মটন বিরিয়ানি ছোটগল্প – দেবস্মিতা সাহা
আজ সকাল থেকে সুদীপবাবু খুব উত্তেজিত। তাঁর একমাত্র মেয়ে তিয়াশা আজ প্রায় এক বছর পরে বাড়ি ফিরছে। মেয়ে,জামাই,নাতি……উফ্ কি আনন্দ। কতদিন পরে আবার বাড়িটা গমগম করে উঠবে। আবার শ্বশুর আর জামাইয়ের রাজনীতি, খেলা নিয়ে বিতর্ক,বুমবুমের দুষ্টুমি, মেয়ের শাসন,খুনসুঁটি,আদর,আহ্লাদ, এসবের মাঝখানে অনুপমার সবকিছু আবার সময়মত করা নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানি…….এসব নিয়েই কেটে যাবে বেশ কয়েকটা দিন। আজ সুদীপবাবু ব্যস্তও বটে। তিয়াশার জন্য তিনি নিজে হাতে মটন বিরিয়ানি বানাচ্ছেন। আসলে ছোটো বেলা থেকে তিয়াশা খাওয়া নিয়ে খুব বিরক্ত, বায়না করলেও এই একটা খাবার সে খুব মন এবং পেট ভরে খায়। এবং সেটা সুদীপবাবুর হাতেরই বানানো হতে হবে। সুদীপবাবুও নিজ চাকরিসূত্রে অনেক বছর বাইরে থাকায় রন্ধনশৈলীতে যথেষ্ট দক্ষ। একা হাতেই কুটনো কুটে, বাটনা বেটে ,রান্না করে জনা ত্রিশেক লোককে তিনি খাওয়াতে পারেন। সে যাক্ গে , গতকাল থেকেই তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ত। গতকাল বিকেলে গিয়ে তিনি বাজার করে নিয়ে এসেছেন। কতবার যে মেয়েকে ফোন করা হয়ে গিয়েছে তারা কখন ফ্লাইটে উঠবে। গতকাল থেকেই তিনি সমস্ত কিছু গিন্নির সাহায্য ছাড়াই গুছিয়ে রেখেছেন। কোন মশলা কতটুকু লাগবে, কোন চাল সবথেকে ভালো , সব সব অতি উৎসাহ তিনি গুছিয়ে রেখেছেন। শুধু গতকাল বিকেল থেকে তাঁর শরীরে মাঝেমাঝে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। সে হোক গিয়ে, এখন শরীরের কথা ভাবলে চলবে না। আজ তো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তিনি লেগে পড়লেন। ‘মেয়েটা ওখানে একা সংসার ,ছেলে, নিজের চাকরি সামলে কতটুকুই বা নিজের পছন্দের খেয়াল রাখতে পারে? এখন কদিন আমাদের কাছে থাকবে , আমরা ওর একটু যত্ন আত্তি করব’। বিরিয়ানির চাল ভালো করে ধুইয়ে আধঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর হাঁড়িতে পরিমাণ মত জল দিয়ে তার মধ্যে তেজপাতা, সাদা তেল সামান্য, এলাচ,লবঙ্গ ইত্যাদি দিয়ে তারপর চাল দিলেন সুদীপবাবু । ‘কি গো, ভাতটা কতটা হল দেখ। ‘ গিন্নির কথায় সম্বিত ফিরল সুদীপবাবুর। ‘দাঁড়াও আর কিছুটা হবে।’ মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন আজ সুদীপবাবু। সুদীপ আর অনুপমার বিয়ের বছর ছয়েক পর তিয়াশা তাঁদের জীবনে আসে। অনুপমার জীবন মরণ সমস্যা দেখা দিয়েছিল বলা যায়। এর আগে দু দুটো বাচ্চা গর্ভাবস্হায় নষ্ট হয়ে যায়। আত্মীয়, পাড়ার লোকজনদের সমালোচনা, অনুপমাকে কারণে অকারণে অপমান দিন দিন বেড়েই চলছিল। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে, চেষ্টা চরিত্র করে অনুপমা আর সুদীপের কোল আলো করে তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান জন্মায়। তাদের বংশে এই প্রথম এবং একমাত্র মেয়ে তিয়াশা। খুব আদরের। তাই সুদীপবাবু সবসময় চেষ্টা করে এসেছেন মেয়ের যাতে কোনোভাবে কোনোদিন কষ্ট না হয়। মেয়ের সমস্ত ইচ্ছে, আব্দার,বায়না মুখনিঃসৃত হতে যেটুকু দেরী,বাবার বায়না মেটাতে দেরী নেই। এইসব নিয়ে অনুপমার সাথে তাঁর মতপার্থক্য ছিল বিস্তর। অনুপমা ভাবতেন মেয়ে বুঝি বিগড়ে যাবে। কিন্তু সুদীপবাবুর নিজের শিক্ষা ও মেয়ের প্রতি বরাবরই আস্হা ছিল। তিয়াশাও কোনোদিন বাবার দেওয়া স্বাধীনতার অমর্যাদা করেনি। তাছাড়া তার মনের দোসর বলো,বন্ধু বলো সবটাই তার বাবা। মন খুলে সমস্ত আলোচনা মায়ের সাথে নয়,বাবার সাথেই চলত ।তাই তো, আকাশকে যখন নিজে পছন্দ করেছিল তিয়াশা,এই সম্পর্কে নিমরাজী অনুপমাকে সুদীপবাবুই রাজি করিয়েছিলেন। আর সত্যিই,অনুপমা পরবর্তী কালে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি নিজে পছন্দ করলে আকাশের মত এত সৎ,নির্লোভ, বংশমর্যাদা সম্পন্ন এবং সর্বোপরি ভালো রোজগেরে ছেলে তিনি তিয়াশার জন্য খুঁজে পেতেন না। এইসব ভাবছেন একদিকে আর অন্যদিকে বিরিয়ানি প্রস্তুতি চলছে। কম খাটুনির রান্না এসব! ভাত রেডি। এবার কড়াইয়ে সামান্য ঘি দিয়ে জায়ফল,জয়িত্রী একটু নেড়ে তুলে নিলেন। এবার কড়াইয়ে পরিমাণ মত তেল দিয়ে পেঁয়াজ ভেজে বারিস্তা রেডি করে রাখলেন,আলু ভেজে তুলে রাখলেন। এরপর আগে থেকে ম্যারিনেট করে রাখা মাংস কড়াইয়ে তেলে দিয়ে ভালো করে কষাতে লাগলেন পরিমাণ মত প্রয়োজনীয় মশলা দিয়ে । এবার মাংস হয়ে গেলে হাঁড়িতে ঘি মাখিয়ে ভাত, মাংস,আলু,ডিম,বারিস্তা সব পরপর স্তরে স্তরে সাজিয়ে হাঁড়ির মুখ মাখানো আটা দিয়ে আটকে তার ওপর ভারী কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে গ্যাসের ওপর কম আঁচে বেশ কিছুক্ষণের জন্য বসিয়ে দিলেই রেডি বিরিয়ানি। টিং টং! ঐ বুঝি এসে গেল। দরজা খুলতেই তিয়াশা ছুটে এসে বাপিকে জড়িয়ে ধরল। সুদীপ আর অনুপমার প্রাণ যেন জুড়োলো মেয়েকে কাছে পেয়ে। সারাদিন হৈ হুল্লোড়, গল্প, হাসি ঠাট্টা চলল। যেন চাঁদের হাট। সুদীপবাবু তো বারবার ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন মেয়েকে কখন তাঁর হাতের রান্না করা বিরিয়ানি খাওয়াবেন। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসে তিয়াশাও অস্থির বিরিয়ানি খাবে বলে । সুদীপবাবু তো বলেই দিয়েছেন রান্না তিনি করেছেন ,পরিবেশনও তাঁরই দায়িত্ব। নাতি,জামাই এমনকি অনুপমাও সবাই টেবিলে বসে রেডি। ‘আরে বাবা খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি দাও। কত সময় লাগছে! ‘ ‘আরে এত অধৈর্য্য হচ্ছিস কেন? গার্নিশিংটাও তো ঠিকঠাক করতে হবে । ‘ রান্নাঘর থেকে বলে উঠলেন সুদীপবাবু। খুব সুন্দর করে প্রত্যেক প্লেটে সাজিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে আনতে ‘এই দ্যাখ মামনি এরপর আমি একটা বিরিয়ানির হোটেল দেব’ বলতে বলতে ভীষণ খুশিতে ডাইনিং রুমের দিকেই আসছিলেন সুদীপবাবু। হঠাৎ তার মাথা ঘুরতে লাগল, প্রচণ্ড বুকে ব্যথা হতে লাগল, চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে এল তাঁর। সমস্ত কিছু সমেতই তিনি মেঝের ওপর উল্টে পড়লেন। তিয়াশা,অনুপমা, আকাশ সবাই তড়িঘড়ি এসে বারবার ডাকাডাকি করেও সাড়া পেল না। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে সব শেষ। পড়ে রইল যত্নে আদরে বানানো বিরিয়ানি , পড়ে রইল একমাত্র মেয়ের জন্য একজন বাবার এত দিনের অপেক্ষা, পরিশ্রম, আনন্দ, চাঁদের হাট।
শ্মশানে পৌঁছে বাবার দেহ ইলেকট্রিক চুল্লিতে দেওয়ার পর তিয়াশা একটা গাছের গোড়ায় একটু হেলান দিয়ে বসে। নিজের সঙ্গে যেন একটু একা থাকতে চায়। এখন ৪৫ মিনিটের অপেক্ষা নশ্বর দেহ শেষ হওয়ার। আত্মীয় স্বজন সবাই এক এক করে চলে যেতে চাইছে। যেন এরপর আর তো বিশেষ কোনো কাজ নেই। শুধু অস্থিটুকু ভাসানোই যা বাকি। তিয়াশার যেন কাঁদতেও আর ইচ্ছা করছে না। এখন মায়ের সমস্ত দায়দায়িত্ব তার। কি করে সবটা সামলাবে সে! মায়ের করুণ মুখটা বারবার মনে পড়ছিল তার। মা হঠাৎ করে কেমন যেন চুপ হয়ে গিয়েছিল খবরটা শুনে। বাবার দেহটা দেখে তাঁর বুঝি সম্বিত ফিরল। এত কিছু এত তাড়াতাড়ি সব শেষ,সব শেষ…..সে যেন মানতে পারছে না। তিয়াশার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আকাশ ওকে বিরক্ত না করে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। এত তাড়াতাড়ি একটা জ্বলজ্যান্ত লোক এইভাবে কথা বলতে বলতে কি করে চলে গেল এইসব কথা ভেবে ভেবে তিয়াশার নিজের অজান্তে কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝতে পারেনি। হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শে তিয়াশা ফিরে তাকাল। এই অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা স্পর্শ তার খুব চেনা। কোথায় পেয়েছে এই স্পর্শ! হঠাৎ তার মনে পড়ল একটু আগেই যখন বাবাকে সে ছুঁয়েছিল তখন এরকম একটা স্পর্শ অনুভব করেছিল। অস্বাভাবিক শীতলতা। কিন্তু তিয়াশা ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দিলনা । একটা লোক গায়ে চাদর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে চাদর দিয়ে মুখটা চাপা দিয়ে আছে তিয়াশা অনেক চেষ্টা করেও মুখটা দেখতে পেল না। মনে মনে সে একটু বিরক্ত হল। একেই কথা বলার মত অবস্থায় সে নেই তার মধ্যে উটকো একটা লোক। ‘এখানে একা একা কি এইভাবে বসে থাকতে আছে! শ্মশানে এরকম একা বসে থাকা উচিত নয়।’ প্রচণ্ড বিরক্ত হল তিয়াশা। একেই লোকটার মুখটা একটুও দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর তার গা থেকে কেমন যেন পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে। তিয়াশা মুখ ঘুরিয়ে কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিল……
যাঃ বাবা। কোথায় গেল লোকটা এর মধ্যে। কর্পুরের মত উবে গেল নাকি। এত কম সময়ে কতদূরই বা যেতে পারেন উনি! কোথাও তো তিয়াশা দেখতে পাচ্ছে না মানুষটাকে। হঠাৎ তিয়াশা তার পাশে রাখা একটা কাগজ দেখতে পেল,ভাঁজ করা। কাগজটা খুলে দেখতে পেল অবিকল তার বাবার হাতের লেখায় একটা চিঠি লেখা। চিঠিতে লেখা’সোনা মা বাড়িতে ফিরে বিরিয়ানিটা খেয়ে নিস। রাত্তিরে তোর জন্য আলাদা একটা বাটিতে করে ফ্রিজে তুলে রেখেছিলাম। আর একটা কথা এই কদিন নিরামিষ খেয়ে শরীরকে কষ্ট দিতে হবে না। জানি তো তোর মাছ ছাড়া খেতে অসুবিধা হয়। ‘ তিয়াশা বাড়ি ফিরে দেখল সত্যিই তার বাবা তার জন্য এক বাটি বিরিয়ানি আলাদা করে ফ্রিজে তুলে রেখেছে।
মটন বিরিয়ানি ছোটগল্প – সমাপ্তি
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
বাংলার রূপের সাত সতেরো
সাগর দেখার স্বপ্ন
বেড়ানোর টুকিটাকি – টিউসানের সাইকেল টুর থেকে স্কুটিতে দার্জিলিং