অমাবস্যার দিনে ছোটো গল্প – চিত্তরঞ্জন গিরি
বিজ্ঞানের স্যার হয়ে কেন ভূত-পেত্নী বিশ্বাস করেন আপনি ? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে স্যারের দিকে তাকায় সায়নী।টেবিলের দুই প্রান্তে বসে- স্যার ও ছাত্রী। সায়নী কলকাতা র আশুতোষ কলেজের ফিজিক্স অনার্স এর থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। টেবিলের উপর খাতা পেনে ফিজিক্সের একটা প্রবলেম নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন অরূপ স্যার। সায়নীর প্রাইভেট টিউটর। সায়নী কে প্রায় ইলেভেন থেকে টিউশন পড়ায়।স্যারের কাছ থেকে প্রশ্নটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় মানুষের জ্ঞান থেকেই বিজ্ঞান। মানুষের জ্ঞানের পরিধি যত বাড়বে বিজ্ঞানের পরিধি বাড়বে। যতই বিজ্ঞানের উন্নতি হোক না কেন। তবু যেন অনেক কিছুই হয়ে ওঠেনি। তাহলে হাজার হাজার মানুষ ক্যান্সারে বা এডস এ মরতো না। বিজ্ঞানীরা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রয়াস। তার মানে এই নয় যে বিজ্ঞান চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। স্যারের কাছ থেকে প্রায় 5 বছর ধরে শুনে আসছে। ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে। মানুষের অতৃপ্ত আত্মা ভূত প্রেত হয়ে আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। শনিবার মঙ্গলবার নিরামিষ খেতে। অমাবস্যা পূর্ণিমায় ডিম মাংস বা কোনো অ্যালকোহল জাতীয় খাবার বর্জন করতে। অরূপ স্যার খুব শান্ত স্বভাবের। সবার সাথে খুব মিশে যায়। তার প্রিন্সিপাল হল স্যার যদি “ফ্রেন্ড ইজ ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড “এই ভাবনায় যদি বিশ্বাস না থাকে, তা হলে ছাত্র ছাত্রীর সমস্যা ও কোনদিন বুঝতে পারবে না। তাই ছাত্র ছাত্রীর সাথে বন্ধুর মতো মেসে। বয়স 28-30 হবে। এখনো বিয়ে করেনি। বিজ্ঞানের সাথে ভৌতিক বা তন্ত্রের কি রিলেশান সেটা খোঁজার চেষ্টা করে। যখন তখন অমাবস্যায় তারাপীঠ শ্মশান বা কামাখ্যায় চলে যায়। ওখান থেকে দু- পাঁচ দিন কাটিয়ে আসে। আর এতেই খুব তিনি মজা পান।কিন্তু সায়নী স্যার কে শ্রদ্ধা করে। ফিজিক্সের দক্ষ বলে। তার জ্ঞানের জন্য তাকে রেসপেক্ট করে। কিন্তু ভুত-প্রেত ঈশ্বর ও মানতে চায়না। ভূত যদি থাকে আর অন্য কারোর চোখে ধরা পড়বে। আমাদের চোখে কোনো না কোনো সময় ধরা পড়বে। কই ২১ বছর তো কেটে গেল একবারেও চোখে পড়লনা। তাহলে কি করে তাকে বিশ্বাস করি। আজগুবি বানানো গল্প ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। তবুও মনে মনে মজা পাওয়ার জন্য স্যারের সাথে এইরকম দু -চারটা প্রশ্ন করে বসে। তাতে স্যার নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দেয় । কখনো জাতিস্মর সম্বন্ধে, কখনো প্রডিজি। তবুও স্যার একসময় আক্ষেপ করে বলে। এত প্রমাণ দিয়েও তোমাকে বুঝিয়ে লাভ হল না। তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না।
তখন সায়ানি বলে, হয়তো এমন একদিন আমি প্রমাণ পাবো বাস্তবে দেখতে পাবো। তখন আপনার বলার অপেক্ষায় থাকবে না আমি নিজে থেকেই বিশ্বাস করে নেব। এখন যেমন আমার মনের মধ্যে ঈশ্বর বিশ্বাস নেই কারণ কেউ আমার মাথায় ভিতর বিশ্বাস ঢুকাতে পারবে না। বিশ্বাস সেদিন করবো যেদিন আমার সামনে আপনারা কেউ ঈশ্বরকে হাজির করাবেন। প্রত্যুত্তরে অরুপ স্যার বলে, কিছু জিনিস আছে সহজে চাইলেই পাওয়া যায় না। তার জন্য তপস্যা করতে হয় ধ্যান করতে হয়। অনেক ডেডিকেসানের প্রয়োজন। গুরু নানক রামকৃষ্ণ চৈতন্য। এরাই তো দৃষ্টান্ত। সামান্য কয়লাকে পোড়ালে হীরে পাওয়া যায় না। অনেক টন টন কয়লা পোড়ালে হীরে পাওয়া যায়। যুগ যুগ ধরে তপস্যা করলে তবেই তো ঈশ্বরের সন্ধান মেলে। নিমাই চৈতন্য কে আমরা দেখেছি হা কৃষ্ণ ।হা কৃষ্ণ বলে সমগ্র জগতকে কৃষ্ণ বলে মনে করতেন। সব সময় চোখের সামনে কৃষ্ণকে দেখতে পেতেন ।কারণ সারাক্ষণ কৃষ্ণকে খুঁজে বেড়াতেন। তার জন্য তিনি কৃষ্ণের দর্শন পেয়েছেন। যেমন বামাক্ষ্যাপা। রামপ্রসাদ। এনারা মা কালীর দর্শন পেয়েছেন।— ঠিক আছে আমি মানলাম ঈশ্বরের জন্য তপস্যা করে ঈশ্বরের সন্ধান মেলে। আমি সে পথে গেলাম না। কিন্তু ভূত-পেতের তো সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের জন্য তো তপস্যার প্রয়োজন নয়।— ঠিক বলেছ। ও র সন্ধান পেতে হলে। তাহলে তোমাকে শ্মশানে বা কবরস্থানে ঘুরে বেড়াতে হবে। গাঢ় অমাবস্যার দিনে হলে খুব ভালো হয়। অনেক তান্ত্রিকরা ভূত চতুর্দশীর দিন কামাখ্যা বা তারাপীঠের শ্মশানে তন্ত্র সাধনা করেন। কেউ কেউ তার দেখা পেয়ে যায়।
আপনার কথা শুনে আমারও তো ইচ্ছে করে ,তন্ত্র সাধনায় যেতে ।অমাবস্যার দিনে শ্মশানে বসে দেখতে কেমন করে ভূত পেতরা আসে। কিন্তু আমাকে পাঠাবে না কেউ। ছেলে হলে একবার সুযোগ নিতাম।
অরূপ বাবুর ওর দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো।
সায়নী বলে– হাসলেন যে!
অরুপ বাবু বলে–ছেলে হলেও তুমি করতে না। আমি শুনেছি বাড়িতে কারেন্ট চলে গেলে, তুমি চিৎকার শুরু করে দাও।
—কে বলেছে, নিশ্চয়ই মা বলেছে ?
তোমার মা বলবে কেন -বেশ কয়েক বছর তো তোমার এখানে আমার পড়ানো হল।
সায়নি একগাল হেসে ফেলে। মাথা নেড়ে মেনেও নেয়।
সায়নীর প্রতি অনুপ স্যারের অনেক দুর্বলতা আজও আছে। আজও আছে বলার কারণ হলো। একদিন পাটুলিতে একটা ছেলের সাথে সায়নী কে পার্কে ঘুরতে দেখেছে । তারপর স্যার সাইনি কে বোঝায়– তুমি ফিজিক্স অনার্স যখন পড়ছো। শুধু অনার্স পাশ করলে তেমন ডিমান্ড নেই। ৭৫শতাংশ নম্বর না পেলে এর কোনো গুরুত্ব নেই। অনার্স টা ভালো করে পাশ করে যাও তারপর তুমি প্রেম-টেম যা পারো করো। সেদিন ঠোঁটের কোণে মুচকি হেসে সায়নী বলেছিল, অনুপ আমার বন্ধু স্যার ।একই ক্লাসে পড়ি। প্রেম ট্রেম কিছু করিনা। স্যার বলেছিল এরকম পরিস্থিতিতে মেয়েরা সত্যি কথা বলে না।কিন্তু সেদিন সায়নী স্যারের অ্যাটিচিউডকে ভালো করে লক্ষ্য করেছিল। সেদিন থেকেই বুঝতে পেরেছিল -স্যার তাকে খুব ভালবাসে । ওর জন্য স্যারের ডেডিকেশন তার মার চোখেও ধরা পড়েছিল। তার মা বলেছিল স্যারের মতো কোনো ছেলে যদি জামাই হয় আমি এক বাক্যে রাজি।তখন সায়নী বলেছিল- কেন, তোমার এমন মনে হল ?
তখন তার মা বলেছিল” এত বছর ধরে তো লক্ষ করেছি। তাই আমি বললাম। তোকে যে পড়ায় টাকার কোন সম্পর্ক নেই। তোর যাতে ভালো বলে সদা সর্বদা চেষ্টা। তুই যা বললে সব কথাই শোনে ।তারপর থেকে প্রায়ই ফলো করছিল সায়নী। একদিন সায়নী স্যারকে বলেই ফেলল। স্যার আপনি বিয়ে করছেন না কেন ?কথাটা শুনে, স্যার -শুধু হাসল।তখন সায়নী বলে– যদিও এটা আমার প্রশ্ন করার এক্তিয়ার নয়। তবু আমি করলাম কারণ আপনি আমার সাথে বন্ধুর মতন মেশেন। এই অনুভূতি থেকেই প্রশ্নটা করলাম।সেদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। বাবা-মা রা পিসির বাড়িতে অন্নপ্রাশনে আমন্ত্রিত ছিলেন। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সায়নী প্রশ্ন করেছিল। স্যার তা বুঝতে পেরে ভাবে -এই সময় প্রেমের প্রস্তাবটা যদি করা যায়। মনে মনে ভেবেনেয় স্যার- নিশ্চয়ই সায়নী তার প্রতি একটু দুর্বলতা আছে না হলে সায়নীবা প্রশ্ন করবে কেন ?স্যার একটু অতিরিক্ত উৎসাহে উৎসাহী হয়ে বলেছিল। আমি যাকে পছন্দ করি। তাকে যদি পেতাম তাহলে বিয়ে করে নিতাম।
আপনার পছন্দটা কেমন- মানে কাকে পছন্দ করেন ?আবেগি দৃষ্টিতে স্যার সায়নীর দিকে তাকিয়ে ছিল। উত্তর দিচ্ছিল না।
সায়নী তাড়া দিচ্ছিল– বলুন না স্যার, বলুন না স্যার।
স্যার শুধু মাথা নেড়ে বলল– না পড়ায় মন দাও।
তখন সায়নী বলেছিল– আমাকে বলবেন কেন ? আমাকে বলার যোগ্য লোক মনে করেন না।
বলেই সায়নী চুপ হয়ে যায়। মুখ শুকনো করে অংক করতে থাকে। তা দেখে স্যার ঠিক থাকতে পারেনি। বলে অনেকদিন ধরে তো তুমি জানো কিনা বা বুঝতে পেরেছো কিনা আমি তা বলতে পারব না।
অংকের খাতা থেকে মুখটা তুলে স্যারের দিকে তাকায়।
বলে” না আমি কিছু বুঝতে পারিনি স্যার।
স্যার কিছুক্ষণ সায়নী কে পর্যবেক্ষণ করে। বলে তুমি কিছু খারাপ মনে করো না। আমি একটা কথা বলবো। তুমি যদি আশ্বাস দাও তাহলে বলতে পারি।
সায়নী কিছুক্ষণ কি একটা ভাবল। তারপর কৌতূহলের দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বলে, বলুন স্যার।
অনেকদিন ধরে তুমি আমার হাবেভাবে নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ “আমি তোমাকে ভালোবাসি”।
ঠোঁটের এক কোনে হাসি গড়িয়ে সায়নি শুধু মাথা নাড়িয়ে হাঁ বলে।
চুপচাপ দুজন। সায়নী বলে। আপনাকে পেলে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী বলে মনে করতাম। কিন্তু অনেক আগেই একজনকে কথা দিয়েছি স্যার।
তা শুনে মুখটা শুকনো হয়ে গেল স্যারের। আমি জানি তুমি অনুপকে ভালোবাসো।
সায়নী চুপ থাকে কিছু উত্তর দেয় না। স্যার বলে বেস্ট অফ লাক। তোমাদের জীবন সুন্দর হোক। বলেই আনমনে কিছুক্ষণ অন্য দিকে তাকায়। স্যারের মুখটা ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল। তারপর খাতায় পেনের হিজিবিজি দাগ কেটে কি যেন ভাবছিল। তা সায়নীর চোখে ধরা পড়ে। স্যার আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনাকে কষ্ট দিতে আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার করার কিছু নেই স্যার। আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার।কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্যার বলে। আমার প্রেম একতরফা। আমার ভালোবাসাটা থাক অন্তরে। তবু একটা কথা বলি।
স্যারের দিকে চোখ তুলে তাকায় সায়নী।
স্যার বলে– যখন দরকার হবে অর্থাৎ আমাকে যদি কোন সময় দরকার হয়। আমি সবসময় তোমার জন্য সাড়া দিতে প্রস্তুত। আমি আগেও যেমন তোমায় ভালবাসতাম পরেও ঠিক সেই রকমই তোমাকে ভালোবাসবো। এখন আমার উদ্দেশ্য ,তোমাকে ভালো রেজাল্ট করিয়ে দেওয়া। ভগবান যেন সেই শক্তিটুকু আমাকে দেয়।
কিছুক্ষণ পর স্যার অংক করার জন্য তাড়া দেয়।
মনে মনে তখন সায়নী বলে। এরকম একটা ভালো মানুষকে আমি আঘাত করলাম। কিন্তু আমার কি বা করার ছিল। অনুপ আমাকে প্রচুর ভালোবাসে। আমি যে তাকে কথা দিয়েছি। মনের ভিতর একটা আকুতি নিয়ে সায়নী স্যারকে বলে ,স্যার। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না ।
আমি এখানে নিরুপায়।স্যার বলে –ঠিক আছে। ঠিক আছে ।চ্যাপ্টার ক্লোজ। তোমার কোন দোষ নেই।স্যার পড়ানোতে মন দেয়। এরপর বেশ কিছু দিন কেটে যায়।
কয়েকদিন ক্যালকাটা ইনভারসিটির ফিজিকস অনার্স এর থার্ড ইয়ারের রেজাল্ট বেরোলো। সায়নী র রেজাল্ট খারাপ হয়নি ৭৮% এ পুরো ফিজিকস অনার্স কমপ্লিট করল।আজ মার্কশিট দেখতে অতনু এসছে সায়নীর বাড়িতে।
বাড়িতে সবারই আনন্দ। সায়নী বলে স্যার আমার ইচ্ছা ছিল প্লানচেট করার। গতকাল করেছিলাম। বাড়িতে কেউ ছিল না। আমি আমার বান্ধবীকে নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে যেমন আপনি বলেছিলেন সেরকম করেছিলাম। কিন্তু কিছুই পেলাম না। ঘর সব অন্ধকার করে দিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে আইনস্টাইনকে আনার চেষ্টা করেছিলাম। কই ?
কিছুই হলো না!
যতসব আজগুবি ।
এইজন্যই তো আমি বিশ্বাস করিনা।
স্যার বলে- যেখানে সেখানে প্ল্যানচেট করলে তো হবে না। তার জন্য পরিবেশ চাই ।একটা তিথি চাই।সায়নী বিস্ময়ে তাকায়। আবার কেমন পরিবেশ !–ভাঙ্গা পোড়ো বাড়ি । প্রায় 50-60 বছর আগেকার। তার সাথে হয়তো পুরনো আমলে বট বা অশস্থ গাছ থাকলে ভালো হয়। বিশেষ করে গ্রামের অবস্থা হলে ভালো। আর দিন বলতে অমাবস্যা বা মঙ্গলবার শনিবার রাত হলে আরো ভালো।আমার বান্ধবী তো বলেই দিল- তোর স্যার গুল গাপ্পা মেরেছে।
তোমরা বিশ্বাস করো আর না করো সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ‘”বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।” এ নিয়ে আমি ডিবেট করব না।
সায়ানি ভাবে স্যারকে আঘাত দিয়ে ফেললাম। সামাল দেওয়ার জন্য বলে। ওসব কথা ছাড়ুন স্যার। আমরা কালকে দীঘা যাচ্ছি। গড়িয়া স্টেশন থেকে যে দীঘা বাস ছাড়ে, সকাল সাতটার সময়। আমরা ওই বাসে যাব। চলুন না আমাদের সাথে। আপনার বাড়ি ওইখানে, তাইনা ?মাথা নেড়ে অতনু স্যার” হ্যাঁ” বলে। বাড়িটা ঠিক রামনগর এর কাছে। আমার গ্রামের নাম মান্দার। কিন্তু কাল আমার দিদির বাড়ি যাবার কথা। পিছাবনীতে দিদির বাড়ি। কালকেই তো আমাবস্যা। পিছাবনী হল রামনগর কাঁথির মাঝামাঝি জায়গায় একটা বাস স্টপেজ। তোমরা পারো তো আমার সাথে চলো। কালকে দিদির বাড়িতে কালীপুজো হবে। রক্ষাকালী। কালকে গাঢ় অমাবস্যা ! তারপর কালকে মঙ্গলবার। দিনটা খুব ভয়ঙ্কর। এই দিনটাই তোমরা বেছে নিলে দীঘা বেড়াতে যাওয়ার।সঙ্গে সঙ্গে সায়নী বলেন” আবার কেন এসব বলে আমাদের যাত্রা ভঙ্গ করছেন। এমনিতেই এ-গুলো আমি বিশ্বাস করিনা।ভালো রেজাল্ট করেছো। মন চাইছে আনন্দ করতে, যাও কালকে যখন যেতে চাইছ চলে যাও। আপনি যখন কালকে ওখানে যাচ্ছেন। ওখান থেকে আমাদের সাথে দীঘায় একটু দেখা করবেন। আমরা তো 4-5 দিন থাকবো।ঠিক আছে আমি কালকে দিদির বাড়ি গিয়ে পরের দিন তোমাদের সাথে দেখা করব দীঘায়।
পরের দিন সমস্ত কাজ সেরে বাড়িতে যখন ফিরে তখন সকাল 11 টা । সকালে ভোরে উঠেই ব্যাগ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছে। চান করে খেতে বসার সময় টিভি নিউজ চ্যানেল টা খুলে দিয়েছে। খবর শুনেই হতভম্ব হয়ে অতনু। দীঘা গড়িয়া স্টেশনের বাসটি কন্টাই এর কাছে নাচিন্দা স্টপেজ এর পরে লরির সাথে সংঘর্ষ। কিছু মানুষ স্পট ডেড। আর বেশ কিছু আহত অবস্থায় হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে।সঙ্গে সঙ্গে কিছু না ভেবেই তাড়াতাড়ি ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়ে বাস ধরে। হসপিটালে গিয়ে দেখে সায়নীর কাকা কাকিমা জেঠিমা অনেকেই এসে হাজির হয়েছে। সায়নীর মায়েরও সায়নীর অবস্থা খুব খারাপ। দুজনের জন্য রক্ত দরকার। সায়নীর মায়ের রক্ত oপজেটিভ তা সহজে পাওয়া গেছে । কিন্তু সায়নীর দরকার বি পজিটিভ। তা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। নিজের আত্মীয়দের মধ্যে চেক করা হয়েছে। কারোর বি পজিটিভ নেই। তা জানতে পেরে অতনু বলে আমার রক্ত বি পজেটিভ আমার কাছে নেন। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ট্রান্সফার করা হয়। অতনুর রক্ত সরাসরি সায়নী কে দেওয়া হয় পাশাপাশি বেডে শুয়ে ।
রক্ত দেওয়ার কিছুক্ষণ আগে সায়নীর জ্ঞান ফিরে আসে। শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকায় অতনুর দিকে। চোখের কোল থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছিল। তা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল অতনুর। কিছু বলতে পারছিল না।হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রিক্সা ধরে সেন্ট্রাল বাস স্টপেজ আসে। বাস নেই বললেও চলে। এমনিতেই রাত হয়ে গেছে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর একটা হাওড়া বাস দেখতে পায়। ওই বাসে উঠে। বাসে উঠেই একটা সিট পেয়ে যায়। সিটে বসে কখন যে মনের কোনায় সায়নীর ছবিটা ফুটে উঠেছে তার খেয়াল নেই । নীরব দৃষ্টিতে তাকানো। শরীরে অনেক যন্ত্রনা। কপালের শিরা উপশিরায় বেরিয়ে আসছিল। ভাগ্যিস আমি পৌঁছেছিলাম ।রক্ত টা দিতে পেরে খুব আনন্দ হচ্ছে। প্রিয়জনকে কিছু দিতে পারলেইয যে কত আনন্দ হয় আজ তা বুঝতে পারলাম। মনে মনে ভগবানকে ডাকে ভগবান যেন সায়নী কে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোলে। এরকম কত কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ কন্টাকটার বলে পিছাবনী এসে গেছে। বাস থেকে নেমে দেখে ঘড়িতে রাত ১টা১৫ !সব দোকানগুলো বন্ধ। রিক্সা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। পূব দিকে সাড়ে তিন কিমি হাঁটতে হবে। বাস স্টপেজের কাছে কারেন্টের আলো থাকলেও। মিনিট তিনেক হাঁটার পর পুরো অন্ধকার । এখন হেমন্তের শেষের দিক চলছে। ঠান্ডা প্রায় পড়ে গেছে। তারপর গ্রামের দিকটা জলা জায়গা বেশি। শহরের থেকে বেশি ঠান্ডা পড়ে যায়। ব্যাগে থাকা সোয়েটার বাসে আসার সময় পরে নিয়েছিল। মধ্যে মধ্যে ঠান্ডা হাওয়া শরীরকে কেমন নাড়িয়ে দিয়ে যায়। এরপর এক কিমির মতো মত রাস্তা পুরো ফাঁকা। মধ্যে মধ্যে বৃহৎ বৃহৎ বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাটা ঠিক পাশাপাশি সমান্তরালভাবে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে পিছাবনী খালটা চলে গেছে। এই খালের দুই প্রান্তে দুর দুর এলাকা থেকে শবদেহ নিয়ে এসে পোড়ানো হয়। এখানে তো আর ইলেকট্রিক শ্মশানের চুল্লি তো নেই। দু একটা বিদঘুটে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। এসব ওয়াজ কোনদিন শুনেছে বলে মনে করতে পারছে না। দ্রুতগতিতে হাঁটতে চাইলেও যেন হাঁটতে পারছে না। কয়েক পা হাঁটতেই মনে হলো পিছনে কার যেন পায়ের শব্ধ! হাঁটা বন্ধ করে পিছনের দিকে তাকায়। না কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। আর দেখবে বা কি করে। কোন আলো নেই। গাঢ় অমাবস্যা ! মনে মনে ভাবে দূর ভুল শুনেছি। নিশ্চয়ই মনের ভ্রম। হওয়া তো স্বাভাবিক। কারণ সামনে যে দুটি বটগাছ তফাতে আছে। ওই তফাতের মধ্যে কত ভৌতিক গল্প শুনেছে সে। ওইগুলো মনে আসতেই গা যেনো শিউরে উঠে। তবু নিজেকে সাহস দেওয়ার জন্য মনে মনে বলে ওই সব ভৌতিক গল্প বাচ্চাদের মনে ভয় পাওয়ানোর জন্য গল্প কথা। বোকা বোকা ভাবা। কয়েক পা হাঁটতে আবার সেই পায়ে হাঁটার শব্দ শুধু নয়। তার সাথে পায়ের নুপুর। যেন কোন মেয়ে নুপুর পায়ে ঠিক পিছনে পিছনে হেঁটে আসছে। আবার ঘাড় ঘোড়ায়। না কিছুই দেখা যাচ্ছে। দাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায়। হঠাৎ মনে যেন সন্দেহ হল। একবার ভুল না হয় করলাম দ্বিতীয়বার তো ভুল শুনিনি। আমি স্পষ্টই শুনেছি একটা মেয়ের পায়ের নুপুরের ধ্বনি! গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠে। কে পিছনে হেঁটে আসছিল? তবুও মনের জোরে হাঁটতে শুরু করেছে। অতনু যত দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছে। পিছনে একইভাবে সমান দ্রুততায় নুপুর পায়ে মেয়েটিও সেইভাবে হাঁটছে। মাথার ভেতর প্রশ্ন -কে হাঁটছে ? কেন তাকে দেখতে পাচ্ছি না ! আবার থমকে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক তাকায়। হঠাৎ একটা চোখে পড়ে খালপাড়ের দিকে কে যেন দাঁড়িয়ে। অতনু চিৎকার করে বলে ,কে -কে ওখানে? কোন উত্তর নেই। একটা মূর্তি তারই দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু আশ্চর্য মূর্তিটির আকার ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে। অতনু ওর শরীর থেকে ঘাম বেরোতে শুরু করেছে। তাও চলতে শুরু করেছে সামনের দিকে। এবার এদিক ওদিক না তাকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে হেটে যায় দ্রুত গতিতে। সামনে সেই দুটো বটগাছের একটি বটগাছ। হঠাৎ একটা ডাল ভেঙে পড়ল তার সামনে। শরীরটা যেন শিউরে উঠলো। গাছের নিচ দিয়ে হাঁটতে হয়। গাছের ডাল টা কে হাত দিয়ে সরিয়ে এগোতে যাবে। এমন সময় তার পা টাকে কে যেন পেছন থেকে ধরে টানছে! বাচ্চা কালে ভালো কবাডি প্লেয়ার ছিল অরূপ। বিভিন্ন টিম গিয়ে খেলত। কবাডি খেলতে গিয়ে যেমন বিপক্ষ প্লেয়াররা ঘিরে ধরলে তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় তেমনি সেই চেষ্টা অরূপ করে। কিন্তু আশ্চর্য যতই এগিয়ে যায় গাছের ডাল টাও তার সাথে আটকে থাকে। ঠিক সেই সময় উপরে গাছের ডালে কিছু একটা পাখির বিদঘুটে আওয়াজ। অসহ্যকর! ভয় পাওয়ার মত । থমকে দাঁড়িয়ে যায়। ডালটার দিকে তাকায়। ভালো করে হাত দিয়ে ছুঁড়ে দেয়। তারপর দৌড়াতে শুরু করে। মনে মনে ভাবে পরের বটগাছ টাকে যদি টপকাতে পারে তাহলে বিপদ কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু আশ্চর্য ! গাছের ওই ডালটা কয়েক হাত তফাতে পিছনে পিছনেই গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে ডালটা থমকে দাঁড়ায়।” কি সব দেখছি। আমি কি স্বপ্ন দেখছি না বাস্তবে দাঁড়িয়ে আছি ? “এদিক ওদিক তাকায়।
রাস্তার ডান দিকটায় কে ওখানে! বিড়াল মনে হয়। বিড়াল এত বড় হবে! চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না! চোখ দুটো কি উজ্জ্বল! চারদিকে গাড়ো অন্ধকার বলে কি ওর চোখের আলো টা এতো বেশি উজ্জ্বল লাগছে?কিন্তু বিড়ালটা এত কালো! নাকি অন্ধকারে এতো কালো লাগছে। সত্যিই কি এ বিড়াল? আকারে তো কুকুরের মত লাগছে। কিন্তু কুকুর তো নয়। কি আশ্চর্য! চোখ দুটো কি ভয়ংকরভাবে ঘুরছে! এখানে তো চিৎকার করলে তো কেউ সাড়া দেবে না। চারদিকটা তো প্রায় ফাঁকা। দূরে কোন লোকের বাড়ি থাকলেও তারাই ঠান্ডায় জানলা দরজা বন্ধ করে শুয়ে গেছে। আমার চিৎকার ওদের কানে গিয়ে পৌছবে না। এবার ঠাকুরের নাম ডাকতে ডাকতে সামনের দিকে এগোতে থাকে। শরীরে এতই কাঁপুনি যে হাঁটতে গিয়েও স্লিপ খেয়ে পড়ে গেল। আবার কষ্ট করে উঠতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য গাছের ডাল টা কিন্তু আর আসেনি। মনে মনে ভাবে বিপদটা বুঝি কেটে গেছে। কিন্তু এখনো অনেকটা দূর বাকি আছে ওই ওই বটগাছকে টপকাতে। যদি কিছু দেখতে পাবে ভেবে এদিক ওদিক তাকাতে আর সাহস পায়না। এক নিঃশ্বাসে তাড়াতাড়ি বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে অন্য বটগাছকে দেখতে পায়। মনে মনে ভাবে এই বটগাছকে যদি টপকাতে পারি তাহলে আর বিপদ হবেনা। কিন্তু আশ্চর্য কয়েক পা দৌড়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। বট গাছের নিচে কে যেন বসে আছে। কে ও ?এ আর এক ভয়ঙ্কর কিছু ? কিন্তু কি করবে। পিছনে ও বিপদ। সামনেও বিপদ। মরতে যখন হবে এগিয়ে গিয়েই মরি। এইসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যায়। কিন্তু চোখ টা পড়ে আছে ওই বটে গাছের নিচে ।
কে যেন বসে আছে তার উপর! যত কাছে আসে ছবিটা আরো পরিষ্কার হয়ে উঠে। দেখে তো মনে হচ্ছে একটি মেয়ে। একটি মেয়ে বসে আছে। কুড়ি পঁচিশ বছর হবে মনে হয়। একেবারে কাছে এসে পৌঁছেছে। যেভাবে হোক ওকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। মেয়েটির মুখটা ওড়না দিয়ে ঢাকা। পোশাকটা যেন চেনা চেনা। মেয়েটাকেও যেন কোথাও দেখেছি। অজানা ভয় সারা শরীরকে জাপ্টে ধরে আছে। মৃত্যুর কাছে এসে যখন পৌঁছেছি মৃত্যুকে আর ভয় করে লাভ নেই। তারপর মাথায় এলো ভূত পেত্নীরা মায়ায় যেকোনো মানুষের রূপ ধরে হাজির হতে পারে। তাই ঠাকুরের নাম করতে করতে এদিক ওদিক না তাকিয়ে এগিয়ে যায়। গাছটির নিচে বসে আছে- ও কে ? তবুও নিজেকে সংবরণ করে এগিয়ে চলে একটার পর একটা পা ফেলে। বুকের ভিতরে রাখিব কম্পন ধড়াস ধড়াস শব্দ। তারপর পাশ কাটিয়ে গাছটা পেরিয়ে সামনের দিকে তাকায়। না কোন কিছু নেই। দে দৌড় ! দ্রুতগতিতে কয়েক নিঃশ্বাসে দিদির বাড়িতে হাজির।দিদির বাড়িতে পুজো শেষ। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। দিদি শুধু ভাইয়ের অপেক্ষায় আছে। আধ ঘন্টার ভিতরে হাত-পা ধুয়ে দিদিকে আর ঘটনাটা না বলে খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে যায়। শোয়ার ব্যবস্থা ছাদের উপর। বারান্দায় চৌকিতে !ক্লান্ত শরীর বিছানার উপর গা এলাতেই ঘুম।বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। হঠাৎ দেখে তাকে কি যেন সেই বট গাছের কাছে আবার নিয়ে এসেছে। চেনা চেনা মেয়েটা এখনো দাঁড়িয়ে। ওর সামনেটা দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু যেন অনেক চেনা।
সাহস নিয়ে অরুপ বলে -কে আপনি ?আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি ? আপনারা এই রকম ব্যবহার করছেনকেন ?আমি কোন খারাপ ব্যবহার করে থাকলে বলুন একবার। ঠিক সেই সময় চারদিক থেকে চারজন এর আওয়াজ। খনা গলায় বলে হিঁ হিঁ হিঁ। অবাক হয় অতনু। তার চারদিকে চারজন একই রকম দেখতে। চারটি কোণায় দাঁড়িয়ে। চারজনের চোখগুলো উজ্জ্বল ঠিক সেই বিড়ালের মত। হাঁ করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি ভয়ঙ্কর রূপ তাদের। ভয়ঙ্কর বলতে সারা শরীরটা নয়। মুখমণ্ডল। গলার উপরে মাথাটা যেন বন বন করে ঘুরছে। চারজনে একই ভাবে মুখ ঘুরিয়ে যাচ্ছে। এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে যেন হৃদপিণ্ড থমকে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাচ্চাকালের মায়ের সেই কথাটা মনে পড়ে যায়। যখনই বিপদে পড়বি হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে হরে। এই কথাগুলো উচ্চারণ করবি। সঙ্গে উচ্চারণ করে অতনু।
ম্যাজিকের মতো কাজ। যারা ছিল সঙ্গে সঙ্গে উধাও। মনটা খুশিতে ভরে উঠল। দু’পা হেঁটেছে সবে ঠিক বট গাছের নিচে ,সঙ্গে সঙ্গে কে যেন তার হাতটা ধরে টেনে নিচে ফেলে দেয়। পড়ে যাওয়ার পর হাঁটু গেড়ে বসে এদিক ওদিক তাকায়। কাউকে দেখতে পেল না। শরীরে আবার কাঁপুনি শুরু হল। চোখ মুখ অচেনা আতঙ্কে অস্থির। এরপর হাঁটতে যাবে তাতে ভয়! এখন কি করবে ? মনে মনে ঠিক করে ঠাকুরের নাম ধরেই দৌড় দেবে। যেই শুরু করবে। সঙ্গে সঙ্গে কে যেন মাথায় একটা ছোট্ট টোকা মারে। ঘুরে পিছনের দিকে তাকায়।কেউ নেই! অতনু চিৎকার করে ,”আমার সাথে এরকম ব্যবহার করছ কেন তোমরা ? আমি কি দোষ করেছি।অতনুর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময়ই বট গাছের কাছে মুখ ঘুরিয়ে পরিচিত কোন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একগাল হেসে উঠে। হাসিতে যেন অতি চেনা। কে ও? অতনু সাহস করে বলে। মুখটা ঘোরান। কি চান আপনি ? আবার একগাল হাসি। এত ভয় পেয়ে গেলেন স্যার। অবাক চোখে মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটি ঘাড় ঘোড়ায়। এ কাকে দেখছে অতনু! সায়নী। তুমি এখানে ?—আপনার জন্যই তো এলাম।অবাক চোখে তাকায় অতনু।
এখানে তুমি, কি করে এলে ?ঠোঁটের কোণ থেকে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলে, কেন আমি কি আসতে পারি না। আমার জন্য অতদুর থেকে এসে আপনি আমাকে রক্ত দিলেন। আর ওই যে আপনার কথাটা তোমার যদি কোন প্রয়োজন লাগে আমি তোমার পাশে আছি। আপনি যখন রক্ত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আপনার করুন চোখের চাউনি আপনার ভালবাসার গভীরতা। কয়েক মুহুর্ত আপনি আমাকে অনেক কাঁদিয়ে দিয়েছেন। অথচ দেখুন আপনার গভীর ভালোবাসাকে বারবার তাচ্ছিল্যের সুরে দেখেছি। আপনার পড়ানো ছাড়া অন্য সব কিছুকে আমি হেয় অবজ্ঞা করেছি। অনুপ কে আমি ভালবেসেছি কিন্তু তার মধ্যেই এই প্রেমের গভীরতা ছিল না।
অরূপ অবাক চোখে তাকায়। সায়নী এখানে! তাহলে কি,,,, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে।আপনি কাঁদছেন কেন?তুমি,, এখানে,,,,এখন আমার শরীর খুব ভালো হালকা হয়ে গেছে। যেখানেই যেতে চাই সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে যাই । হসপিটাল থেকে যখন আমি বের হতে পারলাম প্রথম। যখনই যেদিকে চায় সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে যাচ্ছি। তারপর আপনার কথাই মনে পড়লো। ভালোবাসা বুকে নিয়ে মনের মধ্যে ফসিল তৈরি করেছেন। অথচ তা আমি সবসময় হেসে উড়িয়েছি। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আপনার ভালোবাসা অপাত্রে দান করেছেন। আমি সেই অপাত্র।এসব কি বলছ !কিছুক্ষণ আগে আপনার সাথে মজা করছিলাম। আপনি কতটা সাহসী তা দেখার জন্য। আপনিতো অনেকদিন ধরে ভূত তন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাই আপনার সাথে মজা করার জন্য এতক্ষণ অনেক ব্যবহার করেছি। আমার উপর রাগ করবেন না। আগে আপনাকে আমি ভালোবাসিনি যেমন সত্য। কিন্তু হসপিটালে ওই রক্ত দেওয়ার পর থেকে আপনাকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। দেখুন না তার জন্য তো আপনার এখানে ছুটে এসেছি। আমার প্রিয় মানুষটির কাছে। আর কোনদিন দেখা হবে কিনা জানিনা। আপনি ভালো থাকবেন। রাত অনেক হয়েছে। আমাকে অনেক দূর যেতে হবে আরো। আসলাম।
অরুপ স্যার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। করুন মুখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে হাত নাড়তে নাড়তে দূরে আরো দূরে বিলীন হয়ে গেল। অরূপ চিৎকার করে বলে -“-না যেওনা। তোমাকে যেতে দেব না।”” বলেই ধড়ফড় করে উঠে পড়ে। ঘুম ভেঙে যায়। তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম। চৌকির উপর বসে। মনে মনে ভাবে এরকম বাজে স্বপ্ন দেখলাম। ঠাকুরের উদ্দেশ্য হাতজোড় করে বলেন– ঠাকুর সায়ানের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। মনে মনে বলে ওটাতো নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন তো সত্যি হয় না। তারপর আবার চৌকিতে গা এলাতে যাবে। হঠাৎ বাইরে একটা খঠাস করে শব্দ হল। আবার উঠে বসে। বাইরের দিকে তাকায়। বাইরের টা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেখার চেষ্টা করে। না কিছু নেই। মনে মনে বলে শুধু ভুলভাল ভাবছি। সায়নীর কিচ্ছু হয়নি। জালাকা বন্ধ করতে যাবে হঠাৎ ডান দিকে ফাঁকা জায়গায় কে যেন দাঁড়িয়ে। হ্যাঁ চেনা চেনা। কে এই মেয়ে। ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। গায়ে চিমটি কেটে দেখছে।না- সে স্বপ্ন দেখছে না ।
সে-তো দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক পা সামনের দিকে এগিয়ে আসে মেয়েটি। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এ তো সায়নী ! পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে-এতো সায়নী! করুন চোখে তাকিয়ে সে কিছু আমাকে বলতে চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে ছাদ থেকে নিচে নেমে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার নাম আর শব্দে বাড়ির অনেকের ঘুম ভেঙে যায়। দিদি হারকিন নিয়ে তার পিছু পিছু ছুটে আসে। অরূপ চিৎকার করে ডাকে” সায়নী। সায়নী।” পিছন থেকে দিদির চিৎকার” সায়নী সায়নী” বলে কাকে ডাকছিস। অরূপ দ্যাখে– “সায়নী খুব কাছে কিছু কথা বলতে চাইছে।” দিদির চিৎকারে দিদিকে থামিয়ে আবার ঘাড় ঘুরাতে গিয়ে দেখে সায়নী নেই। অবাক চোখে এদিক ওদিক খুঁজে বেড়ায়। দিদি ধমক দিয়ে ভাইকে ঘরে ডেকে নিয়ে যায়” মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। যা ।ঘুমা ।
রাতটা কোনো মতে কেটে যায়। পরের দিন হসপিটালে ছুটে। দেখে সায়নীর লাশ !চোখ থেকে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে। আকাশের দিকে তাকায়। ঘন ঘন মেঘের ফাঁকে সায়নীর গতদিনের সেই দুটো করুন চোখ ভেসে আসে। যেন বলে আবার কোন একদিন আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে।
অমাবস্যার দিনে ছোটো গল্প – সমাপ্তি
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন| এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভালোবাসার দেবালোকে
বিজয়া দশমী
এক চিলতে রোদ্দুর