পালঙ্ক ভৌতিক গল্প – চন্দ্রাণী গুপ্ত ব্যানার্জি
ছোট্ট মেয়ে লক্ষী। ফর্সা রং ,গোলগাল চেহারা, বড় বড় ডাগর ডাগর চোখ। লাল টুকটুক ,ফুল ছাপ ফ্রক পড়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়ায় সে। তার মা গড়িয়ে দিয়েছে তাকে এক জোড়া রূপোর নুপুর। দুই দাদা ও মা-বাবার সাথে লক্ষী কোয়ার্টারে থাকে। সকলের চোখের মনি সে। মফস্বল শহরে লক্ষীর বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী বদলি হয়ে এসেছেন। ওনার স্ত্রী প্রতিমা দেবী গৃহবধূ ।সারাদিন মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরে
লক্ষীর দিন কেটে যায়। দুই দাদা ইস্কুলে যায়, লেখাপড়া করে । বিকেল হলে পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করে। লক্ষীর বয়স তখন কতই বা। চার কিংবা পাঁচ ।তখন সবে ইংরেজরা ভারত ছেড়েছে ।নতুন কোয়ার্টারে আসায় সেরকমভাবে খেলার সাথীদের জোগাড় করে উঠতে পারেনি ছোট্ট মেয়েটি। দাদাদের তুলনায় একটু মুখচোরা সে। খুব একটা কথা বার্তা বলে না। নিজের মনেই কোয়ার্টারের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় সে। বাবা ও দাদারা যখন বাড়ি থাকেনা, তখন পুতুল খেলায় ব্যস্ত থাকে। ছাদে একটা চিলেকোঠা আছে সেখানেই তার গোটা একটা জগত ।ঘন্টার পর ঘন্টা একা একাই খেলে চলে সে ।স্বাধীনতার সময়কার রেল কোম্পানির এই কোয়ার্টারটি বেশ জনবিরল জায়গাতে ছিল। আশেপাশে খুব কম বাড়ি ঘরদোর। সন্ধ্যে হলেই যেন অন্ধকার ঝুপ করে নেমে আসে। বাবা স্টেশন থেকে ফিরে আসেন সন্ধ্যের পর। হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নেন। সারা দিনের ক্লান্তির পর একটু ঝিমুনি চলে আসে । দাদারা তখন লন্ঠনের আলোয় মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে চলেছে। আর ওদিকে মা রান্নাঘরে রাতের রান্না করতে ব্যস্ত। রান্নাঘরটা লাগোয়া নয়। সামান্য একটু দূরে। লক্ষী সারাদিন বাবাকে পায়না। তাই সন্ধ্যের পর বাবা কাজ থেকে ফিরে এলেই লক্ষী একদম বাবার গায়ের সাথে লেপ্টে বসে থাকে। দাদাদের কাউকে ঘেঁষতে দেয় না।এ নিয়ে দাদারা হাসাহাসিও করে।এ হেন লক্ষী আজও বাবার পায়ের কাছে বসে তার আদরের পুতুল ঝুমিকে নিয়ে খেলছে। কিন্তু আজকাল খেলাতে তার একদম মন লাগে না। কেন জানিনা। পুতুলের বাক্সে পুতুল গুলিকে সাজিয়ে রাখে। কিন্তু প্রতিদিনই পুতুল গুলোকে উলটপালট অবস্থায় সে দেখতে পায় ।মাকে বলেওছিল । কিন্তু মা কিছুতেই বুঝতে পারল না। তাই লক্ষী নিজের মতো করে পুরো ব্যাপারটাকে বোঝার চেষ্টা করছে ।দাদারা ইস্কুলে চলে গেলে বাড়িটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করে ।বাবা তো সেই কখন সকাল বেলা কাজে বেরিয়ে পড়ে। মা নিজের কাজেই মশগুল থাকে । লক্ষী টের পায় তাকে কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে।তাই আগের থেকেও বেশি মায়ের পায়ে পায়ে ঘোরে সে।একমুহূর্তও মাকে ছাড়া সে থাকতে চায় না। মায়ের আঁচলে আঙ্গুল বেঁধে রাখে লক্ষী ।গত পরশু ছাদের চিলেকোঠার ঘরে পুতুলের বিয়ে দিচ্ছিল। এই ছাদের ঘরটায় বেশ কিছুদিন আগে একটা পুরনো বাক্স খুঁজে পায় ।সেই বাক্সটায় ছিল বেশ কয়েকটা পুরোনো ,রঙ চটা পুতুল। বেশ ডাগর ডাগর চোখে পুতুলগুলো তার দিকে তাকিয়ে ছিল। লক্ষ্মীও অসীম বিষ্ময়ে তাদের দিকে চোখ মেলে দেখছিল ।একটা বিশাল গুপ্তধনের সন্ধান সে যেন পেয়ে গেছে। এই পুতুলের যেদিন বিয়ে সেদিনই তাকে প্রথম দেখে লক্ষ্মী। কিভাবে যেন সবার অজান্তে টুকটুক করে ছাদে চলে এসেছিল মেয়েটি ।লক্ষ্মী তার সাথে কথা বলতে চাইলেও আর দেখা মেলেনি তার। কোথায় যেন সে পালিয়ে গেল ।আর দেখা গেল না। সবাই অবিশ্বাস করে তাকে হাসবে ,এই আশঙ্কায় লক্ষী এবারেও চুপ করে রইলো ।রুক্ষ, এলোমেলো চুলে তেল না দেওয়া মেয়েটিকে এরপর কিছুদিন আর দেখা পেল না লক্ষী।কোয়াটারের বড়ো বড়ো ঘরগুলোতে লক্ষীর বড্ড ভয় করে। ভয়ে কুঁকড়ে থাকে সে। সন্ধ্যে হলেই শরীরটা যেন কিরকম ভারী হয়ে যেতে থাকে। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকায় বাবাই তার একমাত্র ভরসা। একা একা থাকাটাই তার বড্ড বেশি ভয়ের।গ্রামের বাড়ি থেকে যখন লক্ষীরা এ কোয়ার্টারে চলে আসে তখন তাদের সব কিছু জিনিসপত্র আনা সম্ভবপর হয়নি। কিছু কিছু জিনিসপত্রই আনা গেছিল। এই কোয়ার্টারে যারা আগে থাকতেন তাদের একখানা পেল্লাই সাইজের পালঙ্ক এখানে রয়ে গেছে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তারা এই পালঙ্ক আর সাথে নিয়ে যান নি। তাছাড়া অত বড় পালঙ্ক টি নিয়ে যাওয়াও খুব দুষ্কর। সেই পালঙ্ক দেখতে অদ্ভুত রকমের সুন্দর । লক্ষ্মী ও তার মা সেই পালঙ্কটাতেই শোয়। মশার বডড উপদ্রব। তাই মা ও মেয়ে মশারি খাটিয়ে শুয়ে ছিলেন। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ খুব বেশি ।এখানে ডাক্তার বদি্্য ও মেলা ভার।রাতের খাওয়া দাওয়ার পর লক্ষী গুটিসুটি মেরে তার মায়ের সাথে শুয়ে পড়ে। নিশুতি রাত। কোথাও কোন শব্দ নেই। পাশের ঘরে দাদারা বাবার সাথে শুয়ে পড়েছে। হঠাৎ বেশ রাতে ঘুম ভেঙে যায় লক্ষীর। ঘরের কোণে লন্ঠনের কমিয়ে রাখা মিটমিটে আলোয় কিছু একটা চোখে পড়ে তার। মশারির উপর কারো দুটো সরু সরু কাঠির মত হাত। ভয়ে আঁতকে ওঠে সে। চিৎকার করে মাকে ডাকতে চায় ।কিন্তু বের হয় না তার গলার স্বর। ভয়ে নড়াচড়াও করতে পারে না সে। অতি কষ্টে একটা গোঁ গোঁ অপার্থিব আওয়াজ গলা থেকে বের করতে পারে ।তারপর আর কিছু মনে নেই। এরপর বেশ কয়েকবার লক্ষী মশারির ওপর সেই অদ্ভুত দর্শন কাঠির মতন আঙ্গুল দেখতে পায়। “কাঠি, কাঠি ” বলে সবাইকে রাতের ঘটনা বোঝাতে চায় ।কিন্তু “কাঠি” শব্দের অর্থ মা কিংবা বাড়ির বাকি লোকেদের ঠিক বোধগম্য হয় না।ছোট্ট শিশুর মনের গহীনে থাকা শব্দের সঠিক অর্থ বুঝতে সকলেই ব্যর্থ হয়। লক্ষ্মী তাই নিজের মধ্যে কুঁকড়ে যেতে থাকে। দিনে দিনে শুকিয়ে নেতিয়ে পড়ে সে। সন্ধ্যের পর অন্ধকারে ভয় যেন আরো বেশি করে তাকে চেপে বসে ।মা রান্না ঘরে তাকে ডাকলেও সে একা উঠোন ডিঙিয়ে আর সে ঘরে যায় না ।যে লক্ষী আগে কোয়ার্টারে পাখির মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াতো সেই ছোট্ট মেয়েটা যেন হারিয়ে গেছে ।চোখ মুখ কোটরাগত। অনেক চেষ্টা করেও তার স্বাস্থ্য আর ফিরছে না ।ডাক্তার বদি্্য অনেক হলো কিন্তু কিছুতেই কোন লাভ হল না। ফুলের মতন মেয়েটা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে লাগলো। সারাটা দিন সেই পালঙ্কে শুয়ে থাকে।ওঠার নাম নেয় না। চিলেকোঠার ঘরে তার সাধের পুতুলগুলো গুমড়ে গুমড়ে কাঁদে তার জন্য। চিন্তায় পড়ে যায় তার মা-বাবা ও দাদারা।
এমনি এক বর্ষণমুখর দিনে ধুম জ্বর ওঠে লক্ষীর। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে শুরু করে সে।
— ” তোর সাথে আমি পুতুল খেলব না। আমি যাব না ,আমি যাব না তোর সাথে।”
বারবার একই কথা বলতে থাকে সে। খবর দেওয়া হয় এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তিটিকে। সাথে আসেন মন্দিরের পুরোহিত মশাইও।লক্ষ্মী যে ঘরে পালঙ্কটিতে শুয়ে ছিল সেটাকে খুব ভালো করে তারা জরিপ করেন।বিগত কয়েকদিনের সমস্ত ঘটনাবলি শোনেন। তারপরএকে অপরের দিকে খুব গভীরভাবে তাকান ।
—“যদি মেয়েকে বাঁচাতে চান, আমরা বলব এই বাসস্থান অবিলম্বে আপনারা ত্যাগ করুন। আপনারা বোধহয় জানেন না এ পালঙ্কে আপনার মেয়ের বয়সী আর একটি মেয়ের শেষনিঃশ্বাস পড়েছিল ।আপনার মত পালিতবাবুরও একটি কন্যাসন্তান ছিল। তিনি তার পরিবার নিয়ে এই কোয়ার্টারেই থাকতেন ।খুব ম্যালেরিয়া জ্বর হয় সেবার। এই অঞ্চলের প্রচুর লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। পালিতবাবুর মেয়ে খুকুও তাদের মধ্যে একজন ছিল। মেয়ের মৃত্যুর পর পালিতবাবু আর এখানে থাকতে চাইলেন না। মেয়ের স্মৃতি এখানে তাকে থাকতে দিল না। তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তাকে।যে পালঙ্কে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল খুকু সেটাকে ফেলে চলে গেলেন ওনারা। চিলেকোঠারঘরে পড়ে রইল খুকুর সাধের খেলার পুতুলরা। খুকু বোধহয় তার অতৃপ্ততা নিয়ে এখানেই রয়ে গেছে। তার সমবয়সী সাথীর সাথে খেলতে চেয়েছে।তাই লক্ষ্মীকে নিয়ে যেতে চেয়েছে তার নিজের জগতে ।অতএব আর দেরি করবেন না।”
—বললেন প্রবীণ ব্যক্তি, চুলে পাক ধরা ,রায়বাবু।
মন্দিরের প্রবীণ পুরোহিত মশাই লক্ষ্মীর মাথায় ছুইয়ে দিলেন মন্ত্রপূতঃ আশীর্বাদী ফুল। সেই সপ্তাহেই আশুতোষবাবু তার পরিবার নিয়ে কোয়ার্টার বদল করেন এবং অন্য শহরে বদলির জন্য দরখাস্ত করেন। জায়গা বদল হওয়ার পর লক্ষীর আর কখনো কোন সমস্যা হয়নি। পরবর্তীকালে লক্ষী যখন বার্ধক্যের দোরগোড়ায় তখন তার মুখেই এ কাহিনীটি আমার শোনা।
পালঙ্ক ভৌতিক গল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন