প্রেম চিরন্তন প্রেমের গল্প – রাণা চ্যাটার্জী
কইরে সকালে পড়তে না বসে বিছানায় উঠে ওই গল্পের বই গুলো এলোমেলো করছিস কেন?ওখানে তো তোর কিছু নেই বাবু ।ছেলের কান্ড দেখে অবাক সুমিতা।রাখ রাখ,ওখানে হাত দিস না আমি সব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছি।ওখানে সব বড় দের বইতো সোনা,ঘেঁটে দিস না।আমি কিন্তু গোছাতে সময় পাবো না একদম। ছেলের দিকে নজর পড়তেই রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে সুমিতা একরাশ উদ্বিগ্নতা নিয়ে ঘরে ছুটে এসেছে।ছোট্ট ঘর ও এক চিলতে বারান্দা সহ ভাড়া বাড়িতে পরিপাটি সংসার সুমিতা – রঞ্জনের।
“আহ কি হল গো তোমার , রান্না করতে করতে দৌড়ালে যে! কত্তার অবাক প্রশ্ন! আমার অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে যে!এই সুমিতা,ছেলেটার দিকে অমন করে রেগে তাকাচ্ছ কেন? হ্যাঁরে বাবান নিশ্চয়ই তুই কিছু বদমায়েশি করেছিস বুঝি?বাইরের বারান্দায় একমুখ ফোম মেখে আয়নায় দাড়ি কাটছিল রঞ্জন। সুমিতা উত্তর দিলো,দেখতে পাচ্ছ না বইয়ের তাক গুলো কেমন লন্ডভন্ড করছে ছেলেটা!তোমরা নোংরা করবে আর আমি কি সব সামলাবো নাকি!সুমিতার প্রশ্নে বাবান ততক্ষণে মাকে আশ্বস্ত করতে হাজির। “তাকের বই গুলোতে কি বিশ্রী ধুলো মা,আমি গুছিয়ে রাখব চিন্তা করো না তুমি’- ছেলের স্বান্তনা স্বত্বেও সুমিতা বিছানায় উঠে সব ঠিক ঠাক আছে কিনা এক ঝলকে দেখে তবে শান্তি পেলো।
ক্লাস থ্রিতে পড়া কৌতূহলী বাবানের সব দিকে নজর।এদিকে সুমিতার হয়েছে বেশ জ্বালা! তার একান্ত ব্যক্তিগত একটা জিনিস, দুর্মূল্য উপহার সে যে কোথায় রাখবে এই চঞ্চল ছেলে আর বরের দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবেই অস্থির।সুমিতা না পারে কাউকে বলতে আর না পারে সুরক্ষিত কোথাও রাখতে! অর্থ বিচারে এ উপহারের মূল্য যেমন বিবেচনা করা যাবে না তেমনি এর যে কি অপরিসীম কদর যে পায় একমাত্র সেই জানে আর এই অনুভবটাই তাজা রাখে সুমিতাকে।
নির্জন দুপুরে কখনো কেমন, সময় আর ঘর ফাঁকা পেলে বইয়ের তাক থেকে আর পাঁচটা বই থেকে স্পেশাল ওই বইটা খুলে বসে সুমিতা।বইয়ের ভাঁজে লেপ্টে থাকা এক শুকনো গোলাপ নাকের কাছে এনে একবুক নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে খুঁজে পায় প্রায়শই।নস্টালজিক সুমিতা তখন হয়ে ওঠে চঞ্চলমতী কলেজছাত্রী।তারপর বইটা চেপে আজ থেকে প্রায় ১৩বছর আগে পাওয়া তাজা রক্ত গোলাপের জীবাশ্ম ছুঁয়ে ,এক অদ্ভুত প্রশান্তি মেখে স্বস্থানে পরমযত্নে রেখে দেয় নিৰ্দিষ্ট স্থানে ।ব্যস্ততার মধ্যবিত্ত জীবনে অনেক কিছু না পাওয়ার অভিমানে এ অতীত স্মৃতি,তাকে অনেক খানি চনমনে রাখে যা সুমিতা নিজেই উপলব্ধি করেছে।একটা আক্ষেপও কাজ করে মনে সুমিতার, এক খামচা মন খারাপের প্রলেপও!জীবনের প্রথম ও শেষ পাওয়া প্রেমপত্র সহ উপহার দিয়ে ছিলই যখন তার প্রিয়জন রতনদা তারপর থেকে কোথায় যে উবে গেলো জলজ্যান্ত মানুষটা,আফসোস হয়! বহু ভেবে খোঁজ করেও রতন দার কিনারা করতে পারে নি সুমিতা আর নিজের অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলেছে!তবে কি বাবান কোনোভাবে কিছু টের পেয়েছে মা কি করে ওই তাকের বই নিয়ে প্রায়শই!বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলেও নিজেকে স্বান্তনা দিলো নিজেই সুমিতা যে বাবান তো নেহাত পুঁচকে ও কিছুই এইসব বুঝতে পারবে না !
“এই শোনো সুমিতা, আজ বিকালে রেডি হয়ে থাকবে তোমরা কেমন, অফিস থেকে ফিরেই তোমাদের নিয়ে বেরুবো”- রঞ্জনের হঠাৎ ফোন পেলো সুমিতা। সে জানতো আজ তাদের দশ বছর বিবাহবার্ষিকীতে এমন কিছু একটা সারপ্রাইজ দেবেই রঞ্জন।সত্যি বলতে কি প্রথমে বেশ রাগ হচ্ছিলো তার রঞ্জনের মৌনতা দেখে!কাল রাত পার হলো,আজ সকালেও সামান্য শুভেচ্ছা পর্যন্ত জানাই নি বর।।সুমিতা ভেবেছিল নির্ঘাৎ বিয়ের ডেটটাই ভুলে গেছে কত্তা।এখন ফোন পেতেই দখিনা বাতাসের মতো সুমিতার ঠোঁটে স্বস্তির হাসি হাজির।
বাইপাস ধরে গাড়িটা এমন স্পিডে চালাচ্ছিল রঞ্জন,বেশ অবাক হলো সুমিতা। এই কোথায় চললে তুমি,খানিক আস্তে তো চালাও।সুমিতা বুঝতে পারছে হঠাৎ যেন পুলক জেগেছে রঞ্জনের মনে! সে ভাবছিল তবে হয়তো কোনো ধাবা বা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে রঞ্জন বিবাহ বার্ষিকী সেলিব্রেশন করতে!
বাবানও অবাক হয়ে জানলার কাঁচ থেকে বাইরেটা দেখছে।বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থামলো । বাবানকে একটু গাড়িতে বসতে বলে গিন্নিকে ইশারায় নামতে বলল রঞ্জন। এ কি গো এ যে আমাদের কলেজের সামনে নিয়ে এসেছো!এতদিন পর জায়গাটা দেখে সুমিতার মন ভালো হয়ে গেলো।একঝাঁক তাজা স্মৃতি তাদের দুজনকেই গ্রাস করছে।
সুমিতাকে হাত ধরে গাড়ির পেছনে নিয়ে এলো রঞ্জন।এখনো এদিকটায় লোক চলাচল বিশেষ নেই।বাবান যাতে ওদের দেখতে না পায় গাড়ির ডিকি উঁচু করে খুলে রেখেছিল রঞ্জন।এরপর একটা তাজা রক্তগোলাপ বের করে হালকা অন্ধকার নেমে আসা বিকেলকে সাক্ষী রেখে ঝুঁকে প্রপোজ স্টাইলে সুমিতার হাত ছুঁয়ে আলতো চুম্বনে আই লাভ ইউ বলতেই লজ্জায় শিহরণে লাল হলো সুমিতা।
আরে করছো কি তুমি, ধ্যাৎ আমার তো লজ্জা করছে অস্ফুটে কথাটা বলেও সুমিতার ঘোর কাটছে না।এত গুলো বছর ঘর করেও সে সত্যি বুঝতে পারেনি যে রঞ্জন এক আস্ত প্রেমিক।মুহূর্তে সুমিতার মনে একটা দ্বিধা কাজ করতে লাগলো!তবে কি রঞ্জন কোনোভাবে জানে তার অমন যত্নে শুকনো গোলাপকে রেখে দেওয়ার কথা!এটাই তো একদম সেই জায়গা ,যেখানে কলেজে অনেকের হার্টথ্রব রতনদার কাছ থেকে সুমিতার প্রেমপত্র সহ উপহার প্রাপ্তি হয়েছিল। তাজা রক্ত গোলাপ পেয়ে আনন্দে খুশিতে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো সুমিতার।মনে মনে একটু গিল্টি অনুভব যে করলো না তা নয়,বরং সিদ্ধান্ত নিলো যার পাশে এত সুন্দর পরিবার,দায়িত্ববান পুরুষ সঙ্গী,একটা ফুটফুটে সন্তান তার অন্তত ওই শুকনো গোলাপ আঁকড়ে আক্ষেপ মানায় না!
পরেরদিন দুপুরবেলা সুমিতা লাইব্রেরী গেলো বই আনতে, সঙ্গে রেখেছিল রতনদার থেকে উপহার পাওয়া গল্পের বইটা।
সেদিনই লাইব্রেরিয়ানকে বই দান করতে আগ্রহী বলে উপহার পাওয়া বইখানা দান করে বাড়ি ফিরলো।কাজটা করতে পেরে সুমিতার নিজেকে আজ খুব হালকা ও ফুরফুরে লাগছে। অন্তর থেকে সে অনুভব করছে একটা মুক্তির স্বাদ। মাথা থেকে সুমিতা যেন পাথরের বোঝা নামাতে পারলো অচিরেই।বাজার থেকে রঞ্জনের জন্য দারুন একখানা শান্তিনিকেতনী বাটিকের পাঞ্জাবি ও বাবানের জন্য কিনলো তার প্রিয় বই পান্ডব গোয়েন্দা ।লাইব্রেরীতে দান করে আসা বই থেকে শুকনো গোলাপটা পর্যন্ত বের করেনি সুমিতা।কাল বিকালের অমন ঘটনার পর সুমিতার একবারও ইচ্ছা করেনি এতদিনের সংরক্ষিত বইটার পাতা উল্টে দেখতে । চাপমুক্ত হয়ে আনন্দটা বহুগুন বেড়ে যাওয়ার খুশিতে সুমিতা, তিন প্লেট স্পেশাল ফুচকা কিনে বাড়িমুখো হলো।
প্রেম চিরন্তন প্রেমের গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
জ্বর
ভুবন যায় ভুবন আসে
ভালোবাসা ডট কম