বার্ধক্যের স্বাধীনতা ছোট গল্প -আত্রেয়ী মাইতি
স্পন্ডেলাইটিসের ব্যথাটা সুরমা দেবীকে আজকাল প্রায় সয়মই ভীষণ কাবু করে দেয়। শীতকাল এলে তো আর কথাই নেই ; যতই সেঁক দেননা কেন ব্যথা বেদনা বেড়েই চলে উনি জানেন এটা ওনার বর্তমান এবং এটাই ওনার ভবিষ্যৎ মানে যতদিন বেঁচে থাকবেন।
সুরমা দেবী ষাটোর্দ্ধ মহিলা হিসাব কষে বললে তেষট্টি। ছেলে বউমা আর দুবছরের নাতনীকে নিয়ে তার সংসার। আগে থাকতেন শ্যামপুকুরে নিজেদের বাড়িতে কিন্তু বিষয় আসয় নিয়ে ঝামেলা হওয়াতে এবং বাড়ির মেনটেন্যান্স করা অসম্ভব হয়ে যাওয়াতে উনি ওনার অংশীদারিত্ব ছেড়ে নিউটাউনের ৩ বিএইচকে ফ্ল্যাটে ছেলের কাছে চলে আসেন। এখানে এসে অবশ্য তিনি স্বাচ্ছন্দ্য খুবই পান কিন্তু কিসের একটা অভাব বোধ করেন যা তিনিও নিজেও উপলব্ধি করতে পারেননা। অসীম স্বাচ্ছন্দ্য আর বৈভব্যের মধ্যে একাকীত্ব আর নিরাপত্তাহীনতা ওনাকে ভেতরে ভেতরে গ্রাস করে ফেলে। উনি মনকে প্রবোধ দেন যে উনি একা নেই ; কিন্তু মাঝে মাঝেই মনে হয় যদি পাশে সত্যিই কাউকে পেতেন। হয়ত বয়স বাড়লে মানুষ একটু বেশীই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।
ওনার স্বামী প্রয়াত হয়েছিলেন পাঁচবছর আগে। রেখে গিয়েছিলেন একটা তিনমহলা বাড়ি আর একাকিত্বে নিরাপত্তাহীনতায় ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাওয়া নিজের স্ত্রীকে। যেদিন ওনাকে হসপিটাল থেকে বাড়িতে আনা হয় সেদিন একবারের মতন হা পিত্যেস করে কান্নাকাটি করেননি “আমাকে কেন নিয়ে গেলেনা!!!”বলে ;
বরং খুব শান্তভাবে নিজের ভবিতব্যকে মেনে নিয়েছিলেন।
সৈকতবাবু চলে যাওয়ার পর সুরমা বড্ড একা হয়ে গিয়েছিলেন তাই দেখে দীপান্বিতা ওনার বউমা ওনাকে পরামর্শ দেন ছেলে বউমার সাথে থাকার।
সুরমাদেবী যারপরনাই খুব খুশি হয়েছিলেন। অন্ত্যরীক্ষের 3 বিএইচকে ফ্ল্যাটে আধুনিক সমস্ত জিনিসই ছিল বর্তমান তার ওপর হাল ফ্যাশনের মডিউলার কিচেন, থরে থরে দেওয়ালে ফিটিং ক্যাবিনেট, গ্লাস উইন্ডো, চাকুরিরত বউমার প্ল্যানিং অনুযায়ী ফ্ল্যাটের ইন্টিরিয়র সব কিছু থেকেই বৈভব্য আর রুচিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
কিন্তু চারদিক বন্ধ এই ফ্ল্যাটে সুরমা দেবী সবসময় হাঁপিয়ে ওঠেন তারপর থাকে বাচ্ছার দেখাশোনা। ওটা উনি বেশ ভালবেসেই করে থাকেন। মাঝে মাঝে মনে হয় এই ফাড়িতে তিনি একজন সদস্য ঠিক কথা কিন্তু কতটা বাঞ্ছিত আর কতটা অবাঞ্ছিত তা তিনি ঠাউর করতে একদমই অপারগ। ছেলে বউমা দুজনেই ব্যস্ত নিজের ডেইলি কাজকর্ম নিয়ে কারোরই সময় নেই দুদন্ড কথা বলার। ওই অফিস বেরোনোর সময় “আসছি মা” আর রাতেরবেলা “গুডনাইট”ছাড়া। এই কেঠো আলাপচারিতায় ওনার সবসময়ই মনে হয় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তো আছেন ঠিকই কিন্তু কাছে কতটা আসতে পারলেন ; সেটা তো আর তিনি হিসাব করতেই পারলেননা।
দুদিন আগে যখন ওনার দিদি ফোন করে দুনিয়ার সবথেকে কঠিন প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করছিলেন যে কেমন দিন কাটছে ; উনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন স্বাভাবিক থেকে এটা জানাতে যে উনি ভাল থাকার চেষ্টা করছেন।
এখন ওনার মাঝে মাঝেই মনে হয় উনি কি সত্যিই চেষ্টা করছেন না ওনার চেষ্টায় এখনো ফাঁকফোকর আছে আর থাকলেই বা ফোকরগুলো ভরাট করার উপায় কি!!!একদমই বুঝতে পারেননা।
কোলকাতায় এমনিতে ঠান্ডা পড়া কমে গেছে তাও নিউটাউন এরিয়াটা ফাঁকা ফাঁকা বলে কার্ত্তিক মাসের শুরুর দিকটা সকালবেলার দিকে বেশ একটা হিমেল ভাব থাকে। রোববার ছুটির দিন। সবাই বেলা করে ঘুম থেকে উঠবে। তাই নিজের জন্য এক কাপ চা বানিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন।দুরে যেদিকে চোখ যায় সেইদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। সকালবেলার সূর্য্যটা বেশ নরম মনে হয় কেউ যেন সিঁদুরে রাঙিয়ে দিয়েছে পুরো আকাশটাকে।অনেকক্ষণ আনমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা স্হির করলেন।
ছেলে বউমা একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে তাদেরকে চা দিয়ে উনি বললেন “তোমাদেরকে আমি আমার একটা সিদ্ধান্ত জানাতে চাই। “দুজনে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকলে উনি বলেন” পেপারে দুই শালিখ বলে এক বৃদ্ধাশ্রমের বিজ্ঞাপন দেখেছি; আমি কর্তৃপক্ষের সাথে কথাও বলেছি। তারা জানিয়েছেন যে ভ্যাকেন্সি আছে ; তাই আমি ঠিক করেছি যে সামনের সপ্তাহে ওখানেই শিফট্ করে যাব। দুজনেই হতভম্ব হয়ে বসে রইল বেশ খানিকক্ষণ বাদে নীরবতা ভেঙে দীপান্বিতাই জিজ্ঞাসা করল “এই ডিশিসনের মানে কি?”
“দেখো আমার বয়স হয়েছে স্পন্ডেলাইটিসের ব্যথায় যেকোন মুহুর্তে বিছানা নিতে পারি ; শরীরে অত জোর ও নেই তাই পরবর্তীকালে আমায় নিয়ে তোমাদের যাতে কোন সমস্যায় না পড়তে হয় তাই আমি নিজে থেকেই এই ডিশিসনটা নিলাম যাতে তোমাদেরকে কোন বিড়ম্বনায় না পড়তে হয়।
দীপান্বিতা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল “কিন্তু আপনার এখানে অসুবিধা কি হচ্ছে?”
দীপান্বিতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন “তুমি তো আমাকে এনেছিলে বিনামূল্যে বাচ্ছাটার দেখাশোনা করার উদ্দেশ্যে আমার সুবিধা অসুবিধার কথা চিন্তা করে নয় ; কিন্তু তোমরা যা যৌথভাবে রোজগার কর তাতে অনায়াসেই একটা আয়ার বন্দোবস্ত তোমরা করে নিতে পারবে। আর তোমাদের ছেলে বড় হলে, তখন ছেলের সুবিধা অসুবিধা ছেলের থাকার আলাদা ঘর সবকিছু নিয়েই তোমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে। তখনও যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে তো আমার ঠিকানা সেই বৃদ্ধাশ্রমই হবে।
বিয়ের পর থেকে সবার জন্য চিন্তা করে এসেছি তখন তো আর মেয়েদের চাকরি করা নিয়ে এত মাতামাতি ছিলনা তাহলে হয়ত আমিও কিছু করতাম, কিন্তু আক্ষেপ না করে আর যতদিন বাঁচব নিজের শর্তেই বাঁচব স্বাধীনভাবে ;যাতে চিত্রগুপ্তের হিসেবের খাতায় আমার নামের তলায় হেডিং থাকে “স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন।” উঠি, অনেক গোছগাছ আছে। “
সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে উনি ঘরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আর ভাবলেন “সত্যি ই সব শেষ হয়ে যায়নি ; স্বাধীনতার বেশ কিছু মাস এখনো বাকি আছে।”
বার্ধক্যের স্বাধীনতা ছোট গল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভরুয়া
উদ্বর্তিনী
নীলবাস্প