কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

কানের দুল

কানের দুল ছোটো গল্প –

(এক)

সুবিমলবাবু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢোকার চেষ্টা করলেন। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে গিন্নির ডিরেকশন দেওয়া চলছে, তিনি ওঁকে এগিয়ে যেতে বলছেন। এগোতে গিয়েই বুঝলেন ভুল করেছেন, যতটা নিচু হয়ে যাওয়া উচিৎ তা করেন নি। মাথাটায় খটাশ করে লাগলো। উনি ‘শালা’ বলে মাথায় হাত দিয়ে বসতে গিয়ে আবার মাথায় চোট পেলেন। ওঁর মুখ দিয়ে তখন চার অক্ষরের গালাগালি বেরোচ্ছে। গিন্নি মধুঝরা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন –

  • কি খুব লেগেছে?

প্রথমে ভাবলেন গিন্নির গুষ্টির তুষ্টি করবেন, তারপর ওই ইচ্ছা ত্যাগ করলেন। গিন্নি যা চিজ্, ওর পায়ের কাছেই যখন আছেন, পা দিয়ে একটা লাথি ছেড়ে দিলেই ব্যাস। যতটা সম্ভব গলাটা মোলায়েম করার চেষ্টা করে বললেন –

  • নাঃ, ওই অল্প একটু লেগেছে। এবারে কোন দিকে যাব?
  • মনে তো হয় ডানদিকে। তুমি একটু কষ্ট করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখো না।

সুবিমলবাবু মনে-মনে গিন্নির চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে করতে বললেন –

  • কোন দিকে যাব সেটা না বললে হয়! আমি তো ভালো মতন নড়তেই পারছি না।
  • খেয়ে দেয়ে ভুঁড়ি বাগাচ্ছো, এরকম হবেই তো। আমি দিন দিন খেটে-খেটে রোগা হচ্ছি আর উনি ভুরি বাগাচ্ছেন!

ভুড়ির খোটা সুবিমলবাবু একদম সহ্য করতে পারেন না। রেগে গিয়ে বললেন –

  • ভুরি আমার আছে না তোমার? নিজে ভুড়ির জন্য খাটের তলায় ঢুকতে পারো না বলেই তো আমাকে ঢুকতে বলেছ। তাহলে কে খেয়ে দেয়ে ভুরি বাগাচ্ছে? আমি না তুমি?

বলেই বুঝলেন ভয়ানক ভুল করেছেন। গিন্নির চিৎকার শুরু হয়ে গেল। এই চিৎকারের ঠেলায় বাড়িতে কাক চিল বসতে পারে না, পাখিরা রীতিমতো ওদের বাড়ি বয়কট করেছে। চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে তুই-তোকারি আর মরতে বলা – এসব সুবিমল বাবুর কাছে  জলভাত হয়ে গেছে। এ অনেকক্ষণ চলবে, এখন কোন কথা না বলাই ভালো। উনি খাটের তলার নোংরা মেঝের উপরই শুয়ে পড়লেন। মনে-মনে বাড়ির কাজের লোক, কমলার গুষ্টি উদ্ধার শুরু করলেন – শালী, পাছা-বুক নাচিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ঝাট দেওয়ার কথা বলতে গেলেই বলে খাটের নিচে উনি নাকি ঢুকতে পারেন না! হতচ্ছাড়া –

(দুই)

সুবিমলবাবুর খাটের তলায় ঢোকার কারন ওঁর স্ত্রী সাজতে গিয়ে হাত থেকে দুলটা পড়ে নাকি খাটের তলায় ঢুকে গেছে! সুবিমলবাবুর স্ত্রী খাটের তলায় ঢুকতে পারেন না, তাই সুবিমলবাবুকে ভিতরে ঢুকে কানের দুলটা উদ্ধার করে আনতে হবে। এই দুলটা ওঁর অত্যন্ত প্রিয় দুল। চিৎকার করে গালাগাল বেশ কিছুক্ষন চলার পর গিন্নি কিছুটা ঠান্ডা হলেন। সুবিমলবাবু তখন আবার খোঁজায় মন দিলেন।

মে মাসে ভয়ঙ্কর গরম, সুবিমলবাবু ঘেমে টেমে একসা হয়েছেন, কানের দুল পাওয়া যাচ্ছে না। খাটের তলায় হাবিজাবি জিনিসে ভর্তি, তার উপর ধুলো, সুবিমলবাবুর উত্তরোত্তর মেজাজ চড়ছিল। সাদা রঙের কী একটা দেখে বললেন –

  • সাদা গোল কী একটা দেখতে পাচ্ছি।

গিন্নি হামলে উঠলেন –

  • হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওটাই আমার দুল।

সুবিমল খুব সাবধানে দু আঙুলে ধরে যেটা আনলেন সেটা একটা টিকটিকির ডিম। ‘দূর শালা’ বলে ছুড়ে ফেলে খোঁজায় মন দিলেন। এই দুল যতক্ষণ না পাওয়া যায় ততক্ষণ খাওয়া-দাওয়া, কাজকর্ম সব বন্ধ। গিন্নিকে উনি ভালই চেনেন। অবশ্য সোনা আজকের বাজারে দুর্মূল্য, সেই সোনার কানের দুল হারালে শোক হবারই কথা। সুবিমলবাবুর মনে হচ্ছিল দুলটা খাটের তলায় নেই, অন্য কোথাও পড়েছে। খাটের নিচ থেকে বহু কষ্টে বেরিয়ে এলেন। অবশেষে দুলটাকে খুঁজে বার করলেন ড্রেসিং টেবিলের তলা থেকে! গিন্নিকে দুলটা দিতেই বললেন –

  • আমি আগেই বুঝেছি ড্রেসিং টেবিলের তলায় ঢুকেছে, শুধু শুধু তুমি খাটের নিচে ঢুকে কষ্ট করলে।

সুবিমলবাবু এই কথার উত্তর না দিয়ে বললেন –

  • সোনার কানের দুল, একটু সাবধানে পড়তে পারো না?
  • সোনার দুল কেন হবে! এ তো রোল গোল্ডের জিনিস। সোনা আজকাল আবার কেউ বাড়িতে রাখে নাকি! ওসব ব্যাংকের লকারে আছে।

সুবিমলবাবু কিছুক্ষন অবাক হয়ে স্ত্রীকে দেখলেন, তারপর বললেন –

  • একটা দু পয়সা দামের দুলের জন্য আমাকে দিয়ে এত কষ্ট করালে!

ব্যস, শুরু হয়ে গেল গিন্নির তান্ডব নৃত্য। সুবিমলবাবু গন্ডগোল বুঝে প্যান্ট শার্ট পড়ে মানিব্যাগ নিয়ে সোজা বাড়ি ছেড়ে পালালেন।

(তিন)

বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবেন কোথায়! যাওয়ার জায়গা কি আছে? রবিবারের সকালে পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডা বসে। একটু ইতস্তত করে সেখানেই গেলেন। উনি রেগুলার খদ্দের নন, মাঝে মধ্যে আসেন। যারা রেগুলার কাস্টমার তাদের কয়েকজনকে চেনেন, চায়ের দোকানে আলাপ হয়েছে। সবাই একই পাড়ার ছেলে আর ওঁর থেকে বয়সে ছোট। ওঁকে দোকানে ঢুকতে দেখে ছেলেদের দঙ্গলের একটি ছেলে বলে উঠলো –

  • সুবিমলদা, আসুন আসুন। অ্যাই, দাদাকে চা দে।  দুধ ছাড়া লিকার চা।

ছেলেটিকে সুবিমলবাবু চেনেন, নাম অশেষ, ওদের দলের মধ্যমনি। সুবিমলবাবু বেঞ্চে বসে চারপাশে তাকালেন নিউজ পেপার এর খোঁজে, ওঁকে চাইতে হলো না, একজন নিউজ পেপারটা ওঁর দিকে এগিয়ে দিল। উনি নিউজ পেপারটা খুলে পড়তে যাবেন, অশেষ ছেলেটি বলে উঠলো –

  • দাদা, এটা কি আপনার বেড টি? আসলে জানতে চাইছি এখানেই কি ব্রেকফাস্ট করবেন?

সুবিমলবাবু আগে কয়েকবার এখানে ব্রেকফাস্ট করেছেন। করেছেন বলার থেকে করতে বাধ্য হয়েছেন বলা ভালো। আজ অত ভেবে টেবে আসেন নি। অশেষের কথা শুনে মনে হল এখানেই ব্রেকফাস্ট করে নেওয়া ভালো। বাড়িতে গিয়ে খাবার পাবেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর খাবার পেলেও  তো সেই অখাদ্য গিন্নির হাতের তৈরি চাওমিন। তার থেকে এখানে ডিম পাউরুটি খাওয়া ভালো। উনি হেসে বললেন –

  • হ্যাঁ, ব্রেকফাস্ট এখানে করবো। আজকে আসলে কাজের লোক আসেনি।

অশেষ হাসতে হাসতে জবাব দিল –

  • আমাদের সবার বাড়িতেই আজ কাজের লোক আসেনি। তাই, সবাই ব্রেকফাস্ট এখানেই করছি।

ওর কথা শুনে সুবিমলবাবুও হেসে ফেললেন। সবারই বাড়িতে এক সমস্যা। স্ত্রীর ভয়ে পালিয়ে এখানে এসে জুটেছে। নিউজ পেপারটা পড়ায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলেন। মন দেবেন কী, দোকানে তখন তুমুল তর্ক চলছে – ছেলেদের পরস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা উচিত কি উচিত না, তাই নিয়ে। উনি বিরক্ত হয়ে খবরের কাগজটা সরিয়ে রাখলেন।

(চার)

আলোচনা পরস্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করা থেকে শুরু হয়ে বাচ্চা হওয়া আর তারপর রেডলাইট এরিয়ায় যাওয়ায় যখন এলো তখন মনে মনে শংকিত হলেন। এরপরে আলোচনা কোন দিকে এগোবে বোঝা যাচ্ছে না। অশেষ সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল –

  • বউ যদি লেডি দুর্বাসা হয় তাহলে তাহলে সেই পুরুষ বাড়িতে শান্তি না পেয়ে বাইরে শান্তি খুঁজবে। কি ঠিক তো? আর বউ যদি দিনের পর দিন রাতে অন্যত্র শোয় তখন সে কী করবে? পরস্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করার থেকে রেড লাইট এরিয়ায় যাওয়া ভাল নয় কি? এ ব্যাপারে কিছু বলুন সুবিমলদা।

সুবিমলবাবু এবারে বিপদে পড়লেন, বললেন –

  • দেখো ভায়া, একজন মহিলাকেই সামাল দিতে পারছি না, ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, আবার সাধ করে আরেকটা ঝামেলায় যাব কেন! আমার তো মনে হয় বিয়ে না করাই সবচেয়ে ভালো। অনেক নিশ্চিন্তে থাকা যায়।

ব্যাস, আলোচনা নতুন মোড় নিল। বিয়ে করা উচিত কি উচিত নয় তাই নিয়ে শুরু হলো তর্ক। এর মধ্যে দোকানদার সুবিমলবাবুকে ডিম পাউরুটি দিয়ে গিয়েছিল, উনি সেগুলো সদ্ব্যবহার করার দিকে মন দিলেন।

দোকানে যখন বিয়ে করার পক্ষে আর বিপক্ষে নানান যুক্তি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে তখন নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন। এখন কোথায় যাবেন? বাড়ি ছাড়া গতি নেই। গুটি গুটি পায়ে এগোলেন বাড়ির দিকে। সকালে যখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিলেন তখন পুত্র ঘুমাচ্ছিল। ওঁর ধারণা গিন্নি পুত্রের মাথাটি চিবিয়ে খেয়েছেন। অথচ, সেসব কিছু বলা যাবে না। ছোটবেলায়, উনি জীবনে কোনদিন সকালে দশটার সময় ঘুম থেকে ওঠেন নি, খুব সকালে উঠতেন। অথচ, ওঁর পুত্র কোনদিন সকাল আটটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। আর ছুটির দিনে? সকাল দশটার সময় টেনে তুলতে হয়। কিছু বলতে গেলেই গিন্নি হাউমাউ করে তেড়ে আসেন। উনি তাই কোন রকম বলা টলা ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িতে উনি পেইং গেস্ট। পেইং গেস্টরা টাকা দিয়ে অন্তত খাবার টাবারগুলো ঠিকমতো পায়, উনি তাও পান না। সংসারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন। মাঝেমধ্যে ভাবেন লোটাকম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। মা আর ছেলে যা বোঝার বুঝে নিক। কয়েকদিন না থাকলে একদম সিধে হয়ে যাবে।

সুবিমলবাবু আতঙ্কিত হয়ে বেল টিপলেন। গিন্নির কী মূর্তি দেখবেন কে জানে? গিন্নি দরজা খুলে ওঁকে দেখে মধুঝরা কন্ঠে বললেন –

  • ও-মা, তুমি এসেছ। ভালোই হয়েছে। ছেলের জন্য লুচি আলুর দম করছিলাম, তা তোমার খাবারটা দেব?

সুবিমলবাবু আঁতকে উঠলেন, আবার খেতে হবে! তাও আবার লুচি আলুর দম! অনেক ভেবে চিন্তে বেজার মুখ করে বললেন –

  • আমার শরীরটা খারাপ, পেটে ব্যথা ব্যথা করছে। ভাবছি, এবেলা আর কিছু খাব না।

ওঁর স্ত্রী খুশি মনেই চলে গেলেন, ওঁর লুচি ভাজতে হবে না। সুবিমলবাবুও হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, মনে মনে ভাবলেন – কি কুক্ষণেই না বিয়েটা করেছিলেন! ওহ্!

কানের দুল ছোটো গল্প – সমাপ্তি

যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন| এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!