কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪২৯ » ছোটগল্প » প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তন ছোটগল্প – অভিষেক ঘোষ

“এখন যদি বাইরে এক পা-ও যাও… আমায় কোনোদিনও ‘মা’ বলে ডাকবে না.. আমি আর তোমার মা হব না ! যাও না বাইরে… জানো না তো.. ঠিক দুপ্পুরবেলা, ভূতে মারে ঠেলা । শয়তানে আঁচড়ে দেয় ।” – সন্দীপ মনে করার চেষ্টা করছিল, এসব বলে তাকে ছেলেবেলায় ঘরে বসিয়ে রাখা যেত কিনা ! মুশকিল হল সেই কবেকার শাসনের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে, অথচ সেই শাসনে কাজ হয়েছিল কিনা, তা আর কিছুতেই মনে পড়ে না ! শয়তানের আঁচড় যে আসলে অসাবধানে কুল কাঁটা বা, বাবলা কাঁটায় হাতে-পায়ে ছড়ে যাওয়ার দাগ, তা সেই শৈশবে কখনও মনে হয় নি ! সন্দীপের সেই ছেলেবেলাটাকে আরেকবার ফিরে পাবার জন্য একটা অদ্ভুত আকুতি জাগে বুকের মধ্যে । একবার ফিরতে পারলে সে কত কিছু শুধরে নেবে, ভাবতে থাকে সে । কত ভুল আছে, যা ঠিক করে নেওয়া গেলে, জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যেত ।

কোনোদিন একটা প্রণাম না করা, একটা ক্ষমা না চাওয়া, একটা আদর করার মতো ঠোঁট ফিরিয়ে দেওয়া, একটা ভালোবেসে এগিয়ে দেওয়া চকোলেট ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার খেদ আজও তাকে তাড়া করে বেড়ায় । তবে এসব কিছুই নয় । ভুলের তালিকা স্মরণ করলে সন্দীপ ঘামতে থাকে । তখন প্রতিক্রিয়া হয় উলটো, মনে হয় এর চেয়ে সব ভুলে যেতে পারলে ভালো হত – শান্তি পেত সে ।

শীতের প্রকোপ এদিকটায় কলকাতার তুলনায় কিছু বেশি । গাছপালারও যে একটা গন্ধ থাকে, এখানে এলে মনে পড়ে যায় তার । সন্ধ্যা নামছে, ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর গায়ে টেনে নিচ্ছে রাত । তেমনি ভাবে স্মৃতির সহস্র লতাপাতা ক্রমশ জড়িয়ে ধরছে তাকে । কেবল বিষাদমাখা স্মৃতিতে মন দুমড়ে দেওয়াই নয়, পাকা আমের মতো কোনো কোনো মধুর স্মৃতিও এখন ঝুলছে তার চোখের সামনে ।

                             *  *  *  *  *

ধুলো ঝেড়ে সেই পুরাতন ঘরটায় এই এত বছর পরে আবার নতুন বিছানা পাতা হয়েছে । পায়ে মোজা পরেই সন্দীপ লাফিয়ে উঠে পড়েছে বিছানায় আর দু চোখ বুজে ডুব দিয়েছে অতীতে – জীবনানন্দ ঠিকই বলেছিলেন –

“পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল” !

জোনাকিই বটে । জ্বলছে, নিভছে । এখন শব্দ নেই কোনো আশেপাশে । পাখির ঘরে ফেরা সাঙ্গ হয়েছে, সান্ধ্য শাঁখের রব থেমেছে কিছুক্ষণ । একটু আগে বিলম্বিত লয়ে টেনে টেনে একটা কুকুর ডেকে উঠেছিল কোথাও । তারপর সম্ভবত কেউ বিরক্ত হয়ে তাকে কিছু ছুঁড়ে মেরে তাড়িয়েছে । এখন সব শান্ত । সন্দীপের মনে পড়ে যায় ছেলেবেলায় ভালো লেগে যাওয়া একটা গান আর দুই পংক্তির রহস্য । ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে…’ গানটায়  দুটো লাইন আছে, ‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’ আর ‘আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী’ ! সেই বয়সে এই লাইনদুটো ছিল এক দুর্ভেদ্য রহস্য । সন্দীপ ভাবতো, সোনার মন্দিরের দরজা খুলে যাওয়ার অর্থটা কী ? ‘মা’ কি তাহলে ভিতরে ছিলেন নাকি, বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন এতদিন ? দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসার মানেই বা কী ? গানের সুর অবশ্য সব ছাপিয়ে ভালো লেগেছিল ।

বাবা সন্তোষের ক্যাসেট প্লেয়ার কিনে এনেছিল যখন, তখন বছর দশেক বয়স সন্দীপের । তারপর কুড়ি বছর কেটে গিয়েছে, কিন্তু এখনও সন্দীপের মনে আছে, এক কালীপুজোর রাতে ‘ফিদা’-র মিউজিক অ্যালবাম এসেছিল, আরেকবার দুর্গা পুজোয় বায়না করে কিনেছিল ‘কেয়া কহনা’র গানের ক্যাসেট । মান্না দে, হেমন্ত, সন্ধ্যা, লতা, দেবব্রত বিশ্বাস নিয়মিত বাজতো তাদের বাড়িতে । তখনও যৌথ পরিবার – ভাঙল যখন তখন বোঝা গেল, এবার থেকে একই ছাদের নীচে দুই পৃথক উনুন জ্বলবে যেমন, তেমনই এক পক্ষের গান-বাজনার সাথে প্রতিযোগিতা চলবে অন্য পক্ষের পছন্দেরও । সন্দীপের হঠাৎ মনে পড়ে গেল ‘বুদ্ধু-ভুতুম’-এর সেই অদ্ভুত গানটা – ‘এই না হাট গমগম, সঙ্গে সঙ্গে ভাঙে !’ আজ হাট সত্যিই ভেঙেছে, এই ফাঁকা বাড়িটার চারপাশে ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে মশা, সাপ-খোপ আর ঝোপ-ঝাড়ের ত্রিশক্তি আঁতাত । কাল সকালেই একটু সাফ-সুতরো করতে হবে বাড়িটার চারিদিক । এগোতে থাকা গাছ-পালাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, এ বাড়িতে আবার একটা মানুষ এসেছে । এবং সে ফিরেছে কিছুদিন অন্তত থাকার জন্যই । হেরে পালিয়ে যাওয়ার জন্য নয় ।

                            *  *  *  *  *

ভাবের ঘোরে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল সন্দীপ । একটা বাঁশির শব্দে সহসা ঘুম ভাঙে তার । মোবাইলে আঙুল ছুঁয়ে টের পায় রাত পৌনে দুটো বাজে । এখানেই সন্দীপের জীবনের সমস্ত গল্প শুরু হয়েছিল, সমস্ত সমঝোতাও । জীবন যে ফড়িংয়েরই, তাতে কোনো সন্দেহই নেই তার । কেউ কোথাও বসতে দিতে চায় না শুধু । ছোট্ট পাখনা দুটো মেলে উড়তে উড়তে ক্লান্ত সে । অন্তত কোনো কচু পাতা বা, শুকনো ডালেও তো বসতে পারতো সে ! কিন্তু নাহ্, সেটুকুও সয় না মধ্যবিত্তের কপালে । এখন দেখা যাক এত রাতে ‘কে তুমি আমারে ডাকো ?’ দরজা খুলে দেয় সন্দীপ । গ্রামের দুই স্বঘোষিত মাতব্বর ।

“আরে ! কাকা এত রাতে ? বাঁশি কেন ?”

“খুব ঘুমোচ্ছিলে বুঝি ? আরে আমাদের কি আর চিন্তা কম ভায়া ! এই তো গত পরশুই মিত্তির পাড়ায় ডাকাতি হল । যদিও তোমাদের ঘরে কিছুই নেই, তবু তুমি নিজে তো একলা আছ ! বলা তো যায় না – শহরের চকচকে জিনিস দেখে সোনাদানা মনে করে তোমাকেই না তুলে নিয়ে যায় ! আমাদের তো একটা দায়িত্ব আছে নাকি !” – বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে থাকেন বছর পঞ্চাশের পাল বাবু, সঙ্গে উপস্থিত মধু চক্কোত্তিও হাসতে থাকে । 

গ্রামের লোকজনের চোখে সে এখন বহিরাগত, এটা সন্দীপ বোঝে । সন্দীপ পাত্তা না দিয়ে, শান্ত মুখেই বলে, “কাকা চিন্তা নেই, আপনারা থাকতে আমায় কেউ তুলে নিয়ে যাবে না । এবার একটু ঘুমোই ? আপনারা ও যান, অনেক রাত হল ।” 

দু-জনেরই মুখ দেখে মনে হল কথাগুলো তাদের পছন্দ হয় নি । বোধহয় গল্পের আসর বসাবার তালে ছিল । আবার দূরে একটা কুকুর সেই তখনকার মতো টেনে টেনে ডাকছে । পাল বাবু এক-পা পিছিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তাহলে শুয়ে পড়ো । আমারাও যাই । চলো মধু, সবাই তো আর আমাদের মতো নিশাচর নয় ।”

মধু চক্কোত্তি সায় দেয়, “তা যা বলেছো ।”

দুই মূর্তি হাঁটতে হাঁটতে ল্যাম্প পোস্ট পেরিয়ে, অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে সন্দীপ ও দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল । এই ঘর হল ভালোবাসা, আশা আর স্বপ্নের শুরুয়াত । ছেলেবেলায় লাফিয়ে লাফিয়ে অনেক মুঠো মুঠো স্বপ্ন সে ধরতে চেয়েছিল, সে সব অধরাই থেকে গেছে । সেই সব স্বপ্নের শবদেহ মারিয়ে সে একদিন শহরে চলে গিয়েছিল । “বাংলা ভাষার এই এক মাধুর্য, আসছি বলে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যায়” – সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন বোধহয় ! কিন্তু সেই শহর তাকে কলুর চোখ বাঁধা বলদের মতো পাক খাওয়াচ্ছিল চাকরি নামক ঘানির চারপাশে । একটু মুক্তির আশায়, একটু শান্তি পেতে, সে ফিরেছে । খুব কি অসম্ভব তা ? একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে চায় সে ।

                            *  *  *  *  *

জীবনে একটা ভালো, নিরূপদ্রব, নিরাপদ বাসস্থানের চেয়ে বড়ো আর কিছু হয় না – আরো ভালো হয় যদি তোমার ছোট্ট ঘরেও সব প্রিয় বন্ধুদের জায়গা হয়ে যায় । এগুলো আজ প্রতি মুহূর্তে বোঝে সন্দীপ । আজ এই এত বছরেও শহরে পাকাপাকি কিছু হল না । কবে একটা ফ্ল্যাট হবে কে জানে ! দাম যে হারে বাড়ছে ! ওদিকে ক্রমশ নির্বান্ধব আর একলা হয়ে পড়ছে সে । যোগাযোগ হারিয়ে ফেলছে চেনা আর প্রিয় দুনিয়ার সঙ্গে । একটা অচেনা আর মেকি দুনিয়ার ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছে সে ও তার মতো আরো অনেকে । কাকে বলবে সে, “দাদা, আমি বাঁচতে চাই ?”

একটু বেলা হতেই, ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়েছে সে । পুকুর পাড় পেরিয়ে এসেছে সে, নিজের পাড়া ফেলে এগিয়ে এসেছে । ওই পুকুরে একদিন কত সাঁতার কেটেছে গরমকালে, কলার ভেলা থেকে তাদের তোলা যেত না সারা দুপুর ! বাবাকে বেরিয়ে আসতে হতো লাঠি হাতে । পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেছে, ‘মনে আছে মাছ, জলে হয়েছিল দেখা ?

ডোবা আর ভাসা, তোমার কাছেই শেখা ।’ হাঁটতে হাঁটতে দুটো-একটা দোকান ছুঁয়ে, পৌঁছেছে স্টেশনে ।

গ্রামের স্টেশন পেরিয়ে ওপারে গেলেই তার পিসতুতো দিদির বাড়ি । এক সময়ে এই দিদির বাড়ি কিছুদিন ছিল সে । দরকারে অনেক সাহায্য করেছে একসময় ওরা । জামাই বাবুও মাটির মানুষ, প্রাইমারি স্কুলের টিচার । রেলের ভগ্নপ্রায় ওভার ব্রিজে ওঠার সময় সন্দীপের চোখ আটকে যায় নিচে । এ কী ! এ যে তাদের ছেলেবেলায় সর্বক্ষণ দেখাশোনা করা রত্না দি ! হ্যাঁ, ওই নামেই তো ডাকতো সবাই । স্পষ্ট মনে পড়ছে ।

সে কোনো কালেই ভালো গাছে চড়তে পারতো না । অন্য ছেলেপুলেদের সাথে মারপিটেও সে বরাবর হারতো । তখন এই রত্না দিই ছিল তার জোর । সন্দীপ এক হাতে আড়াইশো টাকার মিষ্টির প্যাকেট, দিদির জন্য কেনা শাড়ি আর অন্য হাতে দিদির বছর পাঁচেকের মেয়েটার জন্য কেনা প্রমাণ সাইজের টেডি বিয়ার-টাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় । ওভার ব্রিজের ঠিক নিচে, ছায়ায় একটা বাচ্চা মেয়ে রত্না দি-র পাশে বসে একটা ছেঁড়া কাগজে সম্ভবত রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা, ফেলে দেওয়া রঙ পেনসিল ঘসছে । সন্দীপ হাঁটু মুড়ে বসে, জিজ্ঞেস করে, “চিনতে পারছো ?”

বাচ্চা মেয়েটা কটমট করে তাকিয়ে বলে, “দেকছুনি মা-র জ্বর !” তার পর টেডি বিয়ারের দিকে চোখ পড়তেই একটা আলো ফুটে ওঠে চোখে, “এই সাবাস ! হেবি তো !”

সন্দীপ বেশি কিছু ভাবে না । সে অনুমান করে, মেয়েটা রত্না দি-র কেউ হবে । নাতনি ও হতে পারে ! দিদির মেয়েটাকে পরে না হয় কিছু কিনে দেওয়া যাবে – সেটুকু ক্ষমতা তার আছে । সে সরাসরি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার চাই ?”

মেয়েটা অবাক হয়ে যায়, কী বলবে, বুঝে পায় না । সন্দীপ মৃদু হেসে প্যাকেট থেকে পুতুলটা বের করে মেয়েটার কোলে রেখে দেয় । মেয়েটা কিছুক্ষণ অবিশ্বাসে চেয়ে থাকে সন্দীপের মুখের দিকে । তারপর তার মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে ওঠে, যেন কতদিন পরে সে হাসলো, যেন হাসতে ভুলে যাচ্ছিল । ভুলে যাচ্ছিল কৃতজ্ঞ হতে । পুতুলটা পেয়ে তার সব মনে পড়ে গেল । আর সন্দীপ দেখল, মেয়েটার মুখে সামনের দুটো দাঁত নেই ।

কিন্তু এবার সন্দীপের অবাক হওয়ার পালা । বাচ্চা মেয়েটা একবার কোলের পুতুলটাকে দু হাতে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো । তারপর রত্না দি-র জ্বরতপ্ত মাথাখানা ছোট্ট দু-হাতে সামান্য উঁচু করে টেডি বিয়ার-টাকে শুইয়ে দিল মাথার নিচে, বালিশের মতো করে । বিহ্বল সন্দীপ উঠে দাঁড়ালো, তারপর পায়ে পায়ে ওভার ব্রিজে উঠে পড়লো । একবার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল, টেডি বিয়ারটা পরম নিশ্চিন্তে রত্না দি-র ছোট্ট মাথাটা কোলে নিয়ে শুয়ে আছে । আর পাশে বাচ্চা মেয়েটা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কাগজ পর রঙ্ পেনসিল নিয়ে । একদিন কিছু খাবার কিনে দিয়ে যাবে, ভাবে সে । সন্দীপের মনের মধ্যে একটা সার্থকতার তৃপ্তি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

প্রত্যাবর্তন ছোটগল্প- সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!