দার্জিলিংয়ের দুর্যোগ ছোটগল্প – অর্ঘ্য শূররায়
বাঙালি মাত্রই ভ্রমণ বিলাসী,এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।আমার গল্পের নায়ক রিতেশ এর ব্যাতিক্রম না।ছোটবেলা থেকে বাবা মা এর সাথে বছরে একবার ঘুরতে যেত।দেশের বেশিরভাগ জায়গা ঘোরা হয়ে গেছে।এখন কলেজ পাস করে বন্ধুদের সাথে অথবা নিজে একা আবার ঘুরতে যাওয়া শুরু করেছে।
এবার বছরের শেষ কয়টা দিন বহুবার যাওয়া দার্জিলিং এ কাটাবে বলে স্থির করলো।সঙ্গে কোনো বন্ধু জোটেনি,তাই একটু জেদের বসেই একা যাবে বলে ঠিক করে ফেললো।
অক্টোবর থেকেই জম্পেশ শীত।পাহাড়ি অঞ্চলে আরো বেশি,হিমাঙ্কর কাছাকাছি হবে,সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।রিতেশ খুব খুশি।যত শীত,ততই বরফ দেখার সুযোগ বাড়ে।তাই নেট ঘেঁটে হোটেল বুক করে নিল। কোলাহল থেকে দূরে,দার্জিলিং এ পর্যটকরা যেখানে সচারাচর ওঠেনা,সেইরকম একটা হোটেল। নেটে দেখলো খুব সুন্দর,ছিমছাম।চারিদিকে শুধুই সবুজ আর পাহাড়ের হাতছানি।অনেকটা কটেজের মতোই।কিন্তু রুমের ছবিটা অস্পষ্ট।দোতলা,কাঠের তৈরি।পাহাড়ের এর খাঁজে।নাম: স্ট্যানলিস ইন।রেটিং পাওয়ার কথা নয়।কয়জন যায় সেটাই সন্দেহ। তাও রিতেশ এই হোটেলেই উঠবে বলে ঠিক করলো।যত কষ্ট হোক,যা বেডিং নিয়ে যাবে,তাতেই কাজ হয়ে যাবে।শুধু নিরিবিলি হওয়া চাই।হোটেলটা জনশূন্য হলেও ক্ষতি নেই।
যেমন ভাবা,তেমন কাজ।কাঞ্চনকন্যা ধরে নির্ধারিত দিনে পৌঁছালো।সাধারণত দেখা যায়, নেটে যে সব ছবি আর কথা লেখা থাকে,সেগুলো একটু বাড়তি হয়।বাস্তবে মেলেনা।তাই নিয়ে বিস্তর অভিযোগ।কিন্তু রিতেশ এর এতদিনকার অভিজ্ঞতা হার মানলো এই হোটেল দেখে।সে যা যা কল্পনাও করেনি,তেমন সুন্দর আর মন মত এই হোটেলটা।চারিদিকটা একদম ফাঁকা।দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।এখন কিছুটা আবছা,কারণ চারিদিকে কুয়াশার চাদরে মোড়া।ম্যানেজার মিস্টার লামা রিসিভ করে দোতলার এক ঘরে পৌঁছে দিল।ঘরটা রিতেশ নিজেই পছন্দ করলো।সোজা একটা টিলার উপর ঘরটা দাড়িয়ে আছে।নিচে অনেকটা দেখা যায়।যেনো ঝুলন্ত এক রোপওয়েতে রিতেশ বসে আছে। কিছু স্নাকস খেয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল।ঘুম যখন ভাঙলো তখন ধুম্র বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের গা জুড়ে কেউ যেনো সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালালো।অকাল দীপাবলি।কখনো মনেহচ্ছে বুঝি সন্ধ্যাতারা রিতেশ এর কাঁচের জানলায় অপেক্ষমান।এমন দৃশ্যের সাক্ষী কোনোবার হয়নি সে।রিতেশ উত্তেজনায় ফুটছে।তার অনেকদিনের ইচ্ছাগুলো যেনো ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।ঝাপসা কাঁচ সরাতেই সে যেনো মহাকাশের আত্মীয়তা গ্রহণ করলো।ঝটপট ক্যামেরায় বন্দী করলো দৃশ্যগুলোকে।নিজেকেই নিজে ধন্যবাদ জানালো। একা না আসলে আর সর্বোপরি এই হোটেলটা না পেলে হয়তো এইরকম অপার্থিব সৌন্দয্যের আস্বাদন হতো না।
হোটেলে রিতেশ একমাত্র রয়েছে।করিডোরে একটা মৃদু আলো জ্বলছে।হোটেলের চারিধারে পাইনের জঙ্গল।ম্যানেজার জানিয়েছে মাঝে মাঝে নাকি নেকড়ে আর জংলী কুকুরের ডাক ভেসে আসে।হয়তো খুব নির্জন বলে পর্যটকরা বেশি আসেনা।কিন্তু রিতেশের মত প্রকৃতির টানে যারা আসে, তারা বারবার এখানে আসবেই।
হোটেলে সে,আর দুজন।একজন কুক।আর একজন অ্যাটেনডেন্ট। বৃদ্ধ ব্রিজেস লামা।খুব আমুদে।তবে রাতে হোটেলে থাকে শুধু অ্যাটেনডেন্ট।বাকিরা বাড়ি চলে যায়।লামা এইমাত্র জানিয়ে গেলো সে আর কুক আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির পথ ধরবে।রাতের খাওয়া গরম পাত্রে দিয়ে গেলো।
এই মাত্র হোটেলে কারেন্ট চলে গেল।ঘরে মোমবাতি জ্বালালো। রীতেশের বেশ রোমাঞ্চকর মনে হলো।ওর কাছেও একটা বড়ো ব্যাটারির টর্চ আছে।তাই কোনো অসুবিধা নেই।এমন পরিবেশে পাহাড়ের গায়ে টিমটিম করে আলোগুলো আরো স্পষ্ট আর উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।তীব্র শীতের রাত সঙ্গে ক্যান্ডেল লাইট একদম পারফেক্ট,রীতেশের জন্যে।
দিনদুয়েক থাকবে।এখান থেকে ম্যালে দশ মিনিটের পথ।সব তাই চেনা।কিন্তু এইরকম পরিবেশ আর হোটেলটাই নতুন আবিষ্কার।জানলার দিকে তাকিয়ে থাকলেই রাত শেষ হয়ে যাবে।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুম এসেছে মনে নেই।হটাৎ গায়ে তীব্র জ্বালা বোধ করায় ঘুম ভেংগে গেল।সজোরে দরজা খুলে একবার ডাক ছাড়লো,কিন্তু কেউ এলো না।লেপ,কম্বল ছেড়ে,ঊর্ধ্বশ্বাসে রিতেশ ঘর থেকে বেরিয়ে সটান রাস্তায় তারপর পাইনের গভীর জঙ্গলের পথে ছুটতে লাগলো।এত ঠাণ্ডা, তাও গায়ে জ্বালা দিচ্ছে।সারা গায়ে যেনো আগুন ধরে গেছে।যেনো একটা আগুনের হল্কা তাকে তাড়া করছে।ধীরে ধীরে তার পোশাকে আগুন ধরে যাচ্ছে।সে আর্তনাদ করছে।পোশাক খুলে ফেলার চেষ্টা করছে কিন্তু আগুন আরো আকড়ে ধরছে।রিতেশ দেখার চেষ্টা করছে,কোথায় আগুন লাগলো।কিন্তু অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না।মুহূর্তে রিতেশ থেমে গেলো।অন্ধকারে তো আগুন দেখা যায়!কিন্তু সে কেন দেখতে পারছেনা?কিন্তু কোথা আগুনের ছ্যাঁকা তার সারা দেহে জ্বালা ধরাচ্ছে?মোমবাতি থেকেই আগুন ধরেছে?কেউ কেনো তাকে বাঁচাতে আসছেনা। পিছনে দেখলেই শুধু ঘন অন্ধকার।ভাবতে ভাবতে
প্রচন্ড আঘাত লাগলো। পাথরে লেগে পা হড়কে পড়ে জ্ঞান হারালো রিতেশ।
আজ সেই দিন।হাঁটুর সেলাই আর পিঠের পোড়া আবছা দাগগুলো এক বছর পরেও সেই ঘটনার জানান দিচ্ছে।ফেসবুক মেমোরি দেখালো।রিতেশ পৌঁছানোর পর হোটেল আর আসপাশের চোখ জুড়ানো ছবি পোস্ট করেছিল।কি থেকে যে কি হয়ে গেলো, আজও অজানা!বৃদ্ধ লামা ওই রাতে কোথা থেকে দেবদূতের মত তাকে রক্ষা করলো,সেটাও অজানা!
সে যাইহোক,লামার জন্য বেচেঁ ফিরেছে।মা বাবা আর একা রিতেশকে ছাড়েনি আজ পর্যন্ত।বাবাকে নাকি লামা ফোন করে দুর্ঘটনার কথা জানিয়ে ছিল।
কিছুটা কৌতূহল বশত রিতেশ গুগলে সার্চ মারলো।এত সুন্দর হোটেলের এখন কি অবস্থা কি জানি!কিন্তু গুগলের তথ্যগুলো রিতেশকে হতবাক করে দিলো।এটা কি সত্যি? আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে জন স্ট্যানলি নামে এক সাহেব ,তার মেয়েকে জন্মদিনের উপহার দিল এই সবুজে ঘেরা হোটেল।মেয়ের জন্মদিনের পার্টি চলছে,হটাৎ আগুন লেগে পুরো হোটেলটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।সবাই আগুনের গ্রাসে প্রাণ হারালো। ওদের খাস ভৃত্য ব্রিজেস লামা!ওই স্ট্যানলি সাহেবের একমাত্র মেয়েকে সর্বগ্রাসী আগুন থেকে বাঁচিয়েছিল!সেই থেকেই হোটেলটা ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়ে আছে আজ পর্যন্ত।
কিভাবে সম্ভব? রীতেশের সারা শরীরে একটা অজানা কম্পন হতে লাগলো।
নাহ! এটা শীতের কম্পন নয়!
দার্জিলিংয়ের দুর্যোগ ছোটগল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
গল্প হলেও সত্যি
প্রচ্ছদ
কায়দায় জীয়ন কায়দায় মরণ