রহস্যময়ী ভৌতিক গল্প – নীলেশ নন্দী
সন্ধের পর বাবা অফিস থেকে ফেরার পর অন্যদিনের মতই আমি আর ভুলো ছুটে গিয়েছিলাম। বাবা রোজ আমাদের জন্য কিছু না কিছু খাবার এনে দেয়। ভুলো খুবই শান্ত স্বভাবের। সারাক্ষণ আমার পেছন পেছন চলে। অপরিচিত কাউকে দেখলে লেজ গুটিয়ে আমার পায়ের পেছনে ঘেঁষে পড়ে থাকে। ও আসলে খুবই ছোট। আর একটু বড় হোক, তবেই সাহস বাড়বে। আজ বাবার কাছে গিয়ে দেখি বাবার পাশে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা খুব মায়াময় আর দারুণ সুন্দরী। আমি পায়ের পেছন দিকটায় অনুভব করলাম ভুলোর লোমশ দেহ অবিরত কেঁপে চলেছে এবং মুখ দিয়ে কুঁই কুঁই আওয়াজ করে চলেছে। বাবা বলল, “ইনি আজ থেকে এবাড়িতে থাকবেন। এঁর নাম সুকন্যা। এঁর সঙ্গে সবসময় মাতৃসুলভ আচরণ করবে।”
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। তারপর মহিলাটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে। আমি মনে মনে বেশ বুঝলাম মহিলাটির কোন গড়বড় আছে। ইনি কোন সাধারণ মহিলা নন। নাহলে অপরিচিত লোকের সঙ্গে কখনই তার বাড়ি এসে উঠত না। ভুলোও তার হাবভাবে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। যদিও বাবা আমাদের জন্য খাবার আনতে ভোলেনি। আমি খুশিমনে খাবার নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলাম। তারপর ভাবতে লাগলাম কে ওই মহিলা? কি তার উদ্দেশ্য? চারপাশে এত মানুষ থাকতে শেষে আমার বাবার সঙ্গেই এই বাড়িতে উঠল। ভুলো এখনও দরজার দিকে চেয়ে নেতিয়ে পড়ে আছে। ওর যেন কি একটা হয়েছে? আচ্ছা আমি শুনেছি যে আত্মারা কুকুরের দেহ থেকে শক্তি অর্জন করে। তাহলে কি ওই মহিলা…
না, ব্যাপারটা জেঠুকে জানাতেই হবে। তবে তার কাছে যেতে হলে আমাকে ওই বাড়ি যেতে হবে। কাল সকাল ছাড়া যেতে পারব না। এসব কথা ভাবতে ভাবতে দরজা সামান্য ফাঁক করে ওই মহিলা বলে উঠল, “ভেতরে আসতে পারি রাজা?”
আমার নাম রাজা। বললাম, “হ্যাঁ, আসুন। এতে আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে?”
সে ভেতরে এসে আমার পাশে আস্তে করে বসে বলল, “আমায় আপনি সম্বোধন করে নয়, তুমি করে বলবে। আমি তোমার মায়ের মত।”
মা! আমার হাসি পেল। চাইলেই কি যে কেউ মায়ের জায়গা দখল করতে পারে। আমার মা অনেক বছর হল আমাদের ছেড়ে চিরদিনের মত আকাশের তারা হয়ে গেছে। মায়ের কথা মনে পড়লেই চোখে জল চলে আসে।
“কি হল, কি ভাবছ? মায়ের কথা মনে পড়ছে?”
আমার যে মায়ের কথা মনে পড়ছে, মহিলাটি জানতে পারল কি করে। আমার পরবর্তী সন্দেহ। সে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অন্য হাতে আমার গালে আদর করে বলল, “আমি এসে গেছি। আর তোমার কোন চিন্তা নেই।”
আমি ক্রমশই যেন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লাম। মহিলাটি জাদু জানে? মানুষকে বশে করার জাদু? এভাবেই কি সে বাবাকে বশ করেছে। আমি দুহাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কোলের উপর ঢলে পড়লাম। এভাবে কতক্ষন কেটে গিয়েছে জানি না, বাইরে থেকে বাবার ডাক শুনতে পেলাম, “তোমরা খেয়ে যাও।”
মহিলাটি আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে দুজনে ঘর থেকে বের হলাম। বাবা ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করছিল। আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে বলল, “বাঃ, এরইমধ্যে তোমাদের দুজনের বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দেখে খুব ভালো লাগল। তোমরা দুজন এভাবেই মিলেমিশে থেকো।”
আমি কিছু না বললেও বুঝতে পারলাম মহিলাটির জালে আমি জড়িয়ে পড়ছি। কাল সকালে যেভাবেই হোক জেঠুকে ব্যাপারটা জানাতেই হবে।
রাতে ঘুমের মধ্যে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। আমি আর বাবা পাশাপাশি চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছি। আমাদের দুজনের হাত, পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। দূরে মেঝেতে ভুলো মুখ হা করে পড়ে রয়েছে। ওর চারপাশে কিসব পোকা ভনভন করে উড়ে বেড়াচ্ছে। মাছি! ঠিক তখনই আমাদের সামনে কালো শাড়ি পরা মহিলাটিকে দেখতে পেলাম। খোলা পিঠে তার খোঁপাবিহীন চুলগুলো হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। আর ঠিক তখনই নিদ্রা ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখলাম ভোর হয়েছে। সূর্য তার প্রথম কিরণটুকু চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ভুলো আমার কাছে এসে পায়ে মুখ ঘষতে লাগল এবং মাঝে মাঝে চেটে দিল। আমি দাঁত মাজার জন্য বাথরুমে গেলাম। ঠিক তখন বাইরের ঘরে জেঠুর গলা শুনতে পেলাম, “রাজা বেটা, উঠে পড়েছিস?”
আমি উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ জেঠু।”
যাক বাবা, আমাকে আর কষ্ট করে জেঠুর বাড়ি যেতে হল না। সে নিজেই চলে এসেছে। এখন আমার একমাত্র কাজ হল জেঠুকে নিজের ঘরে ডেকে সবটা খুলে বলা। দাঁত মাজতে মাজতেই শুনতে পেলাম জেঠু বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, “ইনি কে?”
বাবা বলছেন, “ও সুকন্যা। গতকাল ওকে বাড়িতে নিয়ে আসি।”
“তা ও থাকে কোথায়?”
“আমি জানি না। গতকাল ওকে ভয়ানক অ্যাকসিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসি। এখন ওকে একা ছাড়তে মন চাইছে না।”
আমি ততক্ষণে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসি। দেখি জেঠু সন্দেহভাজনের দৃষ্টিতে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তবে আমাকে দেখেই জেঠুর মুখে হাসি ফুটল। আমি তাকে ইশারা করে আমার ঘরে আসতে বললাম। জেঠু আমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাছে এসে বলল, “বল, ব্যাপার কি?”
আমি বললাম, “জেঠু, আমার মনে হচ্ছে ওই মহিলা কোন সাধারণ মহিলা নয়। শুধু বাবাই নয়, সে আমার কাছে আসলেও কোন এক জাদুবলে আমি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ি।”
“ঠিক বলেছিস। আমারও তাই মনে হয়েছে। মহিলাটি ডাইনি। এরা ছলে-বলে-কৌশলে মানুষকে নিজের বশে করে নেয়। তারপর কোন একটা অমাবস্যা তিথিতে তাদের হত্যা করে সর্বশক্তিমান এবং চিরযৌবনা হয়ে যায়। আমি ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলাম।
“তাহলে কি আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত?”
“আমি থাকতে তা কখনই হবে না। তুই স্কুলে যা। আমি ব্যাপারটা দেখছি।”
জেঠু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমি স্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। ঠিক তখনই মহিলাটি আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তার গায়ের থেকে একটা নেশামাখানো সুগন্ধ পেলাম। সে আমায় বুকে টেনে নিল। তারপর পরম স্নেবর্ষণ করতে লাগল।
আজ স্কুল ছুটির পর দেখলাম জেঠু স্কুটার নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপার কি? এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোন সমস্যা হয়েছে জেঠু?”
“আমার বাড়ি চল। ওই মহিলাটির ব্যাপারে জানতে পেরেছি। তোকে সব বলব। কিন্তু এখন তুই বাড়ি গেলে খুব বিপদ।”
আমার তখনই মনে পড়ল আজ তো শনিবার। বাবার অফিস হাফ ছুটি। হিসেব মত বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ফিরবে। জেঠুকে সেকথা বলতেই সে বলল, “আগে তুই আমার বাড়ি চল। তোর ওপর বিপদ বেশি। তোর বাবাকে তারপর নিয়ে যাব।”
আমি জেঠুর স্কুটার চেপে মিনিট পনেরোর মধ্যে তার বাড়ি পৌঁছলাম। জেঠু আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এবার কি হয়েছে বলো। মহিলাটি কে?”
জেঠু ফ্রিজ থেকে আমার জন্য আইস্ক্রিম বের করে অনল। জেঠুর বাড়ি যখনই আসি, তখনই খাই। জেঠু বলল, “মহিলাটির অনেক নাম জানিস। এক একজন ওকে এক এক নামে চেনে। ওর আসল কাজ হল নির্জন পথে কোন একা ব্যাক্তিকে পেলে তাকে বশে করে তার বাড়ি যায় এবং তার কিছুদিনের মধ্যে তার পুরো পরিবারকেই সে ধ্বংস করে। ও তোদেরকেও ছাড়বে না।”
জেঠুর শেষ কথাগুলো যেন মনে হল অনেক দুর থেকে ভেসে আসছে। আমার চোখ, কান বন্ধ হয়ে আসছে। একসময় সোফার ওপর ঢলে পড়লাম।
জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম আমার হাত, পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। মাথা সামান্য পাশে ঘোরাতেই বাবাকে দেখতে পেলাম। তার হাত, পাও দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমাদের দুজনের মুখই পেপার টেপ দিয়ে আটকানো রয়েছে। এ যে ঠিক গতকাল রাতে দেখা স্বপ্নের মত। গতকাল রাতে কি? নাকি ভোরের স্বপ্ন? কারণ ভোরের স্বপ্ন একমাত্র সত্যি হয়। তাহলে হিসেবমত দূরে ভুলোর প্রাণহীন দেহটা পড়ে থাকবে। মেঝেতে তাকিয়েই দেখলাম সব সত্যি। বুকের ভেতর থেকে একরাশ চাপা কষ্ট বেরিয়ে আসতে চাইছে। এমন সর্বনাশ কে করল? দেখলাম তখনই আমাদের সামনে জেঠু এসে হাজির। সে বলল, “আই অ্যাম ভেরি সরি রাজা। কি করব বল? সবটাই তো সম্পত্তির জন্য করা। তাদেরকে মেরে ফেলে সমস্ত জমি, জায়গাটুকু নিজের নামে করে নেওয়া। তবে গতকাল একজন এসে আমার মাস্টারপ্ল্যানে জল ঢেলে দিল। তবে একটা কথা জানিস তো, মহিলাটি ডাইনি নয়। সাধারণ মানুষ। আজ তোর বাবা অফিস যাওয়ার পর তাকে খাবারে বিষ দিয়ে তা খাইয়ে মেরে ফেলি। তোর কুকুরটার সঙ্গেও তাই করি। আর এখন তোদের দুজনের শরীরে বিষ ইনজেক্ট করে মারব।”
আমার চোখ, কান ধরে এসেছিল। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না যে, যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি, সেই কিনা বিশ্বাসঘাতক! বাবার মুখ থেকে চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। আমিও প্রাণপণ চেষ্টা করছি দড়ির বাঁধন খোলার। কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলাম। হাতে, পায়ে প্রচন্ড যন্ত্রণা হতে শুরু করেছে। জেঠু এক পা এক পা করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ঠিক সেই মুহুর্তে আমি লক্ষ্য করলাম আমাদের ঠিক সামনে সুকন্যা এসে উপস্থিত হয়েছে। কালো শাড়ি পরিহিতা খোলা পিঠে তার খোঁপাবিহীন চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। ঠিক স্বপ্নে যেমনটা দেখেছি। তার একহাত শূন্যে ওঠা এবং সেই হাতের আঙুলগুলো থেকে তীক্ষ্ণ বড় নখ বের হয়ে এসেছে। জেঠু ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, “না, এ হতে পারে না। আমি নিজের হাতে তোমায় বিষ খাইয়ে মেরেছি।”
মহিলাটি প্রকাণ্ড অট্টহাস্যে বলে উঠল, “যে একবার মরে গিয়েছে, তাকে কি বারবার মারা যায়? আমি এসেছি ওদেরকে তোর মত শয়তানের হাত থেকে বাঁচাতে। এখন দেখ তোর কি হাল হয়?”
আমি দেখলাম মহিলাটি তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত আঙুলগুলো জেঠুর পেট চিরে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সে প্রচন্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করতে শুরু করেছে। খানিকক্ষণ পর তার মুখ দিয়ে গ্যাজলা বেরিয়ে এল। তার পরমুহুর্তেই তার প্রাণহীন দেহ মেঝেতে থুবড়ে পড়ল। ততক্ষণে আমাদের হাত, পায়ের বাঁধনও কোন এক জাদুবলে খুলে গিয়েছে। আমি মুখ থেকে পেপার টেপ খুলে ফেলে ছুটে গিয়ে সুকন্যাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার তাকে এর আগেও ভয় লাগেনি। এখনও ভয় লাগছে না। মানুষ যার বুকে নিরাপদ, তাকে সে কখনও ভয় করে না। সে যেই হোক। আমি মাথায় তার স্নেহস্পর্ষ পেতে শুরু করলাম। সেইসঙ্গে মনমাতাল করা সুরভী আমার নাকে আসতে লাগল।
রহস্যময়ী ভৌতিক গল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন