মহামায়া মা দুর্গার আগমনী সুরে প্রবন্ধ – রূপম চক্রবর্ত্তী
শ্রী মায়ের আগমনী সুরে ভক্তপ্রাণে আনন্দের দোলা লাগে। ছুটে চলে সবাই মায়ের শ্রী চরণে অঞ্জলি দিতে। শ্বশুর আলয় থেকে মেয়ে আসবে বাপের বাড়িতে। তাই সকলের মুখে হাসির ধারা বহমান। পাড়া প্রতিবেশীর চোখে ঘুম আসেনা, সবাই চেয়ে আছে নতুন প্রভাতের দিকে। সবার একটাই আকুতি কখন তাদের মেয়ে ঘরে আসবে, কখন তাদের মেয়েকে শিউলি ফুলের মালা গেঁথে পড়াবে। বার্তা প্রেরকের ভূমিকা নিয়ে মহালয়া আসে। বাপের বাড়িতে শুরু হয়ে যায় প্রেমানন্দের সমারোহ। ধর্মীয় চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ ভক্ত সজ্জনদের কাছে মহালয়া তিথি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহালয়া এলেই বাংলার মাটি-নদী –আকাশ প্রস্তুত হয় মাতৃপূজার মহালগ্নকে বরণ করার জন্য। কাশফুল ফুটলে শরৎ আসে, না শরৎ এলে কাশফুল এসব নিয়ে বিস্তর তর্ক চলতে পারে। কিন্তু মহালয়া এলেই যে দূর্গাপূজা এসে যায়, তা নিয়ে তর্কের কোনও অবকাশ নেই। মহালয়া এলেই সেই দেবী-বন্দনার সুর ধ্বনিত হয় বাংলার হৃদয়ে। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ। বুকের মধ্যে জাগে আনন্দ-শিহরিত কম্পন, মা আসবেন সেই অপেক্ষায় থাকে ভক্তকূল। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ
আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা।
নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে
সাজিয়ে এনেছি ডালা।
এসো গো শারদ লক্ষ্মী,
তোমার শুভ্র মেঘের রথে।
যে মেয়ে বাপের বাড়িতে আসবেন তিনি দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা। তিনি অসুর বিনাশিনী, মহিষাসুরমর্দিনী। মহিষাসুরকে যুদ্ধে তিনি নিহত করেছিলেন। মহিষাসুর রম্ভ নামক এক অসুরের পুত্র ছিলেন। দুর্দান্ত মহিষাসুর দেবতাদেরকে স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন। রাজ্যহারা দেবতারা বিষ্ণুর কাছে এর প্রতিকার প্রার্থনা করলেন। সকলে মিলে কঠোর তপস্যায় বসলেন। তাদের তপস্যা প্রভাবে দেহ থেকে তেজ বিনির্গত হল। সেই তেজ সম্ভুত দেবী মহামায়া দুর্গা। নানাবিধ অলংকার ও বিভিন্ন ধরণের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দেবী অট্টহাস্য করে ঘন ঘন গর্জন করতে লাগলেন। ভয়ংকর যুদ্ধে মহিষাসুর দেবীর কাছে পরাজিত হলেন। যিনি উগ্রভাবে জগতকে কামনা করেন তিনি মহিষাসুর। কাম, ক্রোধ,লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যের ঘনীভূত মূর্তি মহিষাসুর। এই অশুভ অহংকারী অসুরকে মা যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। জগতের প্রায় প্রতিটি জায়গায় প্রতিনিয়ত এই সুর আর অসুর শক্তির সংগ্রাম চলছে। মহাশক্তির প্রভাবে সুরশক্তি অসুরশক্তিকে পরাজিত করতে পারে।
প্রতিটি মানুষ সংসার বন্ধনে আবদ্ধ। সংসারের ঘুর্ণিপাকে ঘুরতে ঘুরতে মানুষ হয়ে পড়ে সার্থান্ধ। স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারকল্পে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বিকিয়ে দিয়ে হিংসার দাবানলে নিজেকে দহন করতে থাকে। কেউবা চায় অন্যকে ছোট করতে আর কেউবা চায় পরের সম্পত্তি দখল করে নিজেকে বিত্তশালী করে সমাজে উপহার দিতে। কেউবা চায় অপরজনকে জুলুম নির্যাতন করে তার সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা। আমরা পূজো বাড়িতে যখন যায় তখন দেখি মায়ের পদতলে বিজিত মহিষাসুর। আবার মায়ের উপরে থাকে মঙ্গলের প্রতীক শিব। এখানে একটা অনুপম শিক্ষা আমরা মাতৃকাঠামো থেকে পেয়ে থাকি। মঙ্গলকে ধারণ করে আমাদের শক্তি দিয়ে সেই অসুর শক্তিকে পরাজিত করতে হবে। পশুশক্তি এত বেশি বেড়ে গেছে যার প্রেক্ষিতে এখন সমাজে শুভশক্তির মানুষগুলো দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। সার্থান্ধ মানুষগুলোর অনাচার সহ্য করার সীমা সংকুচিত হচ্ছে। মা দুর্গা সেই পশুশক্তি স্বরুপ সার্থান্ধতা নামক দুর্গম অসুরের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেন। মা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এসে আমাদের রক্ষা করেছেন। দেবী ভাগবতে আছে,
সেয়ং শক্তির্মহামায়া সচ্চিদানন্দরূপিণী।
রূপং বিভর্ত্যরূপা চ ভক্তানুগ্রহ হেতবে।।
সেই সচ্চিদানন্দরূপিণী মহামায়া পরাশক্তি অরূপা হইয়া ভক্তগণকে কৃপা করিবার জন্য রূপ ধারণ করেন। মা এত করুণাময়ী কেউ থাকে সকামভাবে ডাকুক অথবা নিষ্কামভাবে ডাকুক তিনি মায়ের কৃপা অবশ্যই পাবেন। মা জগৎজননী আমাদের সৃষ্টি করেন এবং তিনিই আমাদের মায়ামোহে আবদ্ধ করে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছেন। মাকে নিষ্কামভাবে আরাধনা করলে তিনি আমাদের কৃপা করেন।
মাতৃভাবনা জাগ্রত করার অনুপম শিক্ষা পেয়ে থেকে দুর্গা পূজার মাধ্যমে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাই বলেছেন, তোমরা যাকে ব্রহ্ম বল আমি তাকে মা বলি, মা অতি মধুর নাম। প্রতিটি ঘরে ঘরে মাতৃজাতি সম্মান লাভ করুক। মাতৃ আরাধনা তখনই স্বার্থক হয়ে উঠবে, যখন ঘরে ঘরে দূর্গার মত মেয়েদের প্রকাশ ঘটবে। বছর বছর ঢাক-ঢোল বাজিয়ে দূর্গতিনাশিনীর আরাধনা করেও কেন আমাদের দূর্গতি দূর হচ্ছেনা তা এখন ভেবে দেখতে হবে। পূজার মর্ম কথা আমাদের জানতে হবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্র বললেন,
‘পূঁজা পার্বন তুই যতই করিস,
ফুল, তুলসী, গঙ্গা জলে
অনুশীলনী কৌশল ছাড়া,
ফল পাবে না কোন কালে।’
তাই, দূর্গা পূজা কেবল মাত্র পুস্প বিল্বপত্রের এবং ঢাক-ঢোলের পূজা নয়। এ পূজা মানবতার এক বিরাট মিলন উৎসব। ঈশ্বর এক, অদ্বিতীয় ও নিরাকার। বিভিন্ন দেব-দেবীও এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের বিচিত্র শক্তির প্রকাশ মাত্র। ভক্ত ঈশ্বরের প্রতীক। মূর্তিতে তার হৃদয়ের অর্ঘ্য দেবতার পাদপদ্মে নিবেদন করে করুণা লাভের চেষ্টাই পূজা বা উপাসনা। তাই পূজারী আরাধ্য দেবতার মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে চিন্ময়ী জ্ঞানে অর্চনা করেন। ভক্তের হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাভক্তিতে মৃন্ময়ী মূর্তি তার মানসলোকে চিন্ময়ী হয়ে ওঠে।
চিন্ময়ী মা আমাদের সকল মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি প্রদান করেন। আজকে চারদিকে যদি থাকাই তাহলে দেখব আমরা প্রতিনিয়ত মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছি। মায়ামুগ্ধ জীব ভাবে পৃথিবীতে সে চিরদিন জীবিত থাকবে। যা ভোগ করতে ইচ্ছা করে তিনি সেটাই ভোগ করতে চেষ্টা করেন। মায়া শক্তির কারণে জীব ভাবে আমিই কর্তা। পাপ কর্মপরায়ণ বিবেকশূন্য মানুষ প্রতিনিয়ত মায়া দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। নিজের অস্তিত্ব বিনাশী অবিদ্যা রূপ মায়াকে যিনি ধ্বংস করেন তিনি জগৎ জননী মা দুর্গা। মা হচ্ছেন অভীষ্টদায়িনী, পরমা ইচ্ছা শক্তি। মানুষের মধস্থিত আসুরিক শক্তিকে বিনাশ করে মুক্তি পথের সন্ধান দেন মা জগৎজননী। আমাদের মতো ব্যক্তিদের মায়ার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া খুবই দুরহ ব্যাপার। মায়ার কাজ হচ্ছে যারা ধর্মবিমুখ তাদেরকে প্রতিনিয়ত আবদ্ধ করা। শ্রী চৈতন্য চরিত্রামৃতে বলা হচ্ছে,
” কৃষ্ণ ভুলি সেই জীব অনাদি বহির্ম্মুখ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসার দুখ।।
কভু স্বর্গে উঠায় কভু নরকে ডুবায়।
দন্ড্যজনে রাজা যেন নদীতে চুবায়।।
মাতৃপূজায় আমাদের প্রার্থনা থাকবে আমরা যেন ধর্মপথে অথবা ইষ্টপথে পরিচালিত হতে পারি। কেননা মানব জীবনে অর্থের প্রাচুর্যতা থাকতে পারে কিন্তু সে অর্থ যদি সঠিকভাবে বন্টিত না হয় তাহলে সুন্দর জীবন গঠন করা যাবেনা। ধর্মীয় অনুশাসনবাদ মানুষের চোখ খুলে দেয়। আমরা যারা দুর্গা পূজা করি, সরস্বতী পূজা করি তাদের খেয়াল রাখতে হবে পূজোর ভিতরের রহস্যগুলো নিজের জীবনে অধিষ্ঠিত করতে পারি। যেমন ধরুন পূজা করতে বসলাম কিন্তু দেখা গেল ভক্তি করে মায়ের শ্রীচরণে অঞ্জলি দিলামনা। তাহলে ভাবুন আমরা কি সঠিকভাবে পূজা করেছি। সমাজে কিছু কিছু লোক পাওয়া যাবে যারা আত্মপ্রচারের জন্য অথবা আত্মপ্রতিষ্ঠা করার জন্য পূজা করছেন। সেই পূজোগুলিতে রাজসিকতা আর তামসিকতায় পূর্ণ।
একবার আমি চট্টগ্রাম শহরের একটি নামকরা পূজামণ্ডপে তন্ত্রধারকের কাজ করেছিলাম। আমি প্রত্যক্ষ করলাম জগৎজননী মায়ের পূজা হচ্ছে অথচ কোনো একজন মহিলাকে পাওয়া যাচ্ছেনা একটু উলুধ্বনি করার জন্য। ব্রাহ্মণ পূজো করছেন আর তাকে সাহায্য করার জন্য কোনো ব্যক্তি নাই। আমরা যদি প্রকৃত ভক্ত হয়ে উঠতে না পারি তাহলে দেখা যাবে মাতৃ কৃপা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। হিংসা ও অহমিকার প্রচন্ড আঘাতে জর্জরিত সনাতন সমাজকে সাত্তিক পূজা করে মাতৃ করুণা লাভ করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। দেবী মাহাত্ম্যে মহাদেবী বলেছেন,”যে আমার উৎকৃষ্ট মাহাত্ম্য ভক্তি সহকারে পাঠ করিবে তাহার কোনো পাপ বা পাপজনিত বিপদ হইবে না। নিজের পরমার্থিক মুক্তির জন্য আমরা শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে মায়ের কাছে আত্মনিবেদন করব। পাশাপাশি দুর্গাপূজার মূলশিক্ষা সার্বজনীনতাকেও আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর পরস্পরের প্রতি প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ হতে হবে।
মহামায়া মা দুর্গার আগমনী সুরে প্রবন্ধ – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না