কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » সায়েন্স ফিকশন গল্প » প্রাণ প্রতিষ্ঠা

প্রাণ প্রতিষ্ঠা

প্রাণ প্রতিষ্ঠা সায়েন্স ফিকশন গল্প – কল্যাণ সেনগুপ্ত

রাতের পোশাক পরে শুতে যাবার সময় ফুল বললে ” মা একটা কথা বলব?
ঘুমোতে যাবার সময় তোমার যত বাহানা। বিরক্তি নিয়ে ফুলের বালিশটা ঠিক করে দিতে দিতে অনন্যা বললে ” বল। কি বলবে ? ওই এক কথা , ঠামির সাথে শুই “? রোজ রোজ তোমার এক বায়না।
একটু থেমে বললে ” না ঠামির রাত্রে ঘুম টা খুব দরকার ।তাই ঠামি একা নীচে শোয়”।
“ঠামি গল্প শোনাবে বলেছে”।
অনন্যা বললে “তুমি তো খুব লক্ষ্মী মেয়ে। পিঠে হাত বুলিয়ে বলে ” ঠামির শরীর খারাপ হোক তুমি নিশ্চই চাও না’?
“না”
“ঠামি সারাদিন কত কাজ করেন। তোমার ঘুম থেকে ওঠা থেকে সব করিয়ে তো উনি তোমায় স্কুলে পাঠান । ঠিক কিনা”?
“হ্যা”।
“বয়েস হয়েছে ওনার। তাই বিশ্রাম তো দরকার।
ঠামির গল্প আমার খুব ভালো লাগে।
ঠিক আছে সেটা দুপুরে শুনো। এখন ঘুমিয়ে পড়। আমি গল্প বলছি।
গল্প শুনলে কি হয়? বায়না চলতেই থাকে।
পরিত্রাণ পেতে বলে ” আসলে ঠামির ঘুমের ওষুধ খেতে হয় খাবার আগে। যদি তোমায় গল্প বললে ঘুম না আসে তাহলে রাত জেগে শরীর খারাপ হবে। তুমি ই বল কি চাও?
ফুল চোখ বোজে।

উদীপ্তর মা নিরুপমা দেবী র কাজ কিছু কম নয়। বউ অনন্যা সকাল সকাল রেডি হয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যায়। মেয়ে ফুল কে ঘুম থেকে ওর ঠামিই তোলে। উদীপ্ত ও মেয়ের সাথে বের হয়। সকাল থেকে নাতনি কে ঠেলে তুলে ব্রাশ করানো, সকালের দুধ, ব্রেড, এগ , বেকড বিনস রান্নাঘরে গিয়ে তৈরি করা । খাওয়া তৈরি করা নাতনি কে জামাকাপড় পড়ানো, জুতো পড়ানো। ঘুম থেকে রোজ কি উঠতে চায় ?
নাতনি ও ছেলে বেরিয়ে গেলে একগাদা কাজ এসে পড়ে নিরুপমা দেবীর। গাছে জল দেওয়া, ঘাস পাতা পরিস্কার করা । দুতলা বাংলোর ফ্লোর পরিস্কার করা ।জামা কাপড় মেশিনে এ ধোয়া ।
মাঝে মাঝে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসে। এই বয়সেও দুপুরে ঘুমোন না নিরুপমা দেবী।
নাতনি র বাস আসতে আসতে বিকেল। সব কাজ শেষ হলে বারান্দায় এসে বসে থাকেন। প্রথম আসবে নাতনি, তারপর বৌমা ।শেষে ছেলে উদীপ্ত। নাতনি ফিরে এলেই নীচে নামেন ।
আগে বাবা বেঁচে থাকতে উদীপ্ত প্রতিবছর নিয়ম করে দিন কুড়ি পঁচিশের জন্যে দেশে গ্রামের বাড়িতে যেত। বাবা চলে যাবার পর কতবার নিয়ে আসতে চেয়েছে মা কে কিন্তু পারেনি। নানা অজুহাত ছিল। তুলসি তলায় কে জল দেবে? গরুর খাবার তৈরি কে করবে? রোজ প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরের জন্যে ফুল তোলা, পুজো করা , রাত্রে শয়ান দেওয়া কে করবে ? ফুল গ্রামের বাড়ি গেলে আসতে ফিরে আস্তে চায় না। ও ঠামি কে ছাড়বে না। ঠামি ও তাই। তবু চাকরির জন্যে ফিরে আসতেই হয় আমেরিকা। ঠামির কল থেকে ছিনিয়ে নিতে খারাপ লাগে তবু করতে হয়।

উদীপ্ত র পাড়ায় তিনটে বাড়ি পড়ে থাকে ফুলের স্কুলের বন্ধু জেমস। প্লে স্কুলের একই ক্লাস ।দুজনের বন্ধুত্বে র খাতিরে ফুল মাঝে মাঝে খেলতে যায় জেমসের বাড়ি । আগে ফোন করে ওর মা বাবার সঙ্গে কথা বলে নিয়ে যায় ফুল কে। জেমসও আসে মাঝে মাঝে। বাড়ির পিছনের উঠোনে ব্যাট, বল ,পুতুল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। জেমস এর এক নানি আছে। মাঝে এসে থাকে জেমস এর বাড়ি। নানি এলে জেমস আর আসতে চায় না। তখন নানি স্নান করিয়ে দেবে, খাইয়ে দেবে ,স্টোরি বলবে ,ঘুম পাড়িয়ে দেবে। খালি নানির গল্প বলবে।
ফুল মাঝে মাঝে নিজে নিজে তুলনা করে নিজের ঠামির সঙ্গে। কখনো এসে বলে জানো উল90ল জেমস কে আজ বকেছে ওর নানি। উনি খুব রাগী।একদিন বললে জানো জেমস এর দুহাত ধরে ঝাঁকাচ্ছিল ও ফুলগাছ ভেঙে দিয়েছে বলে।
নিরুপমা দেবী বলেন ” ফুল , গাছের তো প্রাণ আছে। তাই গাছ ভেঙে গেলে ওদের তো লাগে । তাই উনি বলেছেন, হয়ত ও শুনছে না বলে হাত ধরে ঝাঁকানি দিয়েছেন । ওটা জেমস কে শেখানোর জন্যে।
ফুল ঠামি কে জড়িয়ে ধরে। তুমি ই সবচেয়ে ভালো । তুমি বকো না। মানা করো না।
নিরুপমা দেবী হাসেন।

কিছুদিন ধরে ফুল প্রায়ই জেমস এর বাড়ি যায় খেলতে। মাঝে মাঝে পড়তে বসে জিজ্ঞাসা করে ” বাবা জেমস এর নানি জানো মাঝে মাঝে কথা না শুনলে গজগজ করে বকে । একদিন তো পিঠে একটা চাপড় বসিয়ে দিয়েছিল।
কারণ ?
ও বড় রাস্তায় চলে গিয়েছিল।
আশ্বস্ত হয় উদীপ্ত, “তাহলে তো ঠিকই করেছে”।
“বাবা আমার ঠামি কিন্তু কখনো বকে না”।
“তোমার দিদা কত ভালো বল?”
“সত্যি ঠামি খুব ভালো । শুধু আদর করে । বকে না । বুঝিয়ে বলে নরম করে” ।
“সেটাই ভালো না “?
“হ্যা বাবা আমার ঠামি বেস্ট”।
“কিন্তু কেন বাবা আমার ঠামি শুধু পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় আর কিছু করে না। কখনো কেন বকে না জেমসের নানির মত”?
“হ্যা সেটা ঠিক।
কখনো মানা করে না।বকে না। কেমন এরকম বাবা?
আমি বলে দিয়েছি তোমায় না বকতে।
তাইকি শুধু ই আদর করে ?
হ্যা বাবা।
রাত্রে শুতে গিয়ে একদিন ফুল বললে ” মা, জেমস এর নানি এত চিৎকার করে , দুমদুম করে হাঁটে , এই বকা দিচ্ছে , এই জড়িয়ে ধরছে। রেগে গেলে বকে তারপর চেপে ধরে চোখের জল ফেলছিল।
অনন্যা মাথার বালিশ ঠিক করতে করতে বললে ” ভালই তো।
আমার ঠামি তো তেমন নয়।
অনন্যা সতর্ক হয়” কেন তোমার ঠামি তো ভালো ফুল। সবাই তো সমান হয় না।
কেন বকে না মা?
অনন্যা থতমত খেয়ে কথা ঘোরায় ” ঠিক আছে আমি মা কে বলে দেব তোমায় যেন বকে । তাহলেতো ঠিক আছে?
ফুল হেসে চুপ করে যায়।

দুদিন বাদে অনন্যা বললে উদীপ্ত কে ” দেখো , ফুল আজকাল জেমস দের বাড়ি খালি যেতে চাইছে। তোমার মায়ের কাছে কেমন দায়সারা ভাবে রোজকার স্নান, খাওয়া করছে। মায়ের সাথে কথা বলতে চায় না। সুযোগ পেলেই ওদের বাড়ি যাবার বায়না করছে। মনেহয় ওর কিছু অসুবিধা হচ্ছে মা কে নিয়ে। ওরা শিশু ওরা উষ্ণতা টা বেশি বোঝে। মায়ের কাছে
বোধহয় সেটার অভাব হচ্ছে।
উদীপ্ত উদাস স্বরে বলে ” মায়ের সাথে আমার সারাদিন তেমন কথাই হত না। রাত্রে বা দুপুরে বিছানায় শুয়ে অনেক কথা হত। গল্প হত।

অনন্যার ফোনটা এল অফিসে মিটিং চলা কালীন। “তুমি কি বলছ? মা কোথায় ছিল? নিজের কাছেই গলার স্বর অচেনা লাগে। অনন্যা হাঁপাতে হাঁপাতে বললে ” সব বলব । পারলে এখুনি চলে এস মেডিক্যাল সেন্টার এ। অফিসে অনন্যার ফোনে ফুলের আঘাতের খবর পেয়ে কি বসে থাকা যায়? উদীপ্ত হন্তদন্ত হয়ে পৌঁছে দেখলে ফুল কে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনন্যা পায়চারি করছিল উদীপ্ত কে দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। কি হয়েছে একটু বলবে ?
অনন্যা নীচু গলায় উত্তেজনা চেপে বললে ” আমাকে ফোন করেন পাশের বাড়ির মিস্টার মরিসন। জেমস আর ফুল বল নিয়ে খেলছিল।
তারপর?
বলটা পাশের কম্পাউন্ড এ পড়ে যায়। ফুল বেড়ার পাঁচিল এ উঠে ওদিকে নেমে বল আনতে লাফ দিয়েছিল কিন্তু ওনাদের উঁচু নীচু জায়গায় বেকায়দায় পড়ে পা মুচকে যায়। উঠতে গিয়ে দেখে উঠতে পারছে না। জেমস মিসেস মরিসন কে ডাকে। উনি ই কোলে তুলে নিয়ে গিয়েছেন গাড়ি চালিয়ে।
মা? মা কি করছিল? আরো উদ্বিগ্ন হয় উদীপ্ত।
মিস্টার মরিসন তোমার মা কে ডাকেন। উনি এসে ছিলেন । তেমন উদ্বিগ্ন ছিলেন না। ফ্রিজ থেকে বরফ এনে দিয়েছিলেন। আর পিঠে হাত বুলাচ্ছিলেন বার বার। খালি বলছিলেন ” ঠিক হয়ে যাবে সোনা। ঠিক হয়ে যাবে। মিস্টার মরিসন তোমার মায়ের নিরুদ্বিগ্ন দ্বিধাগ্রস্ত মুখ দেখে জিজ্ঞাসা ও করেছিলেন ” ম্যাডাম আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন? তাহলে আমি ই নিয়ে যাচ্ছি ফুল কে মেডিক্যাল সেন্টার এ।
অনন্যা বললে ” কি করি বলত? ব্যাপারটা আশ্চর্যের না?
ফুলের কি হল শেষে?
চিন্তা কর না । ডাক্তার এক্সরে করে বলেছেন ডিসলোকেশন হয়েছে। অপারেশন টেবিলে নিয়ে সেট করে ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ করে দেবে। চিন্তার তেমন কিছু নেই।
উদীপ্ত হাঁফ ছাড়ে। কিন্তু মা ?মাথা চুলকাতে থাকে মা এমন কেন ?
অনন্যা বলে বোঝনি ?
সহসা মনে পড়ে । বলে ” ঠিক , বুঝলে আমি বড় হয়ে যাবার পর সেরকম ভাবে চোট পাইনি।
তাতে কি?
বুঝলে না? আমার শেষ দশ বছরের রেকর্ডিংয়ে এরকম কোনো ডাটা নেই।

বেশ চলছিল গ্রামে ওনার একা একা থাকা । দুদিনের জ্বর শ্যামলী দেবী কে এ দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিল। খবর পেয়ে ছেলে এল।
কাজ শেষ করে আমেরিকায় ফিরে বহুদিন মন খারাপের ধোঁয়া ঘিরে ছিল। কাজে কর্মে ভুল হত। ফুল কে কিছু বলেনি ঠামির চলে যাওয়ার কথা। সবচেয়ে বড় কথা ফুল খালি জিজ্ঞাসা করত ঠামির কথা। ” নিজের খেলা থামলেই বাবা কে প্রশ্ন ” ঠামি এখন কি করছে বাবা? ঠামি কখন ঘুমোয়? কখন পুজো করে , ফুল তোলে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খালি জিজ্ঞেস করে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। তখনই মাথায় আসে পুরনো ভিডিও রেকর্ডিং কে কাজে লাগানোর।

শেষ দশ বছরের আদর আর প্রশ্রয় টাই কুড়িয়ে রেকর্ড করে এনে মার মত দেখতে রোবোট এ ভরে দিয়েছে। মা ফুলের মত পড়ে গিয়ে এমন চোট পাওয়া দেখেনি। ছোট বেলায় বকুনিগুলোর মধ্যে যে হৃদয় ভরা ভালোবাসা লুকিয়ে থাকত সেটা তো রেকর্ডিং ইনপুট দিতে পারেনি। এখানে মায়ের স্থায়ী আসার পর প্রথম প্রথম ও মা কে দেখে ভালই লাগত। ঘুরে বেড়াচ্ছে, বসছে, কথা বলছে। কত কাজ করে দিচ্ছে বাড়ির। কিছুদিন যাওয়ার পর দেখা গেল মায়ের অনেককিছু নেই। মায়ের শাড়িতে ,গায়ের গন্ধ লেগে থাকত সেটা নেই। মার সঙ্গে কথা বললেই মুহূর্তে উদ্বেগ, ভয় উধাও হত কিন্তু এখন সেটা পাওয়া যায় না। এখন আর সেই তথ্য দেওয়াও যাবে না। জেমস এর নানি বকে, শাসন করে চোখ পাকিয়ে আবার টেনেও নেয় বুকে । জেমসের নানি আসল রক্ত মাংসের নানি ।
মায়ের রোবট শুধু আদর ই দিতে পারে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে পারে। খাইয়ে দিতে পারে। জামা কাপড় পরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয় না। মুখ টেনে চুল আঁচড়ে দেয় না। দেয় না কারণ ডাটা ব্যাংক এ নেই। বড় অসহায় লাগল উদিপ্তর। বুক জুড়ে অতৃপ্তির হাহাকার ছেয়ে গেল। পুরোপুরি প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল না । মা কে ফিরে পাওয়া গেল না। মার মডেল কে কি ফেরত দিয়ে আসবে ওয়ার্কশপে? এর পরের জেনারেশন হয়ত এই খুঁত টুকু ঢেকে দেবে তাদের মায়ের ,বাবার ভিডিওগুলো নিজেদের ছোট বেলা থেকেই তুলে রাখবে।

প্রাণ প্রতিষ্ঠা সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!