কুমায়ুন পর্বতের উপত্যকা ভ্রমন কাহিনী – সুমিতা নন্দী দে
আরো একবার পাহাড়ের টানে বেরিয়ে পড়লাম আমি মা, বাবা ও দিদির সঙ্গে ২০২১ সালের ২৩ শে এপ্রিল শনিবার। আমাদের ট্রেন ছিল হাওড়া স্টেশন থেকে ৯:৪৫ মিনিটে বাঘ এক্সপ্রেস, যাবে কাঠগোদাম পর্যন্ত। আর আমরা কাঠগোদামেই নামবো।ট্রেন লেট ছিল না বলে, ৯:৫০ মিনিটে প্রায় ঠিকঠাকই পৌছালাম। স্টেশনের পাশে থাকা গাড়ি গুলোর মধ্যে একটা গাড়ি বুক করে আলমোরার দিকে এগিয়ে গেলাম।
আলমোরা যাবার দিকে যতো এগোচ্ছি, রাস্তায় পড়ছে পাহাড়ি বাঁক, আর দুপাশে ছোট ছোট পাহাড় আর তৃণভূমি। গাড়ির জানলার পাশে এরম দৃশ্য দেখতে দেখতে মনটা বারবারই হারিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কিছু পথ যাবার পর প্রথমেই পড়ল “ভীমতাল লেক”। আমরা সেখানে কিছুক্ষনের জন্য নামলাম। সেই লেকের পাশে কিছু সময় কাটালাম, তারপর আবার সেখান থেকে আমাদের গাড়ি এগিয়ে যেতে লাগলো, পড়ল মাঝেরা, এখানে পাহাড়ি নদী আছে, তার স্রোত খুবই কম , আমরা এখানে নেবে সেই জলে একটু পা, হাত ভিজিয়ে নিলাম। তারপর আবার এগিয়ে গেলাম এই জায়গার নাম লোধিয়া। সেখানে একটা ঝুলন্ত সেতু দেখলাম, পাহাড়ি নদীর ওপর দিয়ে তৈরি। অবশেষে আমরা আমাদের হোটেল মিলাম ইননে এসে পৌছালাম, তখন বেলা ২ টোর কাছাকাছি। সেখানে সবাই স্নান সেরে, খেলাম। শরীর ক্লান্ত থাকায় কোথায়ও বেরোলাম না, তাই হোটেলের বারান্দায় বসে বসে সূর্যাস্ত দেখলাম।
দ্বিতীয় দিন –
খুব সকালে উঠে স্নান সেরে জলখাবার খেয়েনিলাম, আজ আমরা চৌকারি যাবো। হোটেল থেকেই গাড়ি বুকের ব্যবস্থা থাকায়, আমরা দেরি না করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলাম। যাবার পথে পড়ল সেরাঘাট। সেখানে বেশখানিকটা সময় কাটালাম। তারপর গেলাম চৌকারিতে আমাদের হোটেল ওজাস্বী রিসোর্ট। সেখানে গিয়ে সকালের জলখাবার খেলাম, তারপর গেলাম চৌকারী থেকে পাতাল ভুবনেশ্বরে। ৯০ ফুট নিচে অবস্থিত, তবে এখানে সিঁড়ি আছে সেখান দিয়ে নিচে নেমে গেলে পাতাল ভুবনেশ্বরের দর্শন পাওয়া যাবে। এখানে এলেই নাকি চার ধাম যাত্রা করার মত পুণ্য ফল পাওয়া যায়। তারপর আমরা সবাই মন্দিরের গভীরে ও বাইরের চারপাশ ঘুরে বেড়ালাম। স্নিগ্ধ পাহাড়, আর আবহাওয়া খুব মনোরম চোখ জুড়ানো শান্ত পরিবেশ। কখন যে অনেকটা সময় কেটে গেলো বোঝা গেলো না। তারপর আমরা রাস্তার পাশে থাকা ধাবায় দুপুরের খাবার খেলাম। রাত্রিবাস ঐ হোটেলেই
করেছিলাম।
তৃতীয় দিন –
কুমায়ুন পর্বতের ঢালে আরো একটি সুন্দর গ্রাম হলো এই মুন্সিয়ারি। হোটেল থেকে মুন্সিয়ারির দূরত্ব প্রায় চার ঘণ্টা। তাই আমরা সকাল আটটার মধ্যেই বেড়িয়ে গেলাম। যাবার পথে পড়ল একটা সুন্দর ঝর্না, নাম বীথি ফলস। সেই ঝর্নার জল যখন নিচের পাথরে পড়ছে সেই জলের বাষ্পে রামধনুর রং চোখে পড়ছে। এই দৃশ্য কিছুক্ষন উপভোগ করলাম, কারণ আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে। এছাড়াও আরো দুবার রাস্তার মাঝে গাড়ি থামিয়েছি, আমাদের হোটেল বালা প্যারাডাইস এ যখন পৌঁচ্ছালাম তখন ১: ৩০ এর কাছাকাছি।এখানে এসে স্নান করে লাঞ্চ করলাম। তারপর একটু রেস্ট নিয়ে মুন্সিয়ারি মার্কেটে গেলাম, সেখানে নানান ধরনের দেখবার জিনিস আছে। আমরা কিছু কেনাকাটাও করলাম। ফিরে এসে শরীর ক্লান্ত থাকায় তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
চতুর্থ দিন –
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। ঘড়িতে ৫:০০ বাজে, আমরা উঠে পড়লাম সূর্যোদয় দেখবো বলে। সূর্যোদয় দেখার পর আমরা চা, জলখাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম নন্দাদেবী দর্শনে, হোটেল থেকে পায়ে হাঁটা পথ প্রায় ৩৫-৪০মিনিট। অপূর্ব সুন্দর সেই স্থান, সূর্যের আলোয় ঝলমলে চারিপাশ, খুবই সুন্দর। আমরা মন্দিরে ঘণ্টা বাজিয়ে প্রবেশ করলাম। কিছু সময় কাটিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম খালিয়া টপে যেখান থেকে পঞ্চচুল্লি দেখা যায়। আমরা একটি গাড়ি ভাড়া করে সেখানে গেলাম, অনেকটা রাস্তা বলে। ট্রেক করার ইচ্ছা থাকলে এই ইচ্ছা অল্প হলেও পূর্ণ হবে খালিয়া টপে ওঠার সময়। কারণ ট্রেক স্টিক দুহাতে নিয়ে উঠতে হবে চরাই উৎরাই পথে। আমাদের প্রায় ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট হাঁটার পর খালিয়া টপে এসে পৌঁছেছিলাম, একজন গাইডকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম । তারপরই দেখা মিলল বরফের আবরণে ঢাকা পঞ্চচুল্লি পর্বত। এটা দেখার পর সব ক্লান্তি একনিমেশে চলে গেলো। তারপর আমরা আমাদের হোটেলে ফিরে আসি, আর সেখানেই রাত্রিবাস করি।
পঞ্চম দিন-
সকাল ৭:৩০ মিনিটে হোটেল থেকে শুধু চা খেয়েই আমরা বেড়িয়ে পরি কৌশানির উদ্দেশ্যে। আমরা রামগঙ্গা নদীর পাড় ধরে এগিয়ে গেলাম বাঘেশ্বের মন্দিরে। সরযূ আর গোমতী নদীর সংযোগ্থলে অবস্থিত এই বাঘেশ্বর শহর। এখানে পৌষমাসের শেষে মেলা হয়। তারপর সেখান থেকে আমরা বৈজনাথ মন্দিরে গেলাম। এখানে ছোট বড় মিলে ১৮ টি মন্দির আছে। তবে সব মন্দিরের মধ্যে প্রধান হলো হর – গৌরীর মন্দির। এরপর আমরা বিকেলবেলায় গান্ধীজির অনাসক্তি আশ্রমে আসি, এখানে গান্ধীজি এসেছিলেন, ওনার কিছু ক্রিয়াকর্ম এখানে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ষষ্ট দিন –
কৌশানি থেকে আমরা খুব সকালে বেরিয়ে গেলাম “সিটি অফ লেক” নৈনিতালে। নৈনিতালে এসে আমরা প্রথমে নয়নাদেবীর মন্দিরে, তারপর লেকের জলে বোটিং করলাম, লেকের জলে হিমেল বাতাসে শরীর মন ভরে গেলো, সে এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। তারপর হোটেলে ফিরে এলাম। বিকেলবেলায় জিম করবেটের বাড়ি গেলাম, সেখানে চারপাশে গাছের জঙ্গল, বেশ শান্ত নিরিবিলি। ওখান থেকে কেভ গার্ডেনে ঘুরে এলাম, এখানে নানান পশুর নামে বিভিন্ন কেভ গুলো আছে, আর তাদের ডাকগুলো মিউজিকে বাজছে। পরে ফিরে এসে সেই হোটেলেই রাতে থাকি।
আজ বাড়ি ফেরার দিন, সবার মনটা একটু হলেও ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। আমরা নৈনিতাল থেকে ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ বেরোলাম কাঠগোদামে, ওখান থেকেই হাওড়া যাবার ট্রেন ছিল ৯:৫০ মিনিটে। তারপর আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।
কুমায়ুন পর্বতের উপত্যকা ভ্রমন কাহিনী – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
অদৃশ্য সৈকত চাঁদিপুর
পরবাসী টুসুর দেশে
ভরুয়া