্কুলের সবাই ওদের দুজন কেই খুব ভালবাসত । রানার বোন রাধাও ভারি মিস্টি মেয়ে আর পরাশোনাতে ও বেশ ভাল । এবার ওরা চারজন মিলে আনেক নতুন কথা শিখে গেল, অনেক জায়গা, খাওয়া – দাওয়ার সম্বন্ধে জেনে গেল । বাড়ি ও স্কুল মিলে প্রচুর খেলাধুলো হতে হতে , খুব মিশে গেল বাচ্চারা ।
একবার হোলি এসে গেল । বাঙালি পরিবারের সকলে মিলে ওদের কেও ডেকে নিল আর খুব রঙ খেলা হল । প্রথম প্রথম সাইরা র একটু ভয় করছিল , কিন্তু খেলতে খেলতে আস্তে আস্তে ওরাও মজা পেয়ে গেল । রঙ লাগাবার সময় মজা করে রানা বলল যে ও সাইরা কে সিথি তে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে, তাই ওরা এবার থেকে স্বামী – স্ত্রী । হিন্দি সিনেমা দেখা সাইরা সরল মনে সেটা বিশ্বাস ও করে নিল । রানা ওকে বড় হওয়ার আগে কাউকে বলতে বারন করল । এভাবে কেটে গেল আরেকটা বছর । আবার হোলি এল । খেলার আগেই ছুপি ছুপি সাইরা ওকে অনুরোধ করল আবার সিঁদুর পরিয়ে দিতে । এবার একটু ঘাবড়ে গেল রানা । ওকে বোঝা্ল যে ও ইয়ারকি মারছিল, মজা করছিল । সত্যি বিয়ে বড় হয়ে, সবাই কে নেমন্তন্ন করে , বাবা – মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে করতে হয় । সাইরা বলে ও যে মনে মনে রানাকেই ভবিষ্যতের স্বামী মেনে নিয়েছে । খুব ভয় পেয়ে গেল রানা । বলে সাইরা যদিও ওর খুব ভাল বন্ধু, কিন্তু বউ ? ও এসব এখন ভাবতেই পারেনা । কিন্তু সাইরা তাতে এক্টুও ভয় পায়না । বলে যে ও ওদের বড় হওয়ার অপেক্ষা করবে ।
এর মাঝে শুরু হয় ইরাক – ইরান যুদ্ধ । বাড়ির মধ্যেই ট্রেঞ্চ কাটা হয় । যুদ্ধের সাইরেন বাজতেই ঢুকে পরতে হয় ট্রেঞ্চে । লাইট নিবে যায় । চারদিকে শুধু অন্ধকার। কিছুক্ষন পর উঠে আসলেই দেখা যায় চারিদিকে শুধু ধংশাবশেস । কোনরকমে মিলে মিশে বাঁচে ওরা । বাড়ির কিছুটা অংশ ভেঙ্গে জল, খাবার , বিদ্যুত সব কিছুর অভাব দেখা যায় । কিন্তু একটি পরিবারের মত একসাথে থাকে ওরা । সব মিলে মিশে সামলে নেয় । ওদের পরিবারের দু – একজন বন্ধু ও মারা যায়, বেশ কিছু চেনা লোকজনও মারা যায়, অনেক ভারতীয় লোকজন দেশে ফিরে যায় । ওরা কিন্তু বেঁচে যায় ওই বিদেশি পরিবারের জন্য ই । বাচ্চাদের চার জনের কাছেই যুদ্ধ ও মৃত্যু নতুন বিভীষিকা । নিজের লোক কে হারানোর দুঃখ কিছুটা বুঝতে পারে ওরা । আরও কাছাকাছি এসে যায় ওরা । রানা কথা দেয় যে ও সাইরা কেই বিয়ে করবে ভবিষ্যতে । ওকে ছাড়া যে রানা থাকতেও পারবেনা ।
যুদ্ধ এক সময়ে শেষ হয় । এভাবে চলতে চলতে প্রায় তিন – চার বছর হয়ে যায় । বদলির খবর আসে ওই বাঙালি ভদ্রলোকের অফিস থেকে । একদিকে দেশে ফেরার আনন্দ, আর অন্য দিকে এদের সাথে বিচ্ছেদ । বাচ্চারা কান্না কাটি শুরু করে দেয় । ঠিকানা আদান প্রদান হয় । ভারতে আসার আমন্ত্রন দিয়ে ওনারা বিদায় নেন বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে। চিঠি লেখালেখি চলার প্রতিস্রুতি দাওয়া থাকে । যোগাযোগ কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়না । আস্তে আস্তে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ভারচুয়ালি দেখা সাক্ষাত হতে থাকে । রানা ওর বাবা- মা কে সব খুলে বলে । আশ্চর্য ভাবে ওর বাবা – মা একবারেই রাজি হয়ে যান । জাতিধর্ম – ভাষার ঊর্ধ্বে যে ভালবাসা ।
আজ পনের বছর পর সাইরা আসছে ভারতে । রানা আজ ছাব্বিশ বছরের য়ুবক । এয়ারপোর্টে আনতে যায় ওকে সবাই মিলে । কিছুক্ষন পর দেখতে পায় শাড়ি পরা, সিঁথিতে সিঁদুর দাওয়া সাইরা কে । রানা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সাইরা কে । ইতিমধ্যে আরও অনেক যুদ্ধ হয়েছে সিরিয়া তে ।বাবা কে হারিয়েছে সাইরা । মা আর ভাই কে ছেড়ে চলে এসেছে রানার কাছে । রানার বাবা -মা আনন্দে চোখ মোছেন , খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে সাইরা কে ওরা সবাই । পারবে ত ও সব ছেড়ে থাকতে , এদেশে , রানার বউ হয়ে । আধো আধো বাংলাতে বলে ওঠে সাইরা , ” আমি যে শুধু তোমারি জন্যে সব ছেড়ে এসেছি , পারব , সব ছেড়ে থাকতে ।”
শুধু তোমারই জন্য প্রেমের গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
জ্বর
ভুবন যায় ভুবন আসে
প্রেম চিরন্তন