কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪৩১ » গল্প বলেন জ্যাঠামশাই

গল্প বলেন জ্যাঠামশাই

গল্প বলেন জ্যাঠামশাই অলৌকিক গল্প – নিনিয়া সুকথা

গুড়গুড়িয়ে বাজ পড়ছে আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আর তারই মধ্যে এই মধুগড়ের মেসে আটকা পড়ে আছি শুধু আমি আর শ্রীযুক্ত অপরেশ লাহিড়ী ওরফে জ্যাঠাবাবু।

শুনেছি আমাদের এই মেসের ই এক বাসিন্দা শ্রীযুক্ত অরিঞ্জয় মৈত্র ওরফে ভন্ডুলদা’র কেমন একটা সম্পর্কে জ্যাঠা হন ইনি। তাই মেসশুদ্ধু সবাই যে তাঁকে জ্যাঠাবাবু বলে ডাকে সে কথাটা বলাই বাহুল্য।

ছয় ফুটের ওপর উচ্চতা, মাজা রঙা ,কাঁচাপাকা চুলের মানুষটার গলার আওয়াজ টাও একেবারে মেঘ গর্জনের মতন, বয়সের ভারে ইদানিং একটু নুয়ে পড়েছেন, যেটুকু সময় মেসে থাকেন, একটা কাঁঠাল কাঠের  কেদারার ওপর বসে কিসব বইপত্তর পড়েন।

পরণে ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী আর চোখে কুচকুচে কালো লেন্সের চশমা। এ মেসের কেউ ওঁকে কোনোদিন চশমা খুলতে দেখেননি।

আজ ওঁর মুখোমুখি হয়ে যাওয়াটাও একেবারে কাকতালীয়। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হল হঠাৎ করেই। মেসের আর সবাই নয় গরমের ছুটি পেয়ে বাড়ীর দিকে পা বাড়িয়েছে, নাহয় এই দুপুরে নিজ নিজ কাজে কর্মক্ষেত্রে।

আমার ও বাড়ী যাওয়ারই কথা।  কিন্তু বিধি বাম। কিটস্ ব্যাগটা গুছিয়ে সবে বেরোতে যাব। অমনি একেবারে প্রবলবেগে শুরু হল কালবৈশাখী। আকাশের সে কি রুদ্ররূপ। মনে হচ্ছে জটাখোলা কালো চুলে গর্জন করছেন ক্রুদ্ধ কালভৈরব। জানলা দরজা তো এইসান জোরে খটখট করতে শুরু করল, মনে হচ্ছিল এই বুঝি খসে পড়ল বলে; তার মধ্যেই আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন এমন অলপ্পেয়ে কারেন্ট অফ। 

এমনি নিকষ কালো অন্ধকার রে, একহাত দূরে নিজের হাত পা’ই দেখতে হোঁচট খেতে হচ্ছে। অগত্যা কি আর করা। বাড়িওয়ালা বিপিনবাবু বাড়ী নেই জানি, তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই জ্যাঠাবাবুর ঘরে ঢুঁ মারতে হল, কারণ মোমবাতি আর কারো ঘরে না পাওয়া যাক, ওনার ঘরে ঠিক মিলবে।

আসলে, মোমবাতি জমানো ও জ্বালানোর অদ্ভুতুড়ে শখ ওনার। মাঝেমধ্যে এমন কি, ঘরের আলোটালো নিভিয়ে সারা ঘরময় ও জ্বালিয়ে রাখেন শুনেছি। তাই একেবারে নিশ্চিত হয়েই টোকা মারলাম ওনার জন্যে বরাদ্দ দোতলার সিঁড়ির ঠিক পাশের ঘরটায়।

দুবার টোকা দিতেই হাট করে খুলে গেল দরজাটা,তাও একেবারে আচমকাই। আর তারপর, ঘর থেকে ভেসে এল; জ্যাঠাবাবুর বজ্রগম্ভীর কন্ঠস্বর,’ ধৃতিকান্ত ভিতরে এসো, চিন্তা নেই’।

ঘরে ঢুকে এলাম বটে, তবে একটাই খটকা রয়ে গেল, এই কুপকুপে অন্ধকারে, আমিই যে ধৃতিকান্ত সেটা জ্যাঠাবাবু চোখে কালো কুচকুচ চশমা হেঁটেও ঠাহর করলেন কিভাবে। তবে হাজার হোক, উনি আমার গুরুজন, তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না।

সারা ঘরে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাগানো আছে কয়েক শো নানান আকার প্রকারের মোমবাতি। ঘরের ডানদিক ঘেঁষে একখানা তিন মানুষ উঁচু তক্তপোষ।আর বাঁদিকের খোপটানা দেওয়ালে থিক থিক করছে লালশালু মোড়া প্রচুর পুঁথিপত্র।

আর তার পাশের সাদা দেওয়ালে বড় করে লাল আলতা জাতীয় কিছু দিয়ে বড় করে লেখা মা। আর সেই লেখাটার ঠিক নীচে, একটা জলচৌকির ওপর একটা সিঁদুরটিদুঁর লেপা ছোটোখাটো পাথরের সামনে ধিকিধিকি জ্বলছে ধুনি, এতগুলো মোমবাতির সঙ্গে সেই ঝাঁঝালো ধুনোর গন্ধ মিশে সে এক অস্থির কান্ড।

‘কী হল, হাঁ করে হাঁদা গঙ্গারামের মতন দাঁড়িয়ে দেখছ কি বাপু? বিছানায় এসে বস দেখি, এই ঝড় এখন থামবে না।’ হঠাৎই  জ্যাঠামশাইয়ের কম্বুকন্ঠ শুনে হুঁশ ফিরল আমার। তড়িঘড়ি ,কোনোমতে পা টিপে ওই আলো আঁধারি আলোয়, তক্তপোষের ওপর চেপে বসলাম আমি।

শব্দ করে কেদারা টা তক্তপোষের দিকে ফিরিয়ে, তাতে রাজসিক কায়দায় বসলেন তিনি। 

স্মিত হেসে  তাঁর  কালো চশমার মধ্যে দিয়ে, সেই অদ্ভুত মর্মভেদী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন জ্যাঠামশাই।  মুহুর্তের জন্যে হলেও গা টা কেমন যেন শিরশিরিয়ে উঠল আমার।

অপ্রস্তুত হলেও নিমেষে নিজেকে সামলে নিলাম। ‘ভয় পেয়ো না ধৃতিকান্ত’ সহজ গলায় বলে উঠলেন তিনি। ওনাকে ঠিক কি বলা উচিত সেটাই ভাবছিলাম আমি‌। এদিকে আলো আঁধারিতে চুপচাপ বোকার মতন বসে থাকাও পোষাচ্ছিলনা , সব মিলিয়ে আমার ক্ষেত্রে সে এক প্রাণান্তকর পরিস্থিতি।

জ্যাঠামশাই কি সেদিন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন? কে জানে? তাইই হয়তো ঈষৎ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠেছিলেন,’ তোমার ভাল্লাগছে না বুঝতে পারছি, তাই চল, তোমাকে একখানা গল্প বলি, দেখবে এ গল্পের শেষ হতে হতে, ঝড়বৃষ্টি ও ধরে আসবে আর কারেন্ট ও চলে আসবে’ এটুকু বলে হাল্কা করে একটু হেসেছিলেন তিনি।

আমার তখন সসেমিরা অবস্থা। হাঁ কিংবা না কিছু বলে উঠতে পারিনি। তাই হয়তো আমার সম্মতির তোয়াক্কা না করেই জ্যাঠামশাই শুরু করেছিলেন তাঁর গল্পের।

‘ তখন আমি একেবারে তরুণ, বুঝলে না, একেবারে বছর একুশের যুবক। ভূত ভবিষ্যৎ কিছুতেই বিশ্বাস নেই। আর ভগবান? সে তো তখন আমার কাছে একেবারে কৌতুকের বস্তু। ঝকঝকে ছাত্র ছিলাম। ইতিহাসে মাস্টার্স সদ্য শেষ করে বাড়িতে বসে আছি, হঠাৎই বাড়িতে সন্দীপদার তার এসে হাজির, সন্দীপদা বুঝলে কি না, আমাদের আড্ডাতুতো দাদা।  অনেকদিন ধরে ঘষে ঘষে হঠাৎই ভাগ্যে সিকে ছিঁড়েছিল তার, পোস্টিং মিলেছিল, অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্ণাটকের সীমান্তবর্তী একটা জঙ্গল এলাকায় । নাম রত্নপুরা ফরেস্ট।

এককালে স্থানীয় রাজাদের হান্টিং গ্রাউন্ড তখন সদ্য সদ্য রিজার্ভ ফরেস্ট হয়েছে। ছোট্ট জঙ্গল তবে গভীর। তখন ফরেস্ট অফিসারদের কাজবাজ বিশেষ ছিল না। সকাল, দুপুর, রাত তিনবার রাউন্ড দিতে হতো, কাম ফতে। 

আমি আবার বরাবরের হুজুগে, তাই সন্দীপদার তার আসার ঠিক পরের দিন ই একেবারে তল্পিতল্পা গুছিয়ে দে দৌড় রত্নপুরা। প্রথমে হাওড়া থেকে মাদ্রাজ আর তারপর সেখান থেকে কখনো বাস আর কতকটা পায়ে হেঁটে, আর তারপর হুডখোলা জিপে পৌঁছালাম সেই জঙ্গলে।

পান্নার মতন সবুজ সেই জঙ্গলে, চারিদিক নিস্তব্ধ, একটা ঝিঁঝিঁ ডাক ও শোনা যাচ্ছে না। সন্দীপদা এত দিন বাদে আমাকে পেয়ে ভয়ঙ্কর রকম বকবকানি শুরু করেছে তখন, হঠাৎই একদম নিশ্চুপ হয়ে  জঙ্গলের  একটা জায়গার কাছে হ্যাঁচকা টানে জিপ থামিয়ে দিল সে। বুঝতেই পারছ, তখনকার দিনের জুঙ্গা জিপ, ব্রেক কষতেই, প্রায় ছিটকে সিট থেকে ফেলে দেবার জোগাড়।

কোনোমতে দুপাশ ধরে সামলালাম। ইশারায় আমাকে নামতে বলে, নিজেও নামল সন্দীপদা।  নেমে দেখি, একটা চৌকো মতন পাথর, দুপাশে দুটো পিতলজাতীয় কিছুর চোখ আর তার নিচে একটা পিতলের জিভ আটকানো। পাথরটা তেলে সিঁদুরে একেবারে জবজবে হয়ে আছে।  পাথরটার গায়ে একগাদা ফুল মালার স্তুপ। আর পাথরটার পাশে গাদাগাদি করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো লোহার ত্রিশূল। পাশেই একটা পাতার ঝোপড়া। হঠাৎই সেখান থেকে উদয় হল, কালো কোলো চেহারার এক লম্বা চওড়া জটাধারী সাধু, কপালে বড় করে রক্তচন্দনের তিলক। 

সন্দীপদা পাথরটাকে দুহাত জোড় করে প্রণাম করতেই, সাধু তার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, আমাকেও করতে চাইছিলেন, আমি এক ঝটকা মেরে সরিয়ে নিয়েছিলাম মাথাটা। হঠাৎই দেখি সাধু বাবা হাত তুলে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে আমাকে কিসব বললেন। 

একটা অস্ফূট চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল সন্দীপ দা’র । আমার দিকে ফিরে বলেছিল, ‘কাজটা তুই ভালো করলি না সুকোমল, জটাধারী বাবা বাকসিদ্ধ পুরুষ, এই যোগুলাম্বা মন্দিরের অনেককাল ধরে সেবা করছেন, এই জঙ্গলের চারপাশের দশ বিশ গ্রামের লোক এই সন্ন্যাসী আর তাঁর আরাধ্য মা যোগুলাম্বা কে খুব মানেন। আর তুই এমনটা করলি যে তিনি এক্ষুনি তোকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন!’ ‘ তা কি অভিশাপ দিয়ে বসলেন তোমার ভন্ড সাধু’ ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠেছিলাম আমি। 

গাড়িটা স্টার্ট দিতে দিতে আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে, সন্দীপদা বলেছিল, উনি তেলুগু তে বললেন, ‘ তোকে আবার এই মন্দিরে ফিরতে হবে  তোর কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তের জন্যে!’তখন তরুণ বয়সের মাদকতায় কথাটা গ্রাহ্য করিনি। এখন এই বয়সে পৌঁছে বুঝতে পারি, কাজটা করা উচিত হয়নি, কিন্তু গতস্য শোচনা নাস্তি। এই শব্দবন্ধটুকু উচ্চারণ করেই কেমন একটা হাঃ হাঃ করে বিকট ভাবে  হেসে উঠলেন জ্যাঠাবাবু।

তাঁর সেই হাসির তালে তালে যোগ্য সঙ্গত করল মেঘের গর্জন।

হঠাৎই কোথায় যেন একখানা ভয়ঙ্কর শব্দ করে পড়ল বিকট এক বাজ, আর ওই ছোট্ট করে প্রতিধ্বণিত হতে লাগল ওই ছোট একচিলতে ঘরে , কিন্তু কিমাশ্চর্যম! এমন হুহু বাতাসেও নেভেনি এ ঘরের একটাও মোমবাতি!

এরপরে যেন হুঁশ ফিরে পেলেন জ্যাঠাবাবু, কাঁচাপাকা চুলের অভ্যাসবশত একবার আঙুল চালিয়ে আবার গল্পে ফিরলেন তিনি।

যোগুলাম্বা মন্দির থেকে খানিকক্ষণ গাড়ি করে এগিয়েই সামনে পড়ল একটা সুদৃশ্য বন বাংলো, সুন্দর করে চুনকাম করা। একঝলকে দেখে-টেখে মনে 

হল  ব্রিটিশ আমলের, চারপাশে কেয়ারি করা  ফুলবাগান, লাল ভোলায় বিছানো রাস্তা,সব মিলে মিশে বেশ একটা জমাটি ব্যাপার। কাঁধে হোল্ড অল  ফেলে , সন্দীপদার পিছু পিছু বুকে পড়লাম সেই বনবাংলোয়।

দোতলার সবচাইতে বড় আর সুন্দর ঘরটায় আমার বিছানা পাতা হয়েছে। সেই রাতে মোটা মোটা আটার রুটি আর বনমুরগির  ঝোল খেয়ে নিদ্রা গেলাম। আর পরের দিন…

হঠাৎ করে কেমন যেন ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলেন জ্যাঠামশাই, পরক্ষণেই আবার যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন তিনি, আবার ডুবে গেলেন গল্পে।

সন্দীপদার কি একটা জরুরি মিটিং ছিল পরদিন। তাই ইচ্ছে থাকলেও সাথে করে জঙ্গল ঘোরাতে পারল না সে আমাকে। তাই, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে, নিজের জিপটা করে মোহনের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল আমায়।

মোহনলাল, সন্দীপদার বিশ্বস্ত চাকর কাম ড্রাইভার, আদপে বনবিভাগের ফোর্থ ক্লাস স্টাফ, কিন্তু অসম সাহসী ও বুদ্ধিমান, ইংরেজি ও হিন্দিতে বেশ ভালোরকম চোস্ত মোহনকে সন্দীপদা নিজের সমকক্ষ ভাবতেই বেশি পছন্দ করতেন।

তাই আমাকে জঙ্গলটা ভালো করে ঘোরাতে বিশ্বস্ত মোহনলালকে আমার সঙ্গে পাঠাতে বিন্দুমাত্র ভাবেননি তিনি।

দিনটার কথা আমার আজো মনে আছে, একটা ঝকঝকে নীল শনিবারের সকাল। মনে হচ্ছিল, গোটা আকাশটাকে কেউ যেন ধুয়ে মুছে সাফ করে টাঙিয়ে দিয়েছে।

তখন গভীর জঙ্গল ভেদ করে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে, এলোমেলো করে ছুটে চলেছে আমাদের জিপ।  হঠাৎই আমার কি মনে হল, মোহনকে বলে বসলাম, একটু অন্যরকম কোথাও নিয়ে চল না, যেখানে বিশেষ কেউ যায় না।

একগাল হেসে, মোহন আমাকে নিয়ে এল একটা সুন্দর প্রপাতের ধারে। অসম্ভব সুন্দর একটা বড়সড় জলপ্রপাত। সবুজ জঙ্গলের বুক চিরে যেন সফেন মুক্তোর মতন ঝরে ঝরে পড়ছে স্বচ্ছ কাচের মত পরিস্কার ঠান্ডা জল। 

গাড়ীটা থামবার সাথে সাথেই একলাফে গাড়ী থেকে নেমে পড়লাম আমি, তারপর আমার নিত্য সঙ্গী পোলারয়েড ক্যামেরা থেকে খচাখচ ছবি তুলতে লাগলাম আমি। হঠাৎই চোখে পড়ল জল প্রপাতের অপর প্রান্তে একটা প্রাসাদ মতন কিছু। তারপর কি যে হয়ে গেল আমার, এখনো ভাবতে গেলে মাথার ভিতরটা কিরকম যেন অন্ধকার হয়ে যায়।

সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতন লাগছিল, পরে জেনেছি, আমি দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে নবীনা নবীনা বলতে বলতে লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি একেবারে জলপ্রপাতের সবচাইতে খরস্রোতা অংশে। এত যে গাঁট্টাগোঁট্টা বলশালী চেহারার মোহন সে কি না অবধি আমাকে ধরে রাখতে পারছিল না সেদিন।

ভাগ্য ভালো, সরকারি পারমিট নিয়ে জঙ্গলের পাশ্ববর্তী এলাকার কিছু গ্রামবাসী,স্থানীয় আদিবাসী তরুণ

ওই প্রপাতের খানিকটা দূরে ঝরা পাতা কুড়োতে গেছিল, মোহনের গলার আওয়াজ পেয়ে, তড়িঘড়ি এসে দেখে এই কান্ড, তারাই আমাকে ধরাধরি করে নিয়ে। আসে।

যদিও আমি মানুষ খুব একটা অধৈর্য্য নই, তবে জ্যাঠাবাবুর গল্প বলার ধরন ধারণে যেন ওই গল্পের একেবারে ভিতরে ঢুকে গেছিলাম, গল্পের শেষাংশ জানার জন্যে স্বভাববিরুদ্ধভাবে অতি কৌতূহলী হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করে উঠলাম, ‘তারপর, তারপর!?’

ভাবলেশহীন গলায় তিনি বলে চললেন বাকিটা। ‘ যখন চোখ খুললাম, দেখলাম শুয়ে আছি সেই যোগুলাম্বা মন্দিরের সামনে, দেবী যোগুলাম্বার সিঁদুর মাখামাখি পাথরের সামনে। গায়ে এককুচি কাপড় ও অবশিষ্ট নেই। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত , নীচে ঘাসলতা আর নিমপাতা দিয়ে তৈরি অদ্ভূত একখানা বেশ, আর সামনে খুব চিন্তিত মুখে বসে আছেন সাধু যোগীরাজ, ঘাড় ঘোরাতে অস্বাভাবিক কষ্ট হচ্ছিল , তাও শরীরের সমস্ত জোর একত্র করে দেখি, একপাশে অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোহনলাল আর তার পাশে সন্দীপদা স্বয়ং! আর আমাদের কে ঘিরে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে  ঐখানকার স্থানীয় মানুষ।

সবে শোয়া থেকে উঠে সন্দীপদার সঙ্গে কথা বলতে যাব, একটা হ্যাঁচকা টান আবার আমাকে শুইয়ে দিল মাটিতে, ভালো করে দেখে বুঝলাম, হাত দুটো, দুদিকের দুটো খুঁটিতে শক্ত করে বাঁধা আছে আমার।

এ নিশ্চয়ই ওই ব্যাটা ভন্ড সাধু যোগীরাজের কম্ম, সবে লোকটাকে কষে একটা কানমাথা গরম করা কাঁচা খিস্তি মারতে যাব, হঠাৎই, সেই শিলারূপীনি দেবীমূর্তির পায়ের কাছ থেকে পাত্রে রাখে হলুদ কুমকুম আমার দুই চোখ লক্ষ্য করে নাগাড়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে নিক্ষেপ করলেন তিনি।

হঠাৎই চোখ থেকে যেন চোখের ওপর থেকে হট করে সরে গেল এক অদৃশ্য পর্দা। দেখলাম ঠিক আমার পেটের ওপর জুৎ করে বসে আছে এক বীভৎস দর্শনা নারীমূর্তি, সে যে কি ভয়াল রূপীনি, আমি সে ভাষায় বর্ণনা করতে অক্ষম ধৃতিকান্ত। 

এতোটাই কলজে ঠান্ডা করা সেই পিশাচীনি, যে চিৎকার করতে চাইলেও অসম্ভব ভয়ে একটি শব্দ ও আমার মুখ থেকে বেরোচ্ছিল না।

হঠাৎই কোথাও কিছু নেই কাছেপিঠের একটা ত্রিশূলের ওপর গেঁথে রাখা লেবু তুলে ফেলে, দেবী যোগুলাম্বা রূপীনি সেই শিলামূর্তির মাথায় সেটি কচলে , রস দিয়ে স্নান করালেন দেবীকে। আম্মা আম্মা বলে দেবীর জয়ধ্বণিতে ভরে উঠল আমার চারিদিক।

সন্দীপদার তখন দুচোখে জলের ধারা। মা মা বলে সেই শিলার সামনে আভূমিষ্ঠ নতজানু হয়ে প্রণাম করল সে। আমার তখন একেবারে সঙ্গীন অবস্থা,বুঝলে কিনা ধৃতিকান্ত, ওই শয়তানির থেকে চোখ সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু মুশকিলটা কি জানো, চোখ বন্ধ করলেই একটু একটু করে আমার আরো আরো কাছে ঘেঁষে আসছিল ওটা।

অগত্যা খানিক বাধ্য হয়েই সেই শিলার দিকে চোখ ফিরিয়ে ছিলাম, তারপর যার সাক্ষী হলাম, তার বলতে পারো আমার সমস্ত নাস্তিকতার অহং একেবারে ভেঙেচুরে একাকার করে দিয়েছিল।

আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম, ওই শিলার ধাতব চোখ পরিণত হচ্ছে কোমল দুটি মানবী আঁখিতে, শিলার ভেতর থেকে যেন ঠিকরে এসে ফুটে উঠছে তিলফুল জিনি নাসা, পদ্মবৎ বিম্বোষ্ঠে।

তারপর ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনেই সেই শিলা আস্তে আস্তে রূপ নিল অনিন্দ্যজ্যোতি, অখিলতেজা এক দেবী মূর্তিতে।

অসিতাঙ্গী, শুক্লবর্ণা, আয়তলোচনা, কৃশদেহী, সেই সুন্দরী নারীমূর্তি সর্বাবভরণভূষিতা, এক হাতে তার কঠিন ত্রিশুল, আরেক হাত খালি, তাঁর পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই আমার গায়ের ওপর উঠে বসা ওইটা প্রাণপণে পালাতে চেষ্টা করলেও পার পেল না।

দেবীশক্তি যোগাম্বার সামনে খড়কুটোর মতন উড়ে গেল তার প্রতিরোধ, তারপরে আমাকে আশীর্বাদ দিয়ে ধীরে ধীরে শিলায় বিলীন হয়ে গেলেন আদি মহাশক্তির ই এক অনন্য রূপ শ্রী যোগাম্বা।

জানতে চেওনা কি ও কে ছিল সেটা, যাকে দেবী ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।পরবর্তীকালে আমি জটাধারী মহারাজের কাছ থেকে ওটার সম্পর্কে প্রায় সবকিছুই জানতে পারলেও , ওনার নির্দেশেই ওটার সম্বন্ধে বিস্তারে কাউকে কিছু জানানো নিষেধ কারণ ওর উৎপত্তি সম্বন্ধে অনধিকারী জানতে চাইলে তার দশাও হবে আমার মতন…

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো একসাথে বলেই তিনি  একটানে খুলে ফেললেন তাঁর চোখের ওই রহস্যময় কালো চশমাটা। ততক্ষণে ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে, এবং চলে এসেছে কারেন্ট।

তবে, বোধহয় এখন কারেন্টটা না আসলেই ভালো হতো, কারণ তাহলে চল্লিশ ওয়াটের সাদা ফ্যাটফ্যাটে টিউবলাইটের আলোয় জ্যাঠামশাইয়ের দুই চোখের কোটর জোড়া, অবিকল মাছির মতন কালো থকথকে পুঞ্জাক্ষি দেখতে হতো না আমায়।

গল্প বলেন জ্যাঠামশাই অলৌকিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!