প্রেমে পড়া বারণ নয় প্রেমের গল্প – সংযুক্তা পাল
মলির সাথে তার দাদার সাত সকালেই তর্ক। মলির ইচ্ছা কলেজের পাঠ চুকিয়ে সেও দাদার মত কোনো কাজ করে।কিন্তু তার দাদাভাই তাকে খালি পড়তে বলে। অসুস্থ মা’র চিকিৎসার খরচ,মলির পড়াশোনা সব কেন দাদাভাই করবে!
কলেজে ঢুকে এই মাঠটার কোণে বসে থাকতে মলির খুব ভালো লাগে অফ পিরিয়ডে।ও অন্যমনস্ক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল,বিরক্তিকর বাইকের হর্নে সম্বিত ফিরল। যা ভেবেছিল তাই।পীযূষ ফুল স্পিডে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে,পিছন ঘুরে মলির সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ টিপল।মলি মুখ ঘুরিয়ে নিল।পেছনে বসা মেয়েটাকে মলি চেনে না।ফার্স্ট ইয়ারের হবে হয়তো। সুন্দরী মলিকে পীযূষ সুযোগ পেলেই বিরক্ত করে।মলি পাত্তা দেয় না।অসভ্য লোফার বড়লোকের বখাটে ছেলে একটা।মলিদের ইয়ারে পড়া কোনো মেয়েকেই ওর বাইকের পিছনে তুলতে বাকি নেই শুধু মলির মত দু’একজন ছাড়া।মলি ভেবে পায় না কি করে পাশ করে ছেলেটা!নারীঘটিত কত কেচ্ছা কাহিনী পীযূষের নামে হাওয়ায় ভাসে। বেশিরভাগ মেয়েরা পীযূষের চেহারা আর ঠাট-বাটে পটে গিয়ে ওর সাথে বাইকে করে ঘুরে বেড়ায়। লজ্জাও করে না ওদের কলেজের প্রফেসরদের পাশ দিয়ে ফেভিকলের মত বাইকে চিপকে বসে হাওয়ায় উড়ে যেতে।পড়তে আসে না সব বেলেল্লাপনা করতে আসে!মলি দাদাকে কিছু বলে না,দাদা আবার রাগের মাথায় পীযূষকে যদি চড়-চাপড় মেরে বসে!বড়লোক মানুষদের পোষা গুন্ডা থাকতেও পারে। মলি সিনেমাতে দেখেছে।
কলেজে সুবিধা করতে না পেরে পীযূষ এবার মলির টিউশন পড়তে যাওয়ার জায়গাতেও মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে।কখনো একা আবার কখনো দু’তিনজন সঙ্গী-সাথী নিয়ে।
সেদিন টিউশন ব্যাচে পড়তে পড়তেই শুনতে পেল বাইরে তুমুল বৃষ্টির আওয়াজ। বৃষ্টি যখন অনেকটা কমল,পড়াও শেষ।মলি ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়ল।রাস্তাঘাট অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। শর্টকাটে যাওয়ার একটা গলির কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় পীযূষকে। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে পীযূষ হাত দিয়ে আটকে মৃদু স্বরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে, ‘আমাকে এত ঘেন্না কেন করিস মলি?তোকে জ্বলানোর জন্য সারা কলেজের কত মেয়ের সাথে আমাকে ঘুরে বেড়াতে হয়।তুই ভাবিস আমি খুব খারাপ ছেলে তাই তো?’ মলি এবার কথা বলতে বাধ্য হয়। ‘তুই আমার রাস্তা ছেড়ে দে।আমি বাড়ি যাব।আমার বাড়িতে অনেক কাজ থাকে।তোদের মত বড়লোকদের চালিয়াতির জীবন আমাদের নয়’। পীযূষ এবার কিছুটা থেমে থেমে বলে, ‘চল এগিয়ে দি তোকে’।মলি এবার চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘দরকার নেই’। শুরু হয় দুজনের ধ্বস্তাধ্বস্তি।
মলির দাদার বন্ধু পিকলু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে সিগারেট খাচ্ছিল আর ছেলে-মেয়ে-দুটিকে দেখছিল। এবার ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হতেই দুদ্দাড় করে নীচে নেমে এসে মলি আর পীযূষকে থামাল। পিকলু মলি আর পীযূষকে সামনে এসে চিনতে পেরেছিল।পীযূষকে এক ধাক্কায় সরিয়ে কাধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘এভাবে একটা মেয়েকে বিরক্ত করছিস। পুলিশের উপর তলার সাথে আমার ওঠা-বসা আছে। তোর বাবার চালের দোকানের ঠেকগুলো কিন্তু চেনা’।পুলিশের সাথে ওঠা বসা ঢপটা বেশ জোরদার কাজ করল। পীযূষ নিঃশব্দে চলে গেল।মলি পীযূষের চলে যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।মনটাতে একটা তোলপাড় হল।
পিকলু মলিকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিল।মলি এসব কথা দাদাকে না বলার অনুরোধ রাখল।
আজ ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা হয়ে গেল।কয়েক মাসে পীযূষ তাকে বিরক্ত করেনি।এও তো মলির কাছে অসহনীয়। মলি কি পীযূষের চাহনি,পীযূষের ঝারি মারা মনে মনে পছন্দ করত! মলির দৃষ্টি পীযূষকে এখন খোঁজে প্রতি পল।পীযূষ একবারের জন্য না তাকালেও মলি হ্যাংলার মত তাকিয়ে থাকে! মার্কশীট নেওয়ার দিন একটু চোখাচোখি হয়েছিল,পীযূষ বেশ বিরক্তির সাথে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছিল।মলি চোখ নামিয়ে নিয়েছিল।চোখে উপচে পড়েছিল হৃদয় নিংড়ানো নোনা জোয়ারের জল।যাকে পাত্তাই দেয়নি সে যদি একই ব্যবহার ফিরিয়ে দেয় কেমন হয় সেই অনুভূতি মলি এখন বুঝতে পারছে।
এর মধ্যেই মলি তার দাদার সাথে পিকলুর বিয়েতে গিয়েছিল। পিকলুর মিশুকে বৌ রিমলি কথায় কথায় মলিকে জিজ্ঞেস করল,‘পীযূষ তোমাকে আর বিরক্ত করে?’ মলি সাথে সাথে মাথা নীচু করে ঘাড় নেড়েছিল।তার মন উত্তর খুঁজছিল, বিরক্ত শব্দটা ভালোবাসার বিপরীতমুখী ? এরকম যদি হয় পীযূষকে সে বিরক্ত করছে।তবে পীযূষ কি ভাববে মলি ওর প্রেমে পড়েছে!কি করবে মলি জানে না।কার কাছে খবর পাবে পীযূষের?বিগ মার্কেটে চাল-পট্টিতে ওর বাবার দোকান না! পীযূষের ফোন নাম্বার…….ঠিকানা।লজ্জার মাথা খেয়ে পিকলুদার স্মরণাপন্ন হল। পিকলুর বাবার দোকানটাও ওই বিগ মার্কেটে হওয়ার সুবাদে পীযূষের বাবার সাথে ভালোই পরিচয় ছিল।ঠিকানা পাওয়া গেল।
মলির দাদার অফিসে প্রমোশন হওয়ার পর সংসারের অবস্থা একটু ভালর দিকে।মা বেশ সুস্থ।মলির এম.বি.এ পড়া শুরু হবে আর কিছুদিন পরেই।কিন্তু মলির সবসময়ের অন্যমনস্কতা তার মায়ের চোখ এড়ায় না।মলির হাতটা টেনে ধরে তার মা বলে, ‘অ্যাই কি হয়েছে রে তোর?প্রেমে পড়েছিস?হতভাগাটি কে?’ মলি মায়ের গলা জড়িয়ে কলেজের সব ঘটনাই বলে।মলির মা অবাক হয়ে বলে, ‘এত কিছুর পর সেই পীযূষকেই বা তোর হঠাৎ মনে ধরল কেন?‘ মলি তার মাকে অনুরোধ করল, পীযূষদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলতে। মা বললেন, ‘যদি ওরা অপমান করে সেটা তোর ব্যাপার।‘
স্বপ্নাদেবী মেয়ের অনুরোধে পীযূষের বাড়ি গেলেন, পীযূষকে পেলেন না। সে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে অন্য রাজ্যে। ছেলে- মেয়েদের বন্ধুত্বের গল্প বলে পীযূষের মায়ের থেকে পীযূষের ফোন নম্বর জোগাড় করলেন।বাড়ি ফিরে ফোন নম্বর মলিকে দিয়ে বললেন, ‘এবার যা ভাল বুঝিস কর’।
মলির প্রতীক্ষা শুরু।প্রথম দুদিন ফোন করে কোনো উত্তর পেল না।তৃতীয় দিন তার বহু প্রতীক্ষিত মানুষটার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল কিন্তু ফোন কেটে দিল।চতুর্থ দিন দু’জনের দু’একটা কথা হওয়ার পর পীযূষ বিরক্তভরা গলায় বলল,’তুই আমায় বিরক্ত করছিস কেন?ফারদার আর ফোন করবি না।আমি তোকে পছন্দ করি না’। মলি ফোন রেখে দেওয়ার আগে শুধু বলেছিল, ‘ভালো থাকিস’।
মলি অনেক কষ্টে তার আবেগগুলোকে বশীভূত করেছে।মলি মেনে নিয়েছে পীযূষ যা করেছে তা করার হক ওর আছে।
ক্যাম্পাসের পলাশ গাছ আগুন লাগিয়েছে জোড়ায় বসে থাকা মনগুলোতে।মলির অনুভূতি নিশ্চিহ্ন। ক্লাস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। একটা বাইক হুশ করে এগিয়ে গিয়ে আবার ব্যাক গিয়ার দিয়ে ফিরে আসতে লাগল। হেলমেট-সানগ্লাসে মুখ বোঝা দায়।মলি ভীষণ বিরক্ত হল।বাইক আরোহী ভারী গলায় বলল, ‘বাড়ি পৌছে দিতে পারি’? গলাটা শুনে পীযূষের কথা মনে হলেও সে তো এখন হায়দ্রাবাদ-এ ভেবে নিজের মনকেই দু’একটা গালি দিল এবং ভীত হয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল। বাইক আরোহী হেলমেটটা খুলে বলল, ‘কে কাকে বিরক্ত করি চল বাইকে যেতে যেতে ঠিক করে নেব’। মলি হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে সামলে নিয়ে ‘তুই এখানে’, ‘কি চেহারা হয়েছে’,’বাইকটা কি নতুন’ একগাদা প্রশ্ন পীযূষের দিকে ছুঁড়ে দিল।পীযূষ বলল, ‘বাইকে না উঠলে জবাব দেবই না।হু,বিরহ আর পূর্বরাগের অধিকার যেন ওনারই আছে আর কারো নেই’।মলি বাইকে উঠে বসল,একেবারে পীযূষের পিঠের সাথে চিপকে বসে রইল।হাওয়ায় উড়ে চলল রঙিন প্রজাপতির মত।পীযূষ দু’মাস পর মলির সাথে দেখা করতে এসেছে হায়দ্রাবাদ থেকে।মলি উড়তে উড়তে পীযূষের পিঠে মাথাটা রাখল।
প্রেমে পড়া বারণ নয় প্রেমের গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
জ্বর
ভুবন যায় ভুবন আসে
প্রেম চিরন্তন