কালো মেয়ে অণুগল্প – সুপর্ণা আচার্য্য চক্রবর্ত্তী
‘কালো মেয়ে’ কথাটি প্রায়ই শুনে থাকি, বা বলা হয় মেয়েটি কালো। এখন কথা হল কালো মেয়ের সংজ্ঞা কি?
সাধারণত কালো মেয়ে বলতে মেয়েটির গায়ের রং কি তা চিহ্নিত করে থাকি।
এখনো পর্যন্ত্য সমাজের কোণে কোণে ছড়িয়ে আছে কালো মেয়ের সমীকরণ করার মত কিছু কালো মনের মানুষ।
কালো চেহারাতে তার সব গুনই চাপা পড়ে যায়, তাইনা ?
এরকম কত উদাহরণ আছে সর্ব গুণের অধিকারী হয়েও শুধুমাত্র গায়ের কালো রং এর জন্য সে সব কিছু থেকে বঞ্চিত অবহেলিত।
কিন্তু কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি যে মা কালীর গায়ের রং কালো কিন্তু তা বলে কি আমরা তাকে অসম্মান করি? করি না কারন মা কালী হলেন ভগবান তাই তারে আমরা ডড়ি, শ্রদ্ধা করি।
তাহলে তাকে যদি আমরা শ্রদ্ধা করতে পারি তবে কালো মেয়েদেরকে আমরা শ্রদ্ধা, সম্মান করতে বা ভালবাসতে পারিনা কেন?
আসলে আমরা যতই বলি না কেন, সমাজ উন্নত হয়েছে কিন্তু মানুষের মন এখনো উন্মুক্ত হয়নি। কলুষতা, অপবিত্রতা, মুর্খামি সবকিছুর ছাপ তাদের মধ্যে মূর্তমান।
কালো গায়ের রং এর জন্য ভদ্র শিক্ষিত সমাজের সব লোকেরা কনে দেখতে যাওয়ার সময় মেয়ের গুন না দেখে রূপ দেখতেই ব্যস্ত থাকে।
আর গায়ের রং কালো হলে তো কথাই নেই , মেয়ের বাবাকে যৌতুক দিতে হয়।
এরকমই একটি কালো মেয়ের গল্প বলি শোনো-
গল্পটি একটি গ্রাম্য মেয়ের। মেয়েটির নাম শ্যামা। গায়ের রং শ্যাম বর্ণ। চোখ দুখানি পটলচেরা ,মিষ্টি হাসি মুখে ভরা আর ঘন কেশে তার মাথা আবৃত এটাই হলো শ্যামার শারীরিক বর্ণনা ।
শ্যামা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজের দোরগোড়ায় যেতে চায়, কিন্তু বাবা অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল। পরের জমিতে চাষাবাদ করে আর মা লোকের বাড়ি কাজ করে; এভাবেই কোনরকমে তাদের দিন চলে যায়।
শ্যামার বরাবরই লেখাপড়ায় বেশ মাথা ছিল। গ্রামের স্কুলের মাস্টারমশাই একবার শ্যামার বাবাকে বলেছিলেন ‘হারু তোমার মেয়েকে পড়াও , শ্যামা লেখাপড়াতে বেশ ভালো।’
উত্তরে হারু বলে “কিভাবে পড়ামু ম্যাস্টরমশায়, আপনে তো জ্যানেন, আমগো কিভাবে দিন চলে। রাইত পোহাইলেই দুই মুঠা খাওনের জন্য পরের গোলায় কাজ করতে হয় আর সমস্ত ফাইফরমাশ খাইটতে হয়। এর মধ্যে কি কইরা পড়ানোর কথা কন আপনি ম্যাস্টরমশাই?”
মাস্টারমশাই বলেন যে তিনি সবই বোঝেন কিন্তু মেয়েটির মধ্যে প্রতিভা ছিল। যাই হোক….
শ্যামার বাবার নাম হারান মন্ডল। ডাকনাম হারু আর মায়ের নাম পদ্মা। একদিন শ্যামার বাবা তার মাকে বলে যে গ্রামের মাস্টারমশাইদের সাথে দেখা হলেই তারা শ্যামার লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞাসা করেন যখন শোনেন সে লেখাপড়া করে না, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে তখন তারা একটু হতাশ আর একটু অবাক চোখে তার (হারু) দিকে তাকায়।
তিনি আর এই মানসিক যন্ত্রণা নিতে পারছেন না তাই তিনি স্থির করেছেন যে তিনি শ্যামার বিয়ে দিয়ে দেবেন।
এছাড়াও গ্রামের লোকেরা প্রায়ই কথায় কথায় বলে যে, ‘মেয়ের বিয়ে দিবি কবে ? বয়স তো হচ্ছে, বেশ ডাগর ডোগর চেহারা হয়েছে ওর।’
লোকের এসব কথা হারাণের বুকে তীরের ফলার ন্যায় বেঁধে। আর তাছাড়া মেয়েরা তো পরের ধন মেয়ে কি ঘরে রাখার জিনিস?
এসব বিভিন্ন দিক ভেবে হারু মনস্থির করে ফেলে যেভাবেই হোক এবার সে শ্যামার বিয়ে দেবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ, ঘটকের সাথে যোগাযোগ মারফত এক পাত্রপক্ষ আসে শ্যামাকে দেখতে। উচ্চ-বংশীয় কায়স্থ পরিবার। পাত্র শহুরে চাকুরীজীবী।
এতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু শ্যামার অগোচরে ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসব জানতে পেরে শ্যামা ভীষন অশান্তি করে। কিন্তু বাবা-মায়ের চাপের মুখে নতি-স্বীকার করতে বাধ্য হয় সে।
শ্যামাকে দেখে পাত্রের বাবার প্রথম উক্তি,”এহ- হে!! ঘটক, মেয়ের গায়ের রং যে বড্ড ময়লা একথা তো তুমি আমায় আগে বলনি; আর তাছাড়া আমার ছেলে শহরে চাকরি করে তার তো একটা মান সম্মান আছে, এরকম একটা মেয়েকে বউ করে নিয়ে গেলে ওরতো মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়বে।”
এসব কথা শুনে শ্যামা নিজেকে আর ভগবানকে মনে মনে দোষারোপ করতে লাগলো।
সে বলে, ‘হে ভগবান কোন পরীক্ষা নিচ্ছো আমার কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছ এ সকল বাক্য শুনে তো মনে হয় যেন কোনো নারীর অঙ্গ থেকে বস্ত্র হরণ করা হচ্ছে।’
আগেই বলেছি কালো মেয়েদের বাবাকে সাধারণত পাত্রের বাবাকে যৌতুক প্রদান করতে হয়। শ্যামার ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি।
যৌতুকের পরিবর্তে পাত্রের বাবা বিয়ের দিন স্থির করে যায়।
এরপর যথাসময়ে বিয়ের সমস্ত আয়োজন করা হয়, মণ্ডপে শ্যামা কে আনাও হয়।
যথাসময়ে বিয়ে শুরু হয়। কিন্তু শুভদৃষ্টির সময় শ্যামাকে দেখে পাত্র বিয়ে নাকচ করে দেয়।
বিয়ের মন্ডপ তছনছ করে দেওয়া হয় এবং শ্যামার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের যথেষ্ট অপমানজনক কথাবার্তার সম্মুখীন হতে হয় পাত্রপক্ষের তরফ থেকে।
শ্যামার বাবা পাত্রের বাবার পা দুটি ধরে অশ্রুধারায় লুটিয়ে পড়ে ।কিন্তু পাত্রের বাবা বলে যে, যদিও তিনি যৌতুকের বিনিময়ে শ্যামার সাথে তার ছেলের বিয়ে দিতে রাজী হয়েছিলেন কিন্তু ছেলে যদি অমত করে তার দায় তিনি কেন নেবেন?
চূড়ান্ত অপমান লাঞ্ছনা ও পাড়া-প্রতিবেশীদের কটূক্তির শিকার হতে হয় শ্যামা এবং তার পরিবারকে।
দিনের-পর-দিন চরম অপমান চারিদিকের রঙ্গ- রসিকতা এসব আর সহ্য করতে না পেরে তার বাবা আত্মহত্যা করেন।
এরপর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে জর্জরিত হয়ে শ্যামা তার মাকে নিয়ে শহরে চলে যায় কাজের সন্ধানে। সেখানে সে ও তার মা বিল্ডিং কন্সট্রাকশন সাইট এ দিনমজুরের কাজ করতো আর দিন শেষে বাড়ি ফিরে নিজে নিজে লেখাপড়া করতো। এভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলতে থাকে। শ্যামা লেখাপড়া করে এবং কলেজে ভর্তি হয় ও বি.এ পাস করে।
এখন শ্যামা মানসিকভাবে অনেক উন্নত হয়ে উঠেছে অল্প আঘাতে এখন আর তার চোখ ফেটে জল আসে না। শুধু তার মনে একটাই কথা ভেসে বেড়ায়, বছর পাঁচেক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা। কিভাবে তার ও তার পরিবারের সাথে ঘটে গিয়েছিল চরম দুর্ভোগ। তার বাবার মৃত্যু আর মায়ের আর্তনাদ সব সময় তার কানে বাজে।
শ্যামার লেখা লেখাপড়ার প্রতি গভীর অধ্যাবসায় দেখে কনস্ট্রাকশন বিল্ডিং এর মালিকের তার প্রতি স্নেহভাবাপন্ন মনোভাব গড়ে ওঠে।
তিনি শ্যামাকে চাকরির প্রস্তাব দেন এবং সে তাতে রাজি হয়ে যায়। এভাবে বেশ কয়েক বছর ভালোই কাটছিল। একদিন অফিস ফিরতি পথে একটি বিজ্ঞাপন দেখে থমকে দাঁড়ায় সে। পুলিশের বিভিন্ন পদের জন্য লোক নেওয়া হবে। সে তাতে আবেদন করে আর তার গভীর অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতি স্বরূপ পরীক্ষায় পাশ করে এবং পুলিশের এসআই পদে নিযুক্ত হয়।
চাকুরী জীবনে অনেক জটিল কেস এর সম্মুখীন হতে হয় তাকে। এর মধ্যে একটি হলো একটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা। পরপর দু’বার ডাকাতি হয় সেই ব্যাংকে এবং শ্যামা নিজের চেষ্টায় সেই ডাকাত দল কে পাকড়াও করে।
এর কিছুদিন পরেই এক নামিদামী কোম্পানিতে ম্যানেজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে দু নম্বর মাল পাচার চক্রে।
যথারীতি সেই ম্যানেজারকে আটক করা হয় এবং এবং জেলে সেই ম্যানেজার ও শ্যামা পরস্পরের মুখোমুখি হয়।
শ্যামাকে দেখেই ম্যানেজারের চক্ষু ছানাবড়া।
এ কাকে দেখছে সে? এ তো সেই মেয়ে যাকে সে বিয়ে করতে রাজী হয়নি কালো মেয়ে বলে।
আসলে এই ব্যাঙ্ক ম্যানেজার হল সেই-ই ব্যাক্তি যে বিয়ের মন্ডপ ছেড়ে শ্যামা ও তার পরিবারকে অশ্লীল করেছিল। সেই ম্যানেজারের নাম প্রদীপ্ত মিত্র। শ্যামাকে দেখে সে নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না।
শ্যামা ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,’কি মশাই চিনতে পারছেন?’
প্রদীপ্ত লজ্জায় মাথানত করে বলল,’শ্যামা আমায় ক্ষমা করে দাও।
শ্যামা বলল ‘সরি ম্যানেজার বাবু আমার নাম শ্যামা নয়, সাব-ইন্সপেক্টর শ্যামশ্রী মন্ডল। তাই…. বুঝলেন তো!’
“আর তাছাড়া আপনাকে মাথা নত করতে হবে না সময় কি জিনিস দেখলেন তো ?
সময়ের ব্যবধানে আজ আপনি কোথায় আর আমি কোথায়;
আসলে আপনি কোনদিন ভাবতেও পারেননি যাকে এত অবজ্ঞা করেছিলেন, লোকের কাছে সমাজের কাছে টেনে নিচে নামিয়ে ছিলেন, একদিন সেই কালো মেয়ের কাছেই আপনাকে মাথা নত করতে হবে।
আসলে আপনাদের মত সো কল্ড শিক্ষিত লোকেরা ভুলে যান যে মেয়েরা মা দুর্গার আরেক রূপ। মা দুর্গা যেমন তার দশ হাতে অস্ত্র ধারণ করে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন বলে তাকে মহিষাসুরমর্দিনী বলা হয় সেরকম আমরা প্রত্যেকটা মেয়েই দশভূজা। নারী ছাড়া পুরুষ যে অসম্পূর্ণ।
আর তাইতো আমরা নারী আমরা সব পারি।
নারীর বহু রূপ কখনো সে কর্মরতা, কখনো গৃহবধূ , কখনো মা, নারী সর্বত্র বিরাজমান।
তাই কোন নারীকে কালো বলে তাকে অসম্মান না করে বরং সে নারী বলে তাকে সম্মান করতে শিখুন তাহলে সমাজে থাকা যেসব মহিষাসুর রয়েছে তাদের পতন নিশ্চিত।
তাই বলা যেতেই পারে কালো মেয়ে কালো নয় মা দুর্গার অংশবিশেষ-
রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো জহি….”
কালো মেয়ে অণুগল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভরুয়া
উদ্বর্তিনী
নীলবাস্প