আসমান সে ভি উঁচা ছোটগল্প – রথীন্দ্রনাথ রায়
ছেলেটাকে প্রায় প্রতিদিনই দেখে অরুণাভ । বয়স দশ এগারোর কোঠায় হবে। তবে বেশ সপ্রতিভ। কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন। হোটেলে কোনও খদ্দের এলেই – আসুন বাবু , এদিকে চেয়ার খালি। তারপর টেবলটা ঝেড়ে মুছে বলে কি খাবেন বাবু ?খদ্দেররা খুশী হয় । শুধু খদ্দেররা নয় । হোটেলের মালিক শোভনলালওখুশী হয়। আর মাসেও শেষে যখন ওর বাবা আসে তখন তার হাতে টাকার সাথে এটাওটা তুলে দেয় । খুশী হয় ছেলেটার বাবা।
ছেলেটা মানে রতন। একদিন অরুণাভর টেবলএ খাবার দিয়ে বলল, দাদা , আপনে অনেক লিখাপড়া জানেন ?
– তোর কি মনে হয় ?
– আমার ঠিক কথাই মনে হয় ।
– তুই লেখাপড়া শিখবি ?
– না ।
– কেন ?
– তাহলে টাকা আসবে কোথা থেকে ?
– তোর বাবা ?
– ওতো আমার মজুরির টাকা নেয় আর মদ খেয়ে উড়াই দেয় ।
– তুই বারণ করতে পারিস না ?
– শুনবেই না । বরং খুব পিটবে ।
‘রতন , এই রতনা , হারামজাদা ১৪ নম্বরে কে খাবার দেবে শুনি ? ‘ মালিক শোভনলাল হাঁক পাড়ে । রতন চলে যায় । কিন্তু ওর কথাগুলো কানের কাছে বাজতেই থাকে অরুণাভর । এরকম হাজার হাজার রতন শৈশবেই সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছে। কেউ হোটেলে, কেউ চায়ের দোকানে , কেউ বাজির কারখানায় , আবার কেউ খেতখামারে — ছোট ছোট হাতগুলো ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে চলে। কোথাও কোথাও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই । মোড়টা ঘুরতেই শিশুশ্রম নিবারণের একটা ঢাউস বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। আর তারই নিচে রতনের মতোই আর একজন জুতো পালিশ করে চলেছে শিশুশ্রমের জীবন্ত বিজ্ঞাপন হয়ে।
এসব নিয়ে অরুণাভ আগে বেশ ভাবত । সেমিনারে শিশুশ্রম নিবারণের জন্য জ্বালাময়ী ভাষণ দিত । বড় বড় নিবন্ধ লিখত । তবে ওসব নিবন্ধগুলো কেউ কখনো পড়েছে বলে মনে হয়নি। তাই ধরেই নিয়েছে শিশুশ্রম ছিল , আছে , থাকবে । কেন ছিল, কেন আছে, কেন থাকবে ? প্রশ্নগুলো অর্থনীতির চোরাবালিতে কেমন ভাবে হারিয়ে যা । উত্তর মেলে না । আজকাল উত্তর খোঁজার চেষ্টাও করে না । এই বেশ ভালো আছি গোছের ভাব দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে শুধু সে নয়, আরও অনেকেই।
বছরখানেক কেটে গেছে। আজকাল আর ওই হোটেলে খেতে যায় না। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা এখন বাড়িতেই সারতে হয় । তাই রতনের কথা ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন দুর্গাপুর স্টেশন থেকে বেরোবার মুখেই রতনের সঙ্গে দেখা। প্রথমটায় চিনতে পারেনি। কারণ রতন একটা অদ্ভুত সাজ সেজেছে। হনুমান বা ভাল্লুক গোছের কিছু একটা। রতন কাছে এসে বলে, দাদাবাবু চিনতে পারছেন ?
– হ্যাঁ ,কিন্তু তুই এখানে ?
– ও হোটেলের কাজ ছেড়ে দিইচি । এখন টেরেনে সাজ দিখাই । পয়সা ভালোই কামাই হয় । কিন্তু সব আমার বাবার মদে চলে যায়।
– তুই দিস কেন ?
– না দিলে মারে যে ।জ্যান্তয় ধরে মড়ায় ছাড়ে । দাদাবাবু একটা কথা বলব ?
– কি কথা ?
– তুমি আমাকে ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে ?
অরুণাভ হনুমান অথবা ভাল্লুকরূপী রতনের দিকে চেয়ে থাকে ।
– সত্যিগো দাদাবাবু , আমি পড়ালিখা করব ।আমি বড় হব, আসমান সে ভি উঁচা । হনুমানটা আকাশের থেকেও বড়ো হতে চায়। কিন্তু ওকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে একটু বেগ পেতে হল বৈ কি । রতনের বয়স প্রায় বারো । এই বয়সে প্রথম শ্রেণীতেও ভর্তি করা যায় না। আবার প্রথাগত শিক্ষার চতুর্থ শ্রেণী পাশের শংসাপত্র না থাকায় পঞ্চম শ্রেণীতেও কোনও স্কুল ওকে ভর্তি করতে চাইল না। এখন উপায় ? রতনের আসমান সে ভি উঁচা’হওয়ার বাসনা কি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে ? অরুণাভ হেরে যাবে ?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল মহকুমা শাসকের কথা । বছরখানেক আগে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন , আপনারাও আসুন । নাহলে শুধুমাত্র সরকারি প্রচেষ্টায় এটা সফল হতে পারে না । সেদিন রাত্রেই টেলিফোন করে মহকুমা শাসকের কাছ থেকে একটু সময় চেয়ে নিল অরুণাভ।
পরদিন রতনকে সঙ্গে নিয়ে এস ডি ও র চেম্বারে যেতেই পিএ ভদ্রলোক বললেন , আরে অরুণাভবাবু আসুন , অনেকদিন হল এদিকে আসেননি । কি ব্যাপার বলুন তো ?
এর আগে এস ডি ও র কাছে অনেকবার এসেছে অরুণাভ । নানাজনের নানা সমস্যা সমাধানের উমেদারি করতে । তাই এই অফিসের অনেকেই তার চেনাজানা । এসডিও অরুণাভকে বললেন , আসুন আসুন , তা আপনার সেই আসমান সে ভি উঁচা ‘ রতন কোথায় ?
– ও বাইরে বসে আছে ।
– বাইরে কেন ?।ওকে ভিতরে নিয়ে আসুন ।
রতন এসডিও র ঘরে আসে । কোনও ভূমিকা না করেই বলে ,আপনে পারবেন , দাদাবাবু বলেচে । আমাকে কোনও ই স্কুল ভর্তি করতে চাইছে না । আমি পারব ওদের মতোই পড়ালিখা করতে পারব । আপনে দেখে নিবেন । ইস্কুলের টাকাও দিতে পারব । কারোর বাড়ির বাসন মেজে হোক , ডাবের খোলা পিটিয়ে ছোবড়া বানিয়ে হোক – ঠিক আমি ইস্কুলের টাকা মিটাই দিব ।
– ঠিক আছে ঠিক আছে, তুমি বসো ।
এসডিও র চোখের কোণগুলো বোধ হয় চিক চিক করতে শুরু করেছিল । আড়াল করে মুছে নিয়ে টেলিফোনে কাকে যেন বললেন , না না আপনাকে ব্যবস্থা করতেই হবে । আমরা তো চাই প্রতিটি শিশু শিক্ষার আঙিনায় আসুক । তাহলে আমরা রতনদের ফিরিয়ে দেব কেন ?
এসডিও রিসিভার রেখে বললেন , যান অরুণাভবাবু , টিএন স্কুলে রতনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে ।
রতনের দিকে ফিরে বললেন, তুমকো আসমান সে ভি উঁচা হোনা চাহিয়ে ।
– কৌশিস করুঙ্গা ।
এসডিওর পা ছুঁতে চাইল রতন ।
– নো মাই বয় – চেয়ার ছেড়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন , তোমাকে অনেক বড়ো হতে হবে।
তারপর আর তেমন কোনও অসুবিধা হয়নি রতনের । না ওকে বাসন মেজে বা ডাবের খোলা পিটিয়ে পড়াশোনার খরচ যোগার করতে হয়নি। স্কুলের হোস্টেলে থেকেই পড়ার সুযোগ পেয়েছিল । জনৈক শুভানুধ্যায়ী ওর পড়ার খরচ মিটিয়ে দিত ।
এরপর প্রায় বছর দশেক কেটে গেছে । অরুণাভর পক্ষেও আর খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি কেমন আছে, কোথায় আছে রতন ? পরপর কয়েকটি বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে যাওয়ায় নিজের মধ্যেই সিঁটিয়ে ছিল সে। সেদিন দুর্গাপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছে ঠিক এমন সময় পিছন থেকে কে যেন ডাকল । এগিয়ে এল একজন। টান টান চেহারা । চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা । পরনে দামি স্যুট । কাছে এল সে । পা ছুঁয়ে বলল , দাদাবাবু আমাকে চিনতে পারলেন না , আমি সেই রতন । যার বড়ো হবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন আপনি । আজ আমি ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের পাইলট ।
– আসমান সে ভি উঁচা ।
কথা রেখেছে রতন ।
আনন্দে অরুণাভর চোখের কোণগুলো জলে ভরে ওঠে ।
আসমান সে ভি উঁচা ছোটগল্প – সমাপ্তি
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন| এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
বাংলার রূপের সাত সতেরো
সাগর দেখার স্বপ্ন
হঠাৎ