কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

নিভৃত রক্তক্ষরণ

নিভৃত রক্তক্ষরণ প্রেমের গল্প – অর্ঘ্য শুররায়

হঠাৎ করে ঋষিকাকে দেখে,বিতান চোখ ফিরাতে পারেনি।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।এত বৎসর পর এইভাবে ফিরে পাওয়ার আশা কেউ করেনা।তাও আবার এক সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায়।ভাগ্যিস আজ ছেলেকে স্কুলে দিতে এসেছিল।নাহলে হয়তো সারাজীবনের জন্যে অপেক্ষা রয়ে যেত।
বদলির চাকরি বিতানের।সদ্য এসেছে এই নতুন জায়গায়।ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়েছে।আজ বউ অসুস্থ তাই ছেলেকে স্কুলে আনার দায়িত্ব বিতানের উপর পড়েছে।খুব সকালেই বিতান অফিস বেরিয়ে যায়।ফেরে সন্ধ্যাবেলায়।বছর পাঁচ হলো বিয়ে করে সংসারী হয়েছে।চাকরি পেয়েছে বছর আটেক হলো।সব কিছু পাওয়ার মধ্যেও একটা না পাওয়ার বেদনা ছিল।ঋষিকাকে এই জীবনে পাওয়া হলনা।একটা অব্যক্ত বেদনা আমরণ বয়ে যেতে হবে।হাজারো কাজের মাঝে অথবা অলস মুহুর্ত যখনই সময় পায় ঋষিকা তার হৃদয়ে উঁকি মারে।কখন রাগ হয়, দুঃখ হয়,আবার কখনো আবার ফিরতে ইচ্ছা করে ঋষিকার কাছে।
ঋষিকার সাথে সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল,কলেজ পাশ করার পর।চাকরির পরীক্ষার জন্য এক কোচিং ক্লাসে একসাথে ভর্তি হয়েছিল।এরপর চোখে চোখে কথা,তারপর একে অন্যের হৃদয়ে কখন বাসা বেঁধেছে মনেনেই।সেসব দিনগুলি ছিল স্বপ্নের মত।বিতানের মাঝে মাঝেই মনেহত প্রেমে বিরহ,বিচ্ছেদ কোনোদিন আসে না,যদি তাদের মত বোঝাপড়া থাকে।বন্ধুরা রীতিমত হিংসা করত।একদিনের জন্যেও তাদের মধ্যে কোনোদিন অভিমান আসেনি,বিরোধ আসেনি, সম্পর্কে চিড় ধরেনি। ঋষিকা এইসব বিষয়ে খুব সচেতন ছিল আর সস্নেহে ও সম্পর্কটাকে আগলে রাখতো। বিতানের মা এর খুব পছন্দের ছিল ঋষিকা।এমন সুমিষ্ট,নম্র স্বভাবের মেয়েকে পারলে তখনই বউ করে নেয়!ছেলে হিসেবে বিতান যথেষ্ট শিক্ষিত ছিল,তাই ঋষিকার বাড়িতে ছিল অবাধ যাতায়াত।বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য হারিয়ে গেলেও,ওদের সম্পর্কের দিনগুলোয় প্রত্যেকটা ঋতু যেনো তার ঐশ্বর্য্য দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল।
কিন্তু এতকিছুর পর এইভাবে হটাৎ সম্পর্কটা ভেঙে যাবে,কেউ ভাবেনি। ঋষিকা কিভাবে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেলো,সেটা এতদিন পরেও বিতানের অজানা,অবসর সময়ে শুধু একটাই প্রশ্ন বিতানকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে চলেছে।বারবার বিতান ভাবতে চেষ্টা করেছে তার কোনো কাজ কি ঋষিকাকে চিরকালের মত সরিয়ে দিলো!বন্ধু আত্মীয় সকলের সামনে বহুদিন বিতান যেতে পারেনি,পাছে এই অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।
সেবার কলেজে সরস্বতী পূজায় দুজনে খুব আনন্দ করে ঘুরল।দুপুরে ঋষিকার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল।ঋষিকাকে খুব খুশি লাগছিল।ঐবার বিতান চাকরির ইন্টারভিউতে পাশ করলো।পরের বছর বিয়ে মোটামুটি পাকা ছিল।ওদের নিজস্ব কেনাকাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল।হঠাৎ এক বুধবার থেকে ফোন করা বন্ধ হয়ে গেলো।বিতান বারবার ফোন করে কোনো উত্তর পেলনা।তারপর বিশেষ কারণে মামাবাড়ি থেকে ফিরে উদভ্রান্তের মত ছুটে গিয়েছিল ঋষিকার বাড়ি।শুনলো চলে গেছে।অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারলনা কারণ।ঠিক আরো তিনদিন পর ভালোবাসার মানুষটির থেকে ছোট একটা টেক্সট পেলো।”আমাকে ভুলে যাও।”
মুহূর্তে বিতান নির্বাক হয়ে গেলো।তারপর অনেক টেক্সট করেছিল আজ পর্যন্ত কোনো উত্তর পায়নি।অনেকদিন পর সূত্র মারফৎ জেনেছিল,ওর বাবার ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু ট্রান্সফার হলে কি সম্পর্কের বাঁধন ছিঁড়ে যায়!!সব রাগ গিয়ে পড়েছিল ঋষিকার উপর।এত নির্দয়,হৃদয়হীন ঋষিকাকে প্রথম আবিষ্কার করলো বিতান।আশা ছিল,হয়তো ফিরে আসবে ভুল বুঝে,কিন্তু ঈশ্বর হয়তো অন্য কিছু লিখেছিলেন,তাই বিতান আজ ঋষিকার পরিবর্তে অন্য কাউকে নিয়ে সংসার করছে।কত কথা,কত পরিকল্পনা,কত আশা চিরকালের মতো নিভে গিয়েছিল।
ঋষিকাকে আজও প্রতিদিন সকালে উঠেই মনে করে বিতান।কেনো করে,বিতান নিজেই জানেনা।এখনও বিতান সম্পর্কের একটা সূত্র ধরে রেখেছে গোপনে,মনে গহীন গর্ভে,সকলের অন্তরালে।আবার হটাৎ করে ঋষিকাকে একপলক দেখায় এই নিস্তরঙ্গ জীবন যেনো অশান্ত হয়ে উঠেছে।বিতান যেনো সব প্রশ্নের উত্তর সোনার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে।প্রতিনিয়ত ঋষিকাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট থেকেও হারিয়ে যাওয়ার কারণটা ভীষণ করে বিতানকে ক্ষতবিক্ষত করছে।এই জীবনে ঋষিকাকে না পেলেও,ঋষিকার থেকে তার এহেন আচরণের উত্তর জেনেই ছাড়বে বিতান।
বিতানের ছেলে আর ঋষিকার মেয়ে একই ক্লাসে পড়ে।ওর নাম সাঝি।বিতান ইচ্ছা করেই আরো দুইদিন স্কুলে গিয়ে দূর থেকে ঋষিকা আর সাঝিকে দেখেছে।খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে।এখনও সাহস করে সামনে যেতে পারেনি।কি জানি হয়তো বিতান কে দেখলেই ঋষিকা আবার চলে যাবে!তারচেয়ে আরো কিছু সময় দুচোখ ভরে বিতান ওদের দুজনকে দেখে নিতে চায়।যত দেখছে ততই যেনো একটু একটু করে রাগ কম হচ্ছে।আবার ভালোবাসার দিনগুলোয় ফিরে যাচ্ছে বিতান।
স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টসের দিনে সুযোগ এলো।ওই তো ঋষিকা বসে আছে ফুটফুটে সাঝিকে নিয়ে।ঋষিকা উঠে মাঠের কোনার দিকে যেতেই বিতান মুখোমুখি হয়ে গেলো। ভূত দেখার মত ভয় পেয়ে কয়েক মুহুর্ত নিস্পলক থেকেই ঋষিকা পালিয়ে গেলো।
অস্ফুটে বিতান যেন বলে উঠলো,”ঋষিকা, ঋষিকা আমার অন্যায়টা কি বলে দাও।” মনের ক্ষোভ দুঃখ, প্রশ্ন,অনেক জমা কথা যেনো হাজারো লোকের ভীড়ে হারিয়ে গেলো।কয়েক ফুটের দূরত্ব আবার হাজার হাজার মাইল বেড়ে গেলো।কোনো কিছুই জানা হলো না।একজন এত কাছের মানুষ বার বার লুকোচুরি খেলেছে।বিতান শুধু নীরব দর্শক।ঋষিকা ভাবছে হয়তো ওর কোনো ক্ষতি করার জন্য বিতান চেষ্টা করছে।এক তরফা ভাবে সব কিছুই ঘটে যাচ্ছে।
বিতান এরপর থেকে কোনোদিন স্কুলে যায়নি।আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেলো।ভুলে যাওয়াই শ্রেয়।জীবনে কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যায়না।
“হ্যালো!
কাজের সময় ফোনের ওপারে মেয়েলি কণ্ঠ পেয়ে বেশ বিরক্ত হলো।একটা ভুল হতে গিয়েও বেঁচে গেলো।নিশ্চয় লোনের অফার।
“কি চাই??আমার লোন, ক্রেডিট কার্ড কিছুই চাই না।” বিতান উত্তর দিয়েই কেটে দিতে যাচ্ছিল।
“আমি বলছি, কেটো না। একটা কথা বলার ছিল।”
বিতানের অপদমস্তক শিহরিত হলো।স্বপ্নের মত লাগছে। অফিসের সবকিছুই ঝাপসা লাগছে।এত কোলাহল যেনো নিমেষে ওই মৃদু আলতো স্বরে চাপা পড়ে যাচ্ছে।কি বলবে এই ভয়ে বিতানের হাথ পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।ঋষিকার এই গলা বিতানের অডিটরি নার্ভ আগেই চিনে ফেলেছে।ওর সেরিব্রামে সযত্নে বহুদিন ধরে সংরক্ষিত আছে।এরপর মৃদু আলতো স্বরে ঋষিকা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো জানালো,
“তোমার মেয়ে প্রথম তোমায় দেখলো ।আমি কখনো তোমার অপমান সইতে পারবোনা বলে তোমার সামনে আসতে চাইনি কোনোদিন।তোমার মেয়ে আমার কাছে গচ্ছিত থাকলো।”
মুহূর্তে বিতানের কয়েক বৎসর আগের সরস্বতী পূজার ঘটনাটা মনে পড়ে গেলো।ওদের সেই দিনের একাত্ম হওয়ার ফসল কি সাঝি?
ইস! এত কাছে পেয়েও কোলে তুলে নিতে পারলনা। ঋষিকা এইসব বিন্দু মাত্রও বুঝতে দেয়নি।সব কুৎসা,অপমান সহ্য করে সমাজের চোখে অসম্মানিত হয়ে বিতানকে সম্মানিত করলো,মুক্তি দিলো।এই আক্ষেপ বিতানের জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তার শরীরের শিরা উপশিরায় হাহাকার করে চলবে।

নিভৃত রক্তক্ষরণ প্রেমের গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!