কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » সায়েন্স ফিকশন গল্প » উপেন উধাও কান্ড

উপেন উধাও কান্ড

উপেন উধাও কান্ড সায়েন্স ফিকশন গল্প – আকাশদীপ গড়গড়ী

সেদিন বাড়িতে বসে ‘সায়েন্স টাইমস’ ডিজিটাল ম্যাগাজিনের পাতায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দৌরাত্ম নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছি, এমন সময় মেঘনাদ ফোন করল। 

–”হ্যাঁ, বল, কী ব্যাপার?”

–”সত্যেন, তুই কি খুব বিজি?”

–”কেন? বল?”

–”একবার ল্যাবে আসতে পারবি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। একটা সমস্যায় পড়েছি।”

–”হ্যাঁ সে তোর ফোন পেয়েই বুঝেছি। রাখ, আসছি।” 

মেঘনাদ মজুমদার, পেশায় কোয়ান্টাম ফিজিক্সের একজন নামকরা প্রফেসর, আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। বিখ্যাত বাঙ্গালী বৈজ্ঞানিক ডঃ মেঘনাদ সাহাকে আদর্শ করে আমার বন্ধুও পরমাণুবিজ্ঞান, আয়নমণ্ডল, থার্মাল আয়োনাইজেশন বিষয়ে গবেষণা শেষ করে এখন কোয়ান্টাম ফিজিক্সের থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উপর বিভিন্ন জিনিস নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে যাতে কম খরচে তাদের ব্যবহার করে মানবসমাজের উন্নতি ঘটানো যায়। 

মেঘনাদ একটু চুপচাপ, ভুলোমনা আর খামখেয়ালি স্বভাবের, কিন্তু মাথাটা খুব শার্প। আমাদের প্রফেশনটা আলাদা হলেও এতবছর পরও বন্ধুত্বটা একই রয়ে গেছে। আজ মেঘনাদের গলা শুনেই বুঝেছি, সে এমন একটা জিনিস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে ফেঁসেছে, সেটার জট খোলার জন্য ওর এই প্রাইভেট ডিটেকটিভ বন্ধুটিরই সাহায্যের প্রয়োজন। 

ও হ্যাঁ, আমার কথা তো এতক্ষণ বলাই হয়নি। আমার বাবা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো এমন একজন মহান বাঙ্গালী সায়েন্টিস্টের নামে আমার নামকরণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু আমি তাঁর মতো জীবনে সফল হয়ে নাম কামাতে পারিনি। 

আমার নাম সত্যেন্দ্রনাথ সমাদ্দার, এই কলকাতা শহরের একমাত্র ফেল মারা প্রাইভেট ডিটেকটিভ। না আছে পুঁজি না আছে ক্লায়েন্ট না কোনো কেস। মধুসূদন স্ট্রিটের কাছে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া আমার একটা নিজস্ব গোয়েন্দা অফিস আছে। কিন্তু আমার ভাগ্যে এখনও পর্যন্ত ছোটখাটো চুরিচামারি বা পরকীয়ার কেস ছাড়া আর বিশেষ কোনো বাঘা কেস জোটেনি। 

যখন মেঘনাদের বাড়ি পৌঁছলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। গঙ্গার পাড়েই মেঘনাদের বাড়ি আর বাড়ি সংলগ্ন একটা পুরোনো ল্যাবোরেটরি। এখানেই যত রাজ্যের উদ্ভট এক্সপেরিমেন্টগুলো করে ও। দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলল মেঘনাদের অ্যাসিস্টেন্ট বছর ত্রিশের রবীন্দ্র ঠাকুর। আমাকে দেখে বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার, সত্যেনদা? কোনো জটিল কেসের গন্ধ শুঁকে ছুটে এলে নাকি?” গায়ে না মেখে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার স্যার কোথায়?”

–”দোতলায়। যেখানে সারাদিন পড়ে থাকেন।”

কথা না বাড়িয়ে সোজা সিঁড়ি ধরে উঠে এলাম উপরে। ল্যাবোরেটরি ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল, ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকেই একটা কড়া কেমিক্যালের গন্ধে নাকটা ঝাঁঝিয়ে গেল। কিন্তু মেঘনাদ গেল কোথায়? নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আমি ঘরের একদম পেছনের সরু প্যাসেজটায় এসে পৌঁছলাম, আর তখনই দেখতে পেলাম একটা অদ্ভুত দৃশ্য। 

এটা ২০৪০ সাল। নিত্যদিন বড় বড় গাছেদের জঙ্গল সাফ করে মানুষ নিজেদের বসতি বিস্তার করেছে, ফলে কমেছে বৃষ্টি, বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা আর গাছেদের সংখ্যা। নিজের বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা যায়, সেই উদ্দেশ্যেই মেঘনাদ বানিয়েছে এই সার বেঁধে দাঁড় করানো লম্বা লম্বা ক্রায়োজেনিক ক্যাপসুল স্টোরেজগুলো, যাদের মধ্যে ও বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে আনা গাছেদের চারা পুঁতে ক্যাপসুলের মধ্যে কৃত্রিম উষ্ণতার পরিবেশ তৈরি করে তাদের বড় করে তুলছে। এটাই ওর ল্যাবের বাগান। 

বাগানের একপাশে একটা ফাঁকা ক্রায়োজেনিক ক্যাপসুলের মধ্যে মেঘনাদ বন্দি করে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে একটি প্রাগৈতিহাসিক জীবকে। সেটা জীবন্ত কারণ স্বাভাবিক ছন্দে তার শ্বাস পড়ছে। ক্যাপসুলের ভেতর যে কোনো জীবন্ত প্রাণী বা গাছ রাখলে ভেতরের পরিবেশ যাতে ওদের বডি টেম্পারেচারের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়, সেরকমই ব্যবস্থা করা আছে। প্রাণীটাকে দেখে এতটাই অবাক হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেটার দিকে তাকিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়েছিলাম, যে কখন এসে মেঘনাদ পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে, সেটা বুঝতেই পারিনি। 

ঘোর লাগা গলায় বললাম, “আশ্চর্য! বিউটিফুল! অদ্ভুত! এটাকে পেলি কোথায়? এ-এটা যে একটা…”

–”একটা জলজ্যান্ত টেরোড্যাকটিল, তাই তো? একদম ঠিক ধরেছিস। ওটা একটা বাচ্চা টেরোড্যাকটিল। খাঁটি জুরাসিক যুগের প্রাণী।” 

–”কিন্তু কোথায় পেলি একে? ডায়ানোসর বার্ড যে এইসময়ে একজিস্ট করতেই পারেনা। এযে ইম্পসিবল ব্যাপার!”

–”সত্যেন, তুই তো জানিস, গত কয়েক বছর ধরে আমি টেলিপোর্টেশন নিয়ে একটা গবেষণা করছিলাম। মানে, এক সময়রেখা থেকে অন্য সময়রেখায় কণার আদান-প্রদান করা এই আর কী। আজকাল তো চায়নার অনেক গবেষণাগারেই গোপনে সিন্থেটিক ওয়ার্মহোল তৈরি করা হচ্ছে, যেটা ব্যবহার করে এক সময়রেখা থেকে অন্য সময়রেখায় ভ্রমণ করা যায়। কিন্তু মুশকিল হল, সেই ওয়ার্মহোল ব্যবহার করে কেউ সময় ভ্রমণ করে অতীতে চলে গেলে তাকে আর ফেরানো যাচ্ছেনা। এই ওয়ার্মহোল কেবল ইউনিডিরেকশনাল। এই ওয়ার্মহোল ব্যবহারের গবেষণায় ফেল করে কত কত নামী বৈজ্ঞানিকরা যে অতীতের সময়রেখায় হারিয়ে গেছে, পুলিশ ফাইলে মিসিং রিপোর্ট খুঁজে দেখলে সেটা তুই বুঝতে পারবি। ভারতেও এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, কিন্তু কেউ সফল হয়নি। আমার গবেষণাও শুরু হয়েছে ঠিক সেখান থেকে। অর্থাৎ একটা মাল্টিডিরেকশনাল ওয়ার্মহোল তৈরি করা, যেটা দিয়ে অতীতে ভ্রমণও করা যাবে, আবার সুস্থ দেহে সেখান থেকে ফিরেও আসা যাবে। আর এই কাজে আমাকে সাহায্য করেছে একটা পাথরখন্ড। এই দ্যাখ্।” বলে আমার নাকের সামনে নিজের হাতের একটা আঙুল বাড়িয়ে দিল মেঘনাদ। দেখলাম, ওর মধ্যমায় জ্বলজ্বল করছে আংটির মাথায় বসানো বেশ অদ্ভুত দেখতে বড়সড় আকৃতির একটা উজ্জ্বল হলদে পাথরের টুকরো।

–”এটা আবার কী?” 

–”এটাই তো সব রহস্যের চাবিকাঠি রে সত্যেন। এটাই হল সেই ম্যাজিক পাথর যেটার সাহায্যে আমি আমার গবেষণায় সফল হয়েছি।” 

এরপর মেঘনাদ পাথরখন্ডটার ব্যাপারে যা যা ঘটনা খুলে বলল, শুনতে শুনতে বিস্ময়ে আমার চোখজোড়া কপালে উঠে গেল। মেঘনাদের কথা সত্যি হলে, এই পাথরখন্ড হল খাঁটি জুরাসিক যুগের পাথর। কীভাবে সেটা ওর কাছে এল, সেটা জিজ্ঞেস করায় শোনালো এক অদ্ভুত ঘটনা। 

বেশ কিছুদিন আগে একদিন রাতে প্রচন্ড একটা শব্দ শুনে চমকে ঘুম ভেঙে যায় মেঘনাদের। ওর ল্যাবোরেটরি সংলগ্ন যে বিরাট গাঙ্গেয় জমিটা আছে, আওয়াজটা এসেছে সেদিক থেকেই। সেই রাতেই জমিতে এসে টর্চ জ্বেলে জায়গাটা ভালো করে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করার সময় মেঘনাদ দেখল, জমির এককোণায় বিশাল বড় একটা গর্ত তৈরি হয়েছে। সেই গর্তের ভেতর থেকে তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে। টর্চের আলো ফেলে সেই গর্তে ঝুঁকে মেঘনাদ দেখে, একটা বেশ মাঝারি সাইজের এবড়োখেবড়ো পাথর মহাকাশ থেকে ছুটে এসে খসে পড়েছে জমিতে। প্রথমে মেঘনাদ ভেবেছিল, ওটা বোধহয় কোনো উল্কাপিণ্ড। কারণ হলদে পাথরটা নাকি তখন আগুনের মতো গনগনে গরম হয়ে লাল বর্ণ ধারণ করেছিল। মেঘনাদ সেরাতের মতো আবার ঘরে ফিরে আসে। 

কিন্তু পরদিন সকালে যখন আবার সে আর রবীন্দ্র জমির গর্তটাকে দেখতে যায়, তখন খেয়াল করল, অত বড় গর্তের মধ্যে শুধু ছোট্ট একটা হলদে পাথরখন্ড সূর্যের আলোয় চকচক করছে। এক রাতের মধ্যেই পাথরটার আকার ছোট হয়ে এসেছে, সেটা তখন বরফের মতো ঠান্ডা। পাথরটা দেখে মেঘনাদের বেশ পছন্দ হয়। সে রবীন্দ্রকে বলে একটা আংটি বানিয়ে সেটা হাতে পরে নিল আর জমির সেই বড় গর্তটা আবার মাটি ফেলে বুজিয়ে দিল। আর সেই পাথরের আংটিটা আঙুলে পরার পরই রাতারাতি যেন মেঘনাদের ভাগ্য বদলে যায়। 

মেঘনাদ যে একটা মাল্টিডিরেকশনাল সিন্থেটিক ওয়ার্মহোল বানানোর গবেষণা চালাচ্ছে অনেকদিন ধরে, সেটা আমাকে আগেই বলেছিল। কিন্তু সফল হতে পারছিল না। এর আগে পরীক্ষা করার জন্য যে যে জিনিস সে টেলিপোর্ট করার চেষ্টা করেছে, সেসব ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার পর আর ফেরৎ আসেনি। কিন্তু পাথরখন্ডের আংটিটা পরার পর সেদিন সকালে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। 

মেঘনাদের একটা পোষা কমলা বেড়াল আছে। নাম উপেন। খুব চঞ্চল আর বদমেজাজী।  কিন্তু সে হচ্ছে আমার বন্ধুর চোখের মণি। বেড়ালটাকে সে বড্ড ভালোবাসে। উপেন আবার আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না বলে আমি আসলে মেঘনাদ সেটাকে অন্য ঘরে রেখে আসে। আজও যথারীতি তাকে কাছেপিঠে দেখতে না পেয়ে সেটাই ভেবেছিলাম, কিন্তু যখন দেখলাম উপেনের কথা বলতে গিয়ে মেঘনাদের মুখটা বেজায় কালো হয়ে গেল, তখন বুঝলাম ব্যাপার বেশ গুরুতর। 

মেঘনাদই খবরটা দিল যে উপেন নিরুদ্দেশ। আর আমাকেই নাকি গোয়েন্দাগিরি করে তাকে খুঁজে আনতে হবে। মেঘনাদের ল্যাবে ক্রায়োজেনিক ক্যাপসুলে বন্দি টেরোড্যাকটিলটাকে দেখে যতটা রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, বেড়াল হারানোর কেস শুনে ঠিক ততটাই মুষড়ে পড়লাম। নাহ্! কপালটাই খারাপ। এ জীবনে বোধহয় আর কপালে একটা বেশ জটিল কেস সলভ করার সুযোগ পেলাম না। 

সেদিন সকালে মেঘনাদ যখন তার তৈরি টাইম পোর্টাল মেশিনের গোল চাকতিটার উপর একটা ইঁদুর রেখে টেলিপোর্টেশন নিয়ে পরীক্ষা করছিল, তখনই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটে গেল। মেশিনের সমস্ত স্যুইচ অন্ করে মেঘনাদ তখন চেষ্টা করছিল কীভাবে অতীতে সেই ইঁদুরটাকে পাঠানো যায়। এই পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য যদি ইঁদুরটা সেই সিন্থেটিক ওয়ার্মহোলের মধ্যে দিয়ে টেলিপোর্ট হয়ে সময়রেখার পেছনে গিয়ে আবার সেটা ফিরে আসে এখানেই, তাহলেই এক্সপেরিমেন্ট সফল। গোটা পরীক্ষাটায় সময় লাগার কথা কয়েক সেকেন্ড মতো। কিন্তু ইঁদুরটা যখন সেই সময়দৈর্ঘ্য অতিক্রম করবে ওয়ার্মহোলের ভেতর, তখন কিন্তু তার কাছে সেই সময় চলবে খুবই দ্রুতগতিতে, অর্থাৎ তার বয়স বাড়বে না। পৃথিবীতে একটা গোটা দিনের সময় টাইম ট্র্যাভেল করা ইঁদুরটার কাছে হয়ে দাঁড়াবে মাত্র এক সেকেন্ড। 

কিন্তু অদৃশ্য করার ম্যাজিকের মতো এখানেও একটা নিয়ম আছে। গায়েব হওয়া জিনিস যতক্ষণ না সুস্থদেহে আবার দর্শকদের সামনে ফিরে আসছে, ততক্ষণ এর সার্থকতা অনুভব করা যাবে না। এই এক্সপেরিমেন্টেরও লক্ষ্য সেটাই ছিল যে ইঁদুরটাকে অতীতে পাঠিয়ে আবার স্বস্থানে ফিরিয়ে আনা, অর্থাৎ একটা সফল মাল্টিডিরেকশনাল ওয়ার্মহোল তৈরি করা। সময় ব্যবধান খুবই অল্প, ১৩০ সেকেন্ড, মানে ২ মিনিট ১০ সেকেন্ড। এই দুই মিনিট আগে ইঁদুরটা ছিল খাঁচায় বন্দি, আর বর্তমানে আছে মেশিনের গোল চাকতির উপর। পরীক্ষা সফল হলে ইঁদুরটা পুনরায় খাঁচায় ঢুকে আবার মুহূর্তের মধ্যেই টেলিপোর্ট করে মেশিনের চাকতির উপর চলে আসবে। এর আগে যতবার মেঘনাদ এই পরীক্ষায় চেষ্টা করেছে, প্রতিবার সে বিফল হয়েছে। কিন্তু সেদিন সকালে চমৎকারটা ঘটে গেল একদম আকস্মিকভাবেই। 

ইঁদুরটাকে দেখে উপেন “ম্যাঁও!” শব্দে তীক্ষ্ণ হুঙ্কার ছেড়ে সোজা উঠে পড়ল মেশিনের সামনে লাগানো গোল চাকতিটার উপর, তারপর থাবার নীচে তাকে চেপে ধরে। মেঘনাদ ততক্ষণে টেলিপোর্টেশনের জন্য সিন্থেটিক ওয়ার্মহোলটা খুলে ফেলেছে। উপেন চাকতির মাঝখানে উঠে পড়েছে দেখে হাঁ-হাঁ করে সেদিকে ছুটে আসে মেঘনাদ। কিন্তু যেই সে উপেনকে নামিয়ে আনার জন্য সেদিকে হাত বাড়িয়েছে, অমনি মেশিনের মাথায় সেট করা ব্যাটারির থেকে তীব্র ইলেকট্রিক রশ্মি এসে আঘাত করে মেঘনাদের হাতে। নাহ্, হাতে বলা ভুল, সোজা আঙ্গুলে পরে থাকা আংটিটার হলদে পাথরখন্ডের মাথায়। প্রচন্ড একটা বিদ্যুতের শক্ খেয়ে হাতকয়েকদূরে ছিটকে পড়ে মেঘনাদ। তার টাইম পোর্টাল মেশিনে তখন শুরু হয়েছে বিঁপ বিঁপ বিঁপ শব্দে তীব্র কম্পন, মুহূর্তে সেটা যেন একবালতি তেজী আলোকরশ্মির বন্যায় ভাসিয়ে দিল উপেনকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেশিন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। 

চারপাশের আলো মুছে যেতেই বিস্ফারিত চোখে মেঘনাদ দেখল, চাকতির মাথায় না আছে উপেন না আছে সেই ইঁদুরটা। সেখানে দু’টো বিশাল ডানা দু’দিকে মেলে শুয়ে আছে একটা বিশালকায় প্রাগৈতিহাসিক জন্তু। পৃথিবীর বুক থেকে প্রায় ১৩০ মিলিয়ান বছর আগেই হারিয়ে গেছে এই উড়ন্ত ডায়নোসরের প্রজাতি। দেখেই মেঘনাদ বুঝতে পারল, সেটা একটা বাচ্চা ডায়নোসর আর সে আহত ও অজ্ঞান। মনে হয় অন্য কোনো শক্তিশালী জানোয়ার তাকে আক্রমণ করে এই অবস্থা করেছে। 

মেঘনাদের সমস্ত শরীর ঘেমে উঠল। সে ছুটে এসে মেশিনের গায়ে লাগানো ডিজিটাল ক্যালেন্ডার প্লেটটা লক্ষ্য করেই চমকে উঠল। বিদ্যুতের ঝটকা খেয়ে ছিটকে পড়ার সময় অসাবধানে হাত লেগে ক্যালেন্ডার প্লেটের ডিসপ্লেতে একটা বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। যে তারিখ সে সেট করেছিল, সেই তারিখ পৌঁছে গেছে ১৩০ মিলিয়ন বছর আগের একটি সময়ে, যে যুগে পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হিংস্র ডায়নোসরের দল। মেঘনাদ স্পষ্ট বুঝতে পারে, ইঁদুর সমেত উপেন টেলিপোর্ট করেছে সেই জুরাসিক যুগে, পরিবর্তে সেই যুগের একটা আহত টেরোড্যাকটিল টেলিপোর্ট করে দিয়েছে বর্তমান সময়ে। রবীন্দ্রর সাহায্যে টেরোড্যাকটিলটাকে সাবধানে ধরে তার ক্ষততে ওষুধ লাগিয়ে সেটাকে ক্রায়োজেনিক ক্যাপসুলে বন্দি করে মেঘনাদ মাথায় হাত রেখে বসে পড়ল। উপেনের কথা ভেবে তখন তার চোখ ফেটে কান্না আসছে৷ মেশিনের গন্ডগোল ঠিক করতে অন্তত আরও দিন পাঁচেক লাগবে। ততদিন ওই ছোট্ট বেড়ালটা অত বড় বড় হিংস্র জানোয়ারগুলোর সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকবে তো? 

দিনরাত পরিশ্রম করে সে আবার মেশিনটা ঠিক করে ফেলল। তারপর ডাক পড়ল আমার। মেঘনাদ আমার হাত ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “সত্যেন, আমি তোকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করি না। রবীন্দ্রটা একটা মিঁচকে শয়তান। আমি জানি তুই ঠিক উপেনকে খুঁজে আনতে পারবি।”

উপেনের আবদার শুনে তো আমি রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলাম। আমার প্রিয় বন্ধু চায় তার বজ্জাত বেড়ালটা উদ্ধার করতে গিয়ে আমি সেই জুরাসিক যুগের হিংস্র ডায়নোসরগুলোর মুখে গিয়ে পড়ি? প্রথমে তো এমন প্রস্তাবে মোটেই সম্মত হতে পারিনি। কিন্তু মেঘনাদও নাছোড়বান্দা। কানের কাছে এমন বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যান শুরু করল, যে বাধ্য হয়ে রাজি হতেই হল। 

–”কিন্তু কী প্রমাণ আছে যে উপেন এখনও বেঁচে আছে? ডায়নোসরগুলো তো ওকে আক্রমণ করে মেরেও ফেলতে পারে?”

–”সেটা সম্ভবত হয়নি, কারণ ওই টাইম স্ট্রিমের ডিফারেন্স। আমাদের এখানে পাঁচদিন মানে জুরাসিক যুগে উপেন সবে পাঁচ সেকেন্ড কাটিয়েছে। তোরও তাই মরার চান্স নেই কারণ তুই যাবি, উপেনকে চ্যাংদোলা করবি, আর ফুড়ুৎ করে আবার টেলিপোর্ট হয়ে যাবি। ডায়নোসররা যতক্ষণে তোকে লোকেট করবে, ততক্ষণে তুই আবার তাদের চোখের সামনে থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাবি। আর আমাকে এখানে থাকতেই হবে কারণ মেশিনটা আমিই এখান থেকে কন্ট্রোল করব, যাতে তুই খুব তাড়াতাড়ি আবার ফিরে আসতে পারিস। উপেন যা শান্তশিষ্ট, পাঁচ সেকেন্ডে ও খুব বেশিদূর যাবে না।”

–”শান্ত না ছাই! উপেন হাড়বজ্জাত বেড়াল! উফ্ সেবার আমায় আঁচড়ে কী অবস্থাই না করেছিল! ও যা দুষ্টু বেড়াল, একজায়গায় এক সেকেন্ডই বসে থাকে কিনা সন্দেহ। আর সে যদি পালিয়ে গিয়ে থাকে, তো তাকে কোথায় খুঁজে মরবো আমি?” 

–”তার উপায়ও ভেবে রেখেছি। আগেরবারের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি। ওই যে মেশিনের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ্, ওই জিপিএস ট্র্যাকারটা এ.আই. দিয়ে সেট করে দিয়েছি। ওয়ার্মহোলোর দরজা নিজে থেকেই সেন্স করে সেখানেই খুলবে, যেখানে উপেন আছে। তোর কাজ শুধু তাকে টপ করে তুলে নিয়ে আবার ফিরে আসা।” 

–”সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আবার যে আমি জুরাসিক যুগেই টেলিপোর্ট হবো, তার কি গ্যারান্টি?” 

–”গ্যারান্টি হল এই পাথরখন্ডটা। তোকে বললাম না? আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, পাথরখন্ডটা খাঁটি জুরাসিক যুগের। দৈবাৎ এটা খুঁজে পেয়েছি বলেই তো এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছে। দ্যাখ্, কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অত জটিল সব বিষয় তোর মাথায় ঢুকবে না, কাজেই ছোট করে বলছি। আমার এই মেশিন কাজ করে একটাই ফর্মূলায়। সেটা হল যে দু’টো স্থানে টেলিপোর্ট হবে তাদের সময়রেখায় ব্যবহৃত যে কোনো দু’টো জিনিস ছুঁইয়ে রাখতে হবে সেন্সারের সাথে। এখানে ২০৪০ সালের ইঁদুর-বেড়াল আর ওই যুগের প্রমাণ স্বরূপ এই পাথরখন্ডটা পরষ্পর কাছাকাছি আসার ফলেই মাল্টিডিরেকশনাল ওয়ার্মহোলটা কাজ করেছে। কিন্তু উপেনের থাবার আঁচড়ে মেশিনের সেন্সারে গন্ডগোল দেখা দেওয়ায় তারা উভয়পক্ষই বিপরীত সময়রেখায় আটকে পড়েছে। এবারও তাই-ই অ্যাপ্লাই করব। টেরোড্যাকটিলের ক্যাপসুল নিয়ে তুই টেলিপোর্ট করবি। কারণ প্রাণীটাকে ওর নিজস্ব সময়রেখার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াটাও জরুরি। এখানে থাকলে ওর বিপদ বাড়বে।” 

এই প্রথম আমিও মেঘনাদের মতামতের সাথে সহমত হলাম। বাচ্চা টেরোড্যাকটিলটাকে দেখে বেশ মায়াই লাগছিল। মেঘনাদকে আমার মনের কথাটা জানাতেই সে খুশিতে লাফিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর একটা অদ্ভুত লিক্যুইডের টেস্টটিউব এনে ভেতরের তরলটা আমার সর্বাঙ্গে মাখিয়ে দিতে দিতে হেসে বলল, “এটা আমারই আবিষ্কার। নাম লিক্যুইডক্লক। এটা মাখলে তোর শরীরের চামড়া এতটাই মসৃণ হয়ে যাবে, যে টাইম ট্র্যাভেল করার সময় টাইম ডিসটর্শনের কোনো এফেক্ট তোর উপর পড়বে না।” কিছুক্ষণ পরেই আমার গোটা শরীরের চামড়া মখমলের মতো মসৃণ হয়ে গেল। 

এরপর মেঘনাদ আমাকে নিয়ে গেল মেশিনের কাছে। মেঘনাদের কাজের উপর আমার ভরসা আছে, কিন্তু কেমন যেন অজানা এক আতঙ্কে বুকটা ঢিপঢিপ করছিল। কী হবে যদি আমিও উপেনের মতো সেই জুরাসিক যুগেই আটকে যাই? ইষ্টনাম জপ করতে করতে আমি এসে দাঁড়ালাম মেশিনের চাকতিটার সামনে। মেঘনাদ তখন বিরাট মেশিনটা চালু করে থ্রিডি ডিসপ্লেতে ক্লিক করে করে ক্যালেন্ডার প্লেটে তারিখ পরিবর্তন করে নিয়ে যাচ্ছে ১৩০ মিলিয়ন বছর আগের একটা সময়ে। হোক না সে নিতান্ত বেড়াল উদ্ধারের একটা কেস, কিন্তু টেলিপোর্টেশনের মতো এক কিংবদন্তি প্রজেক্টের অংশ হয়ে একেবারে কলিযুগ থেকে জুরাসিক যুগে গিয়ে পড়ব, ব্যাপারটা ভেবে আর মেশিনটার ঘড়ঘড় শব্দ শুনে সমস্ত শরীরটা কী এক অদ্ভুত রোমাঞ্চে শিরশির করছে আমার। 

সব ব্যবস্থা যখন মোটামুটি রেডি, ঠিক তখনই একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটে গেল। আমি আর মেঘনাদ তখন সবে ঘুমন্ত টেরোড্যাকটিলের ক্রায়োজেনিক ক্যাপসুলটা ঘাড়ে করে বয়ে মেশিনটার সামনে পৌঁছেছি, এমন সময় দরজার দিক থেকে ভারী বুটের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, রবীন্দ্র তার সঙ্গে জনাতিনেক ষণ্ডামার্কা মুখোশ পরা লোকেদের নিয়ে হাজির হয়েছে ঘরের ভেতর। চেহারাই বলে দিচ্ছে, লোকগুলোর উদ্দেশ্য সৎ নয়। রবীন্দ্রর মুখে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে একটা বাঁকা হাসির রেখা। তার বন্দুকের ট্রিগার তাক করা সোজা আমাদের দিকে। বাকিদের হাতেও খোলা পিস্তল। রবীন্দ্র গটগট করে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে হাসতে হাসতে বলল, “কী, প্রফেসর? ভালোমুখে বলেছিলাম পাথরটা দিয়ে দিন। তখন শুনলেন না। এখন বলপ্রয়োগ করতে হবে।” 

এতগুলো খোলা পিস্তলের সামনে পড়ে তখন আমার আর মেঘনাদ দু’জনের মুখই ভয়ে শুকিয়ে গেছে। কেবল শুনতে পেলাম, সে বিড়বিড় করে বলছে, “লোভী! শয়তান! স্কাউন্ড্রেল! অনেক আগে কাজ থেকে বার করে দেওয়া উচিৎ ছিল আমার।” 

রবীন্দ্রর নির্দেশে একটা বন্দুকধারী লোক এগিয়ে এসে জোর করে মেঘনাদের আঙ্গুল থেকে পাথরের আংটিটা খুলে নিয়ে রবীন্দ্রর হাতে দিল। রবীন্দ্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা চোখের সামনে এনে ভালো করে পরীক্ষা করে খুশি খুশি মুখে মধ্যমায় পরতে পরতে বলল, “আংটিটা বানানোর সময়ই কিছুটা পাথরের গুঁড়ো আমি আলাদা করে সরিয়ে রেখে ল্যাবে পাঠিয়েছিলাম। সন্দেহ আমার একটা হয়েছিল বটে যে এটা খুব দামী পাথর। কার্বন ডেটিং করে জানা গেল এটা নাকি জুরাসিক যুগের পাথর। মানে বর্তমান সময়ে এটার মূল্য অমূল্য। তারপর থেকেই ওটা হাতানোর মতলবে ছিলাম, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আমার অলরেডি বায়ার ফিক্স করা হয়ে গেছে। এটা বেচে আমি এত টাকা রোজগার করব, যে বাকি জীবনটা আর চিন্তাই করতে হবে না। তবে হ্যাঁ, বোনাস হিসেবে ওই টেরোড্যাকটিলটাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাব। বর্তমান সময়ে এই ডায়নোসরের বাচ্চাটাই আমাকে রাজা করে দেবে! হা-হা-হা!” রবীন্দ্রর চোখে ঝিলিক দিয়ে গেল লোভের একটা ধারালো রশ্মির রেখা। 

আমার মাথাটা হঠাৎ প্রচন্ড গরম হয়ে গেল। রবীন্দ্র বন্দুক বাগিয়ে টেরোড্যাকটিলের ক্যাপসুলের দিকে এগিয়ে যেতেই মেজাজ হারালাম। ছুটে গেলাম তার দিকে। দেখাদেখি সেই ষণ্ডামার্কা লোকগুলোও ছুটে এল আমার দিকে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মেঘনাদের সেই অত্যাশ্চর্য লিক্যুইডক্লকের গুণেই হয়তো তারা কেউ আমাকে ধরতেই পারল না। 

শিঙ্গি মাছের মতো পিছলে আমি সোজা লাফিয়ে পড়লাম রবীন্দ্রর সামনে, তারপর মারলাম তার বুকে একটা মোক্ষম ধাক্কা। মুখে “আঁক!” করে একটা শব্দ করে রবীন্দ্র টেরোড্যাকটিলের ক্যাপসুলটা নিয়ে জড়াজড়ি করে গড়াতে গড়াতে সোজা এসে পড়ল মেশিনের চওড়া গোল চাকতিটার উপর। টেরোড্যাকটিলের ততক্ষণে ঘুম ভেঙেছে, কাঁচের টুকরো ভেঙ্গে গিয়ে তখন ক্যাপসুলটা থেকে সে মুক্ত হয়ে বিশাল ডানা মেলে মুখে একটা তীব্র হিংস্র চিৎকার করে উঠল। তার গনগনে চোখে যেন ফেটে পড়ছে রক্তলোলুপ দৃষ্টি। তীক্ষ্ণ দাঁতওয়ালা চঞ্চু বাগিয়ে সে তখন আক্রমণ করেছে রবীন্দ্রকে, আর হতভাগ্য রবীন্দ্র চাকতিটার উপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে সেটার আক্রমণ থেকে নিজেকে প্রতিহত করতে চাইছে। সে এক অভাবনীয় ভয়ঙ্কর দৃশ্য! চোখের সামনে অত বড় ডায়নোসরটাকে উড়ে উড়ে আক্রমণ করতে দেখে বাকি লোকগুলোও তখন চিৎকার করে ছুটে পালাতে লেগেছে। 

টেরোড্যাকটিলের ঠোঁটের আঘাতে রবীন্দ্র হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেশিনটার উপর। একটা বড় লাল বোতামে তার কনুই-এর চাপ লেগে মানুষপ্রমাণ লম্বা টাইম পোর্টাল মেশিনটা ঘড়ঘড় শব্দে নড়েচড়ে উঠল। উড়ন্ত টেরোড্যাকটিলটাকে তখন গুলি করবে বলে মরিয়া হয়ে তার দিকে তখন পিস্তল তাক করেছে ক্ষত-বিক্ষত রবীন্দ্র ঠাকুর। 

চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই মেশিনের মাথার উপর রাখা ব্যাটারির থেকে তীব্র বৈদ্যুতিক আলোকছটা বেরিয়ে এসে দ্রুত আঘাত করল রবীন্দ্রর আঙুলে পরে থাকা সেই হলদে চকচকে পাথরটায়। নিমেষে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরল উজ্জ্বল সাদা আলোর বর্ণচ্ছটা। সেই আলোর তীব্র তেজে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কেবল ধোঁয়ার কুন্ডলীর পেছন থেকে একটা মানুষের চিৎকার আর টেরোড্যাকটিলটার ভয়ঙ্কর তীক্ষ্ণ গর্জন শুনতে পেলাম। 

কয়েক সেকেন্ড মাত্র। মেশিনের কম্পন তখন থেমে গেছে। ধোঁয়ার কুন্ডলী সরে যেতেই চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দেখলাম, কোথায় রবীন্দ্র আর কোথায়ই বা সেই উড়ন্ত প্রাগৈতিহাসিক ডায়নোসর পাখি? মেশিনের চাকতির উপর তাদের কারুর চিহ্নমাত্র নেই। কেবল সেখানে চুপ করে বসে পরম আনন্দে নিজের থাবা চাটছে উপেন। পরীক্ষার সাবজেক্ট সেই ইঁদুরটাকে সে ততক্ষণে উদরস্থ করে ফেলেছে। বেশ বুঝতে পারলাম, মেঘনাদের আবিষ্কার করা এই হাইটেক টাইম পোর্টাল মেশিনটা রবীন্দ্র আর তার আঙ্গুলের পাথর বসানো আংটিসহ গোটা টেরোড্যাকটিলটাকে টেলিপোর্ট করে দিয়েছে সেই জুরাসিক যুগে, আর পরিবর্তে মেঘনাদের পোষা অরেঞ্জ ক্যাট উপেন আবার ফিরে এসেছে স্বস্থানে। আমার হয়ে বেচারা রবীন্দ্রই কার্যসিদ্ধি করে দিল। 

আমি ছুটে গিয়ে লোহার একটা রড মাটি থেকে তুলে বাড়ি মেরে মেরে মেশিনের ক্যালেন্ডার প্লেটটা ভেঙে দিলাম, যাতে রবীন্দ্র আবার এখানে টেলিপোর্ট হতে না পারে। আমার কান্ড দেখে মেঘনাদ “গেল, গেল, সব গেল!” বলে মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠল। আর সেই দৃশ্য দেখে গোলাকার চাকতির উপর বসে থাকা উপেন, এই প্রথমবার, আমার দিকে খুশি মুখে তাকিয়ে “ম্যাঁও!” শব্দে ডেকে উঠে পশমের মতো মোটা লেজটা নাড়িয়ে টুপ করে লাফিয়ে নীচে নেমে এসে পায়ে মাথা ঘষতে লাগল। 

উপেন উধাও কান্ড সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!