কোলিয়ারির ভূতেরা ভৌতিক গল্প – তুলিকা মিত্র
অনেক-অনেক বছর আগের কথা । তখন এখনকার মতো চারিদিকে এতো আলো নেই । খালি ধূ-ধূ করছে মাঠ আর মাঠ । বনজঙ্গল আর বড়বড় গাছপালা । একটা বাড়ি থেকে আর একটা বাড়ি কমপক্ষে মাইল এক বা দুই তো হবেই । গাঁয়ের সকলে সারাসকাল কাজ করলেও সন্ধ্যে নামলেই যে যার ঘরে । সারা গাঁ নিঝুম । যেন জনমনিষ্যি নেই । এরপর যদি অমাবস্যার রাত হয় তাহলে তো রক্ষা নেই । সকলে ঘরের খিল এঁটে,লণ্ঠন জ্বালিয়ে রামনাম জব করত । তাতেও ভয় কাটত না ।
হঠাৎ,গভীর রাতে শোনা যেত গা হিম করা নিশির ডাক । বাদুড়ের ডানা ঝটপটানি আর শিয়ালের তারস্বরে চিৎকারে গ্রামবাসীদের হৃৎকম্প শুরু হয়ে যেত !! কেউ কোথাও নেই হঠাৎ,গাঁয়ের পথ ধরে গ্রামবাসীদের কুঁড়েঘরের সামনে দিয়ে কেউ যেন দৌড়ে গেল । আকাশে মেঘ নেই অথচ বাজের কড়কড়-কড়াত শব্দ । ঝড় নেই,হঠাৎই জানলা-দরজা শব্দ করে পড়তে লাগল । লম্ফ নিভে গেল । তারপরেই সেই মেয়েলি খোনা গলায় হাসি–‘হাহাহহাহাহহা………’ সকলের যে কি অবস্থা হত সে আর বলার নয় !! এছাড়াও ধুপধাপ বাসন পড়ার শব্দে সবার পিলে চমকে যেত । বিড়াল নেই,কুকুর নেই,তাহলে কি ভূতে ফেলল ?
হ্যাঁ । ভূতই বটে ! গাঁয়ের রাখাল খুড়ো নিজের চোখে দেখেছিলেন । সেই একবার রাতদুপুরের ঘটনা । তার জামাই আসতে তিনি জামাইকে সঙ্গে নিয়ে ইলিশ হাতে ফিরছিলেন । অত রাতে গরুর গাড়ি নেই । হাঁটা পথই ভরসা ! বাঁ-দিকে শ্মশান ফেলে ডাইনে গ্রামের পথ । সেখানেই একটা বিরাট তালগাছ । সেখান দিয়ে যাবার সময় কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা ! রাখাল খুড়ো পিছন ফিরতেই দেখতে পেল একটা হাড় বের করা পা । রাখাল খুড়োর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা হিমস্রোত নেমে গেল । জামাই চিৎকার করে উঠল–‘বাবা হাতের মাছ কই ?’
রাখাল খুড়ো দেখতে পেল সত্যি তো মাছ কই ? এ যে মাছের কঙ্কাল !! তারপর তাদের আর কিছু মনে ছিল না । শোনা যায়,এর কিছুদিন পর রাখাল খুড়ো বেঘোরে মারা পড়লেন । আর জামাই বেচারা জ্বরের ঘোরে প্রায় মাস তিনেক বিছানায় শুয়ে ছিল । এরপরেও কি ওই গাঁয়ে ভূত নেই ?
হ্যাঁ । সেই গাঁয়ে ভূত ছিল । একটা নয় । অনেকগুলো । কিন্তু সেসব ভূতেরা আজ পালিয়েছে । কিভাবে পালাল ? সেই গল্পই তো আজ বলব ।
একেবারে অজ গাঁ যাকে বলে ! গরুর গাড়ি ছাড়া ওই গাঁয়ে কিছুই চলত না । শোনা কথা,ওই গাঁয়ে বহুকাল আগে একটা কয়লাখনি ছিল । এক অমাবস্যার রাতে সেই খনিতে ধস নেমে প্রায় জনা পঞ্চাশ লোক মারা পড়ে । পরে,সেই মৃতদেহগুলো সৎকার করা হয় । কিন্তু,সাতজনের দেহ খুঁজে পাওয়া যায় না । সকলে বলাবলি করত,সেই সাতজনই নাকি অমাবস্যার রাতে ঘুরে বেড়াত । গাঁয়ের নন্দ বুড়ি অনেক কালের । যখন সে বসে বাচ্ছাদের গল্প করত,বাচ্ছারা ভয়ে জাপটে ধরত বুড়িকে । আর বুড়ি খিলখিল করে হেসে ওঠত ।
এটা সত্যি ঘটনা । প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে সেই কোলিয়ারির ভূতরা জেগে ওঠত । খনির ভিতর থেকে দলে-দলে ভূতেরা বেরিয়ে আসত । এমনি এক অমাবস্যার কথা……………
তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে । এক চাষি তার ছেলের সঙ্গে ফিরছিল । ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা নেমে আসছে । হঠাৎ,চাষির খেয়াল হল আজই তো অমাবস্যা ! সে হাঁটার গতি বাড়াল,-‘চল বাপ তাড়াতাড়ি চল । আজ যে অমাবস্যা ! পথে সন্ধ্যা নেমে এলে আর রক্ষা নেই ।’
ছেলে বাপের কথা শুনেই ছুটতে লাগলো । চাষি বাপ চিৎকার করে উঠল–‘দাঁড়া বাপ আমার । আমায় ফেলে যাস না’ । ছুটতে-ছুটতে যখন ওরা যখন বাড়ি এল ঠিক তখনই ঝুপ করে চারিদিক ঘন অন্ধকারের চাদরে ঢেকে গেল । আর ঠিক তখনই ওই সাতজন ভূত হল্লা করে গান গাইতে-গাইতে খনি থেকে মালবাহী ট্রেনে চেপে বেড়িয়ে এল- ‘চল কোদাল চালাই……খাবো ক্ষীরের মালাই…………………’দেখতে-দেখতে গাঁয়ের সব ঘরের জানলা,দরজা বন্ধ হয়ে গেল । সারা গাঁ যেন শ্মশানপুরী !
সেদিন হয়েছে কি পুঁটির মা জানলা দিতে ভুলে গেছে । আর পুঁটির তখন কতই বা বয়স । সে জানলার পাশের কুলঙ্গিতে খেলনা বাটি তুলে রাখতে গিয়ে হঠাৎই দেখতে পেল ট্রেনে করে কারা যেন যাচ্ছে । মানুষের মতো মোটেই দেখতে নয় । হাড় বের করা । চোখগুলো যেন বেড়িয়ে এসেছে । পুঁটির মা রাম-রাম করতে-করতে ছুটে এল । পুঁটিকে আঁচলের নীচে মুখ চাপা দিয়ে বলতে লাগলো,‘ওইসব দেখতে নেই মা । শুতে চলো । কি মরতে যে এই গাঁয়ে বিয়ে করে এসেছিলাম !’ এরপরেই পুঁটির বাবার দিকে তাকিয়ে হাঁক পারল–‘ওগো শুনছ ? ওরা যে আমাদের জমির পাশ দিয়েই যাচ্ছে গো !! কি হবে ?’
পুঁটির বাবা লেপের তলা থেকে ভয়ে উত্তর দিল–‘আজ কি এ প্রথম ? কিছু হবে না গি-গিন্নি । চ-চলে এসো’। পুঁটির মাও ছাড়বার নয় । মুখ বেঁকিয়ে স্বামীকে ‘ভীতুর ডিম’ বলল ।
ভূতেরা ট্রেন লাইন দিয়ে যায় না । উড়ে-উড়ে চলে । গাছের ডালে প্যাঁচার লোম ফুলে ওঠে । বাদুড়রা ডানা ঝাপটে উড়ে যায় । শিয়ালের সেকি চিৎকার !! গা ছমছম করে ওঠে যেন ! সারা গ্রাম নির্জনপুরী । কালো বিড়াল কেঁদে ওঠে । কোলিয়ারির ভূতেরা ট্রেনে করে আসছে । এই দিনগুলো তারা বাইরে বেড়িয়ে আনন্দ করে । সেদিন আর কোন কাজ নয় । ওরা সাতজন । বেঁটে ভূত,লম্বা ভূত,স্কন্ধকাটা,মামদো,মামদোর বাবা,শুঁটকি আর মোটা ভূত । তারা কিছুদূরে গিয়ে কোদাল দিয়ে মাটি কাটে । মামদোর বাবা সবার চাইতে বড় । সে বলল–‘আজ সারারাত মাটি খুঁড়ব’ । কিন্তু মামদোর ঘোর আপত্তি, ‘আমরা তো খনিতে দিনরাত কুপিয়েই যাচ্ছি । চলো না বাবা আজ এককটু আন্তাক্সারি খেলি’ মামদোর বাবা জীবনে নাম শোনে নি । সে আবার কি ? মামদোর ছেলে বুঝিয়ে দেয় সেটা হল গানের লড়াই । কিন্তু কারুর পছন্দ হয় না । দূর !গান গেয়ে কি হবে ? এর চাইতে মাটির ঢেলা নিয়ে লোফালুফি ভালো । লম্বা ভূত ঠিক করে যে ক্যাচ মিস করবে সে বেশি মাটি কাটবে । সবাই হোহো করে হেসে ওঠে ।
ভূতেরা এক্কাদোক্কা খেলে । একে অপরের হাত ধরে গান গায় । ওদের শরীর বলতে কঙ্কালের কখানা হাড় । সেই হাড় দিয়ে একে অপরের মাথায় হাড়ে-হাড়ে হারমোনিয়ায়ম বাজায় । ভোররাত পর্যন্ত এমনই চলছিল । হঠাৎ স্কন্ধকাটা চিৎকার করে উঠল–‘ওরে সবাই পালাও । হতভাগা মোরগ ডাক দিয়েছে । পালাও সব……………’
মামদোর বাবা সবার সঙ্গে কোলাকুলি করে নিল–‘তাহলে বন্ধুগণ আবার একমাস পর সকলে ঘুরতে আসব’ । লম্বা ভূত সায় দিল–‘এবার চলো সব । খনিতে ফের যাক। আমাদের চোখে আলো পড়লে যে সর্ষে ফুল গজাবে’ । লম্বা ভূত বসলো । বেঁটে ভূত ওর ঘাড়ে উঠল । সকলে মিলে ট্রেনে উঠল । ট্রেন ছাড়তে যাবে,এমন সময় লক্ষ্য গেল মামদো নেই । কোথায় গেল? মামদো তখন একটা কবর খুঁড়ে ঢুকে ভিতরের হাড়গোড় নিয়ে খেলা করছিল । ট্রেনের শব্দে সে বেড়িয়ে এসেছে । মামদোর বাপ মামদোকে টেনে তুলে নিল, ‘ফের এমন বাঁদরামো করলে তোকে ফেলে রেখেই চলে যাব । নে ওঠ হতভাগা’ । ভুতেদের ট্রেন চলে যেতেই সূর্য উঠে পড়ল টুপ করে ।
কিন্তু এইভাবে কতদিন ? গ্রামের লোকজন এই নিয়ে একদিন জমায়েত হল মোড়লের বাড়িতে । এই গাঁয়ের নাম ভূতুড়ে হয়ে গেছে । একজন বলল, না ! এর একটা বিহিত করতেই হবে মোড়লমশাই । বউ-বাচ্ছা নিয়ে থাকি । কখন যে ভূতে এসে ঘাড় মটকে দেবে !!’ সকলে হাঁহাঁ করে উঠল । সকলকে শান্ত হতে বলে মোড়লমশাই বলল– আচ্ছা বেশ । আমি দেখছি কি করা যায় !!’ তার গিন্নি বলে উঠল–‘ওগো আমার বাপের বাড়ির গাঁয়ে একজন ওঝা ছিল । সে কিছু পারবে না ?
গ্রামবাসী বুকে বল পেল । ঠিক হল তারা পরেরদিনই যাবে । এমন সময় নন্দ বুড়ি এসে জানালো–‘এই ভূত কি আজকের ? একশো বছরের !! তাকে তাড়ানো এতই সোজা ?’ সবার মুখে ভয়ের ছাপ প্রবল হয়ে এল । তাহলে এর কি উপায় ? মোড়ল তুড়ি মেরে বুড়ির কথা উড়িয়ে দিল- ‘রাখো তো নন্দ বুড়ির কথা !! চলো সবাই মিলে’ ।
অনেক দূরের গাঁ । সেই গাঁয়ে বুড়ো বটগাছের নীচে ওঝা বসে । গ্রামের লোকেরা বাবা গো বলে ওঝার পায়ে এসে পড়ল । ওঝা বেশ দাপুটে স্বরে বলে উঠল–‘কাকে ভূতে ধরেছে ? তার এখনই মুন্ডুপাত করছি’ । মোড়ল বলে উঠল ‘বাবা ওই যে কোলিয়ারির ভূত । আমাদের গাঁয়ে………’কোলিয়ারি ভূতের নাম শুনেই বাকিটা না কানে দিয়েই ওঝা দে দৌড় । গ্রামবাসী তো মহা মুস্কিলে পড়ল ।আসার পথে নন্দ বুড়ির সঙ্গে দেখা !! সে বলল–‘আমি জানতাম এরমই কিছু হবে । ওরা কি আর আজকের ভূত ? আমার বাবার বাবা একবার ওদের তাড়াতে গিয়েছিলো’। সবার চোখে মুখে কৌতুহল । মোড়ল জিজ্ঞাসা করেই বসলো– ‘তারপর ?’
‘তারপর আর কি !’নন্দ বুড়ি ঢোঁক গিলে বলল –‘ভূতেরা তাঁকে নিয়ে লোফালফি করে দূর মাঠে ফুটবলের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিল । শেষ রাতে যখন ওনাকে খুঁজে পাওয়া গেল সারা গা ফুলে ঢোল’ । এমন কথা শুনে সবার চোখ কপালে !!
এদিকে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । গ্রামবাসী ভেবেও কিছু পায় না । ভূতগুলোকে কিভাবে ভাগানো যেতে পারে ? কোন ওঝা আসতে চাইছে না । সামনের অমাবস্যা এসেই গেল !!কি হবে?
ঠিক এমন সময় অমাবস্যার দুদিন আগে এক সন্ধ্যেবেলায় পুঁটির রাঙাদাদু এসে হাজির । একসময় তিনি নাকি জাঁদরেল দারোগাবাবু ছিলেন । তিনি এসেই হাঁকডাক জুড়লেন–‘এই পুঁটি… কোথায় তোরা ? বাড়িঘর এমন অন্ধকার কেন ?’ পুঁটির মা ভয়েই একশো । তার বাবার মতো গলা করে কে ডাকে ?’ শেষে পুঁটির মায়ের পিড়াপীড়িতে পুঁটির বাবা সাহস করে দরজা খোলে । ‘-ওমা !! এতো সত্ত্যি তার শ্বশুরমশাই’ ।
পুঁটি আহ্লাদে আটখানা । কিন্তু এদিকে সন্ধ্যা নেমে গেছে । পুঁটির মা তাড়াতাড়ি করে বাবাকে ঘরে নিয়ে এল,-‘বাবা বাইরে বেশিক্ষণ থেকো না’ ।
রাঙাদাদু অবাক–‘কেন রে?’
‘-তেনারা এখন ঘুরে বেড়ায় যে!আগামী পরশুই আবার অমাবস্যা’-পুঁটির মা হাত জোর করে মাথায় ঠেকাল।
পুঁটিও মায়ের কথা শুনে যোগ দিল–‘হ্যাঁ দাদু । ওই জন্যই তো আমরা কোথাও বেরোই না। সন্ধ্যে হলেই ওরা বেড়িয়ে আসবে’।
রাঙাদাদুর শুনে হাসি থামে না । হাসতে হাসতেই তিনি বাড়ির ভিতর ঢুকলেন ।
পুঁটি ভাবে দাদুর কি সাহস !! ভুতেদেরও ভয় পায় না ?
পরেরদিন সকালে পুঁটির বাবার মুখে ভূতের ঘটনা সবটা শুনে রাঙাদাদু ঠিক করলেন এইবার তাঁকেই কিছু করতে হবে । পুঁটিও বলল সেদিন রাতে সে কি-কি দেখেছে ! তাঁর তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে আর মরার ভয় তিনি পান না । কিন্তু গ্রামের মানুষগুলোকে কোলিয়ারির ভূতেদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে ।
রাঙাদাদু সেদিন সকালেই কোথায় যেন একটা গেলেন । সারাসকাল কেন,
দুপুর গড়িয়ে বিকেল এমনকি সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতও নেমে এল । কোথাও তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল না । কোথায় গেল রাঙাদাদু ?কিন্তু পুঁটি আর পুঁটির মা ভয়েতে কোথাও দেখতেও যেতে পারল না । পুঁটির বাবাকে পাছে খুঁজতে যেতে হয়,তাই সে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইল । এদিকে পুঁটি আর পুঁটির মা জনালা,দরজা দিয়েই দুশ্চিন্তা করতে লাগলো ।
এদিকে হয়েছে কি !অনেক রাতে ভূতরা কোদাল চালাতে-চালাতে আর গান গাইতে-গাইতে খনি থেকে বেড়িয়ে এল। মামদো বাপকে বলছে, ‘বাবা আজ কিন্তু বাবা ফুটবল খেলব । দেখবে আজ এমন গোল করব না !!’
‘-হ্যাঁ একেবারে সোজা সত্তর মাইল দূরে গিয়ে ঝ…………পাং………’লম্বু ভূতের কথাটা শেষও হল না । হঠাৎ তাদের ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল । মামদোর বাবা চিৎকার করে উঠল,‘কিরে ট্রেন থামালি কেন?’ সকলের চোখ গেল সামনের দিকে । ভূতেরা চোখ বড়বড় করে দেখতে লাগলো ‘আরে এ আবার কে?’
একটা লম্বা ছায়ামূর্তি মাথায় টুপি পড়ে দাঁড়িয়ে ।মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না । হঠাৎ,সেই ছায়ামূর্তি ভারি গলায় উত্তর দিল–‘আমি হলাম ট্যাঁক্স কলেকটার’।
মামদোর বাবা তো অবাক,-‘সেটা আবার কি?’
‘-টাকা ছাড়ো । নাহলে যেতে পারবে না । ট্রেন দাড় করিয়ে রাখব’।
লম্বু ভূত মামদোর বাবার কানে ফিসফিস করলো ,‘-কাকা এ মনে হচ্ছে সেই চেকার-ফেকার গোছের । আমি বেঁচে থাক একবার শহরে গিয়ে দেখেছিলাম’ ।
মামদোর বাবা তো ভয়ে পেয়ে গেছে । হাত জোর করে বিনীত গলায় বলল–‘বাবু এখানে আমরা অনেকদিন আসছি । কাউকে তো ট্যাক্স দিতে হয় না’ ।সব ভূতেরাও গলা মেলাল–‘হ্যাঁ বাবু’ ।
ভারি গলা বলে উঠল-‘ওইসব পুরনো নিয়ম । নতুন নিয়ম এসেছে সরকার থেকে । টাকা ছাড়া । নইলে একপাও এগোতে পারবে না’ ।
মামদোর-বাপ ভয় পেল,‘-আমাদের কাছে তো টাকা নেই’।
গম্ভীর গলা বলে উঠল-‘তাহলে আর কি!!চলো কদিন মামার বাড়ির আদর খেতে……………’
বেঁটেভূত তো কেঁদেই ফেলল,‘-এমন করবেন না বাবু । কত আমল ধরে আমরা ঘুরে
বেড়াচ্ছি এইভাবে । ধনে-প্রাণে মরে যাব’।
গম্ভীর গলা বলল–‘ওসব আমি কি জানি?এতদিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি করেছিস । টাকা না ছাড়লে সবকটাকে হাজতে পুরে দেব’ ।
মামদোর-বাপ হাতজোড় করে বলে উঠল –‘কিছু একটা করুন বাবু’ ।
ভারি গলা ভাবার মত ভঙ্গিতে বলে উঠল-‘হম…একটা কাজ করা যেতে পারে । যদি তোরা আমার
এই বস্তায় উঠিস তাহলে অন্য জায়গায় ছেড়ে আসতে পারি । কেউ জানতেও পারবে না । কিন্তু কোন অমাবস্যায় যদি ফের ফিরে আসিস এই গাঁয়ে,তবে তোদের কয়েদখানার ঘানি টানা থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না’ ।
লম্বাভূত ঢোঁক গিলল , ‘-ঠিক আছে বাবু । আপনি যা বলবেন’ ।
‘-যাবার আগে খনির সন্ধানটা বলে দিয়ে যাস । আর শুনে রাখিস,এই গাঁ ছেড়ে যাবার আগে গাঁয়ের তালগাছটা উপড়ে যাবি প্রমাণ হিসেবে’ ।
ভূতেরা ঘাড় নাড়ল । হাড়েহাড়ে শব্দ হল ঠংঠং ।
সেইমতো ট্যাক্স কলেক্টার ভুতেদের বস্তায় পূরে ট্রেনে চাপিয়ে দূর গাঁয়ে নিয়ে চলে গেল । আর বলে দিল, ‘এখানে যত খুশি মাটি কোপা’ ।
এরপর ছায়ামূর্তি পুঁটির বাড়ির সামনে এসে মুখের কালো রুমাল খুলে ফেলল । আর সেখান থেকে বেড়িয়ে এল রাঙাদাদু । শহরে গিয়ে তাঁর পুরনো পোশাকটা আনতে গিয়েছিলেন। হাফ প্যান্ট,মাথায় টুপি,কোমরে বেল্ট-তাঁকে ঠিক ট্যাক্স কলেকটরের মতই লাগছিল। রাঙাদাদু নিজের মনেমনে বিড়বিড় করে উঠল–‘যাক ! এতদিনে ভূতেরা পালিয়েছে । হাহাহহাহাহাহা’ । এরপর চারদিকে তাকিয়ে রাঙাদাদু বলে উঠল,‘-আর ভোর হতে একটু দেরি । একেবারেই সকাল হলে খবর দেব’ ।
সকাল হতেই রাঙাদাদু গাঁয়ের লোকেদের ডেকে আনল যে ভূতেরা পালিয়েছে । আর প্রমাণ স্বরূপ তালগাছটা উপড়ে পড়ছে । লোকেরা অবাক । কি করে হল ? নন্দ বুড়ি তো অবাক,‘এমন অসাধ্য কাজ কি করে সাধ্য করলেন দাদা ?’
রাঙাদাদু হাসে–‘এ আর এমন শক্ত কি ?এর জন্য সাহস আর অভিনয় প্রয়োজন’ । গ্রামের লোক মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝে না । ওদিকে শহরের সরকারি লোককে বলা ছিল । তারা ঠিক সময়ে এসে পড়ল।রাঙাদাদুর কথামতো খনির কাছে যাওয়া হল।খনিতে প্রচুর কয়লা । সেসব বিক্রি করে যা পাওয়া যাবে তাতে গ্রামে হাসপাতাল স্কুল করা হবে কথা দেওয়া হল ।পুঁটি মনেমনে স্বীকার করলো তার দাদুর সত্যি সাহস আছে বৈকি !!
পুঁটি আনন্দে চিৎকার করে উঠল–‘আমার দাদু সেরার সেরা’ । রাঙাদাদু হেসে পুঁটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।গাঁয়ে ভয় কাটল।
কোলিয়ারির ভূতেরা ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন