বিজোড় গল্প – বাসুদেব গুপ্ত
এ গল্পের শেষ নেই। কাজেই পড়া শুরু না করাই ভালো হবে। সাবধান করছি কিন্তু। পরে বলবেন না সময়টা বরবাদ হলো।
আমার ঘরের পশ্চিম দেয়ালে একটা স্টীলের আলমারি দাঁড়িয়ে। অনেকদিন। আলমারিরা হাঁটে না। হাঁটলে কি ভালো হত? আলমারি এক দায়িত্বশীল আসবাব। অনেক কিছু সোপর্দ ইতিহাস বন্ধ পাল্লায় লুকিয়ে রাখতে হয়। সেগুলো দিন দিন ভারী থেকে আরো ভারী হতে থাকে। পুরনো থেকে আরো পুরনো। তারা আলমারির বুকে শেকড় চারিয়ে দেয়। আলমারির আর হাঁটা হয় না।
থাক। দাঁড়িয়ে থাক। আমি যেমন আছি, এই নিবু নিবু কাঁপতে থাকা টিউব লাইটের নীচে।
মাথা আমার সর্বদাই বেশ ঠান্ডা। এর থেকে বেশি ঠান্ডা হলে শীত করে। গরম হয়ে গেলে রেফ্রিজারেটরে মাথা গুঁজে দেখেছি। যেদিন নিরবধি চলে গেল। ভাবলাম এই দুষ্প্পাপ্য চোখের জলের ফোঁটাগুলো ফ্রিজ করে রাখি। পান্জাবীর বা ব্লাউজের বোতাম হবে।
যখন নয়নকুমারী ‘শহরে হাততালি’ থেকে আমার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে ওয়ার্ক at হোম করতে এল, সে শেখালো ফ্রিজ ডিফ্রস্ট করা ভালো না। মাথাও নয়। খাবার নষ্ট হয়ে যায়।
ডিফ্রস্ট তো করতেই হয় মাথা। আজকাল বড্ড বরফ জমে। আলমারিটাও মাঝে মাঝে সাদা সাদা ট্যাবলেট খায় । মাথার নামে খালি দোষ।
মাথাটা যেন এক আলমারী। নিরবধি গুছিয়ে রাখছে। পাট করছে। শুইয়ে দিচ্ছে শিশুর মত। পাশাপাশি। গোছাগুছি শুরু হলে নিরু পার্কে গিয়ে বসে থাকতো। পার্ক এখন আর সেই পার্ক নয়। জোড়ায় জোড়ায় জড়াজড়ি করে উইড ও চুমুর এক্সপিরিয়েন্স শেয়ার করছে। আবার সেই ছবি ফোনবন্দী করে ইন্স্টায় শেয়ার করছে। আর রাস্তা দিয়ে সারি সারি f f f f হেঁটে যাচ্ছে স্ক্রোল করতে করতে। নিরু এসব দেখে নি। ও ফোন নিয়ে কোনদিন পারকে যায় নি। সেলফি কাকে বলে শেখে নি। স্ক্রোল করতে শেখে নি। শুধু নির্জন আন্গুল গালে ছুঁইয়ে বসে থাকত। কি যে দেখত আর কি যে ভাবত বলতে পারবো না।
নিরবধি কারো নাম হয়? ছেলে না মেয়ে বোঝার উপায় নেই। লোকে এ নিয়ে বড্ড ভাবে। লিন্গ কি? পুং না স্ত্রীং। যতক্ষণ না জানা যাচ্ছে ঠিক ফিট হচ্ছে না। আর যদি জানা যায় না ঘরটা না ঘাটকা অমনি একটা বিশাল পার্লামেন্টারী কোরাস, তাই তো? দেখেই বোঝা যায়। ছি ছি আমরা কিন্তু একই টেবিলে চাল গম খেতে পারবো না। ছোঁয়াছুত। ছুঁলে বর্ণ বা জাত নাকি রাগ করে চলে যায়। ছুঁলে ওঁ পরমো ধর্ম মুখ লুকিয়ে ফেলে।
না জানাই থাক। নিরবধি কি। মানুষ তো বটে। নিরবধি আমার সংগে থাকার কথা ছিল। মার্ফিস ল এবং সুনীল্স ল সর্বদা একটিভ। অভিকর্ষও নাকি পৃথিবীর কেন্দ্রে গিয়ে ফেল করে। সুনীলের কেউ কথা রাখে নি পাল্টে দিতে চেয়েছিল নিরবধি। কেউ কথা রাখেনা। ইউনিভার্সাল। কিন্তু আমি রাখবো দেখো। আমি থাকবো নিরবধি। অপেক্ষা করে। যখন দিন পালটাবে, তুমি ফিরে আসবে জানি।
আমরা কেউ বিশ্বাস করতাম না চিরকালের চপ্ল ভাঁওতা। জানতাম সব কথা মিথ্যে কথা। ও হয় না। চিরকাল কিছু থাকে না। শরীরের উদ্ভট চাওয়া শরীর নিয়ে কাবাডি কাবাডি খেলা, শরীর দিয়ে রাগসংগত কদিন টেকে? কদিন অর্গাজম হয় সুখে, ভালবাসায় আরকদিন হয় অভ্যাসে, রাগে, দুঃখ থেকে ছিটকে পালাতে চাওয়ার আক্রোশ থেকে আমরা তো জানি।
শরীর নিয়ে কিছু বলব না। যারা আশার আলো দেখছিলেন তারা এবার স্ক্রোল করে যেতে পারেন। নিরবধি স্ক্রোল জানতো না। ও বলত একবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি তুমি একসেপট করেছ বাস আমরা বন্ধু নিরবধি।
বন্ধু মানেই কি এক ঘর এক ডাইনিং এক স্নানঘর, এক টিভি চ্যানেল এক সুইগির অর্ডার? এটা আমাকে মুস্কিলে ফেলত। নিরুকে না। ও চলে এল এক সুটকেস বই ল্যাপটপ আর এক বান্ডিল টেক্সটাইল আর ডটপেন নিয়ে। ভোরে সেদিন আবছা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশটা আলোও না আঁধারও না। মাটি ক্লান্ত ভিজে। দুর্বাগুলো ধীরে ধীরে মাথা তুলছে আর তাদের ওপর টুপ টাপ করে ঝরছে ছিন্ন হাওয়ায় কাঠচাঁপাদের শরীর। ও এলো নরম পায়ে। বলল, এসেছি। থাকবো। বলেই লিখতে বসে গেল। কবিতা। বৃষ্টি থামতে এক ঘণ্টা। তার মধ্যে কি লিখল ছাই পাঁশ। তারপর সোজা কিচেনে গিয়ে দুকাপ লিকার চা নিয়ে এসে বসল। আমাকে বলল নাও।
কাপটা আলতো করে এগিয়ে দিয়ে হাসল। যে হাসির জন্য আমি অনেক আগেই বিক্রীত হয়ে গেছি।
সে আজ তিরিশ বছর আগেকার কথা। পরের দিন ওর জন্মদিন। ২৬শে অক্টোবর। ওর নবজন্ম হলো আঠাশ বছর বয়সে। আমারও।
আজ আবার সেই দিন। যেদিন ও চলে গেল তারপর প্রতি বছর আমি এই দিন কেক আনতাম। সংগে আনাতাম দশটা গারবেরা ডেইজি। সেগুলো শুইয়ে দিতাম ওর বিরাট একটা ছবির নীচে। নীচে সাজিয়ে দিতাম দশটা ডটপেন। দশ বছরের স্মৃতি।
ছবির মুখটা থাকতো দেওয়ালের দিকে। একটা পাথরের মত। যাতে কোন মুখ নেই হাসি নেই শুধু জমাট বাধা স্মৃতি। তার নীচে রাখতাম আমার দশটি আঙুল। দশটি গারবেরা ডেইজী।
বিকেলবেলা ডেইজীগুলো ছিঁড়ে কুটিকুটি করতে আমার খুব ভালো লাগত। কেকটাকে রেখে দিতাম বারান্দার রোদ্দুরে। কৃষ্ণকালো কাক এসে খেত, ছিটোতো, সংগে নিয়ে যেত তার বাসায়। পরিতৃপ্ত হতাম আমি। নিরু? কে জানে। কখনও কেউ জেনেছে ওর কি লাগতো? ও কি সেটাই তো রহস্য থেকে গেল।
এগিয়ে এসেছি। পিছোই আবার। নিরুকে বললাম তুমি তো থাকবে এইখানে । এক ছাদের নীচে। এক হাওয়া নিঃশ্বাসে বিনিময় করে। কিন্তু তুমি আমার কে? বন্ধু না গুপ্তঘাতক?
পুঁথির খোঁজে যাদুঘর হয়ে যাওয়া ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে গিয়ে একই বই তোমারও চাই দেখে তোমাকে মনে হয়েছিল এক দুর্গ্রহ, এস্টিরয়েড।
-ঠিক আছে আপনি যখন চান আপনিই নিন। কিন্তু পড়া হলে আমাকে কিন্তু বুঝিয়ে দেবেন।
-দাতব্য করছেন? আমি ছাড়ার পাত্র নই। আমাকে কেউ করুণা করে কিছু দেবে আমার চিরকাল না পসন্দ। আর আপনি আমার কে? যে আপনাকে পড়ে আবার বোঝাতে যাবো।
দেখুন সারা পৃথিবীতে ৮০০ কোটি লোকের মধ্যে ৮ জন এই বইটার খোঁজ করেছেন। তার মধ্যে দুজন আপনি আর আমি। কিছু তো ব্যাপার একটা আছেই।
গায়ে পড়া ব্যাপারটা আমি একেবারেই দেখতে পারি না। আমি আরও বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ওসব কথার কোন মানে হয় না। আপনার কাছে কোন ফালতু উপদেশ আমি চাই না। আপনি বইটা নিন। তাড়াতাড়ি ফেরত দেবেন। আমার থিসিস লেখার জন্য এটা দরকার। আবার পাতা টাতা ছিঁড়বেন না যেন।
— এতক্ষণ বুঝলাম। আপনি যেমন রাগী অধ্যাপকের মত মুখ করে আছেন, আপনার নিজের অমর হবার কোন শখ নেই। আপনার দরকার মেটিরিয়াল। কিছু একটা গোলমেলে কিম্ভূত ব্যাপার লিখে দিলেই আপনার কাজ শেষ। আমি কিন্তু অমর হতেই চাই। সবাই মরে গেলেও আমি বেঁচে থাকবো। কি মজা না?
অবলীলায় তুমি আমার হাত থেকে কেড়ে দিলে অমৃতকলস। হ্যাঁ বইটির তাই নাম। বিদেশের মানুষ হাজার বছর ধরে সাধনা করেছে পরশপাথরের। কি করে পাথরকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গলিয়ে তৈরী করা যায় সোনা। আর আমাদের এই উপমহাদেশে তপস্যা বিপরীতগামী । এখানে সাধনা মুক্তির সাধনা। জীবনচক্র থেকে চিরতরে মহানির্বাণের সাধনা। মনে হয় জীবনে আমাদের পূর্বজরা শুধু যন্ত্রণা শোক শক্তের হাতে অপমান এর বেশি কিছু আশা করেননি। তাই মুক্তির সাধনা আমাদের অন্তরের সাধনা। চল শালা পালিয়ে বাঁচি । এই মহান স্তোত্র গুন্জরিত হয়ে চলেছে এই মহাতীরথ দেশের ঘাটে ঘাটে।
লাইব্রেরীর এনেক্সে চায়ের স্টল। পেস্ট্রি ঘুগনি চা কফি কোল্ড ড্রিংকসের স্টল। আমি অন্য আরো কয়েকটি বই থেকে প্রচুর নোট লিখে ক্লান্ত হয়ে একটা কোক নিয়ে বসেছি তখন নিরবধির আবির্ভাব। বিনা ভনিতায় এসে আমার টেবিলেই বসে পড়লো। একটা চায়ের অর্ডার দিলো। তারপর বলল,
ধন্যবাদ। বইটা খুব কাজের। থিসিসটা এবারে শেষ করা যাবে মনে হচ্ছে। আপনি কোক খান? বাজে জিনিস। বসেই বলতে শুরু করল,
–অমর হওয়ার জন্য যে কজন তপস্যা করেছেন মরুভূমিতে, পাহাড় কেটে জাপানী ক্যাপসুল স্টাইলের গর্ত করে অন্তহীন কাল উপাসনা করে গেছেন তাঁদের সেই যাত্রাপথের কাহিনী লেখা আছে এই বইটিতে। ১৯৩৪ সালে কেভিন স্পেন্ডার নেপালে ভূমিকম্পের উদ্ধার কার্য চালাতে গিয়ে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন । চারদিকে তখন যুদ্ধের আগমনী বাজতে শুরু করেছে। রেড ক্রস খুব চেষ্টা করছে একটা প্রস্তাব পাস করার, যাতে যুদ্ধের সময় অসামরিক মানুষজন আক্রমণের শিকার না হন সেটা সুনিশ্চিত করা হয়। হয় নি। আজও একটি দেশ হাজার হাজার টন বোমা রোজ ফেলে যাচ্ছে সেখানকার অসামরিক মানুষদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য।
সেই ১৯৩৪ সালের পুঁথি চুরি হয় দুবার, নীলামে ওঠে সোদবীতে। তারপর একদিন তা সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় কোনো অজ্ঞাত কারণে।কিন্তু তার থেকে বসে বসে দীর্ঘকাল ধরে নোট নিয়ে লিখে রেখেছিলেন স্পেন্ডার সাহেব। সেই বইএর নাম অমৃত কলস। The jar of elixir.
আমি হাঁ করে শুনছিলাম। অনেকটাই আমার জানা। কিন্তু ও কেম্ন কথাগুলো নিজের করে নিয়েছে, সেটা খুবই অবাক করল। নিজের করে নেওয়াটা যে ওর বিশেষ গুণ সেটা ক্রমশঃ প্রকাশ পেতে থাকলো।
বাজে হোক, কাজের হো্ আমার কাছে ঠান্ডা এক ক্যান কোক তখন অমৃতকলসের থেকে কম না। কোক নিয়ে কটাক্ষ আমার বিরক্ত লাগল। বোধহয় ভুরুও কুঁচকে গেল।
–আপনার চোখের পাওয়ার চেক করাবেন। চোখ কুঁচকে যাচ্ছে। সারাদিন ধরে পুঁথি পড়লে চোখের আর দোষ কি? আমার চেনা ভালো আই স্পেশালিসট আছেন, দেখাবেন? চেন্নাইতে বিখ্যাত ডাক্তার নীল আস্থানা। আস্থা রাখতে পারেন।
বলেই মোবাইল খুঁজে নম্বরটা বার করে বলল,
–আপনার ফোননংটা বলুন। এসএমএস করে দিচ্ছি।
তখনও হোয়া এসে মহামারীর মত গাঁয়ের লোককে পেড়ে ফেলে নি। কিন্তু আমার নম্বরটা দেওয়া উচিত হবে? একেবারে অজানা একজনকে।
–অজানা অপরিচয়ের দিন শেষ। নতুন যুগ আসছে। সবাই সবার নেট ফ্রেন্ড হয়ে যাবে। কি ভাবছেন আমি জানি। দিন দিন আপনার নম্বরটা দিন।
হাসাবো না কাঁদবো না নাচবো মাথার চুল ছিঁড়ে, কেশমুন্ডনং নৃত্য করব বুঝতে পারছিলাম না। অগত্যা হেসে ফেললাম। আর আমি হাসতেই নিরবধি হাত বাড়িয়ে দিল।
নিরবধি নির্বিকল্প। অবশ্যই বাপের জন্মে এমন নাম শুনিনি। যেমন মানুষ তেমনি নাম। এন্থ্পোপলজিস্ট কেমিস্ট এনাস্থেসিস্ট হীরাবাই হস্পিটল। কার্ড এগিয়ে দিল। একটু হাসল। তারপর বললো,
–বুঝতেই পারছেন ইম্প্রেস করার জন্য যা পেরেছি লিখে দিয়েছি। তবে আমি তেমন কোন ইস্ট ফিস্ট নই। আমার কোন ইস্টো ক্রিস্টোও নেই। তবে অমরত্ব ব্যাপারটা নিয়ে আমার খুব কৌতূহল। আমার সামনেই অনেক মরা রোজ দেখি। এই ছিল মানুষ এই হয়ে গেল লাশ। তারপর মর্গে আরামে ঠান্ডায় ঘুম। যতদিন না কেউ এসে ক্লেম করে।
–আপনি ডাক্তার আবার এসব অবৈজ্ঞানিক ব্যাপারে মাথা ঘামান?
–মাথা ঘামানোটা অবৈজ্ঞানিক না। না বুঝে বিশ্বাস করাটা। আপনার পরিচয় কিন্তু পেলাম না।
–আমার প্রেস কারড আছে। শিক্ষানবীশ সাংবাদিক। শখের ঐতিহাসিক। নামটা নাই জানলেন।
–ঠিক আছে আপনার নাম আমি বেনামী বলেই জানলাম।
–বেনামী মানে খারাপ। যার নাম নেই সে হলো অনামী।
ভুরু কুঁচকে তাকাতেই মনে হল আমাকে নিশ্চয় অধ্যাপকের মত লাগছে। হেসে ফেললাম। হাসতেঁই থাকলাম। নিরবধিও হাসল। হাসতে হাসতে অলক্ষ্যে কখন নেশা ধরে গেল।
রাত আটটা ততক্ষণে বেজে গেছে। যে কোন কারণেই হোক সরকারী কর্মচারীরা একটু সরকারের গুমোর দেখাতে ভালোবাসে। সে লাল লাইট আর সাইরেন লাগিয়ে আমলা বা পুলিশের ডি এসপির শ্যালিকাকে পার্লারে নিয়ে যাবার গাড়ীই হোক। সরকারী রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা সেটা দেখায় তাদের মত খাড়ুশি করে। ধপাস করে আলো নিভিয়ে দরজা জানলা বন্ধ করে টাইম আপ ঘোষণা হয়ে গেল। বাস আর কোন কথা নেই। ভাগো।
অন্ধকারে দুটো চলমান মমির মত হাঁটতে হাঁটতে আমি খোঁচা খেলাম একটা পোস্টারের লাঠিতে। পড়ে যাচ্ছিলাম নিরবধি আমায় ধরে ফেলল। বসার সময় দেখেছিলাম। ময়দান চলো। স্বৈরাচারী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে দিকে দিকে আন্দোলন গড়ে তুলুন। এই সব। স্বৈরাচারী বলতে তখন আমি বুঝতাম রেলের টিকিটঘরের ব্যক্তিটিকে। যখন তখন চাপতে হত ট্রেনে। তিনি বলতেন কোটা ফুল। বা রাত এগারোটায় হঠাৎ অমায়িক হেসে লাফ দিয়ে পড়া টিটি মহাশয়কে। রেলের সঙ্গে আমার একটা আঁতাত ছিল চিরকালই শেষে সেই আমাকে শেষ করবে কে জানত?
–সরি। ধন্যবাদ।
–সরি টরি নয়। শোধবোধ করে দেবেন কোনদিন আমি পড়ে গেলে ধরে।
–না। আপনি বই রিকুইজিশান করলে আমি বইটা নিয়ে চম্পাট দেবো। সেটাই হবে ঠিক শোধবোধ।
–কি আশ্চর্য মানুষ আপনি, এখনো মনে করে রেখেছেন। আমি তো ভুলেই গেছি।
তা ঠিক। নিরবধির ভুলে যাওয়াই স্বভাব। আর মনে রেখে দেওয়া আর মনে করিয়ে দেওয়াটা আমার পেশা ও স্বভাবদোষ। তাই পরের দিন যখন আমরা বিড়লা প্লানেটারিয়ামে তারা নিয়ে গবেষণা করব ঠিক করলাম, নিরবধি ভুলেই মেরে দিল। আমি মনে রেখে দিলাম। ওর কার্ড দেখতাম মাঝে মাঝেই। মনে হত ফোন করি। কিন্তু আত্মসম্মানে বাধত।
দিনগুলো সৈন্যদলের মত কুচকাওয়াজ করে ধূলো উড়িয়ে একবার এদিকে যায় আর একবার ওদিক । আঁধিতে আমরা দুহাত দূরে দেখতে পাই না। যখন ধুলো সরে যায় তখন পর্দা ওঠার মত আর এক নতুন স্টেজ। নতুন স্ক্রীন। পাত্র পাত্রীরা সবাই নতুন। পুরনো কুশীলবরা জয় হোক মহারাজ বলে সেলাম ঠুকতে ঠুকতে বেরিয়ে যায় আর আসে না।
নিরো নিরু নীরু আমার নির্মম নিরূপম ফিরে এসেছিল। আগুন জ্বালিয়ে নয়। বেহালা বাজিয়ে। তারপরের গল্প প্রেমের। নিছক প্রেমের। যারা একবার করোনার মত ঐ অসুখটি বাধিয়েছেন, তারা জানেন। যারা তার স্পর্শ পান নি তাদের বলে বোঝানো যাবে না। বিরহ মিলন প্রবল সোহাগ আদর দাঁত মুখ খিঁচিয়ে দুটি আহত নেকড়ের মত কলহ সব করেছি। মনে হয়নি আমরা প্রেম করছি। আমরা শুধু হয়ে যাচ্ছিলাম। এ স্টেট অফ বিইং।
অনেকদিন আমরা একসাথে থাকি নি। নিরু বলত দূরে থাকি বলেই তো তোমার কাছে যেতে পারি। সকাল থেকে ছটফট ঘড়ি দেখা কোন বাসে যাবো ঠিক করা কি পরবো কি পারফিউম লাগাবো হাজার চিন্তা। তখনো বই উপহার দেবার চল ছিল। আমি দিতাম গল্পের বই। ও দিত কবিতার। তারপর কবিরা এমন ধীরে ধীরে শব্দকেরাণী হয়ে গেলেন। গল্প পড়া বন্ধ হয়ে গল্প দেখা চালু হলো।
আমরা তখনো ডেট করার মত ভাষাসাহসী হই নি। আমরা বেরোতাম। শহরটির আনাচে কানাচে রাধুবাবুর চা থেকে পার্কের zen নন্দন থেকে মেট্রো চষে ফেললাম।
তারপর একদিন ও হঠাৎ চলে এলো। রবিবার ভোর। চারদিক ভিজে। ভিজে আকাশ। ভিজে জামা। শুধু চোখদুটো শুকনো খটখটে লাল। সারারাত জেগে ডিউটি করেছে। তারপর না ঘুমতে গিয়ে ওর কেন যে ইচ্ছে হলো বাড়ী বদলের সে ব্যাখ্যা ওর কাছে চাই নি। চাইলে দিতে পারত না জানি।
নিরু থেকে গেল। আর সেই সংগে শুরু হলো ফিসফাস। কে যেন জানতে পেরে গিয়েছিল আমাদের ব্যাপারে। এমনিতে কারো কিছু বলার নয় কারণ আমরা একই জেন্ডার। কেউ রটিয়ে দিলো আমরা নাকি সম।
পাড়ার দোকানদার ঠোঁটকাটা। তিনি জিজ্ঞেস করেই ফেললেন। আপনারা কি ওই? মানে ঐ সেমসাইড আর কি! মানে আমি কিছু মনে করি না। কিন্তু সবাই বলাবলি করে তাই জানতে ইচ্ছে করলো।
বাজারে মাছওলা পর্যন্ত জেনে গেল। মাছ ওজন করতে করতে সে মুচকি মুচকি হাসে। পাশের মাছওলা খদ্দের ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে যেন মন্গলগ্রহ থেকে কেউ মাছ কিনতে এসেছে।
এরকম যে হতে পারে নিরু বলেছিল। আমি পাত্তা দিই নি। দুজন ছেলে বা দুজন মেয়ে তো ঘর শেয়ার করেই থাকে। আসলে আমাদের প্রতিবেশী কোচিং মাস্টার একদিন আমাদের দেখে ফেলল।
তখন লোড শেডিংএর যুগ। প্রচন্ড গরমে যখন তখন পাখা বন্ধ। হাত পাখা নেড়ে নেড়ে হাত ব্যথা। তখন একদিন নিরু অদ্ভুত এক আইডিয়া নিয়ে এল।
–খুব ঝাল লংকা খেলে কি করে জিভে শান্তি আসে বল তো? দুভাবে। হয় দুধ খাও বেশ খানিকটা। নাহলে ভীষণ গরম চা ঢেলে দাও। দেখবে কেমন সব দাউদাউ জ্বলে উঠবে। তারপর সেই জ্বালায় লংকার জ্বালা কোথায় চলে যাবে। এই যেমন দেখো, বলেই সে আমাকে চুমু খেতে শুরু করল। গরমে দরদর করে ঘামছি আর দুজনে দুজনকে আদর করে চলেছি। দেখলাম আর গরম লাগছে না। শরীর যদি বাইরের থেকে বেশী উষ্ণ হইয়া যায় তখন আর গরম লাগে না। পদার্থবিজ্ঞান? ভাবার তখন সময় পাচ্ছি না চুমুর ঝড়ে।
আমরা ধীরে ধীরে বসন্তের কুন্জবন খুঁজে পাচ্ছিলাম দুজনের শরীরে। একটা গুন্জন ঘুরে ঘুরে যাচ্ছিল আমরা আমাদের প্রবল উষ্ণতা মালা করে দুজনকে পরিয়ে দিচ্ছিলাম। জানলা ছিল খোলা। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। বিশ্বব্রহ্মান্ড রসাতলে যাক আমরা ঘুরে যাচ্ছি তারায় তারায় …
হঠাৎ শীত করে উঠল। আলো জ্বলে উঠল। পাখা ঘুরতে শুরু করল বনবন করে। আর জানলার বাইরে পাশের বাড়ীর কোচিং স্যারের বারান্দায় সিগারেটের আগুন দু একবার হুস হুস করে জ্বলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দোকানদার বাবলুদা অমায়িক মানুষ। হাঁটুর ওপর লুন্গি উঠিয়ে তিনি সারাদিন একটা টুলে বসে বিক্রি করেন। হাসিমুখ। কেবলমাঝে মাঝে সায়াটিকার ব্যথায় কাতর হন তখন একটু খিটখিট করে ওঠেন।
আমি কথায় কান না দিয়ে বললাম আপনার ব্যথাটা এখন কেমন? চিকিৎসায় উন্নতি হচ্ছে কিছু ?
দুটি কাজের লোক কে আগে দুধের লাইন দিয়েছে তাই নিয়ে গোলমাল করছিল তাদের দুজনকেই ঠান্ডা করে আমার দিকে তাকালেন কাঁচুমাচু মুখে,
-কৈ সারছে আর কোথায়। কত প্যথী কবিরাজী টোটকা তান্ত্রিক ফকির সব তো করলাম। আপনার চেনা কেউ ডাক্তার আছে নাকি? আপনি তো জার্নালিস্ট। অনেক খবর রাখেন।
— আমার রুমমেট একজন ডাক্তার। ব্যথা কমানোর উপায় এই নিয়ে কাজ করছে। বলবো?
বাবলুদার মুখে আনন্দের ছটা দেখা গেল। তার সংগে অল্প লজ্জা ঐ প্রশ্ন করার জন্য।
—নিশ্চয় নিশ্চয়। কিছু মনে করবেন না ঐ কথা জিজ্ঞাসা করার জন্য। আজকাল তো এমন হচ্ছে কত।
—একদিন আসবেন চা খেতে। আমার রুমমেট বুঝিয়ে দেবে সব।
ওনার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসছি পাড়ার উঠতি নেতা রমেন বোস ঢুকলো। শুনতে পেলাম,
—ঐ সমটা আপনার দোকানে আসে?
—চুপ চুপ শুনতে পাবে, বাবলুদার ফিসফিস। খুব ভালো উনি। সাংবাদিক। আর একটা আবার ডাক্তার।
—সে যাই বলুন আমাদের পাড়ায় এসব আমার একেবারে পছন্দ না। আর জানেন তো এভাবে থাকা লিভ ইন না কি বলে, এটা একেবারে বেআইনী। 377 ধারা জানেন? আমার দাদা উকিল। আমাকে বলছিল। জেলে যেতে পারে।
নিরুকে বললাম 377এর কথা। এটাও বললাম পৃথিবীর অনেক দেশে আমাদের পাবলিক বাজারে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলতো।এখানে non cognisable. কিন্তু কেউ অভিযোগ করলে সুপ্রীম কোর্টে গিয়েও মুক্তি নেই। আইনের মতে, শাসক দলের মতে, বিরোধী দলের মতে, কমিউনিস্টদের মতে, এক জেন্ডারের ভালোবাসা ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী এক অসুস্থ উদাহরণ।
আচ্ছা তোমার বাড়ীর লোক জানে ?
না। শুনলে হার্ট এটাক হয়ে যাবে। তোমার?
না। জানলে তোমার নামে সুপারি দিয়ে দেবে।
পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি
আমরা দুজনা চলতি হাওয়ার পন্থী।
উদ্ধত যত শাখার শিখরে
রডোডেন্ড্রন গুচ্ছ।
নিরু কবিতা পড়তেও ভালবাসতো খুব। সেদিন নিউমার্কেট থেকে দশটা গারবেরা এনে আমার হাতে দিয়ে কবিতাটা আবৃত্তি করতে লাগলো বারবার। বুঝলাম ওর আবার নেশা চেপেছে। নইলে গারবেরাকে রডোডেন্ড্রন বলে চালিয়ে দেয় কেন? আমি মুখে চাপা দিয়ে বন্ধ করতে গেলে আমাকে জোরে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলো।
—কি দেখছো?
— কি দেখে লোকে? আমার সর্বনাশ। আর কি।
-এটা কি চৈত্র মাস? আর এখন তো রাঙ্গা আলোও নেই। খটখট করছে টিউবলাইট!
ও খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। যেন একটা জুতসই উত্তর ভাবছে, তারপর ওর আঙ্গুল আলগা হয়ে গেল, দেয়ালে ভর দিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল আমার কাজ চলে গেছে। পাড়া থেকে কেউ খবর দিয়েছে হাসপাতালে। আমাকে সিনিয়র সার্জন দেখা পর্যন্ত করতে দিলেন না। গেট থেকেই বিদায়।
বাবলুদার উপকার করতে যাওয়াই কাল হলো। আমার চোখ মাটিতে। কি বলবো? যেন মেঝেটা দুভাগ হলে বাঁচি।
-আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে। যেখানে কেউ আমাকে চেনে না তেমন শহরে।
-আর আমি?
-তোমার নিজের বাবার বাড়ী, তুমি কেন ছাড়বে?
-এরা কি আমাকেও ছাড়বে ভেবেছ?
ঠিক তাই। পরদিনই লেটার বক্সে একটা হাতে লেখা চিঠি। ওপরে লাল কালি দিয়ে লেখা
নোটিশ
ভাল চান তো বাড়ী যোগ্য লোকের হাতে তুলে দিয়ে বিদেয় হোন। এসব নোংরামি এখানে চলবে না। পুলিশে খবর দিলে ১০ বছর জেল। ৩৭৭ হাঃ হাঃ হাঃ তারপরে একটা অপটু হাতে আঁকা মাথায় খুলি।
–এটা নিয়ে পুলিশের কাছেও যাওয়া যাবে না। বুঝতে পারছো?
–তাহলে কি হবে? আমার তো কিছু মাথায় আসছে না। এখান হইতে পলায়ন? আমার চাকরিটা তো যাবে। কি খাবো তখন?
নিরু মুখ বাঁকালো।
— আমার তো চাকরিই নেই। আমাকে অনেক দূরে কোথাও গিয়ে ডাক্তারখানা খুলতে হবে। গর্ভপাত কিডনী বিক্রি নকল পেসমেকার কত রকম ব্যবসা চলে গন্জ শহরগুলোতে। একটা কিছু ম্যানেজ হয়ে যাবে।
কথাগুলো শুনে আমার মাথায় হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠলো। আমি নোটিশটাকে কুচি কুচি করে ছিড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে বাবলুদার দোকানে গিয়ে ওঁর মুখোমুখি হলাম।
–বাবলুদা এটা কি করলেন আপনি?
বাবলুদা এখন বোধহয় সায়েটিকা আছে পর্যায়ে। মুখ বিকৃত করে বললেন,
–আমি কিছু জানি না। রমেনকে জিজ্ঞেস করো।
আমি হিসহিস করে উঠলাম,
— আপনার ভালো করতে গেলাম আর আপনি আমার এই সর্বনাশটা করলেন?
বাবলুদা নির্বিকার ভাবে বললেন,
সর্বনাশ তো তুমি নিজেই করেছ নিজের। তুমি কি চাও তোমার জন্য পাড়াটা নষ্ট হয়ে যাক?
মুহূর্তে মাথায় সব পরিস্কার হয়ে গেল। বাবলুদার কাকা যে প্রোমোটার সে কথাটা বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়লো। বাঙ্গালীর সব গল্প শুরু আর শেষ হয় প্রোমোটারে এসে। প্রচন্ড রেগে আমি ওর দোকানের একটা বয়াম নিয়ে ছুঁড়তে গেলাম তখন নিরু এসে পিছন থেকে আমাকে জাপটে ধরে আটকালো।
-বাঃ পাবলিক প্লেসেই এবারে পিডিএ শুরু হয়ে গেছে দেখছি। এবারে মনে হচ্ছে পিটিয়ে সিধে করতে হবে।
পিছন থেকে তীরের ফলার মত আটকে গেল রমেনএর কথাগুলো। নিরু তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল
-চল। আমরা এখান থেকে চলে যাই।
-কোথায় পালাবে দুই টুনটুনি? যেখানে যাবে পারটির লোক গিয়ে ডান্ডা লাগাবে।
বাব্লুদার এমন গলার স্বর হবে ভাবা যায় নি। শান্ত, কঠিন জল্লাদ বা মন্ত্রীদের গলায় এমন শব্দ হয় শুনেছি।
-ভালোয় ভালোয় নোটিশে যা লেখা আছে সেটা শোন, ছেড়ে দেব। তারপর যেখানে ইচ্ছে যাও, বাঁদরামি করো।
-তাহলে আপনিই ঐ লেখাটা ফেলেছেন লেটার বক্সে?
-যদি ফেলেই থাকি, কি করবে? পুলিশে যাবে?
অনেকক্ষণ চুপচাপ নিরু শুনছিল। ওর কথা হয় খাতায় না হয় ঘরে। জনতার সামনে কেমন চুপ হয়ে যায়। কিন্তু ও আর থাকতে না পেরে বাব্লুদাকে সপাটে একটা ঘুষি চালিয়ে দিতেই, আমি বুঝলাম এর পর আমাদের ওপর অল হেল উইল ব্রেক লুজ।
আমাকে বোধহয় পাড়ার লোক বলে ওরা ছেড়ে দিয়েছিল, যত রাগ নিরুর ওপর। বাব্লুদা মাটিতে ছিটকে পড়ে কাতরাতে লাগলেন, তখন রমেন আর তার দুতিন জন সাংগপাঙ্গো এসে ঘিরে ধরল নিরুকে। এদেরি কিছুদিন আগে লাল পতাকা নিয়ে মিছিল করে জনগ্ণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য চাঁদা তুলতে দেখেছি। নিরু ওদের পঞ্চাশ টাকা দিতে ওরা অবাক হয়ে গিয়েছিল।
সেই তারা, ওকে পেটাতে লাগ্লো। মুখ দিয়ে বেরোতে লাগ্ল খিস্তি। আমরা সবাই সে খিস্তি গুলো অহরহ বাজারে শুনে থাকি।
যখন টানতে টান্তে ওকে বার করলাম তখন ওর জামা কাপড় ছিঁড়ে একাকার, নাক ফেটে গেছে, হাঁ মুখে রক্তের ডেলা।
পরের দিন সকাল থেকে আর ওকে দেখা যায় নি। কোন বিদায়ের চিঠি নয়, কোন ঠিকানা নয়, বেমালুম অদৃশ্য। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই গেছে বিখ্যাত রেললাইন। পাড়ার পাশ দিয়ে চলে গেছে বস্তি, সেখানে রোজ ট্রেন থামিয়ে চোরাকারবারীরা মাল নামায়। আর তাদেরি কেউ কেউ হঠাত প্রচুর কারণে বিবশ হয়ে কোন অজানা শোক বা বিরাগে লাইনে গিয়ে শুয়ে পড়ে। সকালে আবিষ্কার হয় তাদের হতবাক মাথা ও রোগে ভোগা শরীর চিরতরে আলাদা হয়ে গেছে।
তিনদিন পরে নাকি পাঞ্জাবী পাজামা পরা একজন মানুষের ধড় ও মুন্ডু পাওয়া যায়। মুখে প্রচুর মারের দাগ। দুটি দাঁত নেই। পকেটে একটি খাতা ও আই ডি কারড।
আমাকে ডাকা হয়েছিল সনাক্ত করতে। আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম। তাকাই নি। ব্লেছিলাম না আমি একে চিনি না।
বাবলুদা মানুষটা ভালো। আমাকে ফ্ল্যাটের চিলেকোঠায় একটা ঘর দিয়েছেন। সেখান থেকে চাঁদ দেখা যায়। মাঝে মাঝে নিরুকেও আমি দেখতে পাই। ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে হাসছে। ওর পায়ের নীচে আকাশ, মাথার ওপরে আকাশ। হাত দুটো ভেসে গেছে দুটি নোউকার মত কুয়াশায়।
ধুর, এগুলো বানানো কথা। আলমারিতে রাখা ওর কবিতার খাতাগুলো। আলমারিটা কোথাও যায় না। আমিও না। শুধু যা আছে পাট করি। গুছোই। নিরু বলত দেশটাকেই গোছানো দরকার। কিন্তু নিরু তো নেই। আজ আর কেউ বলে না। ৩৭৭ এখনও আছে। শুধু জেলে যাওয়াটা নেই।
নিরবধি আছে না নেই আমি জানি না। শুধু জানি, ভালোবাসলেই হয় না। তারো আইন আছে। আর যারা চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, মানুষ যাদের বলি, তাদের সবার লুকনো আছে দাঁত নখ। মানুষ রক্ত চায়। ভালোবাসা নয়।
বিজোড় গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না