কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » সায়েন্স ফিকশন গল্প » ভূতের ছদ্মবেশ

ভূতের ছদ্মবেশ

ভূতের ছদ্মবেশ সায়েন্স ফিকশন গল্প – লালু নেয়ে

রাসুমামা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হলেও সাহিত্য চর্চা করে।ছড়া লেখে,গল্প লেখে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়।সাহিত্যের বড় ভক্ত,মায়ের কাছে শুনেছি ,রাসুমামা ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে চায় নি।সাহিত্য নিয়েই পড়তে চেয়েছিল, হয় বাংলা নয় ইংরাজী।দাদু রেগে গিয়ে বলেছিলেন…”এখন ওসব পড়ে কি হবে? স্কুলের মাস্টারি ছাড়া আর কি কাজ পাবে শুনি? লোকে মাস্টার ছাড়া আর বলবেটা কি? তাও চাকরি পেতে গেলে নেতাদের ধরো,তিন ক্লাস পড়া নেতাদের আমি তেলাতে পারবো না।এখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বেশ চাহিদা।সেটি নিয়েই পড়ো।চাকরি পেতে অন্তত কাউকে তেলাতে হবে না।”
রাশভারী দাদুর মুখের উপর কখনও দিদা কথা বলতে পারেনি,আর মামা কি বলবে? চুপচাপ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়ে গেল।সেই রাসুমামা এখন রেলের মস্ত বড়ো ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু কাজের ফাঁকে ফাঁকে আজও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ে,সেটা বাংলা হোক কিংবা ইংরাজী।ঘর ভর্তি বই,গল্প, উপন্যাস ছাড়াও নানান গবেষণামূলক বইয়ে ভর্তি।রামায়ন,মহাভারত,বাইবেল,গীতা উপনিষদ এমনকি কোরানের বাংলা অনুবাদও দেখেছি কাঁচ ছাড়া আলমারিতে সাজানো রয়েছে।ধর্ম বইগুলো হবে কাঁচওয়ালা আলমারিতে।এই বিন্যাসের কারন জানতে চেয়েছিলাম মামির কাছে।মামি বলেছিল…”কেউ যদি ধর্ম বই নিয়ে যায় তো নিয়ে যাক,তাতে লাভ , মানুষ কিছু শিখতে পারবে।”
মামার বাড়ি গেলে আমি রাসুমামার কাছে মাঝে মধ্যে গল্প শুনি।খুব ব্যস্ত হলেও মামা আমাকে একটুবেশি আদর করে সবসময়।চার ভাইয়ের একমাত্র বোনের আমি একমাত্র ছেলে,যাকে বলে একমাত্র ভাগ্না।তাই আমার আবদার রাসুমামা ফেলতে পারেনা।রাসুমামা হল সেজো মামা, কিন্তু কেন জানিনা ছোটো থেকেই আমি রাসুমামা বলেই ডাকি।আসলে মায়ের পরের ভাই রাসুমামা,মা রাসু বলে বলে ডাকতো বলেই আমি রাসু মামা বলে ডাকতে শিখেছি বোধহয়।রাসুমামার নাম রাসবিহারী দাসগুপ্ত।
সেই রাসুমামা অনেকদিন পরে এসেছে আমাদের বাড়ি।প্রায় তিন বছর পর। আমাদের পুরনো বাড়িটাকে বাবা না ভেঙে বাড়াতে চাইছে,সেটা সম্ভব কিনা তাই দেখতে মামা এসেছে।বাবা এলাকার এক ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে এনেছিল,তার প্রস্তাব মায়ের পছন্দ হয়নি। ইঞ্জিনিয়ার কাকু চলে যেতে মা বলল…” আমি রাসুকে ডেকে পাঠাচ্ছি,ওর মতো অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ইঞ্জিনিয়ার কম আছে।আমি খুব করে অনুরোধ করলে ও না এসে থাকবে না,দিদির বাড়ি তৈরির ব্যাপার বলে কথা।”
সত্যি সত্যি মায়ের অনুরোধ না ফেলে মামা আজ সকালে এসেছে।রবিবার বলে আমিও বাড়ি আছি। দুপুরে খাওয়া শেষ করে মামা যখন বিছানায় একটু গা এলিয়ে নিচ্ছে,সেইসময় আমি গিয়ে বললাম…”মামা, একটা গল্প শোনাও না।”
মামা বিছানায় ডান হাতটা কপালে রেখে চোখ মুদে বিছানায় চিত হয়ে শুয়েছিল।কপাল থেকে হাত সরিয়ে বলল…” এত বেলায় গল্প শুনবি? তুই কি আর সেই পুঁচকে আছিস? ক্লাস এইটে পড়ছিস,নিজেইতো বইপত্র নিয়ে গল্প পড়তে পারিস!”
মা পিছন পিছন এসে বলল..”হ্যাঁ ও পড়বে গল্পের বই, সারাদিন মোবাইল নিয়ে নেটফ্লিক্সে ইংরেজি মুভি আর বিদেশি গান শুনতে সময় পার করে দেয়,ক্লাসের বইই ভালো করে পড়ে না।”
মামা বিছানায় উঠে বসে বলল…”কোন বিদেশী গান শুনিস শুনি?”
আমার বলার আগেই মা বলে উঠলো..”কি সব ইড়িং বিড়িং শুনে আমি বুঝি না, চেঁচাই বলে বাবাকে ম্যানেজ করে হেডফোন আনিয়ে কানে লাগিয়ে শোনে। ওর বাবাও হয়েছে সেইরকম,এক ছেলে বলে বড় আদর দিয়ে বাঁদর করে তুলেছে।”
আমি বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই,মা গিয়ে বসল মামার পাশে।আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে মামা বলল..”বোস, দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বললি না যে কোন ভাষার গান শুনিস?”
আমার বললাম..”কোরিয়ান।শুনবে একটা।”
মামা বলল..”শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছিস?”
“হ্যাঁ, অনেকগুলো।” ” থাক আর শোনাতে হবে না।”
_“ঠিক আছে ,তুমি তোমার লেখা একটা গল্প বলো শুনি।”
মা বলল..”যাক মোবাইলবয় গল্প শুনতে চাইছে,জেনেও ভালো লাগছে।কত করে বলি,কারও গল্প না পড়,মামার লেখা গল্পগুলো পড়, অনেককিছু জানতে পারবি।মামা জীবনে যা চোখে দেখেছে তাই নিয়েই নানান গল্প লিখেছে।”
আমার থেকে চোখ সরিয়ে মামার দিকে তাকিয়ে বলল..” আমার বাপু তোর গল্প পড়তে ভালোই লাগে।একটা গল্প শুরু করলে শেষ না করে উঠি না।”
“মা,ঠিক বলেছে মামা,বাবার ফোন এলেও মা আমায় বলে…”তুই কথা বল,সেরকম দরকার থাকলে গল্পটা শেষ করে ঘুরিয়ে ফোন করছি,বলে দে।”
মামা হেসে বলে…”সব দিদিরাই ভাইয়ের একটু সুনাম করে। Thank you দিদি।”
মা বলল…”আচ্ছা এবার গল্প একটা বল তো ,আমিও শুনি।’
আমি বললাম…”মামা, ভূতের গল্প।”
মামা বলল…” আমি তো ভূতের গল্প লিখিনি,ভূতে বিশ্বাসও করিনা।তবে বলেছিস যখন,আজ আমার দেখা সত্যি একটা ভূতের গল্প বলব।শুনবি? গল্পটা লিখিনি,তোদের যদি ভালো লাগে ,তবে লিখবো।”
মা শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে গুছিয়ে নিয়ে বলল..”আচ্ছা,তাড়াতাড়ি শুরু কর,তোর জামাইবাবু আবার এসে বাড়ির আলোচনা শুরু করে দেবে।”
মামা বলল..”এই হচ্ছে ঝামেলা, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সাহিত্য চর্চা করতে গেলে বড্ড টাল খেয়ে হয়।”
মা বলল..”আচ্ছা নে,তোর ফিলসফি পরে শুনবো,এখন সত্যি ভূত দেখার গল্পটা বলতো শুনি।”
মামা শুরু করল…”দিন কয়েকদিন আগের কথা ,নতুন সেকশনে প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালু হবে,তার আগে বড়ো বড়ো অফিসার সাহেবদের তৎপরতা তুঙ্গে। পরদিন জি.এম সাহেব যাবেন সাইটে।এ.জি.এম সাহেব বললেন..”রাসবিহারী তুমি আগেরদিন গিয়ে সব দেখে নিও,রাত্রে রেস্ট হাউসে থেকে যেও।পরদিন একসঙ্গে ফিরে আসব সবাই।”
“নীলগিরি সাইডিং অফিসের রেস্ট হাউস নামেই রেস্ট হাউস,আসলে খানিকটা ওয়েটিং হলের মতো। এমার্জেন্সির জন্য করা হয়েছে।ঘরটি লম্বায় প্রায় ত্রিশ ফুট হবে,চওড়ায় কুড়ি ফুট, উত্তর দক্ষিণে লম্বা।ঘরটার পূর্ব দিক দিয়ে লাইন চলে গেছে,সেই লাইনে বর্তমানে মালগাড়ি যায় শুধু।ঘরটার পশ্চিমদিকে অনেকগুলি নারকেল গাছ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ঘরটিতে তিনটি খাট রাখা আছে, পূর্ব দিকের দেওয়াল ঘেঁসে পর পর রাখা আছেখাটগুলো।পশ্চিমদিকে একটা বড়ো টেবিল পাতা রয়েছে।গোটা ছয়েক চেয়ার রাখা আছে।দুপুরে ওখানে বসেই ভাত খেলাম।শুনলাম,আমি ছাড়া আরও দুইজন অফিসার রাত্রে থাকবেন।একজন টেলিকমের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার, অন্যজন ইলেকট্রনিকের ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার।”
“রাতে আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম।আসলে আমার তেমন কিছু কাজ ছিল না।যা কাজ ছিল টেলিকম ও ইলেক্ট্রনিকের।ওরা রাতে এসেছে আমি জানি না।মাঝরাত হবে কি আর একটু বেশি রাত হবে জানিনা,মাল গাড়ি যাওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার।বিছানায় পাশ কাটতে দেখি অন্ধকার ঘরের মধ্যে কেউ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।নারকেল গাছের পাতার ভিতর দিয়ে চাঁদের আলোর ছটা এসে পড়ছে ঘরের মধ্যে।সেই আলোর এটাতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, কেউ দাঁত বের করে হাসছে।আমি খানিক ভয় পেয়ে গেলাম।আমি শেষের খাটে ঘুমিয়ে ছিলাম,বাকি দুজন দরজার দিকের খাট দুটিতে অঘোরে ঘুমাচ্ছে।একজনের নাসিকা গর্জন বেশ শুনতে পাচ্ছি,আর অন্যজনের নিঃশ্বাসের শব্দ অন্ধকার রাতের নিঝুম পরিবেশে বেশ প্রকটভাবে বোঝা যাচ্ছে।আমি নড়তে চড়তেও ভয় পাচ্ছি।মনে হল একবার জোর করে ওদের ডেকে তুলি।পরে ভাবলাম,অফিসে বদনাম হয়ে যাবে, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যদি ভূত বিশ্বাস করি,তবে সবার কাছে ছোট হয়ে যাবো।আর আমার হাঁক ডাকে যদি ভূতটা পালিয়ে যায়,তাহলে আরও লজ্জার হবে,বাকি দুজন খুব হাসাহাসি করে আমার অজ্ঞতা নিয়ে মজা করবে‌।”
মামা কিছুক্ষন থেমে মাকে বলল…”একটু জল আন,জল খাব।”
মা বলল..”আনছি,তুই এখনো ভয় পেয়ে আছিস দেখছি।”
মামা মুচকি হেসে মাথা নাড়ল শুধু, হ্যাঁ বোঝালো।
মা জলের গ্লাস এনে দিতে মামা জল খেয়ে খালি গ্লাসটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল…”শোন এবার।আমি মনে মনে ভাবলাম,ভূতে যা করে করুক,এদের ডাকব না।ভূতের হাতে মরি মরব,তবু লজ্জায় মরব না।গল্পের বইয়ে পড়েছি,খালি বাংলো, ফাঁকা গেস্ট হাউস,পোড়ো বাড়িতেই নাকি ভূতেরা রাত কাটায়।তাই ভাবলাম, নিজের আস্তানায় রাত কাটাতে এসেছে।আমি তো আর তার কোনও ক্ষতি করছি না,তাই চুপ করে চোখ বন্ধ করে নিলাম। কিন্তু ঘুম কি আর ধরে? একই ঘরে একটা জ্যান্ত ভূত আমার দিকে দাঁত বের করে হাসছে,আর আমি নিশ্চিতে ঘুমাবো তা কি করে হয়? আবার ভয়ে চোখ পিট পিট করে তাকালাম,দেখি ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার,কিচ্ছুটি নেই,বুঝলাম,সে আমায় দেখেই হাসছিল।তার মানে আমি যে তাকিয়েছিলাম ভূতটা জানতো।যা ভাবা তাই, চাঁদের আলো এক ঝলক পড়তেই দেখি আবার হাসছে।”
ঐ দুপুরেও আমি ভয় পেয়ে গেলাম,মায়ের দিকে সরে গিয়ে মায়ের গা ঘেঁষে আর রাসু মামার মাঝে খাটে বসলাম।
মামা বলল..”আমিই যে কিনা ভূতে কোনও দিন বিশ্বাস করিনি সেই সেদিন ভয়ে কাঁপছি আর তুই তো কোন ছার। ভয়ে তো তোর কাঁপাই উচিত।যাক সে কথা,গল্পটা শেষ করি,আমি বুঝলাম,ভূতটা আমাকেই টার্গেট করেছে।তাই আর চোখ খুলিনি।চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম।কখন ঘুম ধরে গেছে জানি না,একটা মালগাড়ির হর্ণের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।দেখি সকাল হয়ে গেছে। প্রথমেই তাকালাম,যেখান থেকে ভূত আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল সেইদিকে।সকালের আলোয় দেখলাম,টেবিলে একটা গ্লাস রাখা আছে,তার ভিতরে কি একটা চকচক করছে।উঠে গিয়ে দেখলাম,গ্লাসের জলে ফলস দাঁত ভেজানো আছে,মাড়িসহ তিনখানা দাঁতের উপরের মাড়ি।মাথার উপরে পাখা চলছিল,তার বাতাসে জলটা নড়ছে,দাঁতটাও্ নড়ছে।বুঝলাম রাতের ভূতটা কে! পরে জেনেছিলাম,টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার রাতে শোয়ার আগে ফলস দাঁত গ্লাসে ভিজিয়ে ঘুমায়।বেচারা বছর দুই আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনটে দাঁত হারিয়েছেন।”
মা হেসে উঠে বলল…”তুই পারিস রাসু,বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি।তোর গল্পটা জমবে।লিখে ফ্যাল তাড়াতাড়ি।”
আমি বললাম..” মামা,তুমি এত ভালো ভালো গল্প লেখো? এবার থেকে আমি তোমার গল্প পড়বো।”
মা বলল..”আলমারিতে রাখা আছে তোর মামার তিনটে গল্প বই,আজ থেকেই পড়া শুরু কর।”

ভূতের ছদ্মবেশ সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!