নিশি পরী ছোটো গল্প – অদিতি ঘটক
ঋতম এক দৃষ্টে পরীটাকে দেখে যাচ্ছে। ভিক্টররিয়ার নরম ঘাসের উপর গা এলিয়ে দিয়ে কত দিন পর একটা বিকেলকে তার পূর্ণ রূপ মেলে চোখের সামনে সন্ধ্যার আবছায়ায় ঢলতে দেখছে। পরীটা আস্তে আস্তে কালো রঙে মিশে যাচ্ছে। যদিও তার আগেই সমস্ত লাইট জ্বলে উঠে চারিদিক অতি আলোকিত করে সেই সান্দ্র আবেশটাকে নষ্ট করে দিল। যেমন এখানে ফিরে আসার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে গেল। ঋতম তো জীবনটাকে এভাবে সাজাতে চায়নি ! কত মেপেজুপে হিসেব করে পা ফেলেছে। ছোটো বেলা থেকে কোনো দিনই আহামরি রেজাল্ট ওর দ্বারা হয়নি। সেই মেধা কোনো দিনই ছিল না। মেজেঘষে নিজেকে টেনে টেনে ওপরে তোলা। এভাবেই বি.কম, এম .কম। আর মাধ্যমিক পাশ করেই বাড়ি, বাড়ি গিয়ে টিউশনি পড়ানো। পাড়ার মুদি দোকানি বাবার পক্ষে অসুস্থ মা, তিন বোনের বিয়ের খরচ জুগিয়ে ঋতম কে উচ্চশিক্ষিত করা যে সম্ভব নয় তা ‘ও’ ওই বয়সেই বুঝে গিয়েছিল। পরীর দাদাকে পড়াতে গিয়ে পরীকে দেখেছিল ঋতম। কোনো কোনো সময় পড়ানোর সময় আসত। কোনো পড়া বুঝে নিয়ে চলে যেত। আসত যেমন নিঃশব্দে চলেও যেত সে ভাবেই। ডাগর চোখ গুলোয় যেন একটা ত্রস্ততা লুকিয়ে থাকত।
উত্তর বঙ্গের অনামি জায়গার আরও অনামি ছেলে ঋতম। বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি কিছু ভাবত না। ও জানত ওর পড়ার খরচ, শখ, আল্লাদ ওকেই মেটাতে হবে। বাবা দু বেলা খেতে দিতে, স্কুলের জামা, প্যান্ট, টিফিন, মাইনে দিতে পারবে কিন্তু এর থেকে বেশি কিছু পারবে না। সেই বাবাই একদিন সুদূর ময়নাগুড়ি থেকে চার ভাইবোনকে কলকাতা ঘোরাতে নিয়ে এল। একটা হোটেল ভাড়া করে বেশ কিছু দিন থাকা হল। মা খুব খুশি হয়েছিল। ওরা সেই সময় রোজ বিকেলে ভিক্টররিয়ায় আসত। বিড়লা প্লানেটোরিয়াম, যাদুঘর, চিড়িয়াখানা। মেট্রো রেল কত উজ্জ্বল স্মৃতি। মায়ের অসুখও যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছিল। এখন সেই সব রাস্তার গায়ে, আশেপাশে কত পরত চেপেছে। কত কি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেই পুরনো সাবেক বড়, বড় বাড়ি গুলো, গলি রাস্তা সব যেন মিলিয়ে গেছে। এই শহরও অন্যদের দেখাদেখি এক ছাঁদের সুন্দরী হতে চাচ্ছে। পরীও কি তাই চেয়েছিল ?
পরীর আসল নামটা যেন কি ? ‘পরী’ তো ঋতমের দেওয়া ভালোবাসার নাম। আসল নামটা কিছুতেই মনে আসছে না। অল্প স্বল্প মুখ চালাতে ইচ্ছে করছে। বাবার সঙ্গে যখন আসত, বা পরীকে নিয়ে একবার যখন এল তখন তো বাদাম, ঝালমুড়ি বিক্রি হত। ফেরিওয়ালারা পসরা নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। ফ্যামিলি বা জুটি দেখলে বেশি করে সেখানেই ঘোরাঘুরি করত। কি বিজনেস স্ট্র্যাটেজি ! জানত এরা কিনতে বাধ্য হবে। এখন কি আর আসে না ! সেই উঠে গিয়ে খেতে হবে ! আর একটু জিরিয়ে নিয়েই বেরিয়ে যেতে হবে। গেট বন্ধ হয়ে যাবে। কত স্মৃতি ভিড় করে আসছে। সমস্ত হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে। কার জন্য কেন এই বৃথা পন্ডশ্রম। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা এক নিমেষেই কেমন তেতো হয়ে গেল।
পরীর আসল নামটা কিছুতেই মনে আসছে না। আচ্ছা আসল নামটা কি জরুরি ? সেই নাম ধরেই কি ঋতম ওকে যা নয় তাই বলবে ? এই ভাবে ঠকানো ? ছি ! ছি ! কতখানি তলিয়ে গেছে। একবারও কি ফোন করতে পারত না ? নিদেন পক্ষে এস.এম.এস. ! জীবনটা তাহলে এই ভাবে শেষ করতে হত না ! একবার পরীর জন্মদিনে একটা ডানাওয়ালা পুতুল গিফ্ট করেছিল ঋতম। বলেছিল, “ভাগ্যিস তোর ডানা নেই নাহলে তুই কবেই আমার কাছ থেকে উড়ে যেতিস।” ডাগর চোখগুলো আরও ডাগর করে শুনেছিল পরী। সেই পরী কবে সস্তার ফেয়ারী কুইনের ডানাটা লাগিয়ে নিল ! ঋতম টেরও পেল না !
ঋতম কি ওর মুখোমুখি হবে ? না, না করে দেবে ? পরী যে মামাবাড়িতে থাকে। মা, মারা যাবার পর বাবা আর একটা বিয়ে করেছে। এক বছর পরীর মামার ছেলেকে পড়িয়েও ঋতম জানতে পারেনি। একদিন পরী’ই ছুটতে ছুটতে ওর সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনো ভনিতা ছাড়াই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমাকে পড়াবেন ? কোনো টাকা পয়সা দিতে পারব না। এই বাড়িতেও পড়ব না।” তারপর থেকে কম আগান, বাগান, নির্জন স্থান, পুকুর ঘাট, নদীর পাড় ঘোরা হয়নি। পড়াও হয়েছে। প্রেমও হয়েছে। সবাই অবাক হয়ে যেত মেয়েটা এত ভালো রেজাল্ট করে কি করে ! বাড়ির লোকেরা পড়াতে না চাইলেও একপ্রকার স্কুলের চাপে আর ওর স্কলারশিপের কারনে পড়াতে বাধ্য হত। কবে কোথায় ওদের চোখে প্রথম প্রেম ভেসে উঠেছে, কবে প্রথম হাত ধরেছে, কোন দিন প্রথম দুজনের ঠোঁট এক হয়েছে, কোন দিন প্রথম একে অন্যের বাহুপাশে আবদ্ধ হয়ে উষ্ণ সময় কাটিয়ে দিয়েছে, এত কিছু মনে পড়ছে। নাহ, পরীর আসল নাম মনে পড়ছে না।
ঋতম তখন একটা কম্পিউটার সেন্টারে চাকরি করে। আর কোচিং স্কুলের আয়। বাবার টিমটিমে মুদির দোকান। এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে পরীর মামারা সুন্দরী ভাগ্নির বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। অথচ চাকরির পরীক্ষা দেওয়ানোর জন্য ঋতমের সাথে কলকাতায় দু দিনের জন্য ছাড়তে একপায়ে রাজি হয়ে গিয়েছিল। ওরা কি ভেবেছিল এই ভাবে কুৎসা রটিয়ে নিখরচায় ভাগ্নিকে পার করবে ? কই ঋতমের মনে ছিনতাইবাজ হওয়ার বাসনা তো জন্মায়নি। পরীকে পূর্ন মর্যাদায় ঘরে নিয়ে আসার স্বপ্নই তো লালন করে গেছে। এর পর ধীরে, ধীরে তিস্তার জলের স্রোত কমে এল আর ঋতম চড়চড় করে উন্নতি করল। এখন সে একটা বহু জাতিক কোম্পানির ইস্টার্ন রিজিয়নের হেড। পরীর স্বপ্ন সেই রাতের স্বপ্নের মতোই রয়ে গেল। সে আর পূর্ণ হয়নি। তার বদলে ঋতম কলকাতায় এলেই হোটেলে উঠলে তার ‘নিশি পরী’র প্রয়োজন হয়। পরীকে মনে মনে বিস্তর খুঁজেছিল ঋতম। বন্ধু, বান্ধব চেনা পরিচিত মারফত খোঁজও নিয়ে ছিল বিস্তর কিন্তু পায়নি। কর্পূরের মত উবে গিয়েছিল। মামাবাড়ির লোকেরা বাড়ি বয়ে পরীর বাবার ঠিক করা ভালো বিয়ে, ধনী বরের খবর ঘটা করে দিয়ে গিয়েছিল। বাবা, দিদিরা বাড়িতে সবাই পরীর কথা জানত। পরীকে খুঁজে না পাওয়ার পর প্রথম প্রথম বাবা, পরের দিকে দিদিরা অনেক জোর করেছিল। মেজদি তো ওর ননদের, জায়ের, বোনের মেয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ করে ফেলে একেবারে। কিন্তু ‘পরী’ কে যে ভালোবেসেছে সে কি আর কাউকে মনে জায়গা দিতে পারবে ! ঋতম হাত তুলে দিয়েছিল।।প্রথম প্রথম দিদিরা অনেক ওজর আপত্তি করত। কালের নিয়মে সবই আস্তে আস্তে থিতিয়ে গেল।
কাল রাতে হোটেলে চেক ইন করার সময় মনে হল পাশ দিয়ে কে যেন গেল। গড়ন, গঠন খুব জানা। মনে হল বহু দিনের চেনা। মুখটা ঋতম খেয়াল করেনি। আসলে দেখবার জন্য তো দেখেনি। হঠাৎই পাশ দিয়ে চলে যাওয়া। পোড় খাওয়া ঋতমের শরীরী ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কোম্পানি এই জন্য তাকে মোটা মাইনে দিয়ে রেখেছে। কার নার্ভ কি বলছে, কে, কি ভাবছে এক লহমায় ধরে ফেলে সেই অনুযায়ী চাল চালাই ঋতমের বিশেষত্ব। এই মেয়ে কি জন্য এখানে এসছে তা ধরা ওর বাঁ হাতে খেলা দেখানোর মতই সোজা। কিন্তু ধাক্কাটা লাগছে অন্যখানে। এও কি সম্ভব ? পৃথিবীতে একই রকম দেখতে সাতটা মানুষ থাকে। এটা কি সেই রকম কোনো কাকতলীয় ঘটনা ! তাহলে মহিলা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যে টান অনুভব করল তা কি ? সে কি একই মুখের অধিকারীর জন্য হবে ? ঋতম জানে তা হওয়ার চান্স একশ ভাগের পয়েন্ট একভাগ। আর এই খানেই দ্বন্দ—
আজ মিটিংটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। পার্টি যে এত সহজে শর্ত গুলো মেনে নেবে ঋতম আশা করেনি। যে ডিসকাউন্টে ওরা রাজি হল তাতে ওদের প্রফিট প্রায় থাকবে না। তবে এরিয়া বিরাট। লার্জ স্কেলে সেল করতে পারবে। কোম্পানি সেলস প্রমোশনে সাহায্য করবে। গ্রোথ ভালো হলে লুক্রেটিভ ইনসেনটিভ দেবে। এখন হোটেলে ফিরে কি হবে। ‘হোটেল হিন্দুস্তান’ থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে সোজা ‘ভিক্টরিয়া’।
ঋতম যখন কলকাতায় আসে এই হোটেলেই ওঠে। এখানে একটা পরিচিতি হয়ে গেছে। ঋতম কে ওরা ভালো বোঝে। হোটেলের ছেলেটা আজ ব্রেকফাস্ট এর সময় বলেছিল “দাদা মনের মত জিনিস পাবেন। আসেন যখন ঠিক আপনার মনের মত দিতে পারি না। বুঝতে পারি দাদা। এইবার দেখবেন ! আপনাকে মোবাইলে ছবি পাঠিয়ে দেব।”
হ্যাঁ ছেলেটা ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে। ঋতম যেটা মাঝে মাঝে দেখছে আর ভাবছে মুখোমুখি হব না বারণ করে দেব……..
নিশি পরী ছোটো গল্প – সমাপ্তি
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন| এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভালোবাসার দেবালোকে
বিজয়া দশমী
এক চিলতে রোদ্দুর