ব্রহ্ম দৈত্য ছোটগল্প – দেবাশীষ দাস
সেদিন আইনশৃঙ্খলা জনিত কারনে কার্ফিউ জারি করেছিল সরকার। কার্ফিউর মধ্যেও লোকজন চলাফেরা করছে কিনা তা দেখতেই সন্ধ্যা বেলায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিল কৌতুহলী বিক্রম। সে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল ছৈলেংটা বাজারে। বাজার ফাঁকা – দোকানপাট বন্ধ। দুয়েক জন লোক চলাফেরা করছে – পুলিশ প্রশাসনের লোক নেই। তার চোখে পড়ল বাজারের একটা গলির ভেতর একটি দোকানের বারান্দায় বসে কয়েকজন লোক তাস খেলছে। আরও কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। বিক্রম তাদের কাছে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়েছিল। তখনই হঠাৎ সেখানে হানা দেয় পুলিশ। পুলিশ হানা দিতেই সবাই যে যার প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ দেখে পালাতে শুরু করে বাজারে চলাফেরা করা অন্য লোকেরা সবাই। পুলিশ সবার পেছনে ধাওয়া করে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে প্রাণপণে দৌড়ে পালাতে থাকে বিক্রম। সে দৌড়ে পালানোর সময় দেখতে পায় পথে একটি ধুতি এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। হয়তো দৌড়ে পালানোর সময় কোন ধুতি পরিহিত লোকের ধুতি খুলে পড়ে গেছে। বিক্রম সেই ধুতিটা তুলে নিয়ে চলে যায় শ্মশান ঘাটের দিকে। পুলিশের এক কনস্টেবল তার পেছনে ধাওয়া করতে থাকে। বিক্রম দৌড়ে গিয়ে ধুতি গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে শ্মশানের শবদাহের চুল্লির উপর। পুলিশের সেই কনস্টেবল সেখানে গিয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। সূর্যাস্তের পর রাতের আঁধার নেমে এসেছিল তখন। আবছা আলোয় দৃশ্যমানতা ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। জেদি কনস্টেবল পলাতক লোকটাকে খুঁজতে খুঁজতে শ্মশানের চুল্লির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। বিক্রম আর কোনও উপায় না পেয়ে গায়ে ধুতি জড়ানো অবস্থায় হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল কনস্টেবলের সামনে। কনস্টেবল সেটা দেখে ‘ওমাগো! রাম-রাম-রা-ম-রা-ম’ – বলে আছাড়-বিছাড় খেয়ে প্রাণপণে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। সুযোগ বুঝে বাড়ি চলে যায় বিক্রম।
দুদিন পর পাড়ার ওঝা রজনীকান্ত দাসের বাড়িতে সকালবেলা কয়েকজন লোক বসে আড্ডা দিচ্ছিল। সেই আড্ডা দেখে সেখানে যোগ দিয়েছিল বিক্রম। ওঝা ভূত প্রেত নিয়ে আলোচনা করছিলেন। বিক্রম গিয়ে বলল – ‘আর কতকাল লোক ঠকানোর ব্যবসা করবেন কাকা।’ ওঝা বললেন – ‘ভূতে যেদিন ধরবে তোকে, সেদিন তুই বুঝতে পারবি বিক্রম!’ বিক্রম বলল – ‘কোথায় ভূত ? আমি তো শ্মশানে শুয়ে এসেছি। ভূতে তো ধরেনি আমায়!’ জগন লাল বললেন – ‘এ কি কথা বলছিস বিক্রম!’ বিক্রম সবিস্তারে বলল সেদিনের ঘটনা। বিক্রমের কথা শুনে মোহন লাল হাসতে হাসতে বললেন – ‘বিক্রমকে ভূতে ধরবে না ওঝা মশাই, ওকে ভূতেও ভয় পায়!’ বিক্রমের কথা নিয়েই হাসাহাসি হচ্ছিল সেখানে। এমনই সময়ে ওঝার বাড়িতে এসে হাজির হলেন এক বয়স্কা মহিলা। হাসাহাসি বন্ধ – সবাই গম্ভীর। ওঝা মহিলাকে বসার জন্য একটা চেয়ার দিলেন। তারপর বললেন – ‘কি হয়েছে বলুন।’ মহিলা বললেন – ‘আমার ছেলেটা পুলিশের চাকরি করে। সেদিন সন্ধ্যা বেলায় এক জুয়াখোর লোকের পিছনে ধাওয়া করে শ্মশানের দিকে গিয়েছিল। সেখানে সে অদ্ভুত কিছু দেখে ভয় পেয়েছে। তারপর থেকে হাসপাতালে ভর্তি – দুদিন ধরে জ্বর কমছে না।’ মহিলার কথা শুনে উপস্থিত সবারই মনে মনে খুব হাসি পাচ্ছিল। হাসি পাচ্ছিল ওঝা মশাইয়েরও। কিন্তু হাসলে তো হবে না – বিজনেস বলে কথা। ওঝা কিছুক্ষণ সময় ধ্যান করার ভান করলেন। তারপর বললেন – ‘আপনার ছেলে অল্পেতে রক্ষা পেয়েছে – ওটা ব্রহ্ম দৈত্য ছিল। আপনার ছেলেকে স্পর্শ করেনি – কেবল বাতাস লেগেছে তার গায়ে।’ মহিলা বললেন – ‘এখন তবে উপায় কি দাদা ?’ ওঝা বললেন – ‘চিন্তা করবেন না, আপনার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে।’ তিনি একটা বোতলে জল নিয়ে তাতে মন্ত্র দিয়ে বললেন – ‘এই জল নিয়ে ওর গায়ে ছিটিয়ে দেবেন।’ মহিলার হাতে একটি তাবিজ দিয়ে বললেন – ‘এই তাবিজটা ওর ডান হাতে বেঁধে দেবেন।’ দক্ষিণা স্বরূপ মহিলার কাছে তিনি এক শত এক টাকা চাইলেন। মহিলা জল ও তাবিজ নিয়ে ওঝাকে দক্ষিণা দিয়ে চলে গেলেন। উনি সেখান থেকে উঠে যেতেই বিক্রম ফিসফিস করে বলল – ‘এতে কাজ হবে কাকু ?’ ওঝা বললেন – ‘আলবাত কাজ হবে বিক্রম! ওর তো কিছুই হয়নি, শুধু ভয় পেয়েছে। মনের ভয় দূর হলেই সে সুস্থ হয়ে উঠবে। আমার ঐ জলে বিশেষ একটা ঔষধ মেশানো আছে, গায়ে ঐ জলের ছিটা পড়লেই মনে হবে গায়ে বিদ্যুৎ স্পর্শ করেছে। তখনই সে ভাববে ভূত তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তাবিজটা ধারন করার পর ভাববে ভূতে তাকে আর স্পর্শ করতে পারবে না। মনোবল ফিরে আসবে তার – সুস্থ হয়ে ওঠবে সে। তাছাড়া ঐ তাবিজ একটা বিশেষ জড়িবুটি। এই জড়িবুটি বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যা দূর করতে কার্যকরী। আমার চিকিৎসাকে এত হালকা ভাবিস না বিক্রম।’ জগন লাল – মোহন লাল – হরিহর – গোপাল কিছুক্ষণ সময় ধৈর্য ধরে শান্ত হয়ে বসেছিলেন। মহিলা একটু দূরে চলে যেতেই সেখানে হাসির রোল পড়ল। ওঝার স্ত্রী হেঁসেল থেকে বললেন – ‘এত হাসি কিসের জন্যে!’ ওঝা হাসতে হাসতে বললেন – ‘ব্রহ্ম দৈত্য।’ ওঝার স্ত্রী আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে এসে বললেন – ‘কি, কোথায় ব্রহ্ম দৈত্য!’ মোহন লাল বললেন – ‘এই যে – বিক্রম ব্রহ্ম দৈত্য!’ ওঝার স্ত্রী কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন – ‘হায় হায়, কি কাণ্ড! এ কেমন ছেলে রে বাবা!’
ব্রহ্ম দৈত্য ছোটগল্প- সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
প্রচ্ছদ
কায়দায় জীয়ন কায়দায় মরণ