কুলুকুলু কোলাহল ছোট গল্প -ময়ূরী মিত্র
বয়ে চলা নদনদীর থেকে আমার অনেকসময় গাছের পাতায় একটি জলদানা দেখতে বেশি ভালো লাগে ৷ বৃষ্টি শেষ করে মেঘগুলো দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে দৌড়োতে শুরু করে অন্যত্র –নীচে গাছের পাতায় স্থির একবিন্দু জল ৷ বিন্দুটির বড়ো সমাহিত ভাব — যেন ওই একটুখানি বৃষ্টির জল পরিচ্ছন্ন করে দেবে গোটা পৃথিবীর পাপ ৷
আজ ভোরবেলা এক মানুষ আমাকে ওমন জলবিন্দু হয়ে শুদ্ধ করে দিল ৷ সে মানুষের সদ্ভাব ও সৎভাব আমাকে পুণ্যকে চিনতে সাহায্য করল ৷ পাড়ারই ডাবওয়ালা ৷ নিয়মিত নির্দিষ্ট জায়গায় বসে ডাব বিক্রি করেন ও প্রার্থনার সময় এলে ওই রাস্তার একপাশেই জানু পেতে ঈশ্বরকে ডেকে নেন ৷
এটুকুর বেশি খবর রাখিনি মানুষটা সম্পর্কে ৷ দেশের ধান্দাবাজ সংস্কৃতিবাজগুলো যেমন কোনোদিন গরীব মানুষকে খেয়ালে রাখেননা –রাখবেন না আগামীতেও এ মানুষটি সম্পর্কে আমার মনোগত অবহেলা ছিল ঐরকম।
আজ ডাব কিনতে গিয়ে বললাম –আমার এক বন্ধুর জন্য কচি ডাব দিতে হবে ৷ বন্ধু হাসপাতাল থেকে সবে ফিরেছেন এবং ওঁর যা ব্যাধি তাতে ডাবটাই ওষুধ ৷ দিতে পারবেন ? বোঝাই করা ডাবের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে অবাক করে ভদ্রলোক বললেন — হবে না ৷ আর একটিও ডাবওয়ালা বসেননি ৷ বাধ্য হয়ে বললাম –এত নানা সাইজের ডাব আপনার — এত লোককে দিচ্ছেন ৷ ওর ভেতর থেকে আমায় একটা দিন ৷
—-দিদি অসুস্থ রোগীর ডাব দিতে গিয়ে কি মিছে বলব ? সত্যিই আমার কাছে কচি ডাব নেই ৷ যাঁরা খাচ্ছেন তাঁরা শাসওয়ালা ডাবই ভালোবাসেন — তাই খাচ্ছেন –ডাবওয়ালা বললেন ৷ এরপরও আমি বারবার অনুনয় করতে লাগলাম –দিন না ওর মধ্যে থেকেই দিন ৷ রাজি নন ৷ বন্ধুর সুস্থতাকামনায় মাথা তখন আরো বিগড়েছে আমার ৷ আরো ছোটলোকের মতো বলতে লাগলাম — ষাটের জায়গায় সত্তর দেব ৷ নিচের দিকে খুঁজে দেখুন না দাদা ৷ বিক্রেতা অটল — আমার ডাব আমি চিনি৷ ভুল জিনিষ দিতে পারব না ৷ আর আপনার কাছে বেশি অর্থ আছে বলে আমি তা নেবই বা কেন ? লোভে আমার বড়ো ভয় ৷ শেষ লাইনটা শোনার পর আর দাঁড়াবার সাহস হয়নি ৷
দুঘন্টা তিনঘন্টা কেটে গেছে ৷ চুপচাপ বসে আছি —-মাথার মধ্যে ঘুরছে তাঁর কথা –লোভে আমার বড়ো ভয় দিদি -বড়ো ভয় ৷ কলিং বেল বাজল ৷ দেখি –ধার্মিক মানুষটি হাতে দুটো ডাব নিয়ে দাঁড়িয়ে —এই নিন আপনার কচি ডাব ৷ এটা খাওয়ান –বন্ধু ভালো হবে ৷ হাটদুটি তাঁর সাপের মতো জাপটে ধরে বললাম — আপনার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবেন তো ? পাল্টা প্রশ্ন —ঠিক চিকিৎসক দেখছেন তো দিদি ? আপনি শুধু সেটা খেয়াল রাখুন ৷ আর কচি ডাব দেবার দায়িত্ব আমার ৷
এতক্ষণ একজন মানুষের গল্প বললাম –সম্প্রীতির নয় –লঘু বা গুরুরও নয় ৷ কিছুদিন আগে এই গণতান্ত্রিক দেশে এক ভদ্রমহিলার মুণ্ডু কেটে নেয়ার দাবি জানান হয়েছিল ৷ ভদ্রমহিলা খুব সঠিক বক্তব্য রেখেছিলেন এমন নয় ৷ তবে কতটা বেঠিক কাজ করলে একটি সুশিক্ষিত দেশের মানুষের মুণ্ডু কাটার জমায়েত হয় এবং সেই জমায়েতের একটিও প্রতিবাদ অতিবুদ্ধিবাদী সহনাগরিকদের কলম বা জবান থেকে বেরোয় না –তা এখনো ধারণা করতে পারিনি ৷ যাঁরা দাঙ্গার প্রবল সম্ভাবনা দেখেও সেদিন ঘাপটি মেরে ছিলেন চুপ করে থাকার কারণটাও নিশ্চয় তাঁরা বলতে পারবেন ৷
তবে তারপর থেকে সম্প্রীতি শব্দে বড্ড ঘেন্না জন্মেছে আমার ৷ ডাবওয়ালা বন্ধুটির ভাষায় বলি
—–ও মিছে কথা ৷
কুলুকুলু কোলাহল ছোট গল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভরুয়া
উদ্বর্তিনী
নীলবাস্প