সামাজিক ঐক্য স্থাপনে মাতৃ পূজা প্রবন্ধ -রূপম চক্রবর্ত্তী
দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আগমনে প্রতিটি প্রাণকেন্দ্রে বিপ্লবের সঞ্চার হয়। রাশি রাশি ঝরা শিউলির কোমল বুকে মায়ের অরুণ রাঙ্গা চরণ চিহ্ন এই পৃথিবীকে আরও সুন্দর আরও সজীব করে তুলে। মায়ের আগমনী গানে সবাই সামিল হয়। কবিগুরুর ভাষায়,
” তোমার আনন্দগানে আমি দিব সুর
যাহা জানি দু-একটি প্রীতি-সুমধুর
অন্তরের ছন্দোগাথা; দুঃখের ক্রন্দনে
বাজিবে আমার কণ্ঠ বিষাদবিধুর
তোমার কণ্ঠের সনে; কুসুমে চন্দনে
তোমারে পূজিব আমি; পরাব সিন্দূর
তোমার সীমন্তে ভালে; বিচিত্র বন্ধনে
তোমারে বাঁধিব আমি, প্রমোদসিন্ধুর
তরঙ্গেতে দিব দোলা নব ছন্দে তানে।
মানব-আত্মার গর্ব আর নাহি মোর,
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর।”
চারদিক যখন ঘনঘোর অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন থাকে, মহাপ্রলয়ের নগ্ননৃত্য শুরু হয়, তুর্য নিনাদের মতো বজ্রের কর্ণবিদারী আওয়াজে পৃথিবী প্রকম্পিত হয়, সৃষ্টি জগতের সবকিছুই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনে ঠিক তেমন সময়ে শরতের পুষ্পসুবাসের দিব্যানন্দের সিন্ধু নীরে সন্তানদের অবগাহন করানোর মানসে জগৎজননী মা আসেন আমাদের আঙ্গিনায়। মায়ের অমৃত সন্তান সন্ততি মধু মংগলময় ধূপ দীপ শংখরবে ও উলুধ্বনিতে বিশ্বমাতাকে স্বাগত জানায়।
যেখানে প্রেমহীন নির্দয় শূণ্যমরুভূমিতে অশুভ অহংকারী শক্তির প্রেত নৃত্য চলছে, সম্পদ মারণাস্ত্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। যেখানে মানুষের প্রচেষ্টা প্রেমার্দ্র দুঃখ মোচনী প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়ায় বিনিযুক্ত হচ্ছেনা সেখানে ছড়িয়ে দিতে হবে মায়ের গুণকীর্তন। মায়ের আগমনী বার্তা আমাদের শুভ শক্তি জাগ্রত করার প্রেরণা যোগায়। সুর অসুরের দ্বন্ধ চিরকাল দেখা যায়। দেবতাগণ অসুরের নিকট পরাজিত হয়ে রাজ্যহারা হন। স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে দেবতারা যখন এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা সুর শক্তির আগমনের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। দেবতাদের থেকে আমরা মহামিলনের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। সামাজিক ঐক্য স্থাপনের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। সামাজিক ঐক্য স্থাপনের জন্য প্রয়োজন সকল সুর শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নতুবা অশুভ শক্তির পাদুর্ভাব ঘটবে।
এই অশুভ শক্তির প্রতীক মহিষাসুর নারীরূপী মহাশক্তি দুর্গার মোহে মোহিত হয়ে মা দুর্গাকে উগ্রভাবে কামনা করেছিল। এই পাশবিক ভোগেচ্ছা মহিষাসুরকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে নিধন করে। দুর্গা” শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে:-
“দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।”
অর্থাৎ, দ:- দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার:- বিঘ্ন নাশ করে,
রেফ:- রোগ নাশ করে, গ:- পাপ নাশ করে এবং অ-কার:- শত্রু নাশ করে। এর পরিপূর্ণ অর্থ হলো যে= দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দূর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে,
“দূর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দূর্গা বা প্রকীর্তিতা”।
অনুবাদ:- যিনি দূর্গ নামক অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দূর্গা নামে পরিচিত। শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যেম্ অনুসারে যে দেবী:- “নিঃশেষ দেবগণ শক্তি সমূহ মূর্ত্যাঃ”
সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি, তিনিই দূর্গা।
রামচন্দ্র ১০৮ পদ্ম দ্বারা দেবীপূজার সংকল্প করেন। প্রয়োজনীয় ফুল সংগ্রহ হলো। দেবী ভক্তের ভক্তি পরীক্ষা করার জন্য ছলনা করলেন। তিনি একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। পূজার সময় একটি পদ্ম ফুলের অভাব হওয়ায়
রামচন্দ্র বিপদে পড়লেন। পূজা পূর্ণাঙ্গ না হলে দেবী সন্তুষ্ট হবেননা। সংকল্পও সিদ্ধ হবেনা। সেই জন্য তিনি নিজের একটি চোখ উৎপাটিত করে উহাকে পদ্মরূপে শ্রীমায়ের চরণে অঞ্জলি দেবেন এই রকম সংকল্প করলেন। তিনি ধনুর্বাণ হস্তে চক্ষু উৎপাটন করবার উপক্রম করতেই দেবী আবির্ভূত হয়ে তাঁহাকে অভীষ্ট বর প্রদান করেন।
বর্তমান সমাজে ভোগবাদী মানুষের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা পরনারী লোলুপ। তাদের হাতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তারা জানেনা নারীকে জোরপূর্বক অপহরণ করে ভোগ করলে পরিনামে অনেক দুর্দশা ভোগ করতে হয়। কারণ নির্যাতিত মানুষগুলো যখন সম্মিলিতভাবে মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করবে তখন ভোগবাদী আসুরিক শক্তির মানুষ পরাজয় হবে। দুর্গাপূজার কাঠামো বিন্যাস করলে এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার একটা চিত্র চোখে পড়বে। মা দুর্গার পাশে দেখা যায় জ্ঞানদাত্রী স্বরসতী, ধনদাত্রী লক্ষ্মী, প্রশাসনের প্রতীক দেবসেনা কার্তিক, সিদ্ধিদাতা গণেশ, মঙ্গলের প্রতীক শিব, কৃষি ও শিল্পের প্রতীক কলাবৌ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
বীর্য দেহো ক্ষুদ্র জনে
না করিতে হীনজ্ঞান, বলের চরণে
না লুটিতে। বীর্য দেহো চিত্তেরে একাকী
প্রত্যহের তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে দিতে রাখি।
বীর্য দেহো তোমার চরণে পাতি শির
অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির।
সকল পূজার্থী ভাই বোনদের মধ্যে যারা তরুণ প্রজন্ম আছেন তাদের প্রতি অনুরোধ মা দুর্গাকে শ্রদ্ধা ভক্তির পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় খেয়াল রেখে চলার চেষ্টা কর।
আমাদের ধর্ম মা বাবাকে সম্মান করতে বলেছেন। ধর্ম আরো বলেছেন মা বাবার প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করার জন্য। প্রেম বা ভালবাসা নামক দুটি শব্দের নাম দিয়ে আমরা যেন মা বাবাকে ভুলে না যাই। যে মা বাবা পরম স্নেহ মমতায় নিজের সন্তানদের গড়ে তুলেন সে সন্তান বড় হওয়ার পর যদি মা বাবাকে ত্যাগ করে অপরের হাত ধরে চলে যায় তাহলে আমার মনে হয় সন্তানটি মা বাবার সাথে বড় প্রতারনা করেছেন। আমাদের প্রত্যেক সন্তানদের জানতে হবে আমরা যখন শিশু ছিলাম তখন মা বাবা খুব কষ্ট করে আমাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। নিজের সন্তানের মংগল কামনার জন্য অনেক মা বাবা দিনের পর দিন কষ্ট করে দিনাতিপাত করেন। সামান্য চাহিদা মিটানোর জন্য নিজের মা বাবাকে কষ্ট দেওয়া মোটে ও কাম্য নয়। কিছুকিছু ছেলেমেয়ে অথবা ছাত্রছাত্রীদের দেখা যায় সাময়িক উত্তেজনাবশত তারা মা বাবাকে না চেনার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ উচিত নয় বলে আমি মনে করি। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে। সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করা কাম্য নয়। ইদানিং কালের অসংখ্য মোবাইল প্রেম দেখেছি যেখানে দেখা গেছে অনেক মেয়েকে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হয়েছে। পালিয়ে যাওয়ার পর মেয়েটির উপর অকথ্য নির্যাতন করে মানসিক ক্ষমতা নষ্ট করার কথাও শোনা যায়। অনেক ছেলেরাও বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। তাই আমি বলব নিজের ব্যক্তিত্ব ঠিক রাখতে হবে। নিজের মা বাবার উপর শ্রদ্ধা রাখতে হবে। নিজের ভবিষ্যতকে অবশ্যই উজ্জ্বল করতে হবে। আমাদের সকল অহংকার মাতৃ চরণে অঞ্জলি দেওয়ার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করব।
সামাজিক ঐক্য স্থাপনে মাতৃ পূজা প্রবন্ধ – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
মহামায়া মা দুর্গার আগমনী সুরে
মেয়েরা আজ নির্দয়তা/নির্যাতিতা
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় – জাদু-বাস্তবতার এক আদি জনক?