ময়দানের কাহিনী প্রেমের গল্প – অরিএী বিশ্বাস
আমার কাছে ভালোবাসা শব্দটির অর্থ একান্তই ব্যক্তিগত ও মানবিক অনুভূতি।এই অনুভূতি মানুষের প্রতি হতে পারে,পশু-পাখি, ধর্মের প্রতি অথবা প্রকৃতির প্রতি।
আবেগ কেন্দ্রীক হওয়া অথবা আবেগ প্রবন মনোভাব ভালোবাসার মানুষটির জন্য না চাইলেও চলে আসে।
কোন একটি মানুষের অপর আরেকটি মানুষের স্নেহে ভরা হৃদয়কে ভালোলাগা, তাকে শ্রদ্ধা করা, তার কথার মাধুর্য্যে মুগ্ধ হওয়া, তাকে আপন করে নেওয়ার মানসিকতা, মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকেই ভালোবাসা বলে।
প্রেম এবং ভালোবাসা শব্দ দুটি ভিন্ন হলেও আক্ষরিক অর্থ কিন্তু একই। একটা মানুষকে মনে ধরেছে বলেই না প্রতিদিন নতুন নতুন করে তার প্রেমে পড়া,এটিই তো প্রকৃত ভালোবাসা।
প্রবিত্র ভালোবাসার সাক্ষী ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তার মধ্যে অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা, নেপোলিয়ন ও জোসেফিন, শাহজাহান ও মমতাজ মহলের নাম অন্যতম। তাঁদের ভালোবাসার নিদর্শন আজও মানুষের কাছে গৌরবের।
তবে আমার ভালোবাসার সাক্ষী এই মেট্রোপলিটন তিলোত্তমা। চলন্ত মেট্রো রেলের ব্যস্ত প্ল্যাটফর্ম ও অচেনা কিছু যাএী,খোলা নীল আকাশ, এক ঝাঁক শালিক,কাক ও মাঝে মাঝে সাদাকালো বকের দল,তিন-চার জোড়া ঘোড়া, মস্ত মস্ত ডজন খানেক গাছ, বর্ষায় ঘাসের বন,যান ব্যস্ত হলুদ ট্যাক্সির রাস্তা আর দূরে তিলোত্তমার কোলে আবছা ভিক্টোরিয়া। প্রতি রবিবারই আমার আনাগোনা ওই সবুজের সমারোহে ময়দান চত্বরে। ঝালমুড়ি আর পাপড়ি চাটের পসরা, লাল লাল আইসক্রিমের গাড়ি, কিছু জলপানের ফেরিওয়ালার বচসা এইগুলোই তখন দুটি মানুষের কথোপকথনের মাঝে পাঁচফোড়ন। যাকে নিয়ে এতো কথা, এবার তাঁর কথা শুরু করি। ভালোবাসার মানুষটি আমার সহপাঠী মানে আমার কলেজের বন্ধু। ২০১২ সাল তখন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এ দ্বিতীয় বছরের ছাএী। সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম কলেজ চললাম আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে। কলেজ যাওয়ার পথেই আমার ওই মেয়ে বন্ধুটি তার একটি বন্ধুকে ডেকে উঠলো, “কি রে”? চলন্ত সাইকেল থামিয়ে বন্ধুটি নেমে পড়লো,আলাপ হল, টুকটাক কথা হল মিনিট পাঁচেক। ওই প্রথম আলাপ তার সাথে। তারপর সময় স্রোতের মতো ছুটছে, হঠাৎ দেখি ফেসবুকে ওই বন্ধুটির ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, যেহেতু কলেজে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝে কথা হতো তাই কতো কিছু না ভেবেই রিকুয়েস্ট অ্যাসেপ্ট করেনি। কথা চলত সাধারণ দু চারটে বন্ধুর মতোই। দেখতে দেখতে কলেজ ছাড়ার সময় এসে দাঁড়ায় আবার নতুন কলেজে ভর্তির জন্য টানাপোড়েন। আমি এবার চলে এলাম নদীয়া,ওই বন্ধুটিও কৃষ্ণনগরে। কথাবার্তা যথেষ্ট সাদামাটা, মাঝে মাঝে পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়ির খবর আদান প্রদান আর পাঁচটা বন্ধুর সঙ্গে যেমনটা হয় তেমনি। এরই মাঝে কখন যে একটু একটু করে দুজনের মনে ভালো লাগা জন্মায় দুজনের একজনও বুঝতে পারিনি। এপ্রিল মাস ২০১৭ সাল সম্ভবত ১৪ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে দুপুর বেলায় হঠাৎ করে বন্ধুটি ফেসবুক মেসেঞ্জারে বলে ফেলে ” তোকে একটা কথা বলবো কিছু মনে করবি না তো?” আমি কিছুটা বুঝেও না বুঝার ভান করে বলে উঠলাম হ্যাঁ বল, ও বললো “আমার তোকে ভালোলাগে”। কথাটির সাথে এতো পরিচিত ছিলাম যে বেশ খানিকটা সময় কেঁদে নিয়েছিলাম।যদিও আজ পর্যন্ত ওকে এই কান্নাকাটির প্রসঙ্গটি বলিনি। যাই হোক আমি ওর উওরে বলেছিলাম ” তুই আমার চাইতেও অনেক ভালো মেয়ে পাবি”।ও তখন সরল মনে বলে উঠেছিল “তুই কিছু মনে করলি না তো?” আসলে না বলার কারণ ছিল একটাই ছোট থেকে বাড়ির প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে অবহেলা পাওয়া, বাবার কাছে এই ত্রিশ বছরেও অনাদরে বেড়ে ওঠা, মাকে প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে দেখা, আসলে ভরসা করতে পারিনি ওই সময়ে। তবুও সময় তো থেকে যাওয়ার নয়, সাথে চলমান আমরাও বি-টেক শেষ হয়ে গেল দুজনেরই। আমাদের বন্ধুত্বে কিন্তু ফাটল ধরেনি।কথা হয়েছে রীতিমতো। এমনি সময় হোয়াটসঅ্যাপের প্রচলন খুব শুরু হয় আমার সব বন্ধুরা সেই বছর দুই আগেই গ্রুপ বানিয়ে গল্প শুরু করেছিল এইসব শুনতে শুনতে আমিও নিজের পছন্দের উইন্ডোজ ফোনে হোয়াটসঅ্যাপটি ইন্সটল করেই নিলাম। ওমনি তার দিনকয়েক পরেই ওনি বলে বসেন “তোর হোয়াটসঅ্যাপ আছে?” আমিও বলে দিলাম হ্যাঁ,আর কে সময় নষ্ট করে বলে কি “নাম্বার টা দিবি তো চাইতে হবে নাকি?” তখন মনে মনে ভেবেছিলাম “উফ্ ! ওর আবার নাম্বার নেওয়ার কি আছে, ঠিক এবার এখানেও কথা বলবে”। আস্তে আস্তে কথা বাড়তে লাগলো কিন্তু চাকুরির জন্য চিন্তা ছিল দুজনেরই। ছেলেটির সঙ্গে আগের থেকে অনেক বেশি কথা হয়, সাদাকালো মেঘগুলোতে রঙিন স্বপ্নেরা বাসা বাঁধতে চায়। একবারের এক ডিপি ভালো লাগে ওর বলে ওটাই ফেসবুকেও করে দে, আমি কিন্তু কথামতো করেও দিয়েছিলাম ওর নাম সমেত। কিন্তু কেন করেছিলাম সেদিন মানেটা তখনও বুঝতে পারিনি,ও কখনোই আমাকে জোড় করে বোঝাতে চায়নি। আসলে তখন বয়স পরিনত ছিল কিন্তু চিন্তাভাবনা,ধ্যানধারনা ছিল বাচ্চাদের মতো। কিছু ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে আমি মূল বিষয় থেকে সরে দাঁড়াই। কিন্তু ওই সময়েও আমরা বন্ধুত্বটা রেখে গেলাম। কথা হতো নিয়মিত। আবারো বছর দুই পরে জানলাম ও চাকরি পেয়েছে আমি তখনও পড়ছি, দুজনের মধ্যে ভালোবাসা জিনিসটা নেই’ই তবুও কেন জানিনা পরের দিন সকালে পড়তে গিয়ে সহপাঠীদের ওর চাকরির খবর জানিয়েছিলাম। একটা তৃপ্তির হাসি কেন অজান্তেই হেসেছিলাম জানি না। তখনো ওর পোস্টিং আসেনি আমি বলেছিলাম তুই রেলেই কর, অনেক সুযোগ সুবিধা আছে,ওর বরাবরই ইচ্ছে বাড়ির কাছে কাজ করা। আমিও রাজি হয়ে বলেছিলাম ঠিক আছে বাড়ি থেকে যেটা ঠিক মনে করছে ওটাই করিস। কি আশ্চর্য এক খবর, ও পোস্টিং পেলো এই তিলোত্তমায়। তখনো কথা চলতো আগের মতো,আমি আমার পড়ায় ব্যস্ত আর ও একই শহরে কাজে। তবে ছোট্ট থেকেই আমার মধ্যে মানুষের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে একটা চয়েস কাজ করতো, সবার কাছে ওপেনআপ হতে সময় লাগে কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার ওর সাথে এসবের কিছুই হতো না। কথা চলতে থাকলে কি ভাবে সময় পেরিয়ে যেতো বুঝতেও পারতাম না,একটা তৃপ্তি আর মন ভরা শান্তি পেতাম। এরই মাঝে আবার একবার বলে উঠলো তোকে ভালো লাগে। এবারেও ভেবেছিলাম মিছি মিছি, তবে এবার জিজ্ঞেস করলাম আগের বার কি সত্যি বলেছিলি? বললো হ্যাঁ। তখনো কেন জানিনা কেঁদে ফেললাম, পূর্বের সমীকরণগুলো মিলিয়ে বুঝতে পারলাম আমার ভাগ্যরেখা শুধুই তোকে আঁকরে লেখা, নিজের নির্বুদ্ধিতায় কতোগুলো বসন্তের সাক্ষী আমরা হতে পারলাম না। তারিখটা ছিল ২৯ শে নভেম্বর। এতগুলো বছরের বন্ধুটি আজ সম্পর্কের নাম পেয়েছে এর চাইতে বড়ো প্রাপ্তি আর কি হতে পারে। আমার মনে হয় দুটি নিস্পাপ হৃদয় যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকে তবে স্বয়ং ঈশ্বর তাদের এক করে দেবেন। অনেক রঙিন অধ্যায়ের সূচনা সাদাকালো হলেও বসন্তের রঙ তাদের ঠিক ছুঁয়ে যাবেই। ভালোবাসার বর্ননা এক টুকরো কাগজ কলমে করা সত্যিই সম্ভব নয়।এটি একটি সুন্দর অনুভূতি একে শুধু অনুভব করতে হয়। স্বার্থপরতা, হিংসা,ক্ষোভ নিয়ে কখনো প্রেম, ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসার মানে ত্যাগ স্বীকার। দুটি সৎ হৃদয়ের প্রতিফলন বিবাহ বন্ধন। ভালোবাসা সর্বদাই প্রবিএ মনের পূজারী। অনেক সবুজের রোপণ যেমন স্বাস প্রশ্বাসের যানবাহন, তেমনি একটি স্নেহের বাঁধন সারাজীবনের সমস্ত বাধাবিঘ্নের রোধন। যদি প্রশ্ন আসে ভালবেসে কি পেয়েছি? আমি বলবো বিনা বনে বনভোজনের অভিজ্ঞতা, স্কুল ছুট দুই পড়ুয়ার একে অপরের টিফিন কেড়ে খাওয়া, একসাথে সুখ দুঃখের বোঝাপড়া, সবুজের সমারোহে বারিস্নাত হওয়া, ময়দানের মস্ত সবুজের বুকে নিজেদের স্মৃতি রেখে যাওয়া। পরিনত বয়সের প্রেম হলেও মনের শিশুটি আজও আমাদের খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে শৈশবে ফিরে। এখানেই আমাদের ভালোবাসার পূর্ণতা।
ময়দানের কাহিনী প্রেমের গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
জ্বর
ভুবন যায় ভুবন আসে
প্রেম চিরন্তন