লটারি ছোটগল্প – কৃষ্ণ রায়
এই ঝড় বৃষ্টি বাদলার দিনে একটা বড় কেলেঙ্কারির মুহূর্ত হয়ে ওঠে আমাদের সকলের। এই প্যাচপ্যাচে কাদা পথ গুলো যে পচা কাঁঠালের থেকেও খারাপ অবস্থা হয় তা বুঝতে অসুবিধা হবে না তাঁদের, যাদের বাড়ির বুক ভর্তি জল তারা তো দিনরাত পানির উপর ঘর করে মরে। আর যাঁদের বাড়ির পেছনে শুধু জল পড়ে, কিন্তু কাদা হয় তাঁরা। এমন বাড়ির খোঁজে বেরোলে আমাদের বাড়িটাও পাবে। সারাদিন শুধু মুষলধারে বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে আর আমাদের চোখের জল গড়েই যাচ্ছে। সারাটা ঘরের ভিতরে এখনে ফুটো ওখানে ফুটো। জল ঝরে পাতা নড়ে। যাই হোক তবুও বেঁচে তো আছি এই ভরা ভাদরে। সবচেয়ে বড় কথা হল এই সময় সবচেয়ে সুখে থাকে তাঁরা, যাদের মাথার উপর ছাদ আর কংক্রিটের ঘেরা চার দেওয়াল। এই ঘন বর্ষায় খিচুড়ি ভাজা তাঁদের জন্যই শ্রেয়। এমনকি যদি আরো কিছু আবদার করো তবুও পাবে। তারা যে আড়তদার।
যত সমস্যা হয়েছে তা এই আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলোকে নিয়ে। বাইরে এত জোড়ে বৃষ্টি পড়ছে যে আমাদের আত্মা শুকিয়ে শুকনো কাঠ হয়ে যাচ্ছে। এত বৃষ্টি পড়ছে যদিও স্থির হয়ে থাকতে পারছিনা। শুধুই ভয় হচ্ছে এই উপরের ছাউনিটা কখন যেন উড়ে না যায়। যাবে না তার ভরসা দিতে পারছিনা।
সকাল দশটা। বসে আছি বারান্দার পাশে রাখা চেয়ারটাতে। আর সামনে থেকে যতদূর দেখা যায় এটা কুয়াশামাখা বর্ষা। বিদ্যুৎও হার মানবে এমন মনে হচ্ছে। এই ঝমঝম শব্দটা একনাগাড়ে কানে বেজেই যাচ্ছে। অভ্যাস হয়ে গেছে তাই প্যানপ্যানে মনে হচ্ছে না। বেশ বৃষ্টি দিয়েছে মেঘের দল। একেবারে মনেপ্রাণে ঢেলে। মেঘের মন যতই বড় হোক তা নিতে আমাদের মাথায় গানের গুলি হয়ে পড়ছে। আজ রবিবার। ছুটি বার। ছুটির দিন হলেও কি হবে ছোটাছুটি করার সুযোগ তো আর নেই। কাগজওয়ালা খুব সকালে যখন বৃষ্টি ছিল না আরকি তখন খবরের কাগজ দিয়ে গিয়েছিল। মেঘের কি মহিমা! ভোরটা ওই কাগজবিক্রেতাদের জন্যই বরাদ্দ রেখেছে। ডিউটি যাকে বলে, তাই মেঘেদের প্রতি একটু শ্রদ্ধাও জাগলো। মনে মনে মেঘেদের একটা ‘ধন্যবাদ’ জানালাম। পেয়ালা হাতে চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে গিন্নি এল। চেয়ারের পাশে চায়ের ভাড় এগিয়ে দিয়ে বলল,
” কিগো, চা টা ধরো।” আসলে ঘরে বসে পরের খবর জানতে পারছি তো, তাই চায়ের দিকে পা বাড়াতে একটু দেরি হয়ে গেল।
” দাও , দাও কই।” এরকম একটু তোতলানো ভাবে কথা দুটো বেরিয়ে গেল।
গিন্নি বলল, তা বাজার ঘাট কিছু করে আনো। নইলে যে আলু সিদ্ধ ছাড়া গতি নেই। বাজার ঘাট কিচ্ছুটি নেই। পারি না বাবা, এভাবে কি আর সংসার চলে?’ বলে রান্নাঘরে চলে গেলে নিরাশ হয়ে। আমি বুঝতে পারলাম যে অবস্থা খুব ক্রাইসিস। সব ভাড়ার শূন্য। কী আর করা যায় বলুন তো? চায়ে চুমুক দিতেই মনটা নিরাশ হয়ে গেল একেবারে। এটা চা? নাকি চায়ের ঠাকুরদা? না চায়ের মত কিছু? ছ্যাঃ ছ্যাঃ , না আছে চায়ের স্বাদ না আছে জলের স্বাদ।
“কি গো,চিনিও নেই ঘরে?”
রান্নাঘর থেকে উত্তর এল, চিনি তো নেই। এরপর জলও পাবে না।’ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম, না না জলের চিন্তা করোনা গিন্নি। যত জল চাইবে, তত জল পাইবে।” আমার এই কথা শুনে রান্নাঘর থেকে শব্দ দূষণ শুরু হতে লাগল। জানি যে আমি একটু আধটু ঠাট্টা করতে ভালোবাসি। এই সময়ে বোধহয় ঠাট্টা করাটা ঠিক হয় নি। না এখনও আমার শিক্ষা হল না। যখন ছোট ছিলাম তখনও এই অসুখের একটা বাড়াবাড়ি ব্যপার ছিল। এখন কিছুটা কমেছে লোকজন বলে। কিন্তু আজ কি একটু বেশি হয়ে গেল নাকি? যাই হোক আমার এই মুখখানা যেন গিন্নি কোনোভাবেই দর্শন করতে না পারে তাই আড়ালে থাকার জন্য কাগজাটাকে মুখোশ করে আঁকড়ে থাকলাম। কে জানে কখন কী বলে বসে। আর রান্না ঘরের দিকে উঁকি মেরে দেখারও সাহস হল না। বুকটা ধরফর করে উঠছে এমনিতেই এই ঘ্যানঘেনে বৃষ্টির আওয়াজে। না বাবা আর চাই না আমার বিপি বেড়ে যাক। তাই চুপ করে চুপটি করে থাকাই ভদ্র লোকের কাজ।
কাগজের ভেতর মুখ দিয়ে থাকতে থাকতে একটা নেশা ধরে গেল। কাগজটাতে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম সঙ্গে পড়তেও। খবরগুলো একটু তোমাদের জানাই। “গভীর বন্যায় নয়া পাড়ার অবস্থা পুরোনো”,
“এক রাতের ঝড়ে সবাই অনাহারে”, “আজ সারাদিন হালকা বৃষ্টি আর ভারী বৃষ্টি দুটোই হওয়ার সম্ভাবনা আছে”। এরকম আরো কত রকম খবর আছে। নেই কাজ তো খই ভাজ। না খই ভাজার জন্যে যা দরকার তা এখন আমার কাছে নেই। তাই খবর পড়ি গল্প করি। অবশ্য অনেকটা সময় কেটে যায় এই একখানা খবরের কাগজ পড়েই।
কোথায় কি হচ্ছে, কেউ মাথা গোঁজার ঠাঁই পাচ্ছে না। কেউ বৃষ্টিকে নিয়ে কাব্য বানাচ্ছে। কত নদী ডুবে গেছে। রাস্তানদী মিশে গেছে একসাথে। এখন সবাই বন্ধু। অবাক হই কখন যেনো সেদিকে তাকিয়ে থাকতে হারিয়ে যাই। দুঃখিত! ট্রেনের ছবিটা দেখে একটু ইমোশনাল হয়ে গেছি। চায়ের কাপটা অনেক আগেই রেখে দিয়েছি। ইতিমধ্যে পিঁপড়ের দল এসে বসেছে কাপটাতে। খবরের কাগজের শেষ পাতাটা এলেই একটা দুরু দুরু মোহ জেগে ওঠে মনে। আজ বিশেষ করে। লটারির ফলাফল যে ছাপানো হবে। নিয়মমাফিক প্রতি সপ্তাহের মতো খবরের কাগজের শেষ পাতায় বড়ো বড়ো করে লটারির ফলাফল ছাপিয়েছে। একটা বাক্সের ভেতর বিজয়ী নম্বর গুলো তুলে দেওয়া আছে। এই ঘরটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারে কাগজটা রেখে ঘরে গেলাম। বই রাখার টেবিলে গিয়ে ‘পথের পাঁচালী’র ভেতর থেকে গতকালের কাটা লটারিটা বের করলাম। তাকে প্রেমিকার মতো দুবার চুমু দিয়ে কপালে ঠেকিয়ে ‘ জয় বাবা লোকনাথ’ বলে বাইরে এলাম। কেন যেন মনে হচ্ছিল আজকে এই লটারিটা খেলেছে। এই খেলেছে। লটারির প্রথম পুরস্কার দশ হাজার টাকা। দ্বিতীয় পাঁচ হাজার টাকা আর তৃতীয় পুরস্কার তিন হাজার টাকা। লটারির পুরস্কার দেখে আবার হাসবেন না যেন। এ লটারি আমাদের এখানে প্রতি সপ্তাহে খেলা হয়। সারা সপ্তাহ ধরে লটারি বিক্রি করার পর রবিবার করে ফলাফল ঘোষণা আর পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
জীবনে কাটা আমার প্রথম লটারির নম্বর মেলাতে শুরু করলাম। শেষ থেকে শুরু করেছি। অবশেষে ম্যাজিকের মতো মিলে গেল আমার লটারির নাম্বার। সিক্স ফোর টু ওয়ান ফোর। আমার লটারির নাম্বার। আপনিও কী কেটেছেন? নাম্বারটা একটু জানাবেন পারলে।
প্রথম পুরষ্কার দশ হাজার টাকা লেগেছে! এত উৎসাহ নিয়ে গিন্নিকে ডাকলাম যে সে চমকে উঠে দৌড়ে এল। কী হল, কী হল? কিছু হলো নাকি? ভূতটুত দেখলে নাকি?’ আমার যে ভূতে ভয় হয় তা বলে সবার সামনে এভাবে বলতে হয়? একটু ইনসাল্ট না করলেই কী হতো না? মুখে তবু হাসিটা নিয়ে বললাম, ” না গো ভুত দেখিনি। কিন্তু তোমার ভয় পাওয়া জন্য এই সংবাদটা যথেষ্ট।”
-কী? কী? কী হল? বলো। বলো।
– হ্যাঁ। ওই বলব বলেই তো ডাকা নাকি। আমার লটারি লেগেছে। দওশ হাজার টাকা।’ এই কথাটা শুনে যেন ঘেমে যেতে লাগল সে। দশ হাজার টাকার কথা শুনে গিন্নির মুখটা দেখে মনে হল, সে যেন সোনার প্রাসাদে সোনার ভাত খাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর গিন্নি নিজেকে সামলে নিয়ে একটু শান্ত হয়ে বলল, থাম থাম। এবার একটু শোরটা থামাও। লোকজন শুনলে ভালো চোখে দেখবে না। সুধীররা শুনলে হিংসে করবে।
– এই বৃষ্টিতে কেউ কিছু শুনতে পাবেনা। তুমি লোকের ভয় করোনা।
– দেয়ালের যদি কান থাকে জলেরও তবে কান আছে। তাই বলছি কি পাঁচ জন শোনার আগে একটু থাম।’
এমনিতেও লোক শুনবে। তাই তাঁর এই কথা শুনে একটু থামলাম। তারপর একেবারেই একটা অন্য মানুষে পরিবর্তন হলাম। আমি কখনো কখনো অন্য মানুষে পাল্টে যেতে পারি তা কিন্তু বলে রাখি। এরপর গিন্নিকে অন্য মানুষ ভেবে মনের যত ক্ষোভ উগড়ে দিলাম।
– মানুষ? মানুষ তো সে যে নিজের দিকে হুশ রাখে। মানুষ তো সে যে নিজের কাজটা মন দিয়ে করে। অন্যের কাজে বাধা দেয় না। যে অপরের দুঃখে হাসে সে মানুষ নয়। যে অন্যদের নিয়ে পিএনপিসি করে তাদের বিষ খেয়ে মরা উচিত। মানুষ কি বলছে না বলছে তাতে মাথা না ঘামিয়ে চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো তাতে তোমার শরীর ভালো থাকবে। পাঁচ জনকে নিয়ে আসর বানিয়ে লোক নিন্দা করলে কি আর মরলে কি। দেখো লোকে কি বলে বলুক, তাতে কান দেওয়া আর মুর্খামি করা দুটোই এক।” আমি হাঁফাতে লাগলাম। অনেকটা জ্ঞান বা ডায়লগ ঝাড়ার পর নিজেকে নিজের কাছে খানিকটা লজ্জা বোধ হতে লাগল। যাইহোক অনেকটা জ্ঞান লাভ করে গিন্নি বলে উঠলো, আচ্ছা সবই তো বুঝলাম। তা বললাম লটারির পুরস্কার কখন দেবে?’ ঠিকই তো এ নিয়ে তো ভাবিনি। এই কথা শোনার পর কৌতুহলটা যেন আরও খানিকটা বেড়ে গেল। হাতটা আবার চুলকোতে লাগল। লটারি লাগলে কি এমন হয়? একটু ব্যস্ত হয়ে খবরের কাগজের শেষ পাতাটায় উৎসুক হয়ে দেখলাম। লটারির বিজয়ীদের পুরস্কার দেয়া হবে এই বিজ্ঞাপন ছাপার এক ঘন্টা পর থেকে। স্থান- রথডাঙার মাঠের তমাল বিশ্বাসের লটারি কাউন্টার। তাহলে এতক্ষণে পুরষ্কার দেয়া শুরু হয়ে গেছে। দোকানে গিয়ে সেই পুরস্কার নিতে হবে বিজয়ীকে। উক্ত লটারি সঙ্গে রাখতে হবে। গিন্নিকে বললাম, ম্যায় এই যাব আর এই পুরস্কার লিয়ে আয়েগা।” গিন্নি তো আনন্দে আধখানা।
কিন্তু এই বৃষ্টিতে বেরবে কীভাবে?”
“কেন ছাতা নিয়ে।”
গিন্নি ঘর থেকে ছাতাটা নিয়ে এসে হাতে ধরিয়ে দিল।
প্রথম কাটা লটারির প্রথম পুরস্কার পাওয়ার আনন্দে মনটা একেবারে উরুউরু করছে। আহা আমার ভাগ্য যে এত ভালো তা তো আমি জানতাম না। এক হাতে ছাতা অপর হাতে লটারিটা নিয়ে উঠোনে নামলাম। আঙুল চেপে চেপে এক দু পা এগোচ্ছি। পিছনে গিন্নি “দুগ্গা দুগ্গা” বলে দুগ্গাকে স্মরণ করল বুঝতে পারলাম। এমন সময় দুগ্গা সত্যিই চলে এল। পা পিছলে গেল আমার। আমি পড়লাম জলে। সাদা পাঞ্জাবিটা কাদা হয়ে গেল। ছাতাটা উল্টে গেল। তার উপর জল পড়ে দীঘি ভরতে লাগল। হাতের লটারিটা দেখলাম জলে ডুবে সাঁতার কাটছে। আমার কোমরের যে এতক্ষণে তেরোটা বেজে গেছে বুঝলাম। গিন্নি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। যেন একটা স্ট্যচু দাঁড়িয়ে আছে। আমিও পিছন ফিরে গিন্নির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বৃষ্টি আরো বাড়ল। আমার লটারির টাকা পাওয়া হল না আর।
লটারি ছোটগল্প – সমাপ্তি
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
বাংলার রূপের সাত সতেরো
সাগর দেখার স্বপ্ন
বসন্ত ফেরে