ভূতের বলা ভূতের গল্প ভৌতিক গল্প – দিলীপ কুমার দাস
“ভূতের গল্প মানুষই যদি কয় । ভূতে করব কি।” কথাটা আমার এক পাড়াতুতো ঠাকুরমার । সেই কোন শৈশব-বেলায় । তাও প্রায় তিয়াত্তর চুয়াত্তর বছর আগে । আট-নয়ের গন্ডিতে ছিলাম তখন । রোজ যেতাম ঐ ঠাকুরমার কাছে ভূতের গল্প শুনতে। নিজের ঠাকুরমা যে আমার জন্মের আগেই চলে গিয়েছিল অন্য কোন দেশে। সেদিন তো নয়ই । আজও জানিনা সে দেশটা কোথায় । এই ঠাকুরমাও চলে গেছেন বহুদিন হল । কিন্তু মনে আছে তার কথাটা । আজ এই ভূতের গল্পটা লিখতে বসে। মনে পড়ল সংলাপটা তার । এই গল্পটা আমাকে যে বলেছিল একদিন। তাকে আমি আমার মতোই একজন মানুষ বলে ভেবে – ছিলাম সেদিন । পরে শুনেছিলাম ঐ অঞ্চলের মানুষের কাছে । যে মানুষটা আমাকে ঐ গল্পটা বলেছিল। একদিন সন্ধ্যের পর। উত্তরবঙ্গের এক রিসর্টের বারান্দায় বসে। সে নাকি ঐ ঘটনার বহু আগে ।মারা গেছে খরস্রোতা নদীটার ধারে।এক- দিন আমার মতোই বেড়াতে এসে । তারপর থেকে এখানে যারাই বেড়াতে আসে , সে সুযোগ পেলেই তাদের গল্প শোনাতে আসে । বিশেষ করে কেউ যদি ডুয়ার্সের অন্ধকারে একা একা রাতটাকে উপভোগ করতে চায় । রিসর্টের কোন কটেজের বারান্দায় বসে । চোখে হয়ত পড়বে তার। নদীর ধার থেকে উঠে আসছে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা মাঝবয়েসী মানুষ এক – জন। তারপর হয়ত দেখা যাবে ঐ রিসর্টের কোন কটেজের সামনে দিয়ে মানুষটা এগোচ্ছেন হয়ত অন্য কোথাও । কেউ কিছু জিজ্ঞেস না করলেও, সে নাকি কাউকে একা দেখলেই বলবে ,”কেমন লাগছে জায়গাটা ? একা একা । এভাবে বসে।” তখন কেউ যদি বলে ,” আপনিও কি এখানে ঘুর- তে এসেছেন ?” বলবেই সে ,” এখানে তো আমি প্রায়ই আসি ।” তার কথা শুনে বললেই হল ,” আসুন না । একাই তো বসে আছি। একটু গল্প করা যাবে । চা খেতে খেতে ।” মানুষটা যেন ঠিক এই কথাটুকুর জন্যই অপেক্ষা করছিল । সঙ্গে সঙ্গে কটেজের তিন-চারটে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসবে বারান্দায়। তারপর শুরু কর- বে গল্প । আমাকেও ঐ রিসর্টের কটেজের বারান্দায় বসে, ঐ মানুষটাই সেদিন গল্প বলেছিল একটা । তার- পর রাত গভীর হলে দেখেছিলাম । মানুষটা দু’কাপ চা শেষ করে । ফিরে যাচ্ছে একেবারে শেষের কটেজটার দিকে । বলে গিয়েছিল সে যাওয়ার আগে ,” কালও আছেন তো ? আসব গল্প করতে ।” কিন্তু আমি যখন পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় রিসর্টের ম্যানেজারকে বললাম , আগের দিন রাতে মানুষটার সঙ্গে আমার ঐ দীর্ঘ গল্পের কথা । লক্ষ্য করলাম , ছেলেটা হঠাৎ যেন কেমন গম্ভীর হয়ে গেল । তবে আমাকে সে তখনই বলে- নি কিছু। পরদিন সন্ধ্যের সময় হাঁটতে হাঁটতে সে এসেছিল আমার কটেজটার দিকে । বসেও ছিল কিছুক্ষণ । চা-টা ঐ অল্পবয়স্ক ম্যানেজার ছেলে- টিই আনিয়েছিল।যার দামও পরে আর আমাকে সে দিতে দেয়নি।সেদিন যাওয়ার আগে হঠাৎ সে বলল,” কাকু , আপনি তো এ কটেজটায় একাই উঠেছেন । তাই বলছিলাম কি , বেশি রাতে একা একা বারান্দায় বসে থাকবেন না ।” আমি বলেছিলাম আগের দিনের মানুষটার কথা ঐ ছেলেটাকে । সে যে আমাকে বলে গেছে,গল্প করতে আবার আসবে । সেটাও বললাম। সে শুধু বলল,” তেমন দরকার হলে , সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারকমে ডাকবেন ।” আমি হাসতে হাসতে বললাম তাকে ,” আমার কি আর দরকার । দরকার তো ঐ দু-একবার একটু চা । আর পরে তো আমি তোমাদের ওখানেই খেতে যাব ।” ছেলেটা কিছু আর বলল না । শুধু ঘর থেকে আমার ফ্লাস্কটা নিয়ে চলে গেল । পরে পাঠিয়েও দিল এক ফ্লাস্ক লিকার চা । সে চা-টা পাঠাবার একটু পরেই ঐ ভদ্রলোককে দেখলাম । আগের দিনের মতো সেই এক সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরা । নদীর ঐ একই দিক থেকে হাঁটতে হাঁটতে উঠে আসছে আমার কটে- জের দিকেই । কাছে আসতে । আমিই ডাকলাম, “আসুন , একটু গল্প করা যাক । হাঁটতে বেরিয়ে- ছিলেন বুঝি ।” ভদ্রলোক সে কথার উত্তর না দিয়ে , এগিয়ে এল আমার কটেজটার দিকে।তারপর আগের দিনের মতোই বারান্দায় বসে গল্প শুরু করল । আমি ঐ ফ্লাস্ক থেকে এক কাপ লিকার চা ঢেলে মানুষটা- কে দিলাম । নিজেও নিলাম । চা খেতে খেতে ভদ্রলোক সেদিন যে গল্পটা বল- লেন । আগের দিন বলেননি ওসব কিছুই । ভদ্রলোক বললেন ,” এই রিসর্টটা তখন সবেমাত্র তৈরি হয়েছে। খুব একটা তখনও পরিচিতি পায়- নি । বড়ও হয়নি এত । তবে নদী-পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা জায়গাটি এরা বেছেছিল ভালো ।” তারপর চা-য়ে আবার একটু চুমুক দিয়ে বললেন ,”একদিন দক্ষিণবঙ্গ থেকে এক মাঝবয়েসী ভদ্র- লোক এখানে এলেন । আগাম বুকিং করেই । কটেজ একটা ।” “ম্যানেজারকে ফোনে বলেছিলেন- আমি দশদিন থাকব ওখানে । বিশেষ কাজে । ঘুরব একটু । উত্তরের বিভিন্ন জায়গায় । আপনাদের কটেজেই আমার ব্যাগ-ট্যাগ রেখে । যেদিন ফিরতে পারব। থাকব ওখানে । না হলে হয়ত পরদিন ফিরব । ব্যবসার ব্যাপার তো । ” এরপর বললেন মানুষটা,” এদের ব্যবসা । এরা কেন না বলবে ।” গল্পের পরের অংশটা , সেদিন যা বলেছিলেন মানুষটা । আমি আজ বলি । তারই সংলাপে। ভদ্রলোক প্রথম যেদিন এলেন এখানে , রিসর্টেই থাকলেন।হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ালেন নদীর ধারে। কাছের জঙ্গলে । কটেজের বারান্দায় বসে দেখ- লেন দূরের পাহাড় । দিনেও । রাতেও । আসলে রাতের পাহাড়েরও একটা আলাদা সৌন্দর্য থাকে । ঘরে ঘরে আলো জ্বললে । পরদিন সকালে ম্যানেজারকে বলে একটা গাড়ি ব্যবস্থা করে , চলে গেলেন কোথায় যেন । যাও- য়ার আগে ম্যানেজার জিজ্ঞেস করেছিল ,” কখন ফিরবেন ?” মানুষটা বলেছিল,”আমার লাগেজ থাকল। চাবি- টাও থাকল । ঘরটা একটু পরিস্কার করিয়ে রাখ- বেন । আমাকে দিন তিনেক একটু বাইরে বাইরে থাকতে হবে ।ফিরে এসে বাকি দিনগুলি আপনা- দের এখানেই থাকব ।” ম্যানেজার রিসর্টের মালিককে বলেছিল,” ভদ্র- লোক থাকবেন না । অথচ কটেজটা বুক করে রেখে গেলেন কেন ?” “হয়ত ভেবেছেন পরে এসে কটেজটা পাবেন না। কটেজটা পছন্দ হয়ে গেছে দারুণ ।” মালিকের কথায় যুক্তি ছিল । ম্যানেজারও সংক্ষেপে বলেছিল ,” কটেজটা তো সত্যি দারুণ । সবগুলির থেকে আলাদা ।” ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে ,সন্ধ্যের সময় শিলিগুড়ির চম্পাসারি মোড়ে গিয়ে ড্রাইভারকে বলেছিল ,” আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও। কাছেই আমার মাসির বাড়ি।আজ রাতটা আমি ওখানেই থাকব ।” ড্রাইভার ফিরে গিয়েছিল ওখান থেকেই। বাস্তবে মানুষটার কোন মাসির বাড়িই ছিল না ওখানে।সে ওখান থেকে অন্য একটা গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিল এনজিপিতে । সেদিনের দার্জিলিং মেলে আগেই তার টিকিট কাটা ছিল । লোকটা ছিল একজন ঠিকাদার।অন্য একজনে- র জুনিয়র পার্টনার । কলকাতায় পৌঁছে নিজের বাড়িতে যায়নি মানুষ- টা । যেখানে ঠিকাদারি কাজ হচ্ছিল । সেখানেও না । সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে সন্ধ্যে গাঢ় হলে পৌঁছেছিল ওখানে । তাও বেশ একটু রাত করে । তবে সে যে ওখানে গিয়েছিল , দেখেনি কেউ । সাধারণত এইসব জায়গায় রাতে তেমন একটা দরকার না হলে , বাইরে কেউ থাকে না । সিনিয়র পার্টনারও তার ততক্ষণে চলে গেছে নিজের ঘরে।সাইট থেকে।ওখানেই।তার আবার অভ্যেস ছিল রোজ রাতেই একটু ড্রিংক করার । ড্রিংক করতে করতেই কিছু লেখালেখি করত । সেদিনের কাজকর্ম । খরচ-খরচার। জানত সবই তার ঐ জুনিয়র পার্টনারটিও । অনেকদিনের সম্পর্ক । তবু পুরো সংস্থাটি আত্ম- সাৎ করার জন্যই । সে প্ল্যান করেছিল । তার ঐ সিনিয়র পার্টনারকে একেবারে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেয়ার। যদিও সংস্থার কর্মচারীরা। এমন- কি তার সিনিয়র পার্টনারও ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি এতটুকু কখনও । সেদিন জানালা দিয়ে গুলি করে সে হত্যা করেছিল তার ঐ সিনিয়র পার্টনারকে । ওদিকে গুলির আওয়াজ শুনে আশে-পাশের সবাই ছুটে আসার আগেই চলে গিয়েছিল সে । সাইটের ঘন অন্ধকারের মধ্যে অন্য কোথাও । পরদিন সকালে হাওড়া থেকে হলদিবাড়ি এক্স- প্রেস ধরে ফিরে গিয়েছিল এনজিপিতে আবার। পরে পৌঁছে গিয়েছিল বুক করা কটেজে । রিসর্টের কেউ কিছু বুঝতেই পারেনি । সে ভেবে- ছিল ওদিকের ঘটনাটা যখন ঘটে ,তখন সে যে উত্তরের এই রিসর্টে ছিল । পুলিশ সন্দেহ করলে তাকে । সহজেই বোঝাতে পারবে তাদের। ও তো তখন ওখানে ছিল না । এদিকে পরদিনও একটা গাড়ি নিয়ে লোকটা ঘুরতে বেরিয়েছিল কোথাও আবার । ফিরেছিল সন্ধ্যের দিকে । তারপর চা-টা খেয়ে বসেছিল গিয়ে নদীটার ধারে। দু’টো পাশাপাশি পড়ে থাকা বড় পাথরের উপর । ওটা ছিল এক পূর্ণিমার রাত । রিসর্টে আসা আর যারা গিয়েছিল নদীটার ধারে । একসময় সবাই তারা ফিরে এসেছিল নিজের নিজের কটেজে। ম্যানেজার বা রিসর্টের অন্যসব কর্মচারীরা মনে করেছিল , মানুষটাও ফিরে বোধহয় নিজের ঘরে রেস্ট নিচ্ছে । তাই তাদের মনে কোন প্রশ্নই ওঠে- নি । কিন্তু রাত বাড়তে থাকলে । দু’জন একজন করে বিভিন্ন কটেজের সবাই যখন খেয়ে দেয়ে ফিরে গেল । তখন খেয়াল হল কর্মচারীদের ঐ মানুষটা তো আসেনি এখনও । তারা বলল গিয়ে ম্যানেজারকে । ম্যানেজার নিজের ঘরের জানালা দিয়ে তাকাল কটেজটার দিকে । কিন্তু দেখল । কটেজটায় আলো জ্বলছে না কোন । এমনকি বারান্দায়ও না । তাই টর্চটা হাতে নিয়ে সে একাই গেল তাকে ডাকতে । সেদিন ঐ একটা মানুষই তখন পর্যন্ত খেতে আসেনি । এদিকে কাস্টমাররা তাড়াতাড়ি খেয়ে গেলে পর ম্যানেজার কর্মচারীরাও একটু আগে আগে রেস্ট পায় । রাত গাঢ় হওয়ার আগে । দু’জন কর্মচারীও তাদের টর্চ নিয়ে গেল ম্যানজা- রের পিছন পিছন । কটেজটার সামনে গিয়ে সবাই দেখল,কটেজটার দরজায় বাইরে থেকে তালা দেয়া । তারা ভাবল , তাহলে কি মানুষটা এখনও নদীর ধারেই বসে আছে । পূর্ণিমার রাত। হয়ত ভালো লেগে গেছে। নদী পাহাড় জঙ্গল সব একসাথে । তাই রিসর্টের পিছনের গেটটা খুলে ওরা নামল নদীটার পারে । এই গেটটায় ম্যানেজার তালা দিয়ে দেয় সবাই খেয়ে যাওয়ার পর । সামনের গেটেও তালা দেয় তখন ।কর্মচারীদের মধ্যে দু’জনের বাড়ি কাছেই নদীর ধারের সামনের গ্রামটায় । ওরা ঘরে চলে যায় তখন । স্থানীয় মানুষজনের ভয়-ভীতি একটু কমই । সেদিন মানুষটাকে খুঁজতে যে ছেলে দু’টি টর্চ হাতে এসেছিল । ওদেরও কোন ভয় ছিল না । তাই একটু দ্রুতই ওরা চলে গিয়েছিল টর্চ হাতে নদীর পারটা দেখতে । ম্যানেজার ছিল একটু পিছনে । ছেলে দু’টো হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে,”সুপ্রকাশদা শীগগির আসেন ।” “কি হল রে?” ম্যানেজার দ্রুত এগোতে এগোতেই প্রশ্ন করে ওদের । ওরা আবারও বলে ,” দ্যাখেন আইয়া , কি হইছে। দৌড়ান ।” ম্যানেজার এবার সত্যি দৌড়ায় । তারপর রিসর্টটা থেকে একটু দূরে গিয়ে দেখে । দু’টো বড় পাথরের মধ্যে মানুষটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে । দেখেই বুঝেছিল সবাই । মানুষটা যেভাবেই হোক মারা গেছে । তাই কেউ আর সেখানে না দাঁড়িয়ে । ফিরে এসে- ছিল রিসর্টে । ম্যানেজার ফোন করেছিল মালিককে ।মালিকের বাড়ি একটু দূরে । তাই থানা হয়ে , একেবারে সব পুলিশ-টুলিশ নিয়ে ওখানে আসতে তার একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল । ইতিমধ্যে খেয়ে নিয়েছিল ম্যানেজার আর কর্ম- চারী ছেলেগুলি সব । ঐ দু’টো ছেলে স্থানীয় হলেও ম্যানেজার বলেছিল ওদের ,” তোরা এখন আর যাস না।দাদা আসুক আগে।তারপর যাবি।” ওরা ছিল । তাই একটু খেয়েও নিয়েছিল । একসময় মালিক পুলিশ সবাই আসে । পুলিশই পাথর দু’টির মধ্যে উপুর হয়ে পড়ে থাকা লাশটাকে তুলে চিৎ করে শোয়ায় । পাশের মাটি- তে । তখনই দেখে সবাই মানুষটার দেহে কোন আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও , চোখ দু’টো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে । বোঝাই যায় মানুষটা কিছু দেখে ভয় পেয়েছে প্রচন্ড । কিন্তু সেটা যে কি কারুরই জানার কথা না। এত দূরের চিৎকার যে ম্যানেজার বা কর্মচারীদের কানে যাবে , সেটা সম্ভব না। এদিকে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য সন্ধ্যের সময় প্রতিদিনই রিসর্টে ওরা বেশ ভাল ভাল গান চালায় কিছু । পর্যটকরাও যার যার কটেজে দরজা বন্ধ করে ঢুকে গেলে , বাইরের শব্দ তেমন শোনার কথা না । পুলিশ চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখেছিল বেশ ভাল করে । একটা জিনিস নিঃসন্দেহ হয়েছিল তারা । ঐ পাথরের উপর মানুষটা বসে ছিল অনেকক্ষণ । পাথর দু’টোর কাছে পড়েছিল বেশ অনেকগুলি পোড়া সিগরেটের শেষাংশ । একসময় রিসর্টের পর্যটক এবং ম্যানেজার ও কর্মচারীদের নানারকম প্রশ্ন করে ,পুলিশ বেরিয়ে যায় লাশটি নিয়ে মর্গের উদ্দেশ্যে । তার আগে যে কটেজটায় মানুষটা উঠেছিল , পুলিশ সেই দরজার তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকে । কিন্তু আর কোন কিছুতে হাত দেয় না তারা । রিসর্টের খাতা থেকে পুলিশ পেয়ে যায় মানুষটার বাড়ির ঠিকানা । ঠিকানাটা সঠিক হলেও , সেখানে কোন ফোন নম্বর দেয়নি মানুষটা।আসলে তার বাড়িতে তখন কোন ফোনই ছিল না । যাই হোক পুলিশ তার বাড়ির কাছের এবং কর্ম- স্থলের কাছাকাছি থানায় যোগাযোগ করে তার সিনিয়র পার্টনারের মৃত্যুর খবরটাও ডিটেলসে জানতে পারে । মানুষটা ভেবেছিল সেদিন পূর্ণিমার আগের রাত হলেও,ঠিকাদারি কাজের ঐ নির্মিয়মান জায়গার অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সে ঠিক চলে যাবে। কেউ দেখতে পাবে না তাকে । বাস্তবেও ঐ ঠিকাদারি সংস্থার কেউ তাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু পাশের যে স্টেশন থেকে সেদিন মানুষটা শহরে যাওয়ার লাস্ট লোকালটা ধরেছিল । সেই স্টেশনের বাই- রের চা-গুমটির ছেলেটা দেখেছিল তাকে । পর- দিন পুলিশকে সেটা সে বলেওছিল । ফলে পুলি- শের সব সন্দেহ গিয়ে পড়েছিল তার উপর।পরে ওদিক থেকে খবর পেয়ে পরদিনই এদিকের পুলিশ আর বাড়ির লোকজন গিয়ে মর্গে দেহ সনাক্ত করে তার । এই পর্যন্ত বলেই সেদিন মানুষটা উঠে পড়েছিল।তারপর সামনের সিঁড়ির ধাপগুলি ধরে নামতে নামতে বলেছিল ,” কাল আছেন তো ?” “হ্যাঁ , কালকের দিনটাই আছি ।” “তাহলে আবার আসব। তখন বলব পরের ঘটনা সব ।” আমি সেদিন রাতে খেতে গিয়ে ম্যানেজারকে যখন বললাম,মানুষটার বলা ঘটনাটা সংক্ষেপে। ম্যানেজার বলল ,”আজ আমি একটু ব্যস্ত আছি। কাল আপনাকে বলব পুরো ঘটনাটা । সকালে ব্রেকফাস্টে আসবেন যখন ।” মানুষটা সেদিন যে কর্মচারী ছেলে দু’টির কথা বলেছিল । পাশের গ্রামের । তারা তখন ছিল না একজনও সেখানে । একটু দূরে নতুন কোনও রিসর্টে বেশি মাইনে পাওয়ায়।চলে গেছে দু’জনই সেখানে ।ম্যানেজারেরও যাওয়ার কথা ছিল ঐ রিসর্টটায় । মালিক ছাড়েনি । মাইনে বাড়িয়ে । রেখে দিয়েছে ওকে । পরদিন ম্যানেজার বলেছিল ,” আপনাকে যে ঐ গল্পটা বলেছে , আপনার কটেজের বারান্দায় বসে ।ঐ মানুষটাই সেদিন খুন হয়েছিল এখানে। কিন্তু কিভাবে ? সে রহস্যটা পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি কোনদিন । আমরাও পারিনি । অনেক চেষ্টা করেও । তবে পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে নাকি সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট- এর কথা বলা হয়ে- ছিল । সঠিক জানিনা । ” বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম ঐ ম্যানেজারের মুখের দিকে । পরে কটেজে এসে ভাবলাম । বলে তো এসেছি , আজও থাকব এখানে । একটু পরেই ম্যানেজার এল আবার । সে আমার ভয়ার্ত চোখমুখ দেখে কি বুঝেছিল । কে জানে । বলল ,” আপনাকে এই কটেজে আর থাকতে হবে না।আপনি আমার ঘরের পাশের কটেজটায় চলে আসুন । ওখানে ভয়ের কিছু নেই । অত আলোর মধ্যে আপনার ঐ মানুষটা আর আসবে না । আপনাকে তার নিজের গল্প বলতে ।” এরপর সে একজন কর্মচারীকে ডেকে বলল , ” স্যারের ঘরে একটাই ব্যাগ আছে । ওটা আমার পাশের কটেজটায় নিয়ে আয় ।” এরপর সে আমাকে বলল ,” কাকু , আপনি ওকে জিনিসপত্রগুলি বুঝিয়ে দিন।ও ঠিক নিয়ে যাবে। আমি গেলাম ছেলেটার সাথেই । নতুন কটেজটায় সেই যে ঢুকলাম । সেদিন আর বেরোইনি কোথাও । ম্যানেজারকে বলেই দিয়ে- ছিলাম আমার দুপুর আর রাতের খাবারটা ঘরে পাঠাতে । বিকেলের চা-সিঙারাও । ম্যানেজার ছেলেটি তখন একটু হেসে বলেছিল , “কাল রাতে অতক্ষণ ধরে । একটা ভূতের মুখে তারই গল্প শুনলেন । তখন ভয় হল না আপনার। এখন আপনাকে যখন আমার পাশের কটেজে নিয়ে এসেছি , তখন এত ভয়ের কি আছে ? ” কিছু বললাম না । পরদিন গাড়ি বলা ছিল । তাই ঘুরে বেড়ালাম উত্তরের কিছু জায়গায় সকালে । রাতে দার্জিলিং মেলে ফেরার কথা ছিল আমার । তাই বিকেলেও বেরোলাম একটু ঘুরতে । ফিরে এসে যখন এনজিপির উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠছি ,একটি কর্মচারী ছেলে কটেজ থেকে আমার ঐ সবুজ ট্রলি ব্যাগটা তুলে দিয়ে গেল গাড়িতে । এটা ওরা করে । নিজেদের স্বার্থেই । ম্যানেজার ছেলেটিও এল । আমি গাড়িতে ওঠার আগে বলল ,”কাকু ,আবার আসবেন।এত ভালো পরিবেশ আর পাবেন না কোথাও । সঙ্গে ঐ ভূতের বলা ভূতের গল্প ।”
ভূতের বলা ভূতের গল্প ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন