ছন্দ মাঝে ছন্দপতন অণুগল্প – অনিন্দিতা ঠাকুর
ভাবধারা, সমাস, সদর্থক-নঞর্থক, সন্ধি —– এসবমিলেমিশে সেদিন দুপুরে রহা বাংলা ব্যাকরণ করতে বসেছিল।
তখন মে মাসের শেষের দিক, রোদের দাপট উল্লাস সহিত ডানা মেলেছে। এদিক-ওদিক উলুক-ভুলুক চাহনির খেয়াল ছুটে চলেছে ক্রমাগত। মেঘমল্লার গাঢ় নীল লিটমাস-র আকার ধারণ করে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিস্তৃত আকাশের গায়ে।
রহা আমার থেকে সাত বছরের ছোটো।
ক্লাস এইট এ পড়ে। তখন প্রতিবছর গরমের ছুটিতে রহা প্রতিদিন দুপুর বেলায় আমার কাছে বাংলা পড়তে আসতো। যদিও আমি সায়েন্সের ছাত্র। রসায়ন নিয়ে অনার্স করছি। তখন আমার বয়স 21 বছরের দোরগোড়ায়। তবুও ওই বাংলা ভাষায় ছোট থেকেই আমার এক আলাদারকম আগ্রহ কাজ করতো। মা অবশ্য বলতো, যারা সায়েন্সের ছাত্র হয় তারা নাকি সব বিষয়েই পারদর্শী।
একথাটা আমি মনে- প্রানে না মানলেও কিঞ্চিত মানতাম বৈকি! এর কারন অবশ্যই আমার বাবা। আমার বাবা জুলজির(zoology) র শিক্ষক ছিলেন। তবুও ছোটবেলা থেকেই বাংলা থেকে অঙ্ক যেকোনো বিষয়ে কোনোরকম অসুবিধা হলেই আমি ছুটতাম বাবার কাছে। আর বাবা ম্যাজিশিয়ান র মতো হুশ করে যেন সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দিত। আমি তখন বিস্ময়সূচক চিহ্নের মতো হা করে একটানা বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
বলা ভালো বছর একুশের আমি বাবার জায়গা দখল করেছিলাম আর আমার জায়গা রহা!
মাঝে-মধ্যেই রহা আমার দিকে বিস্ময়সূচক চিহ্নের মতোই হা করে তাকিয়ে থাকতো, ঠিক যেমনটা আমি বাবার দিকে তাকিয়ে থাকতাম ছোটবেলায়।
“ও রোদ্দুর দাদা, এই সমাস টা একটু বুঝিয়ে দাওতো। মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই।”
এরকমভাবেই রহা-র কোনো এক ডাকে আমার সম্বতি ফিরতো। এ আমার এক রোগ বলতে পারেন, চারিদিক নিস্তব্ধ থাকলেই হাজারখানেক ভাবনা ঘুটঘুটি পোকার মতো আমাকে ঘিরে ধরে। আর আমি তখন মাটি খুঁড়ে মোহরের তল্লাশি চালায়।
রহা -র মাথায় জটিল সমাসকে সহজ ভাবে ঢুকিয়ে আমার পড়ানোর পালা সেদিনের মতো ইতি হল।
কারন সেদিনই ছিল গরমের ছুটির শেষ দিন, আবার সেই হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার পালা। তাই রহা কে আগে আগে ছেড়ে দিয়ে কিছু গোছগাছ করতে হবে।
সন্ধ্যাবেলায় বইখাতা গোছগাছ করতে গিয়ে দেখি, আমার কেমিস্ট্রি বই-এর ফাঁকে একটা সাদা কাগজ তিন-চার ভাঁজে মুড়ে রাখা।
ভাঁজ খোলামাত্র যা পড়লাম, তার বর্ণনা —-
রোদ্দুর দা,
গত বছর থেকেই লক্ষ্য করছি তুমি আমাকে বেশ সযত্নে আগলে রাখো, অনেকটা নিজের দাদার মতো বা তার থেকেও বেশি কিছু।
আমার অভিজ্ঞতা বা বোঝার ক্ষমতা তোমার থেকে অনেকটাই কম, তবুও এই কিঞ্চিত অভিজ্ঞতা বা বোঝার ক্ষমতা থেকে বুঝতে পারি তুমি আমার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছো, আমিও হয়তোবা বিন্দুমাত্র হলেও জড়িয়ে পড়তে চাইছি তোমার সঙ্গে। হতেও পারে আমার এ ধারনা ভুল। আর যদি আমার ধারনা ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে বরং ছন্দ বজায় রেখে এগিয়ে যায় আমরা দুজনে। আমি কোনোভাবেই চাই না তোমার-আমার মধ্যে জড়িয়ে পড়ার কোনো আত্মিক যোগ তৈরী হোক।
তুমি অনেকটা এগিয়ে যাও এই কামনা করি।
দাদা হিসাবে চিরকাল আমার পাশে থেকো এইটুকু চাইবো।
ভালো থেকো, সুস্থ থেকো আর মানুষের আবদ্ধ মায়ায় জড়িয়ে পড়া থেকে সবসময় নিজেকে সামলে রেখো….।
ইতি,
রহা
26 শে মে, 2014
………
সেদিন রহা-র দেওয়া ওই চিঠিটা পড়ার পরমুহূর্তে আমার বুকে বজ্রপাত হয়। ক্রমাগত ভাবতে থাকি, চোদ্দ বছরের এই ছোট্ট মেয়ে যে আমাকে এতো সুন্দরভাবে বুঝতে পারে, এত গুছিয়ে প্রতিটা ভাবকে প্রকাশ করে আমাকে ছন্দপতন হওয়া থেকে আটকাই, সে কি সত্যিই আমার ছাত্রী নাকি উল্টোটা…..আমি ওর ছাত্র?
সেদিনের পর আজ দশ বছর কেটে গেছে। এখন আমি একজন নামকরা রসায়নবিদ।
রহা-র খবর জানা নেই। বহুবছর গ্রামে যাওয়া হয়না। তবু এখনও মাঝে-মধ্যেই রহা কে মনে পড়ে। মনে পড়ে ওর সেই গজদেন্তর মিষ্টি হাসি, একরাশ ভাবনা মেশানো তীক্ষ্ম দৃষ্টি, আর আমাকে দিয়ে যাওয়া ওর সেই চিরাচরিত ভাঁজপড়া চিঠি। —–
লন্ডনের শীতকালীন গ্রীষ্মে আমার শরীরে ওম ধরে, মন-দূরবিনে রহা কে দেখি রোজ, রোজ মনফোনে ওকে সমাস বোঝায় আর রোজ দিনের শেষে ও আমাকে ছন্দপতন হওয়া থেকে বারংবার বিরত করে , প্রতিমুহূর্তে নতুন করে সৃষ্টি করে দিয়ে যায় আমাকে…..
এতো কিছু মানুষ তো তার জন্যই করে, যাকে সে ভালোবাসে…..
তবে কি রহাও আমাকে ভালোবাসতো?
আমাকে ছন্দমাঝে রেখে ওরই ছন্দপতন ঘটলো তবে?
ছন্দ মাঝে ছন্দপতন অণুগল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
দমকা হাওয়ায়
চা বাগানের জালিয়াত
পথশিশু